কাজী হাসান

এ কেমন স্বাধীনতা?

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

“ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এ কেমন স্বাধীনতা?” এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এই ছড়ার লাইনটা খুব বিখ্যাত হয়েছিল। নব্বই দশকের প্রথম দিকে বাংলার জনগণ ভাবছিল, স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলেই, মানুষ দেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল,তা সত্যি হবে। হাসি, আনন্দে ভরে উঠবে দেশ। একাত্তরে যে কারনে জাতি যুদ্ধ করেছিল, তা হয়তো চুড়ান্তভাবে বাস্তব হবে। এরশাদের পতনের সাথে সাথেই সারা দেশ আনন্দ আর বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল।

পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ট বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় নিঃসন্দেহে অন্যতম। সেই সময়কার খুব বিখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, বন্ধু পণ্ডিত রবি শঙ্কর থেকে শুনলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। ভীষণভাবে অনুভব করলেন বাংলাদেশের লড়াকু মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ। আয়োজন করলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১ আগষ্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিশাল এক অনুষ্ঠান হল বাংলাদেশী উদ্বাস্ত্তুদের জন্যে তহবিল তুলতে। অংশ নিলেন সেই সময়কার সব বিশ্ব বরেন্য শিল্পীরা। জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, ছাড়াও ওস্তাদ আলি আকবর খান, ওস্তাদ আল্লাহ রাখা, এরিক ক্লাপটন, কমলা চক্রবর্তী প্রমুখ।

যারা জানতেন না, তারাও জানলেন বাঙালি সংগ্রামী মানুষদের অসহনীয় কষ্টভোগ, আর দেশকে স্বাধীন করার প্রাণপণ যুদ্ধ করার কথা। সবাই জানলেন বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিড়ে ফেলার জন্যে যুদ্ধ করছে। তার যুদ্ধ করছে গণতন্ত্রের জন্যে, শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্যে আর একটা ফুলকে বাঁচানোর জন্যে। বিশ্ব জনমত তৈরি হতে বেশী সময় লাগলো না। যে যেই ভাবে পারল সে সেই ভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন জানালো।

২৫ শে অক্টোবর, ১৯৭১ আমেরিকার বিখ্যাত Time পত্রিকা সংবাদ করলঃ East Pakistan: Even the Skies Weep।  খবরে প্রকাশিত হল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি মেয়েদের আটকিয়ে পাশবিক অত্যাচার করার কথা। কিছু গাইনী ডাক্তার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাঙালি বীরঙ্গনাদের গর্ভপাত করানোর জন্যে। কিন্তু অনেকের জন্যে তা দেরী হয়ে গিয়েছিল। পাক হানাদার কিছু মহিলাদের শিশুসহ মুক্তি দিয়েছিল। ক্রোধে, ঘৃণায় ফেটে পড়ে  ছিল বিশ্ববাসী। আমেরিকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব এডওয়ার্ড কেনেডি প্রকাশ্যে বাংলাদেশের জন্যে সমর্থন ঘোষণা করলেন। যদিও সে সময়কার মার্কিন সরকার ছিল পাক হানাদারদের বন্ধু।

ক্যানাডার এক শহরে গির্জা থেকে বেরিয়ে উপাসনাকারিরা দেখল, এক লোক হামাগুরি দিয়ে শক্ত কনক্রিটের সাথে ঘসে নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করছে। যখন জানতে চাওয়া হল, করছ কি। উত্তরে তিনি জানালেন, বাংলাদেশের মানুষ এর থেকে অনেক বেশী কষ্ট করছে। বিবেক দংশনে তিনি জর্জরিত। তাদের প্রতি তিনি মানুষের সহানুভুতি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।

এলেন গিন্সবার্গ ছুটে আসলেন বাঙ্গালীদের পাশে দাঁড়াতে। তিনি ছিলেন সেই সময়কার অন্যতম প্রধান মার্কিন কবি। বাঙ্গালীদের কষ্ট তিনিও সহ্য করতে পারলেন না। একেবারে অস্থির হয়ে সৃষ্টি করলেন এক কালজয়ী কবিতাঃ September on Jessore Road। যে কবিতা পড়লে প্রত্যেকটা বিবাকবান মানুষের চোখের কোণায় অশ্রু আসতে বাধ্য।

বিদেশীদের বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়ানোর সব ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে গেলে, হয়ত বিরাট একটা প্রকাশনার দরকার হবে। তবে আজকে আমি সেই চেষ্টা করছি না। ঘটনাগুলো বলার কারন , আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে, যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুধু আমরা একাই যুদ্ধ করি নি, বিশ্বের বহু মানুষ আমাদের সাথে সাথে স্বপ্ন দেখছিল। একটা জাতির জন্ম হবে, যারা হানাহানি করবে না; যারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে না অন্যকে বঞ্চিত করে; যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবে না নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। হাসি আর আনন্দে ভরা একটা দেশ হবে পৃথিবীর বুকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনাতার জন্যে আমরা ঋণী ত্রিশ লক্ষ শহীদদের কাছে, আমাদের মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে, আর মুক্তিযুদ্ধে যারা যারা সহযোগিতা করেছে তাদের সবার কাছে। তারা অনেকে হয়ত স্পষ্টভাবে বলেন নি তারা কেন স্বাধীন বংলাদেশ চেয়েছিলেন, কিন্তু এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের প্রত্যেকের অবচেতন মনে স্বাধীনতার মূল মন্ত্রগুলো কাজ করেছিল। আজ স্বাধীনতার বয়স চল্লিশ। আমাদের এখন পিছনে ফিরে তাকানোর সময় এসেছে। আমরা কি উত্তর দিতে পারবো, শহীদদের, আত্মত্যাগকারিদের আর শুভকাঙ্খিদের। তারা যদি জানতে চায়, তারা আমাদের স্বাধীনতা জন্যে যে এত মুল্য দিল, তার বিনিময়ে আমরা কি করেছি।

আমাদের শাসকরা এখন আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলে। মোটামুটিভাবে কয়েকটা পরিবারের নিয়ন্ত্রনে আমাদের সরকার, রাজনীতি আর আমাদের ভাগ্য। নেতারা নিজেদের নাম ডাক জাহির করতে মনে হয় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড়। অন্যদিকে, বাঙ্গালী শ্রমিকদের মালেয়েশিয়ার জঙ্গলে পাগল অবস্থায় পাওয়া যায়। চরম অমানবিক পরিবেশে তারা হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মধ্যপ্রাচ্যের মায়ামমতাহিন দেশগুলোতে। তাদের পাঠানো টাকায় চলে সরকার, কিন্তু তাদের কষ্ট দেখার কেও নেই।

বাঙ্গালী সৈনিকদের হাতে খুন হয় বাঙ্গালী কৃতিমান সেনা অফিসাররা। সন্ত্রাসী, গুপ্ত হত্যা আর ক্রশ ফায়ারে নির্বিচারে মানুষ মারা যায়। কোনটারই আসল কারণ জনগন জানতে পারে না। ছোট শিশুরা ছুটে আসে গাড়ির কাছে ফুল বিক্রি করতে। নোবেল প্রাইজ পাওয়া মানুষকে অপদস্ত হতে হয়। আসলেও যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে, তা নিজেরা মীমাংসা করে না। বিচার দিতে হয় বিদেশীদের কাছে। বাংলা ভাষা আর বাঙ্গালী সংস্কৃতি অবহেলিত থেকে যায়। মুক্ত চিন্তার কবি শামসুর রহমানকে “স্বাধীনতা তুমি” কবিতা লেখার জন্যে স্বাধীন দেশে পরাজিত শক্তির কাছে আক্রান্ত হতে হয়। রাজাকার, আলবদর না থাকলেও বাঙ্গালী মহিলা আর শিশুরা বিক্রি হয় বিদেশী বেশ্যালয়ে আর উট খেলার ময়দানে। আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায়, আর গার্মেন্টস শ্রমিকরা জীবন্ত দগ্ব হয়ে পুড়ে মরে। হিংসা, দ্বেষ আর দুর্নীতিতে যেন বাংলাদেশ পৃথিবীতে সব চেয়ে এগিয়ে। দেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ দারিদ্র্য সীমার নীচে অবমাননার জীবন যাপন করে।

কোন মুক্তিযোদ্ধাই কখনই বলে নি, তারা ব্যাক্তিগত সুযোগ সুবিধা পাবার জন্যে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু তার পরেও তারা যখন স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ অনাহারে থাকে, রোগে শোকে চিকিৎসা পায় না, যখন তাদের চোখে পানি দেখা যায়, তখন নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আসে তারা কেন জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিল। ত্রিশ লক্ষ শহীদদের হয়ত একই প্রশ্ন। স্বপ্নের সোনার বাংলা, স্বপ্নেই থেকে যায়।

আমাদের নতুন প্রজন্ম ভাবতে পারে, এ কেমন স্বাধীনতা, যেখানে বঞ্চনা ভরা। প্রতিটা পরিবর্তনে তারা আশাবাদী হয়ে উঠে। এরশাদের পতন আর প্রত্যেকটা নির্বাচনের পরে তারা আশায় বুক বাধে। কিন্তু তাদের আশা আশাই থেকে যায়। এর পর, তারা যদি অন্য রকম একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তা হলে কি, অবাক হওয়ার বেশী কিছু থাকবে?

এলেন গিন্সবার্গের September on Jessore Road কবিতার কয়েকটা লাইন আমি নীচে উদ্ধৃত করছি। সম্মানিত পাঠক, আপনারাই বিচার করুন যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ থেকে আমরা কতটুকু আগাতে পেরেছি।

Millions of babies in pain
Millions of mothers in rain
Millions of brothers in woe
Millions of children nowhere to go

মার্চ ২৫, ২০১১
http://www.lekhalekhi.net

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to এ কেমন স্বাধীনতা?

You must be logged in to post a comment Login