আনিসুজ্জামান

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি। পল্টন ময়দানের জনসভায় প্রধান অতিথি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন যখন ঘোষণা করলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ তখনই এর প্রতিবাদে আন্দোলনের ঝড় তুমুল বেগে বয়ে যেতে লাগল। যদিও ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত জিন্নাহর ভাষণের পর থেকেই আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছিল। এবার রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল হয়ে পড়ল দেশের ছাত্র সমাজ। ওই বছরের জানুয়ারিতেই গঠিত হলো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ঠিক হলো ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে একটা পুস্তিকা বের করা হবে। দায়িত্ব দেওয়া হলো সে-সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিপ্লবী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার ওপর। কিন্তু তিনি সময়াভাবে লেখাটা তৈরি করতে পারছিলেন না।

তখন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের পক্ষ থেকে একটি প্রচারপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হলো, মাত্র ১৫ বছর বয়সের এক কিশোরকে। সবে ম্যাট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজে আই.এ প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে সে। ঠাটারিবাজারে তাঁদের বাড়ির কাছে যোগীনগরে যুবলীগের অফিস। যুবলীগের সম্পাদক অলি আহাদের কাছ থেকে পুস্তিকা লেখার প্রস্তাব পেয়ে সে তো অবাক! ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সে কী জানে আর কী-ই বা লিখবে? অলি আহাদ তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মনে যা আসে, তাই লিখবেন, পরে আমি দেখব। শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের কিশোরই ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিষয়ে প্রথম পুস্তিকাটি রচনা করলেন। পুস্তিকাটির নাম দেওয়া হলো ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ আর সেদিনের ওই কিশোর-লেখকই পরবর্তীকালে আজকের বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ‘৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটাই ছিল প্রথম পুস্তিকা।

আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলনের কথা প্রথম শোনেন ১৯৪৮ সালে, তখন তিনি খুলনা জেলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হলো। মুসলিম লীগের লোকজন তাঁদের ডেকে বললেন, এসব যারা করছে তারা পাকিস্তানের শত্রু । কথাটা তখন তাঁর কিশোর মনকে স্পর্শ করেছিল। মাত্র ছ মাস হয়নি তাঁরা দেশভাগের কারণে কলকাতা ছেড়ে খুলনা এসেছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রতি একটা গভীর দরদ ছিল তাঁর। এই রাষ্ট্রটির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, এমন আন্দোলনে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি। এ কারণে তিনি সেদিন স্কুলের ধর্মঘটে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তারপর ১৯৪৯-৫০ এই দুই বছর বিষয়টা নিয়ে অনেক জেনেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি পড়তেন তাঁর মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান। তাঁর কাছে ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা, ভাষার প্রতি আকর্ষণ এসব মিলিয়ে তাঁর মনের ভেতর ভাষা আন্দোলনের চেতনাটি জন্ম নিল। আর তাই এর পুরো তাৎপর্য স্পষ্ট না হলেও, ভাষার জন্য এক ধরনের আবেগ তাঁকে দিয়ে ওই রচনাটি লিখিয়ে নিয়েছিল।

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ডা. এটিএম মোয়াজ্জম, পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, সামান্য লেখালেখিও করতেন। মা সৈয়দা খাতুন, গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ১৮৮৮ সালেই হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী লিখেছিলেন। এটি ছিল কোনো বাঙালি মুসলমানের লেখা হযরত মোহাম্মদের প্রথম জীবনী। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তাঁদের পরিবার। তাঁর রক্তের ভেতর শিল্প-সংস্কৃতির ঢেউ যে খেলা করবে তা তো স্বাভাবিকই।

আনিসুজ্জামানের শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোর শুরু হয়েছিল কলকাতা শহরের নাগরিক পরিবেশে। শিশুমনে নিজের অজান্তেই জন্মস্থান কলকাতাকে ঘিরে যে স্বপ্নের সোপান রচনা হতে শুরু করেছিল, ৪৭-এর দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দশ বছর বয়সে তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আনিসুজ্জামানদের পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় তথা আজকের বাংলাদেশে। এসে তারা প্রথমে আবাস গড়েন খুলনায়। সেখানেও বেশিদিন স্থায়ী হননি। বছরখানেক পরেই চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা শহরেও এক জায়গায় থাকা হয়নি। প্রথমে ছিলেন শান্তিনগরে, পরে ঠাটারিবাজারসহ আরো কয়েক জায়গায়। ফলে বিভিন্ন পরিবেশে, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর জীবনকাল।

কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন আনিসুজ্জামান। ওখানে পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। পরে এদেশে চলে আসার পর অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। কিন্তু বেশিদিন এখানে পড়া হয়নি। একবছর পরই পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রিয়নাথ স্কুলের শেষ ব্যাচ। কারণ তাঁদের ব্যাচের পরেই ওই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায় এবং এর নাম-পরিবর্তন করে রাখা হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। তখন জগন্নাথ কলেজের বেশ নামডাক ছিল। জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স শেষবর্ষের ছাত্রাবস্থায় একদিন বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি পাস করে কী করবে?’ তিনি জবাব দিলেন, আমি শিক্ষকতা করতে চাই। তখন মুহম্মদ আব্দুল হাই তাঁকে শিক্ষকতার আগে গবেষণায় উৎসাহিত করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি অনার্স পাস করলেন এবং ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর প্রথম গবেষণা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শূন্যতায় বাংলা একাডেমীর বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন।

বাংলা একাডেমীর বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে আনিসুজ্জামান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। প্রথমে অ্যাডহক ভিত্তিতে চাকরি হলো তিন মাসের। কথা ছিল গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলেই চাকরি শেষ হয়ে যাবে। চাকরি চলে যাওয়ার পর কয়েক মাস বেকার থাকলেন। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি পেলেন। এর কয়েক মাস পর অক্টোবর মাসে আবার যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। ১৯৬২ সালে তাঁর পিএইচডি হয়ে গেল। তাঁর পিএইচডির অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। ১৯৬৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন ডক্টরাল ফেলো হিসেবে বৃত্তি পেয়ে। তবে তার আগে ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে তথ্যমন্ত্রী জাতীয় পরিষদে বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের জাতীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার হ্রাস করতে বলা হয়েছে। এটা ছিল প্রকারান্তরে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার একটা পাঁয়তারা। এর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিবৃতিতে আনিসুজ্জামান স্বাক্ষর সংগ্রহ করলেন এবং সেটা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দিয়েছিলেন।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে তিনিও পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডক্টর শামসুজ্জোহা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত হলে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঘাতকদের বিচারের দাবিতে অবিরাম ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ডক্টর আব্দুল লতিফ চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক। শিক্ষক হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের পক্ষে, শিক্ষক সমিতির ওই দু’ শিক্ষকদের সঙ্গে তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাঞ্চেলর ও গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্য জানান। কিন্তু ফলাফল ভালো আসে না। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ সকালের ফ্লাইটে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান, ব্যক্তিগত কারণে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডারের পদের জন্য আবেদন করেছিলেন আগের বছর- বিভাগের অধ্যক্ষ ও তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের পরামর্শে। তাঁর জন্য সাক্ষাৎকারের সময় ধার্য হয়েছিল ২৬ মার্চ সকালবেলা। ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম পৌঁছে রেডিওতে খবর শুনলেন: আইয়ুব খান দেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন ইয়াহিয়া খানের কাছে, শাসনতন্ত্র স্থগিত হয়েছে, সামরিক আইন জারি হচ্ছে। ২৬ মার্চ সাক্ষাৎকার হওয়ার পর, সন্ধ্যার দিকে আভাস পেলেন চাকরিটা হবে। ২৭ মার্চ চলে এলেন ঢাকায়। ৩ জুন ভোরবেলায় গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে দুই সঙ্গী- ভূঁইয়া ইকবাল ও আব্দুল মান্নান ওরফে মইনু। দাউদকান্দি আর চান্দিনার মাঝামাঝি জায়গায় তাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটলো। রাস্তা থেকে গাড়িসহ ছিটকে পড়ে গেলেন নিচের ক্ষেতে, গাড়ির চার চাকা তখন আকাশমুখো, আর ভেতরে কুঁজো হয়ে পড়ে আছেন তিনজন। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে কুমিল্লার সিএমএইচে নিয়ে গেলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ- তিনি তখন কুমিল্লার পিএসডি। দুর্ঘটনায় সঙ্গীদের তেমন কিছু না হলেও আনিসুজ্জামানের গুরুতর আহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে ৩ জুন সকালেই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন আনিসুজ্জামানের শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই। কয়েকদিন কুমিল্লায় চিকিৎসা নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ওই সময় বেশকিছুদিন অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিলেন, প্রতিদিন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-সুহৃদরা আসতেন দেখা করতে।

ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান জানান, “নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আমাকে একদিন দেখতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ, সঙ্গে বোধহয় আব্দুল মমিনও ছিলেন। আমার ধারণা, তাজউদ্দীনই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার ঠিক আগে আমার পাঁচ বছরের মেয়ে রুচি এসে আমার কানে কানে জিজ্ঞেস করলো, ‘আসাদ আসেনি?’ আসলে গণঅভ্যুত্থানের সময়ে পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও দুটো শ্লোগান মুখস্থ করে ফেলেছিল: ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’ আর ‘আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। তাদের কাছে মুজিব ও আসাদ খুব কাছের মানুষ। তাই শেখ মুজিব এসেছেন শুনে রুচি আর তার বন্ধুদের মনে হয়েছিল, তবে তো তাঁর সঙ্গে আসাদেরও আসার কথা। রুচিকে কানে কানে কথা বলতে দেখে বঙ্গবন্ধু আমার কাছে জানতে চাইলেন, সে কী বলছে। আমার জবাব শুনে সেই বিশালদেহী মানুষটি নিচু হয়ে রুচির গাল ধরে বললেন, ‘ওরা আমার কাছে এই কৈফিয়ত তো চাইতেই পারে’। আমি যেন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। রুচির মাথায় হাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।” (আমার একাত্তর)

প্রায় মাসখানেক বিশ্রামের পর ১৯৬৯ সালের ৩০ জুন ঢাকা থেকে সপরিবারে বিমানযোগে চট্টগ্রামে পৌঁছেন এবং ঐদিনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেছিলেন। তারপর চলে গেলেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের হোস্টেলে। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। কখনও তিনি আগে বাংলা বক্তৃতা লিখতেন এবং সেটির ইংরেজি অনুবাদ করতেন খান সরওয়ার মুরশিদ, আবার কখনও মুরশিদ সাহেব আগে ইংরেজি ভাষ্য তৈরি করতেন, পরে সেটির বাংলাটা করতেন আনিসুজ্জামান। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে একজন নির্ভীক সৈনিক হিসেবে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান।

১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের মতো শিক্ষকতার পর অবসর নেন ২০০৩ সালে। কিন্তু ২০০৫ সালে আবার সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে দুই বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

আনিসুজ্জামান অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বটে কিন্তু প্রকৃত নেশা তাঁর লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই রয়েছে। যেগুলো আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ববহ। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (1979) Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records (1981) , আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮), Creativity, Reality and Identity (1993), Cultural Pluralism (1993), Identity, Religion and Recent History (1995) , আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮), আমার চোখে (১৯৯৯), বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন। এর মধ্যে- অস্কার ওয়াইল্ডেরAn Ideal Husband এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’ (১৯৮২), আলেক্সেই আরবুঝুভের An Old World Comedy -র বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’ (১৯৮৮)। এছাড়াও অসংখ্য গ্রন্থ একক ও যৌথ সম্পাদনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে- রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (যৌথ, ১৯৬৮), Culture and Thought (যৌথ, ১৯৮৩), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (যৌথ, ১৯৮৭), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯০), স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯৯২), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৩), নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (যৌথ, ১৯৯৩), SAARC : A People’s Perspective (১৯৯৩), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১ ও ৩ খণ্ড, ১৯৯৪-১৯৯৫), নারীর কথা (যৌথ, ১৯৯৪), ফতোয়া (যৌথ, ১৯৯৭), মধুদা (যৌথ, ১৯৯৭), আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী (১ম খণ্ড, যৌথ ২০০১), ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দসংগ্রহ (যৌথ ২০০৩), আইন-শব্দকোষ (যৌথ, ২০০৬) উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্যক্ষেত্রে, সাংগঠনিকক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন আনিসুজ্জামান। তাঁরই ফলস্বরূপ পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬), স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮), দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩), একুশে পদক (১৯৮৫), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬), বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০), দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩), অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। সম্মাননার মধ্যে- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট (২০০৫)। তিনি বেশকিছু উল্লেখযোগ্য স্মারক বক্তৃতা করেছেন। এগুলোর মধ্যে- এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্ধিরাগান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইন্সস্টিটিউট অফ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা এবং অনুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা উল্লেখযোগ্য।

বর্তমানে তিনি শিল্পকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী’ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইন্সস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক কাগজ ও লিটলম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়মিতই ছাপা হচ্ছে।

জীবনসঙ্গিনী সিদ্দিকা জামানের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের প্রথমে প্রেম এবং তারপর বিয়ে। তাঁরা বিয়ে করেন ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর স্ত্রী তখন ইডেন কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্রী। শ্বশুর আবদুল ওয়াহাব, ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক। কাজ করতেন কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়। ঢাকায় চলে আসার পরও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ওই পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। পরে ডন, লন্ডন টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা হন। আনিসুজ্জামান ও সিদ্দিকা জামান দম্পতির দুই মেয়ে, এক ছেলে।

শৈশব থেকেই জীবনের নানারকম বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে জীবনকে দেখেছেন তিনি গভীর অতলস্পর্শীরূপে। মাত্র দশ বছর বয়সেই দেশভাগের ফলে জন্মভূমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে হয়েছে তাঁকে। দেশান্তরী হয়েও একজায়গায় থিতু হতে পারেননি। কখনও খুলনায়, কখনও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়, কখনও বা বিদেশ বিভুঁইয়ে। ফলে তিনি দেখেছেন বিভিন্ন ধরনের বাস্তবতা, বিভিন্ন ধরনের মানুষ, বিভিন্ন ধরনের জীবন। ভাষাআন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রঅস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত এরকম প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষীই শুধু তিনি নন, সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছেন। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন। লেখালেখির মাধ্যমে নিজের চিন্তা, দর্শন ও সৃজনশীলতাকে অব্যাহত রেখেছেন এখনও।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
জন্ম:
১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন আনিসুজ্জামান।

পরিবার-পরিজন:
বাবা ডা. এটিএম মোয়াজ্জম, পেশায় ছিলেন হোমিও ডাক্তার। মা সৈয়দা খাতুন, গৃহিনী। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। আনিসুজ্জামানের স্ত্রী সিদ্দিকা জামান। তাঁদের দুই ছেলে, এক মেয়ে।

পড়াশুনা:
কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন। ওখানে পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। পরে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। একবছর পরই ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ওই কলেজ থেকে আইএ পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ সালে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করেন।

কর্মজীবন:
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। প্রথমে অ্যাডহক ভিত্তিতে চাকরি হলো তিন মাসের। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি পান। পরে আবার যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়। ১৯৬২ সালে তাঁর পিএইচডি হয়ে গেল। ১৯৬৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ডক্টরাল ফেলে হিসেবে বৃত্তি পেয়ে।
১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাবি থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি শিল্পকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী’ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

লেখালেখি:
তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বহু বাংলা ও ইংরেজি বই রয়েছে। যেগুলো আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ববহ। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (1979) Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records (1981) , আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮), Creativity, Reality and Identity (1993), Cultural Pluralism (1993), Identity, Religion and Recent History (1995) , আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮), আমার চোখে (১৯৯৯), বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন। এর মধ্যে- অস্কার ওয়াইল্ডের An Ideal Husband এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’ (১৯৮২), আলেক্সেই আরবুঝুভের An Old World Comedy -র বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’ (১৯৮৮)। এছাড়াও অসংখ্য গ্রন্থ একক ও যৌথ সম্পাদনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে- রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (যৌথ, ১৯৬৮), Culture and Thought (যৌথ, ১৯৮৩), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (যৌথ, ১৯৮৭), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯০), স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯৯২), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৩), নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (যৌথ, ১৯৯৩), SAARC : A People’s Perspective (১৯৯৩), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১ ও ৩ খণ্ড, ১৯৯৪-১৯৯৫), নারীর কথা (যৌথ, ১৯৯৪), ফতোয়া (যৌথ, ১৯৯৭), মধুদা (যৌথ, ১৯৯৭), আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী (১ম খণ্ড, যৌথ ২০০১), ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দসংগ্রহ (যৌথ ২০০৩), আইন-শব্দকোষ (যৌথ, ২০০৬) উল্লেখযোগ্য।

পুরস্কার-সম্মাননা:
পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬), স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮), দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত পুরস্কার (১৯৮৩), একুশে পদক (১৯৮৫), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬), বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০), দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩), অশোককুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪)। সম্মাননার মধ্যে- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট (২০০৫)।

(তথ্যসহযোগিতা নেওয়া হয়েছে- আমার একাত্তর, লেখক- আনিসুজ্জামান, ১৯৯৭; কালনিরবধি, লেখক- আনিসুজ্জামান, ২০০৩, লেখক অভিধান, বাংলা একাডেমী, ২০০৮)

লেখক : সৌমিত্র দেব