জুলিয়ান সিদ্দিকী

একটি বর্ষণমুখর রাত্রি এবং নষ্ট কৌমার্যের গল্প

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কেবল বৃষ্টির জন্যই মানব জীবনে  বর্ষাকালের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। যে কারণে একে মানুষ মনে রাখে। মনে রাখে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীকে। আর এ ছাড়াও হয়তো ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে মানুষের জীবনের কিছু কিছু ঘটনা জড়িয়ে থাকে ওতপ্রোত ভাবে। যে কারণে বিশেষ ঘটনা হিসেবে সেগুলো দখল করে নেয় স্মৃতির কিয়দংশ। আর সেই বিশেষ ঘটনাটির আগে-পরের বেশ কিছু স্মৃতিও উজ্জ্বল থাকে মানস পটে। তো যে ঘটনাটি বলার জন্যে এ গল্পের অবতারণা, তার আগের কিছু কথা না বললেও নয়। যদিও মনে হতে পারে মূল গল্পের সঙ্গে এ ঘটনার কী সম্পর্ক? প্রিয় পাঠক, ঘটনা পরম্পরা বলে একটি কথা আছে। আর তাই হয়তো কোনো একটি বিশেষ ঘটনা ঘটার আগে দিয়ে কোনো না কোনো একটি উপলক্ষ্য তৈরি হয়। আর সেখান থেকেই ঘটনা ঘটার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও হয়তো প্রকৃতির খানিকটা সময় প্রয়োজন। আর তাই দেখা যায় একটি ঘটনা ঘটে গেলে তার আগেও দু একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে, যা কেবল গভীর পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়তে পারে।

ঘটনার কিয়ৎ-কাল আগে গ্রামের পরিবেশ আর বাবার সৎ ভাইদের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত নানা জটিলতা আর মামলা-মকদ্দমার শিকার হয়ে যখন আমি প্রায় পর্যুদস্ত ঠিক তখনই সগির ওরফে শোগা মিয়ার মা সাক্ষী দিলেন যে, আমি বজলু মিয়ার ছোট মেয়ে কাজলকে রেপ করতে উদ্যত হয়েছিলাম। এ নিয়ে পুরো গ্রামে একটি সোরগোল পড়ে গেল। ব্যাপারটাকে আরো গতি দিয়েছিলেন বজলু মিয়া নিজেই। তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে তার মেয়েকে রেপ করার অপরাধে আমার নামে শালিস ডাকালেন, গ্রামবাসী যেন আমার উপযুক্ত শাস্তির বিধান করে দেন।

আমার সমবয়সী বন্ধুরা বা যারা আমাকে ভালোবাসতেন এ ঘটনার কথা শুনে তারা খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে সেই বয়সের ছেলেরা গুরুজনদের কাছে আর মেয়ে মহলে খুব একটা নিরাপদ বলে বিবেচিত হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার জীবনে কোনো মেয়ে ঘটিত কেলেঙ্কারি ছিলো না। এমন একটি সুবোধ ছেলের নামে সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগ, তাও দিন-দুপুরে? ব্যাপারটা যেমন হাস্যকর তেমনি কৌতূহলোদ্দীপকও। অশিক্ষিত বন্ধুদের কেউ কেউ আর গ্রামের নারী-পুরুষ অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, ওই, রেপ করনডা কী? অতি দুষ্টুগুলো দাঁত কেলিয়ে জানতে চেয়েছিলো, র‍্যাফ কেমনে করে রে?

আমার মুখ থেকে অর্থ জানার পর মুহূর্তেই তারা পুরোটা গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছিলো যে, বজলু মিয়া আসলে কী অপরাধের বিচার বসাতে চাচ্ছেন। কেউ কেউ মজা করতে সবার সামনেই আমাকে বলে উঠলো, বিয়ার মাইয়ারে বেইজ্জতির বিচারে জুতার বাড়ি তো খাবিই, তার বাদে কাজলরে তুই বিয়াও করন লাগবো! তর বাপে তহন তর জ্যাডা হউর আর তর মায় অইবো জেডি হরি!

সন্ধ্যার কিছুটা আগে দিয়ে সংবাদ পাই, আমার নামে ডাকা বিচারটা হবে না। বন্ধুরা বললো, তুই মান হানির বিচার চা। বুইড়ারে কেমনে জুতার বাড়ি লাগাই নিজের চক্ষে দেখবি!

কিন্তু বাবা সম্মত হলেন না বলে তা আর ঘটলো না। এ ঘটনার পর বাড়িতে থেকে আমার পক্ষে লেখাপড়া চালানো দুষ্কর হয়ে উঠলো। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে আশ্রয় নিতে হয় স্কুল হোস্টেলে।কিন্তু স্কুলের হোস্টেল বলতে দোতলার একটি পরিত্যক্ত কক্ষ। যা দিনের বেলা সূর্যের উত্তাপে এতটাই তেতে উঠতো যে, রাতের বেলা জানালা খুলে দিলেও দখিনা হাওয়ায় তার উত্তাপ কমতে প্রায় ভোর হয়ে যেত। যে কারণে খাবার দাবার রাখলে নষ্ট হয়ে যেত। রান্না-বান্নার তো সুযোগই নেই। আসলে হোস্টেল কি, বাড়িতে এসে তিন বেলা খেয়ে যাওয়া। আর রাতের বেলাটা স্কুল হোস্টেলে ঘুমানো। ক্লাস শেষে বাড়ি চলে আসি। রাতের খাবার খেয়ে হোস্টেলে চলে যাই। ক্লাস টেনের ছাত্র এভাবে ছুটাছুটি করলে লেখাপড়া হবে কী করে? এ নিয়ে বাবা মা বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সেই সঙ্গে এই পরিকল্পনা করছিলেন যে, চট্টগ্রামে কর্মরত ছেলেদের সাথে পরামর্শ করে কোনো একটা সমাধান বের করা যায় কি না। এমনিতেই একবার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পুনরায় স্ব-ইচ্ছায় স্কুলে ভর্তি হওয়া ছেলের লেখাপড়া যাতে কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয় সে দিকটা নিশ্চিত করাই ছিলো বাবা মার উদ্দেশ্য।

পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়নের তেমন সুযোগ হচ্ছিলো না তাদের। বাড়িতে আমি আর মা-বাবা। চারদিকে শত্রু রেখে বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে আমরা তিনজনই কোথায় চলে যেতে পারি না। নিজে রান্না-বান্না জানি না বলে মা ঘরে না থাকলে না খেয়ে আমার দিন গুজরান করতে হবে। তাহলে এর সমাধান কি?

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর  তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবি তার বাপের বাড়িতেই থাকেন। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসেন। দু-চার সাত দিন থেকে ফের চলে যান। আমাদের এখানে বেশিদিন থাকতে চাইলে তার বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে যান। কারণ হিসেবে জানান তাদের বুড়ো-বুড়ির খুবই সমস্যা। দেখাশোনার কেউ নেই। ছেলের বউ বিধবা বলে আমার বাবা মা তেমন জোর করতে পারেন না। মাঝে মধ্যে উড়ো খবর পাই যে, আমার সঙ্গে নয়তো আমার সাত বছরের বড় খবির ভাইয়ের সঙ্গে ভাবির বিয়ে হবে। আমি ভেবে পাই না, ক্লাস টেনের ছাত্র পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের কোনো কোনো নারী যার আছে তিন ছেলেমেয়ে, তাকে বিয়ে করাটা কতটা স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে? লজ্জার বিষয় না হলে বা সমাজ আর গুরুজনদের চাপে পড়ে এমন একটি অসম বিয়েকে হয়তো সাময়িকভাবে মেনে নিতে বাধ্য হবো। কিন্তু আসন্ন দিনের সঙ্কটগুলো নিয়ে ভাবতে গেলে আর কোনো থই পাচ্ছিলাম না। ব্যাপারটা কোনোভাবে ঘটে গেলেও লোকজনের হাসির পাত্র হয়ে খুব বেশিদিন সে সম্পর্কটিকে বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ফলে, এমন ধরনের উড়ো খবর শুনতে পেলেও মনের দিক থেকে তেমন কোনো সাড়া পাই না। ভাবির সামনেও খুব একটা স্বাভাবিক হতে পারি না। হয়তো বা এমন ধরনের সংকট থেকে পালিয়ে থাকতেই ভাবি যে কদিন আমাদের বাড়িতে থাকেন সেই কদিন কষ্ট করে হলেও হোস্টেলে থাকতে চেষ্টা করি। মা তখন গ্রামের কোনো ছাত্র-ছাত্রীর হাতে  টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার পাঠিয়ে দেন। বৃষ্টির কারণে কাদা পথ মাড়িয়ে আসা-যাওয়ার কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে স্কুলের পাশের মুদি দোকান থেকে চিড়া-গুড় এনে কোনোমতে খেয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু এভাবে যেন আর চলছিলো না। মনে হতো আমার পেটে চব্বিশ ঘণ্টাই ক্ষুধা লেগে আছে।

তো, বাবা-মা চট্টগ্রাম যাবেন বলে আমাকে বললেন, তারা যে কদিন সেখানে থাকবেন সে কদিন যেন স্কুল শেষে বাড়ি চলে আসি। আর তাদের যাওয়ার আগের দিন যেভাবে পারি ভাবিকে তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা চাই। বললাম, আইয়ে কাইল আশুরার বন্ধ আছে, ভাউজরে আননের লাইগ্যা তাইলে কাউলকাই যাই!

বাবা জানালেন, তাইলে তুই শিল্পীর মা’রে লইয়া আইলেই আমরা চ্যাটগাও রওনা দ্যাম!

কথা মত পরদিন সকাল সাতটা কি সাড়ে সাতটার দিকে ভাবির বাপের বাড়ি বদ্রিখোলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো এমন সময় ফরিদা বুবুর ভাইয়ের ছেলে লুলু এসে বললো, কাকু, তোমারে মাস্টর হুবু যাইতা কইছে!

আরে, অহন যাই কেমতে? আমি যাইতাছি বদ্রিখোলা!

ঠিক তখনই ফরিদা বুবুকে দেখা যায় হেলে দুলে আমাদের উঠোনের দিকেই আসছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে দূর থেকেই তিনি বলে উঠলেন, আবুরে, কদ্দুর আইয়চ্চারে বাই!

বললাম, আমি আরেক জাগাত যাইতাছি, আমার যাওনের সময় নাই!

আমার অসম্মতিতে তার মাস্টারনী জোস জেগে উঠলো যেন। বললেন, বেদ্দবের মতন কতা কইস না! একটা কতা কইসি না হুইন্যাই ন্যা কইচ্চা!

মাস্টারনীর মেজাজ আবার যেমন তেমন না। আমাকে চড়-চাপ্পড় মারা অথবা কান ধরে মুচড়ে দেওয়ার বদ অভ্যাস তার কোনো কালেই দূর হবার সম্ভাবনা দেখি না। তাই কিছুটা মিন মিন করে বলি, ভাবিরে আনতাম যাইতাছি!

যাইস! বলে, তিনি আবার বললেন, ঝরি আইলে আমার চাল দিয়া পানি পড়ে। তুই লাম্পা মানু হ্যার লাইগ্যাই তরে কইতাম আইছি!

আইচ্ছা, লন যাই! আমি হাল ছেড়ে দিয়ে সম্মতি জানাতে বাধ্য হই।

ফরিদা বুবু মাস্টারনী হিসেবে খুবই কড়া মেজাজের বলে দুর্নাম আছে। আর তাই তার বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলেও এ পর্যন্ত কোনো বিয়ের সম্বন্ধ আসেনি। সেই সঙ্গে কটকটে মেজাজের কারণেই কোনো প্রেমে সাফল্য পান নি বলেও রটনা আছে।

ফরিদা বুবুর ঘরে গিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই টিনের চালে বেশ কটি ফুটো দেখতে পাই। বলি, সরকারি চাকরি করেন, মাসে  মাসে একটা কইরা টিন বদলাইলে কী অয়?

-পাকনা কতা কইচ্চারে পোলা। যেই কাম করনের লাইগ্যা আইছত হেইডা কর!

অনাবশ্যক ধমক খেয়ে আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে চালের কাছাকাছি আমার হাত পৌঁছানোর মত উচ্চতার অবলম্বন খুঁজি। ঘরের একমাত্র টেবিলটাকে তার বিছানায় তুলে দিয়ে তার ওপর একটি কাঠের চেয়ার দিয়ে তাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলি, কী দিয়া হুলাক বন্ধ করবেন?

উলটো ধমক লাগিয়ে তিনি আমাকে বললেন, তাইলে কী বুইজ্যা তুই উপরে উঠলি?

আমি চুপচাপ চেয়ার আর টেবিল থেকে নেমে পড়ি। বলি, ব্যবস্থা করতাছি!

তারপর আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। তার রান্না ঘরের বেড়া থেকে দুটো মূলী বাঁশের চটা ভাঙতেই তিনি হায় হায় করে উঠলেন। বললেন, আয় হায় হায় হায় হায় রে বলদ! বেড়া ভাঙ্গলি কোন কামে?

কোনো কথা না বলে, আমি ফের সেই চটা দুটো নিয়ে ফরিদা বুবুর ঘরে ঢুকি। টেবিলে উঠে চেয়ারে উঠবার সময় বলি, বুবু, চেয়ারডা ধইরেন কইলাম! পইড়া হাত-পাও ভাঙ্গলে হগলে মিল্যা আম্নেরে জরিমানা করবো!

আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিছানায় উঠে দুহাতে চেয়ারের দু পায়া ধরে বলে উঠলেন, অলক্ষ্মীডায় কয় কি হোনো!

একটি চটা চালের ফুটো বরাবর অবতল দিকটা টিনের সঙ্গে লাগোয়া কাঠের ফ্রেমের ফাঁকে গুঁজে দেই। বাকি চটাটি দিয়ে আগের চটাটিকে চেপে দিতে এবং পানির ধারা যাতে চটা বেয়ে বাইরে চলে যায় তেমন করে আটকে দিয়ে বললাম, দ্যাহেন চাই হুলাক দ্যাহা যায় নি?

তিনি আমার দু পাশে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বললেন, পানি পড়বোনি ক?

আমি নামতে নামতে জানাই, হুলাক দেহা না গেলে পানিও পড়নের ডর নাই!

আমি গেলাম! বলে, ফরিদা বুবুর ঘর থেকে বের হয়ে পড়ি।

শুনতে পাই পেছন থেকে তিনি আমার উদ্দেশ্যে হুমকি দিয়ে বলছেন, বিস্নাৎ আবার পানি পড়লে বুজবি কইলাম!

আমি সে কথায় পাত্তা না দিয়ে দ্রুত পায়ে ক্ষেতের ওপর দিয়ে বিভিন্ন মানুষের চলাচলে সাময়িক ভাবে তৈরি হওয়া বদ্রিখোলা যাওয়ার কোণাকুণি পথে নেমে যাই।

আমাকে দেখে ভাবির চোখ-মুখ উজ্জ্বল ওঠে। হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলেন, কেমন আছস রে পাগলা? অ্যাদ্দিন বাদে ভাউজের কতা মনো অইলো?

তাৎক্ষণিক একটি অজুহাত তুলে ধরতে বলি, ল্যাহা পড়ার চাপ বেশি। অহন আমি ইস্কুলের হোস্টেলে থাহি!

ভাবি বললেন, হাত-মুখ ধুইয়া ঘরো গিয়া ব!

আমি ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠি, তুমি তৈয়ার অও! আমার লগে অহনই যাওন লাগবো!

আমার কথায় কিছু একটা সন্দেহ করে তিনি বলে উঠলেন, আব্বা-আম্মায় বালা আছে?

হ্যামন কোনো ডর নাই! তুমি গেলেই বাহে মায় আউজ্জা চিটাগাং যাইবো!

তখনই ভাবির মাকে দেখা যায় হাতে একটি কুলা নিয়ে এদিকে আসতে। আমাকে দেখতে পেয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাডায় লো হরিদ?

আবুয়ে! বলেই ভাবি প্রায় অস্ফুটে জানালেন, মায় আমারে যাইতে না করলে তুই কইস আব্বা-আম্মার শইল বালা না! তরে পাডাইছে আমারে নিতো বইল্যা!

কিন্তু মাওই মা তেমন কিছু জানতে আগ্রহী বলে মনে হলো না। ভাবিকে বললাম, ভাউজ, দেরি কইরো না! তোমার পোলাপাইনডি কই? ডাক দ্যাও!

-অ্যাত দূরের থাইক্যা আইছস, না খাইয়া না জিরাইয়া গেলে ক্যামন দ্যাহায়?

আমার খাওয়া বা জিরানোতে কোনো আগ্রহ নেই। তাওই সাব আসবার আগে আগে এ বাড়ি থেকে বের হতে পারলেই বেঁচে যাই! তাই বললাম, তুমি বুজতার্তাছ না কিয়ারে? তুমি গেলেই বাহে মায় চিটাগাং রওনা অইবো!

-তুই ঘরো গিয়া ব! আমি তৈয়ার অইতাছি!

তাকে নিতে এলে প্রতিবারই বিরক্ত হই। পিঠার চাল, চিড়া-মুড়ি আর খই ছাড়া তিনি বাপের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি কখনো গেছেন বলে মনে পড়ে না। আর প্রতিবারই অতিরিক্ত বোঝা বওয়ার কষ্টে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, এইবারই শ্যাষ! আর কোনো দিনও এই বাইত আইতাম না! কিন্তু কোনো বারই প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয় না। এবারও হাতে চিড়া-মুড়ি ভর্তি মাটির কলস আর কাঁধে খই, চালের পুটলি নিয়ে কায়ক্লেশে পথ চলি।

ভাবির নামও ফরিদা। তাই ফরিদা বুবু আর ভাবির মাঝে বেশ সখ্য আগে থেকেই। ভাবি আমাদের বাড়ি থাকলে ফরিদা বুবুও আমাদের বাড়ি ছাড়তে চান না সহজে। আজও ভাবির খোঁজে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের বাড়ির উঠোনে এসে খানিকটা উঁচু কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ভাউজ আইছস?

হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ভাবি। দুই সখিতে খানিক জড়াজড়ি, হাসাহাসি আর খুনসুটি চলে। তারপর ফরিদা বুবু বললেন, আমি অহন যাই। পরে আইতাছি!

ভাবি বলে উঠলেন, তুই আইলে ভালাই অইবো। আব্বা-আম্মায় চ্যাটগাও গেছে! কতা কওন যাইবো!

দুই সখির কথা আর ফুরায় না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায়। উঠি উঠি করেও ফরিদা বুবু কথা বলতে  থাকেন। আমার বিরক্তি প্রকাশের সুযোগ নেই বলে, বই হাতে বসে থাকি। বসে বসে তাদের অর্থহীন আলাপচারিতা শুনতে শুনতে এক সময় ঝিমুতে থাকি। তখনই পেছন থেকে ফরিদা বুবু আমার পিঠে ঠেলা দিয়ে বললেন, আবুরে! বাতিডা লইয়া আমারে আউগ্যাইয়া দে চাই!

মনে মনে হাঁপ ছেড়ে হ্যারিকেন হাতে উঠে দাঁড়াই। আর হঠাৎ করেই ঝম ঝম শব্দে কেঁপে উঠতে থাকে টিনের চাল। সুযোগ বুঝে ভাবি বলে উঠলেন, বাইরা মাইয়া ঝরি, এই রাইতে ছাড়নের আশা নাই। রাইতটা থাইক্যা যা! এক লগে খাইয়া আমার লগেই ঘুমাইস!

ফরিদা বুবুও যেন এমনটাই মনে মনে চাচ্ছিলেন, বললেন, হ, যেই ঝরি শুরু অইছে, মাইদ রাইতের আগে ছাড়বো বইল্যা মন অয় না!

আমার পড়ার আশায় মনে মনে ছাই দিয়ে বলি, ভাবি, তোমরা রাইত ভর কতা কইয়ো। আমারে ভাত দিয়া দ্যাও, খাইয়া ঘুম দেই!

-হুদা কামে অ্যাতক্ষণ বইয়া রইলি কিয়ারে? তর ভাইস্তা-ভাস্তির লগে তহন খাইয়া লাইলেই পারতি!

-আমার লগে লগে তোমরা দুইজনেও খাইয়া উডো না কিয়ারে?

-অ্যামন ম্যাঘ শুরু অইবো ক্যাডায় বুজ্জিল?

-তাইলে মইল্যাডা বিছাইয়া ব!

ঘরের ঝাপের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা বেতের পাটিটা নামিয়ে বিছালে আমার আগে ফরিদা বুবু বসে পড়ে বলে উঠলেন, বইন লো, অ্যাত যে বোক লাগযে এতক্ষণ কতাত মইজ্জা বুজ্জি না!

আমি ফরিদা বুবুর পাশে পাটিতে না বসে একটি পিড়ি টেনে বসে পড়লাম। একটু একটু করে মনে হচ্ছিলো বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে। কিন্তু টিনের চাল বলে টের পাওয়া যায় না বৃষ্টি কতটা জোরে বা ধীরে পড়ছিলো। আমি পাতের ভাতগুলো খেয়েই উঠে পড়ি।

ভাবি বলে উঠলেন, কিরে, না খাইয়াই উইট্যালাইলিদি?

বলি, ঘোমে চোক বুইঞ্জা আইতাছে!

ঘরের মাঝখানে দুটো আলাদা বেড়া দিয়ে তিনটা অংশ করা হয়েছে। প্রথম অংশটাতে দুটো বিছানা। একটা বাবার আরেকটা আমার জন্য। মাঝখানের অংশটাতে বাইরের কেউ এলে বসে। তা ছাড়া খাওয়ার সময় হলে পুরুষদের বসার জন্য নির্দিষ্ট স্থান। বাকি অংশে মা থাকেন। ভাত-তরকারির হাঁড়ি-পাতিল, মটকা-কলস, চাল-ডাল, তেল-নুন নিয়ে ময়ের জগত।

শুয়ে পড়ার পর খানিকটা শীত শীত বোধ হলে কাঁথা গায়ে চোখ বুজি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবি আর ফরিদা বুবুর অস্পষ্ট কথাবার্তা, চাপা হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এক সময় তাও আর কানে আসছিলো না। কেবল টিনের চালে টিপটিপ করে ঝরে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দে নিবিড় ঘুমের আমেজে লীন হয়ে যাচ্ছিলাম।

আমি ঘুমিয়ে পড়লে হাত পায়ের কোনটা কী অবস্থায় থাকে বলতে পারি না। ঘুম ভাঙলে দেখা যায় একটি হাত নয়তো একটি পা বিছানার বাইরে ঝুলছে। আর তেমন কিছু না হলে মাথার নিচে বালিশটা থাকে না। হঠাৎ চাপা কণ্ঠ আর হালকা ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙলে অন্ধকারে টের পাই টিনের চালে ঝম ঝম শব্দে অবিরাম বৃষ্টি পতনের শব্দ। নারকেল তেলের ভুরভুরে ঘ্রাণ আমার চোখ থেকে ঘুমের আবেশ যেন লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। বুঝতে না পেরে বলি। ক্যাডা?

-আমিরে! কদ্দুরা হেইফাইল সর চাই!

-বুবু, আফনে এহানো কিয়ারে? ভাবির লগে না হুইছিলেন?

আরে পোলা চুপ কর! তর ভাইস্তা-ভাস্তিগোরে কত জনম গাও গোসল দেয় না কে কইবো? এহেকটার গত্রেত্তে খাডাসের বাস আইতাছে!

ফরিদা বুবুর চাপা কণ্ঠস্বরে ছিটকে আসা ঘৃণা আর বিরক্তি দুটোই আমার কানের পর্দায় আছড়ে পড়ে। বলি, বাহের বিস্নাত যানগা না!

অন্ধকারেই তিনি আমার গালে তার একটি হাত ছুঁইয়ে দিয়ে অস্ফুটে বললেন, ব্যাক্কলডায় কয় কি হোনো! মুরুব্বীর বিস্নাত যাইয়া আমি হুইতাম? হ্যানো না জ্যাডায় নোয়াজ পড়ে!

বর্ষণ মুখর বিচিত্র এই মধ্য রাতের শীত কাতুরে বিছানা থেকে তাকে সরানোর আর কোনো কৌশলের কথা আমার মাথায় আসে না। তখনই তিনি আমার শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়ে কাঁথার অর্ধেকটা টেনে নিলেন অবলীলায়। তারপর কি মনে করে কাত হয়ে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কানের ওপর তার দু ঠোঁটের উষ্ণতা ঢেলে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ডরাইস না বলদ! চিলা-চিক্কুরও করিস না!

দেহ জুড়ে একটি অচেনা অস্থিরতা জেগে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর দ্রুত থেকে দ্রুত লয়ে  হাতুড়ি পেটানোর শব্দে আমি কেমন যেন নিজের কাছেই অচেনা হয়ে যেতে থাকি। ফরিদা বুবুর উষ্ণতায় আমার ঘুমন্ত কৌমার্যের আড়ালে দীর্ঘকাল লুকিয়ে থাকা অচেনা আমিটা যেন হঠাৎ করেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে থাকে।

৩০-৪-২০১১

_______________________________________

শব্দার্থ-

হুবু-ফুফু/ফুপু। আইয়ে কাইল- আগামী কাল। কাউলকাই-কালকেই। চ্যাটগাও- চাটগাঁ। আউজ্জা- আজ, আজকে। আইয়চ্চারে-আয় না রে। কইচ্চা-কইস না, বলিস না। হুলাক- ফুটো, ছিদ্র। বাহে- বাপে, বাবা। আম্নেরে- আপনাকে। ম্যাঘ-বৃষ্টি অর্থে। মইল্যা- পাটি, চাটাই। বুজ্জিল- বুঝেছিলো। বুজতার্তাছ- বুঝতে পারতেছ, বুঝতে পারছ। মাইদ রাইতের –মধ্য রাতের।  বুইঞ্জা- বুঁজে, বন্ধ হয়ে। আউগ্যাইয়া- এগিয়ে। বিস্নাৎ- বিছানায়। অ্যাদ্দিন- এতদিন। বাইরা মাইয়া ঝরি- বর্ষার মাসের বৃষ্টি। কিয়ারে- কেন? উইট্যালাইলিদি- উঠে পড়লি যে। কদ্দুরা হেইফাইল সর চাই- একটু  বা খানিকটা ওদিকে বা ওপাশে সর দেখি। এহেকটার-একেকটার, এক একটার। গত্রেত্তে- গাত্র থেকে, শরীর থেকে। হ্যানো- সেখানে।

(আমরা বন্ধু’র বৃষ্টি বন্দনা মেঘবন্দী ই-বুকে প্রকাশিত।)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to একটি বর্ষণমুখর রাত্রি এবং নষ্ট কৌমার্যের গল্প

You must be logged in to post a comment Login