শৈলী টাইপরাইটার

কোথায় যাচ্ছি: রবীন দত্ত

কোথায় যাচ্ছি: রবীন দত্ত
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

সাব ইনস্পেক্টর অফ পুলিস হিসাবে ডোমজুড় থানায় জয়েন করেছি। তাও মাস ছয়েক হোলো । এই থানায় আসার পর এই প্রথম একটা শিশু মার্ডার কেস এ যার নামে এফ আই আর হয়েছে তার ফ্যামিলির কাছ থেকে বখশিশের টাকা হিসাবে মোটা খাম পেলাম । শর্ত হোলো মার্ডারটাকে এক্সিডেন্টাল ডেথ হিসাবে দেখাতে হবে ।  এফ আই আর লজ করেছে বাচ্চাটার ছোট মামা । যাকে অ্যারেস্ট করেছিলাম , তার বিরুদ্ধে সেকশনগুলো বেলেবল্ করে দিতে ভদ্রলোক  বেল পেয়েও গেলো । সাজানো গোছানো ইনভেস্টিগেশন করে খুব শীঘ্রই কোর্টে চার্জসীট দেবো । এখন ডিউটি সেরে কোয়ার্টারে এসেছি । হঠাৎ কেন যে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না । বাবা চলে গেছে তাও বছর খানেক হয়ে গেছে । আর মা তো বছর দশেক হল । বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম কেন জানি না বাবার কথা খুব মনে পরছে ।

            আমার বাবা অর্ধেন্দু নস্কর ছিলেন স্টেট গভর্মেন্টের ক্লারিকাল গ্রেডে। বাবা আমাদের সংসারটাকে আগলে রেখে ছিলেন। বিশেষ করে মা’র মৃত্যুর পর থেকে । বাবা আমাকে বুকে করে রেখেছিলেন । আমার বাবা আমার পড়াশোনা – শরীর স্বাস্থ্যর দিকে নিখুঁত ভাবে লক্ষ্য রাখতেন । বাবার ইচ্ছা ছিল না পুলিশ সার্ভিস এক্সামিনেশন দিতে। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল প্রবল । পুলিশের চাকরীতে মাইনে ছাড়াও এতে প্রচুর মোটা মোটা খাম পাওয়া যায় ।

            বাবা রেগুলার ব্যায়াম করতেন বলে, তাছাড়া সাত্বিক খাওয়া দাওয়া তাকে নিখুঁত স্বাস্থ্যের অধিকারী করেছিল । বাবার পড়ার টেবিলে কিছু বইয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা , গীতবিতান এই বই দুটো সব সময় থাকত । বাবাকে দেখতাম মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলা বই দুটো একটা পরিষ্কার রুমাল দিয়ে মুছতে । টেবিলের ওপর রাখা রবীন্দ্রনাথের ছবিটার পায়ের কাছে বই দুটো প্রতিদিনের ধূপের গন্ধ পেত । ভাবতাম বাবা গভীর ভাবে রবীন্দ্র প্রেমিক ছিল তাই বই দুটোর এত যত্ন ।

            বাবার মৃত্যুর চার-পাঁচ দিন  আগে বই দুটো টেবিল থেকে চুরি হয়ে যায় বা হারিয়ে যায় । বাবা অনেক খুঁজে ছিল কিন্তু পাওয়া যায়নি । তারপর থেকে দেখলাম আমার সুস্থ সবল বাবা ক্রমশঃ যেন কেমন হয়ে গেল । প্রায় পাগলের মত । লোকাল ডাক্তারকে দেখালাম। উনি বললেন, কন্ডিশন ভালো বুঝছি না , হসপিটালাইজ্ড করতে । নার্সিং হোমে ভর্তি করলাম । আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাবা চলে গেল । মৃত্যুর আগের মুহূর্তে আমি বাবার মাথার পাশে ছিলাম ।

            বাবার শেষ কথা ছিল , “ তথা , ওই বই দুটো আর খুঁজে পাওয়া গেল না নারে । “

            আজ বড্ড বেশী করে বাবার কথা কেন মনে পরছে জানি না । পকেট থেকে টাকার খামটা টেবিলের ওপর রেখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ । মনে হল খামের ওপর কার যেন দুটো চোখ ভেসে উঠল । বাবার , নাকি যে নয় বছরের বাচ্চাটা খুন হল তার । কিন্তু এই রকম অসংখ্য খামের জন্য , যেটার মধ্যে দিয়ে আমি মদ ও মেয়ে পাবো সেটার জন্যই তো এই সার্ভিসে আমার আসা ।

            অমর বলে যে লোকটাকে খুনের চার্জ না দিয়ে অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথের চার্জ দিয়েছি সে স্কচের বোতল নিয়ে এসে হাজির । তারপর দুটো গ্লাসে স্কচ ভর্তি করে দু’জনে মুখোমুখি বসলাম । গল্প করতে করতে আমায় জিজ্ঞাসা করলো –

            “আপনার বাবার নাম কি ? বাড়ী কোথায় –“

            “বাবার নাম অর্ধেন্দু নস্কর । আর বাড়ী শ্যামনগরে ।“

            “শ্যামনগরের পুর্ব-পল্লিতে ।“

            “আমি বললাম , হ্যাঁ  তবে আপনি জানলেন কি করে ।“

            “আরে আপনাদের পাড়ায় তো আমাদেরও বাড়ী । যদিও দুই বাড়ীর মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না। তবুও পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা সবাই আপনাদের চিনত । আর আপনি তো পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন । পাড়ায় মিশতেনই না। তাই আমায় চিনতেন না । যাই হোক বছর দুয়েক হল শ্যামনগরের বাড়ী বিক্রি করে ডোমজুরে একটা বাড়ী কিনে নিয়ে আছি । আপনাকে ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলি। আমার ছ’বছরের বড় এক দিদি আছে । নৈহাটিতে থাকে । আমার দিদি আপনার বাবাকে চিনত । চিনত মানে রাস্তা ঘাটে , পড়তে গিয়ে  স্কুলে আপানার বাবাকে দেখত । কিন্তু আপনার বাবা বা আমার দিদি কেউ কারুর সঙ্গে কোনোদিন কথা পর্যন্ত বলেনি । সেই দিদির বিয়ের দিন দিদি আমার হাতে দুটো বই একটা চিরকুট দিয়ে বলেছিল , অর্ধেন্দুদাকে দিয়ে আসতে । আমি চিরকুট খুলে পড়েছিলাম । তাতে লেখা ছিল বই দুটোর ভেতর নিজেকে পুরে পাঠালাম । আমি চলে যাচ্ছি । তারপর থেকে আমি আর আপনাদের বাড়ী যাইনি।“

            “আপনার দিদির নাম কি ?”

            “সুধা ঘোষ ।“

            অমর বাবু চলে গেছেন তাও ঘণ্টা খানেক হল । বই দুটো চুরি হওয়ার পর একদিন রাতের ঘটনা স্পষ্ট মনে পরছে । রাত্রি বেলায় বিছানায় বাবাকে দেখতে না পেয়ে ছাদে যাই । দেখি বাবা উত্তর আকাশের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছে আর হাত জোর করে বলছে , “ ক্ষমা করে দাও সুধা আমি তোমায় রাখতে পারলাম না।“  জীবনে এই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখলাম ।

            তারও বছর খানেক পরে , আনন্দবাজারে রিপোর্টিং হল  –

            ন’বছরের কন্যা সন্তানের খুনের দায়ে অমর ঘোষের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে হাওড়া কোর্ট ।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login