মুস্তাফা মনোয়ার

তখন ভাষা আন্দোলনের সময়। মুস্তাফা মনোয়ার ছিলেন নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। থাকতেন নারায়ণগঞ্জে মেজ বোনের বাড়িতে। নারায়ণগঞ্জ থেকেই তিনি শুনতে পেলেন ঢাকায় গুলি হয়েছে, কিছু বাঙালি শহীদ হয়েছে। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষা বন্ধ করে দিতে চায়। সেই প্রেক্ষাপটে মুস্তাফা মনোয়ার ছবি আঁকতে শুরু করলেন এবং সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে সারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিতে লাগলেন। ফলশ্রুতিতে পুলিশ এসে তাঁকে এবং তাঁর দুলাভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানকে বন্দি করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিলেন। দীর্ঘ একমাস কারাবাসের পর তিনি মুক্তি পেলেন।

ছবি আঁকার কারণে কিশোর বয়সে কারাবরণ করা এই শিল্পী কারাগার থেকে মুক্তির পর ছবি আঁকা থেকে কিন্তু পিছপা হননি। বরং তিনি ছবি আঁকায় আরও বেশি মনযোগী হয়েছিলেন। আর তাইতো পরবর্তীতে চিত্রশিল্পে তাঁর স্বতঃস্ফুর্ত পদচারণা, বাংলাদেশে নতুন শিল্প আঙ্গিক পাপেটের বিকাশ, টেলিভিশন নাটকে তাঁর অতুলনীয় কৃতিত্ব আমরা দেখতে পাই। তিনি শিল্পকলার উদার ও মহৎ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। দ্বিতীয় সাফ গেমসের মিশুক নির্মাণ এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনের লালরঙের সূর্যের প্রতিরূপ স্থাপনাসহ শিল্পের নানা পরিকল্পনায় তিনি বরাবর তাঁর সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

১৯৩৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর এক শিল্পী পরিবারে মুস্তাফা মনোয়ারের জন্ম। তাঁর বাবা কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন ভীষণ শিল্পরসিক, তিনি শুধু কবিতা লিখতেন না, ভালো গানও গাইতেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার মনোহরপুর গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালী নদী। আর একপাশে বড় একটা বটগাছ। গ্রামের তিন দিকটাই খোলা, যতদূর চোখ যায় শুধু ফসলের মাঠ। মাঠের ওপাশে বহুদূর পর্যন্ত শুধু আকাশ। বাংলাদেশের গ্রাম বলতে তাঁর মনে নিজের গ্রামের ছবিটাই ভেসে ওঠে সবার আগে, যে গ্রামটি তিনি ছোটবেলায় দেখেছেন। তারপর কত গ্রামে গেছেন তিনি কিন্তু গ্রাম বলতে ঘুরেফিরে তাঁর ছেলেবেলার সেই মনোহরপুর গ্রামের ছবিই ভেসে ওঠে। ছেলেবেলায় তাঁর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ, মুক্ত মাঠ, আর যতদূর চোখ যায় কেবলই সবুজ শস্যক্ষেত। যখন সবুজ ধানের ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাওয়া বইত তখন ধান ক্ষেতে খুব সুন্দর ঢেউ খেলে যেত। তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। পরে একটা গান শুনতেন- ‘এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে’- তখন স্পষ্ট মনে হতো এ ছবি তিনি দেখেছেন। বড় হয়ে যখন এরকম কোন কবিতা বা লেখা পড়তেন তখন মনে হতো এটা তো তাঁর দেখা।

প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে বড় পুকুরে, বটগাছে আর নদীতে, বিলে বিস্তর হরিয়াল, শামুকভাঙা, চেগাপাখি, পানকৌড়ি, হাঁস আর লম্বা গলার বক দেখার স্মৃতি তাঁর আজও চোখে ভাসে । যে দেখার অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর পাপেটে খুব বিস্তারে এবং বিশ্বাসে প্রয়োগ করে ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’ গানটির কাহিনীরূপ উপস্থাপন করেছেন।

মুস্তাফা মনোয়ারের মা মারা যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। মা না থাকায় গ্রামের সবাই তাঁকে খুব স্নেহ করত। ছোটাবলায় প্রথম একবার তিনি পানিতে ডুবে যান, সে যাত্রায় পানিতে ঝাঁপ দিয়ে তাঁকে তাঁর মেজ বোন তাড়াতাড়ি উদ্ধার করেন। এরপর থেকে তাঁকে সবাই খুব চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু শিশু মনোয়ার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে গামছা দিয়ে ডোবায়, পুকুরে, বিলে এবং নদীতে মাছ ধরতে যেতেন।

মুস্তাফা মনোয়ারের বাবা কবি গোলাম মোস্তফা কর্মসূত্রে থাকতেন কলকাতায়। বাবার সঙ্গে তাই তাঁকেও অধিকাংশ সময় কলকাতায় থাকতে হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই তাঁর বাবা বেশ ঘটা করে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে মনোহরপুর চলে আসতেন। আসার সময় কলকাতা থেকে অনেক গুণীজনকেও তিনি গ্রামে নিয়ে আসতেন এবং গ্রামময় গানবাজনা আর লাঠিখেলার উৎসব আয়োজন করতেন। এসব আয়োজন হতো তাঁদের বাড়ির সামনের উন্মুক্ত কাচারি ঘরকে ঘিরে। এখানে নিয়মিত অতিথি হতেন কন্ঠ শিল্পী আব্বাস উদ্দিন। আর তিনি এলে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দরাজ গলার গান ছিল ধরাবাঁধা।

কলকাতায় তাঁর প্রিয় খাবার ছিল আইসক্রিম আর চকলেট। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে চকলেট কিনে একটা বাড়ির সামনে দিয়ে দৌড় দেওয়ার সময় একটা কুকুর এসে তাঁকে কামড়ে দিল। তাঁর পা দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ডাক্তার তাঁকে ১৪টি ইনজেকশন দিল।

কলকাতায় থাকতে অনেক ছোট বয়স থেকেই মুস্তাফা মনোয়ার গ্রামোফোন বাজাতেন। রেকর্ড বাজালেই মনোয়ার রেকর্ডের সামনে গিয়ে বসে থাকতেন এবং তাঁর পছন্দের গানগুলো যেকোনো রেকর্ড থেকে বের করে দিতে পারতেন। তখন তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়নি এবং রেকর্ডের সবগুলোর চেহারা ছিল একই রকমের। রেকর্ড থেকে পছন্দের গান বের করার এই প্রতিভা দেখে তাঁর বাবা বেশ অবাক হয়েছিলেন এবং বন্ধুবান্ধবকে ডেকে দেখাতেন। কবি নজরুল ইসলামকেও মুস্তাফা মনোয়ারের এই প্রতিভা দেখিয়েছিলেন তাঁর বাবা।

মুস্তাফা মনোয়ার প্রথম ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। এই স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি গান হতো, ব্রতচারী হতো। স্কুলে পড়ার সময় তিনি বাবা ও বড়ভাইয়ের কাছ থেকে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। সঙ্গীতের শিক্ষায় তাঁর প্রথম শেখা রাগের নাম হচ্ছে জৈনপুরি।

তিনি যখন আর্ট কলেজে পড়তে শুরু করেন তখন নতুন করে আবার সঙ্গীত শিক্ষার সূচনা করেন ওস্তাদ ফাইয়াজ খানের শিষ্য ওস্তাদ সন্তোষ রায়ের কাছে। আর্ট কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে তিনি ‘হিজ মাস্টার ভয়েস কম্পিটিশনে’ অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে একক সঙ্গীত পরিবেশনার জন্য বশীর আহমেদ এবং সুবীর সেনের সঙ্গে যুগ্মভাবে সেরা গায়ক নির্বাচিত হন। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর দলে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত থেকে গান করেছিলেন। পরে ছবি আঁকার ব্যস্ততার কারণে মুস্তাফা মনোয়ারের আর গান গাওয়া হয়নি। কিন্তু সুর থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন নন কোনোদিনই। তাঁর পাপেট শিল্প সুর. কথা, গান অভিনয়, চিত্রকলা, কবিতা সব শিল্পকেই ধরে রেখেছে।

বাবা গোলাম মোস্তফার ফটোগ্রাফি চর্চা আর বইয়ের ইলাস্ট্রেশন দেখে এবং মেজ ভাই মুস্তাফা আজিজের ছবি আঁকা দেখে তিনি শিল্পকলার বহুদিকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। কলকাতার বালিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে কবি গোলাম মোস্তফা যখন হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে গেলেন তখন মুস্তাফা মনোয়ার এখানকার গঙ্গার উদারতা দেখে খুশি হয়ে ওঠেন। আর এখানে এসেই তাঁর শিল্পী জীবনের সচেতন যাত্রা শুরু হয়।

নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে মুস্তাফা মনোয়ার কলকাতায় গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন সায়েন্সে। পড়ালেখায় মনোযোগ তাঁর কোনোদিনই ছিল না, তার উপর আবার কলেজে ভর্তি হয়েছেন সায়েন্সে, অথচ অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। তখন তাঁদের কলেজে দু মাস পরপর ক্লাস পরীক্ষা হতো। ভালো নম্বর যাঁরা পেতেন ক্লাসে সবার সামনে তাঁদের ডেকে সবাইকে দেখানো হতো। একদিন স্যার অঙ্কের খাতা দিতে এসে কয়েকজন ভালো নম্বরধারী ছাত্রের নাম ধরে ডাকলেন এবং খাতা দেওয়ার পর হঠত্‍ বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন ‘মুস্তফা মনোয়ার।’ বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়ে মুস্তাফা মনোয়ার উঠে দাঁড়ালেন। শিক্ষক তো তাঁর মুখে হাসি দেখে অবাক, ‘এই ছেলে, তুমি কত পেয়েছ জানো? হাসছো! তুমি চার পেয়েছ।’ ছেলেটা আরো হাসছে। ‘এখনো হাসছ! লজ্জা করছে না! অঙ্কে কেউ কোনোদিন চার পায়?’ ছেলেটা বলল, ‘স্যার কোন অঙ্কটা ঠিক হয়ে গেল, তাই ভেবে হাসছি।’

অঙ্কে এত খারাপ করে সায়েন্সে পড়া মুশকিল। এসময় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। মুস্তাফা মনোয়ারদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন এই গুণী লেখক। খুব রসিক মানুষ, অনেক নামডাক, দেশ-বিদেশ বেড়িয়েছেন। তিনি মাঝে মাঝে তাঁর ছবি দেখতেন এবং খুব প্রশংসা করতেন। মুজতবা আলী একদিন বললেন, ছেলেটার এত ভালো গুণ সায়েন্স পড়ে নষ্ট হবে! তিনি মুস্তফা মনোয়ারের বড় ভাবির সঙ্গে তাঁকে কলকাতা আর্ট কলেজে নিয়ে গেলেন। শিল্পী রমেন চক্রবর্তী তাঁর আঁকাআঁকি দেখে খুশি হয়ে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। ১৯৫৯ সালে কলকাতা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্টসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন মুস্তাফা মনোয়ার।

১৯৬৫ সালে মেরী মনোয়ারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মুস্তাফা মনোয়ার। পারিবারিক উদ্যোগে তাঁরা বিয়ে করেছেন । মেরী মনোয়ার তখন পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়া ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক বোর্ডে কাজ করেছেন। বেশ কিছুদিন ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবেও কর্মরত ছিলেন মেরী মনোয়ার। এছাড়া ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে সাদাত মনোয়ার বাংলাদেশ বিমানের পাইলট, আর মেয়ে নন্দিনী মনোয়ার চাকুরীজীবি।

মুস্তাফা মনোয়ার কর্মজীবন শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে । এরপর একে একে কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপমহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা’র জেনারেল ম্যানেজার এবং এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ৷ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন জাপান ব্রডকাষ্টিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, এন এইচ কে শিক্ষামূলক টিভি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা কোর্সে; বিবিসি লন্ডন, যুক্তরাজ্য, টেলিভিশন প্রযোজনা কৌশলে এবং এন এইচ কে, জাপান, উর্দ্ধতন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কোর্সে ৷ বিভিন্ন সময়ে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালে বিটিভি থেকে প্রচারিত শিশু প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে জনপ্রিয় ‘নতুন কুঁড়ির’ রূপকার তিনি। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হয়েছেন ।

ওয়ার্ল্ড ভিউ ফাউন্ডেশন আয়োজিত শ্রীলঙ্কা, কলম্বোতে এ্যানিমেশন এ্যান্ড পাপেট ফর টিভি শীর্ষক সম্মেলনে রিসোর্স পারসন হিসেবে, ১৯৯১ সালে সিঙ্গাপুরস্থ এশিয়ান ম্যাস কমিউনিকেশন রিসার্চ ইনফরমেশন সেন্টার আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এবং ১৯৯২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফ আঞ্চলিক দফতর নেপালে অনুষ্ঠিত মা ও শিশু উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন মুস্তাফা মনোয়ার ৷ ১৯৭১ সালে ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রথম বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দান করেন ৷ ১৯৭৬ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান করেন ৷ ১৯৮০ সালে হংকং এ অনুষ্ঠিত এশিয়ান সাংস্কৃতিক উৎসবে অনুষ্ঠান পরিচালকরূপে অংশগ্রহণ করেন ৷ ১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস এ বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি ৷ তাসখন্দে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পাপেট সম্মেলনে বাংলাদেশ পাপেট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান ও শো প্রদর্শন করেন ৷ এছাড়া তিনি আরও বহু দেশ সফর করেন।

২য় ও ৬ষ্ঠ সাফ গেমস এর উদ্বোধনী ও সমাপনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ডিরেক্টর ও ভিজুয়ালাইজার এর দায়িত্ব পালন করেন মুস্তাফা মনোয়ার। অনুষ্ঠানটি দর্শক শ্রোতা কতৃক খুব প্রশংসিত হয়েছে ৷ ২য় সাফ গেমস এর মাসকট মিশুক, ১০ ফুট উঁচু হরিণ শাবক এবং ৬ষ্ঠ সাফ গেমস এর মাসকট অদম্য একটি বড় বাঘরূপী জীবন্ত পাপেট নির্মাণ তাঁর একটি বড় সাফল্য৷ পরবর্তীতে মিশুকের একটি প্রতিরূপ তৈরী করে ঢাকা শহরের প্রধান কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে ৷ এছাড়াও বিশিষ্টনৃত্য পরিকল্পনাকারী এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৷ ১৯৮৫ সালে সার্ক সন্ধ্যা অনুষ্ঠানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান নির্মানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নির্মিত অনুষ্ঠানটি দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে ৷

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে জলরঙের চর্চায় তিনি অবদান রেখেছেন । জলরং ছাড়াও তেলরং ও গ্রাফিক্সে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের দক্ষতার স্বীকৃতি মিলেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে।

কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি প্রথম পাপেট নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গ্রামবাংলার পুতুলনাচ ছোটবেলাতেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। আর এখন তো বাংলাদেশের পাপেটচর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনি। বাংলাদেশে পাপেট তৈরি ও কাহিনী সংবলিত পাপেট প্রদর্শনের তিনিই মূল উদ্যোক্তা। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তে গিয়ে তিনি প্রথম ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পাপেট দেখেছিলেন। পাপেট নিয়ে বহুদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। প্রথমবার তিনি তাঁর নিজের পাপেট দলসহ বাংলাদেশের ফোক পাপেট দল ধনমিয়াকে নিয়ে মস্কো ও তাশখন্দ সফর করেন। সেখানে বাংলাদেশের ফোক পাপেট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। মুস্তাফা মনোয়ার তাঁর সফল শিল্পকর্মের স্পন্দনে বাংলাদেশের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে গেঁথে দিতে সিদ্ধহস্ত। যে কারণে তাঁর পাপেটের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয় পারুল। ‘পারুল’ নামটির সঙ্গে সঙ্গে সেই সাত ভাই জাগানো লোককথার কথা মনে হয়। পারুল বোন একটিই, সেই-ই তো একদিন সাত ভাইকে জাগিয়েছিল। এই মর্তে আবার নবজাগরণের ঘটনাটা খুব সম্ভবত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার সেই ‘পারুল’ বোনটির মাধ্যমেই ঘটাতে চান। কেননা, তিনি তাঁর পাপেটকে এখন আনন্দময় শিক্ষা কর্মসূচিতে প্রয়োগ করতেই অধিক ব্যস্ত। ১৯৬০-৬১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলিম শরাফী তাঁর একটি ডকুমেন্টারিতে সর্বপ্রথম মুস্তাফা মনোয়ারের পাপেটকে অন্তর্ভুক্ত করেন।

টেলিভিশনে ‘আজব দেশে’ অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে তিনি ‘বাঘা’ ও ‘মেনি’ চরিত্র রচনা করে পাপেট প্রদর্শনী করেন। এটা ৬৭-৬৮ সালের ঘটনা। কাহিনীতে দেশের পলিটিক্যাল পরিবেশ এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিরোধী পাকিস্তানী মনোভাবের প্রকাশকে ব্যঙ্গ করা হত পাপেট নাটকের মাধ্যমে। এই সঙ্গে ছোটদের ছবি আঁকা ও দেশের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা প্রকাশ করা হত। অনুষ্ঠানের তিনি পরিকল্পক ও উপস্থাপক ছিলেন।

টেলিভিশনে নতুন শৈলীর অনুষ্ঠান নির্মাণে মুস্তাফা মনোয়ার বরাবর অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। টেলিভিশনে তাঁর প্রযোজিত শেক্সপিয়রের ‘ট্রেমিং অব দি শ্রু’র, মুনীর চৌধুরী অনূদিত বাংলা টেলিভিশন নাটক ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ ইতিহাস সৃষ্টি করে আছে। এই নাটক দুটি যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টিভির ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি অব টিভি ড্রামা’র জন্য মনোনীত হয়। সার্কভুক্ত দেশের টেলিভিশনের জন্য নির্মিত শিশুদের শিক্ষামূলক মীনা কার্টুন বা আনিমেশন ফিল্মের পরিকল্পকদের মধ্যেও তাঁর সক্রিয় অবস্থান ছিল। টেলিভিশনের ছোট স্টুডিওতে ত্রিমাত্রিকতা রচনা করে তিনি তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রকাশ করেন।

কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয় শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে। ১৯৫৭ সালে কলকাতার একাডেমিক অব ফাইন আর্টস আয়োজিত নিখিল ভারত চারু ও কারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রাফিক্স শাখায় শ্রেষ্ঠ কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চারুকলা প্রদর্শনীতে তেলচিত্র ও জলরঙ শাখার শ্রেষ্ঠ কর্মের জন্য দুটি স্বর্ণপদক পান। চারুকলার গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য টেনাশিনাস পদক লাভ করেন। চিত্রশিল্প, নাট্য নির্দেশক এবং পাপেট নির্মাণে অবদানের জন্য শিশু কেন্দ্র থেকে ২০০২ সালে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯২ সালে চারুশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ ‘চারুশিল্পী সংসদ’ পুরস্কারে ভূষিত হন ৷ ১৯৯৯ সালে শিশু শিল্পকলা কেন্দ্র কিডস কালচারাল ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম কর্তৃক ‘কিডস সম্মাননা পদক-১৯৯৯’ এ ভূষিত হন ৷ ২০০২ সালে চারুকলা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী কতৃর্ক ‘ঋষিজ পদক-২০০২’ ভূষিত হন ৷ এছাড়া তিনি আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ১৯৩৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর এক শিল্পী পরিবারে মুস্তাফা মনোয়ারের জন্ম।

বাবা: কবি গোলাম মোস্তফা।

মা: মার নাম জমিলা খাতুন। তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাঁর মা মারা যায়।

ভাই-বোন: তাঁরা ছয় ভাই-বোন। মুস্তাফা মনোয়ার ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট।

পড়াশুনা:মুস্তাফা মনোয়ার প্রথম ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি কলকাতায় গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন সায়েন্সে। কিন্তু সেখানে তিনি পড়াশুনা না করে কলকাতা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে কলকাতা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্টসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন মুস্তাফা মনোয়ার।

বিয়ে ও পরিবার: ১৯৬৫ সালে মেরী মনোয়ারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মুস্তাফা মনোয়ার। পারিবারিক উদ্যোগে তাঁরা বিয়ে করেছেন । মেরী মনোয়ার তখন পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়া ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সট বুক বোর্ডে কাজ করেছেন। বেশ কিছুদিন ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবেও কর্মরত ছিলেন মেরী মনোয়ার। এছাড়া ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে সাদাত মনোয়ার বাংলাদেশ বিমানের পাইলট, আর মেয়ে নন্দিনী মনোয়ার চাকুরীজীবি।

কর্মজীবন: মুস্তাফা মনোয়ার কর্মজীবন শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে । এরপর একে একে কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপমহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা’র জেনারেল ম্যানেজার এবং এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ৷ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন জাপান ব্রডকাষ্টিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, এন এইচ কে শিক্ষামূলক টিভি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা কোর্সে; বিবিসি লন্ডন, যুক্তরাজ্য, টেলিভিশন প্রযোজনা কৌশলে এবং এন এইচ কে, জাপান, উর্দ্ধতন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কোর্সে ৷ বিভিন্ন সময়ে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালে বিটিভি থেকে প্রচারিত শিশু প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে জনপ্রিয় ‘নতুন কুঁড়ির’ রূপকার তিনি। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হয়েছেন ।

লেখক : সাইমন জাকারিয়া