শৈলী বাহক

শেষ বিকেলের চিঠি

শেষ বিকেলের চিঠি
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পড়ন্ত বিকেল।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের সাদা মেঘ দেখছি।কোনো হাওয়া নেই।চারদিকে থমথমে হয়ে রয়েছে।মেঘগুলোও ভাসছে না;এক জায়গায়ই স্থির রয়েছে।গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।ঝড় আসার পূর্বাভাস তবে দিনের শেষ বিকেলটা আমি ভালোই উপভোগ করি।কেন জানি ভালো লাগে।নাসুরও ভালো লাগত।দুজনে মিলে পুকুরে মাছ ধরতাম বর্শি দিয়ে।নাসু বলত এসময় নাকি মাছ ভালো পাওয়া যায়। নদীর পানিতে হালকা ঢেউ দেখলে নাকি বোঝা যায় ওখানে মাছ নড়ছে।যদিও এখনো জানি না ওর কথা ঠিক ছিল না ভূল।তবে আমার এই বিকেল ভালো লাগে অন্য এক কারণে।মানুষের জীবনের সাথে এসময়ের মিল খুঁজে পাই।বিকেলের শেষে যেমন সবাই যার যার ঘরে ফেরে,তেমনই মানুষকেও তার জীবনের শেষ বিকেলে ফিরে যেতে হয় আপন নীড়ে।হঠাৎ একটা প্লেট পড়ার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম।আবার হুলো বিড়ালটা ঘরে ঢুকেছে।আমার হাঁটার শব্দ শুনেই জানালা দিয়ে পালালো ব্যাটা।প্লেটটা তুলে রেখে টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে পরলাম।তারপর টেবিলে বসে একটা খাতা আর কলম নিয়ে লেখা শুরু করলাম।

” প্রিয় নাসু,খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে কেমন আছিস।জানি না উত্তর পাব কিনা।সবসময়ই চাই তুই যেখানেই থাকিস,ভালো থাকিস।মনে আছে তোর নাসু?এইতো সেদিন, জমির ব্যাপারীর আমবাগানে আম চুরি করার কথা?আমি গাছে উঠেছিলাম আর তোকে বলেছিলাম কেউ আসলে বলতে।বাগানের দেখাশোনা করা রূঢ়ভাষী কাকা চলে আসলে তুই তাড়াতাড়ি নামতে বলেছিলি।কিন্তু আমি ছিলাম অনেক ওপরে।নামতে দেরী হবে বলে ধরা পরে যাবি জেনেও আমায় ফেলে যাসনি তুই।দুজনেই মার খেয়েছিলাম সেদিন খুব।সদ্য কাটা কঞ্চির বাড়ি।পশ্চাৎদেশ হয়ত রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল সেদিন।তারপর বাড়ি ফেরার পথে তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চলে গেলি না কেন আগেভাগে।

তুই বলেছিলি-” বন্ধু বন্ধুত্বের জন্য,আর বন্ধুত্ব বন্ধুরই জন্য। সেই বন্ধুকে ফেলে চলে গিয়ে বন্ধুত্বকে অপমান করব?” তারপর দুজন গলাগলি ধরে বাড়ি ফিরলাম।কতদিন হলো বলতে পারবি?কত আর দিন হবে?বড়জোড় দিন তিন-চারেক হবে।না না।কয়েকমাস।নাকি, কয়েক বছর?হ্যা।ষাটটা বছর।”দরজায় খটখটানির আওয়াজ হলো।এতটুকু লিখে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।দেখি পাশের বাড়ির পিচ্চি শয়তানটা।নীরব।এসেই একটা চোরের মত হাসি দিয়ে বলল,”আজকেও বলটা তোমার বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে দাদু।” আমি বললাম-“যা তাড়াতাড়ি গিয়ে নিয়ে আয়।বেশি বকবক করলে আর নিতে দেব না কিন্তু।”নীরব দৌড়ে গিয়ে বলটা নিয়ে আসল।ছেলেটা খুবই ছটফট করে সবসময়।মাঝেমাঝে মনে হয় ওর নাম নীরব না হয়ে সরব হলে ভালো হত।বল নিয়ে যাওয়ার সময় একটু থেমে বলল-“দাদু ওই ছবিটা কাদের?

কোনোদিন তো দেখিনি এখানে।শুধু তোমার ঘরের ছবিতেই দেখি।”আমি বললাম-“ওরা কেউ না।তুই যা ভাগ এখান থেকে।” নীরব এক দৌড়ে চলে গেল।আমি এক তপ্তশ্বাস ফেললাম।একটু আগে পিচ্চিটা যে ছবির কথা বলল ওটা আমার তিন ছেলের ছবি।তিনজনই বিদেশে ভালো চাকরি করে।স্কলারশিপ পেয়ে সেই যে গেল।তারপর ওখানেই সেটেলড।গিন্নি মারা যাওয়ার সময় একবার শুধু এসেছিল।এই বাড়িতে এখন আমি একাই থাকি।সারাজীবন এত কষ্ট করে ছেলেদের  উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে কি পেলাম?এই বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা।মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নেয়।মনে হয় কথা না বলি।কিন্তু নাতি-নাতনিদের সাথে যে কথা বলতেই হয়।তাই আর রাগ করে থাকতে পারি না।সময় কাটানোর জন্য পুরনো বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখি।

এই যেমন আজ লিখতে বসেছি নাসুর কাছে।নাসু আমার ছোটবেলার বন্ধু,নাসের।শুধু বন্ধু বললে ভূল হবে;বলা যায় ভাই।ও আগে বলত,”নুহাশ রে,আমরা বুড়ো হলে দেখিস কেউ থাকবে না পাশে।একসময় খুবই একা লাগবে।কারো সঙ্গ পাওয়ার জন্য চৈত্রের শুকনো ফাঁটা মাটির মত বুক তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবে।হাহাকার জাগবে।তখন তুই আর আমি আবার গ্রামে ফিরে আসব।নদীর পাশে যে বটগাছটা, সেখানে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে থাকবো দুজন।আর সেদিন আমাদের জমানো সব কথা চিঠিতে লিখে একে অপরকে পড়তে দেব। ” ওর কথাগুলো কিশোরমনের নিছক বলা কথা হলেও পরে বুঝেছি কতটুকু খাঁটি। সেইদিনটা এসে গেছে।তাই আমিও চিঠি লিখতে বসেছি আজ।তবে বয়স বাড়ায় লেখার গতিটা প্রায় কচ্ছপের মতই ধীর।”পেরিয়ে গেছে ষাটটা বছর।

মনে হচ্ছে এইতো সেদিন,দুজনে মিলে এত খুনসুটি, এত খেলাধুলা করলাম।অথচ লোকে বলে বুড়ো হলে নাকি স্মৃতিভ্রম হয়।আমার কিন্তু হয় নি।এইযে, বাল্যকালে তোর সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার স্মৃতির পাতায় এখনো নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে।মনে আছে তোর বলা প্রত্যেকটি কথা।তাহলে কি আমি বুড়ো হই নি? হাহাহা।একটু রসিকতা করলাম।যদিও আমি জানি তুই হলে এখানে হাসতি না।আমি অতো ভালো কৌতুকও বলতে পারি না,যেমন করে তুই সবাইকে হাসিয়ে ছাড়তি।সময় সত্যিই খুব দ্রুত চলে যায়।আমার তোর কাছে বলার মত জমানো কথা তেমন নেই।যেদিন থেকে দুজন দুজনকে ছেড়ে পড়াশোনা, চাকরি বাকরিতে মনোযোগ দিয়েছি,সেদিন থেকে কোনো দিনকেই আর দিন মনে হয় নি।নিজেকে মনে হয়েছে কাজের মেশিন।

তাই আর তোকে বলার মত তেমন কিছু ঘটেও নি। বিশ্বাস কর,আজও আমি চোখ বুজলে গ্রামের সেই স্মৃতিগুলোই ভেসে ওঠে।মাঝখানের স্মৃতিগুলো যে কিভাবে মুছে গেল,নাকি মূল্যহীন হয়ে স্মৃতির বাক্সের কোণায় পড়ে আছে তাও বুঝি না।আমি শুধু বুঝি,আমি মুক্তি চাই এই বাঁধাধরা পৃথিবী থেকে।তোর সাথে সেই আগের মতন খড়কুটোর বল দিয়ে খেলতে চাই,বর্শি দিয়ে মাছ ধরতে চাই,গুলটি দিয়ে পাখি শিকার করতে চাই, নদীতে উল্টো সাঁতারের প্রতিযোগিতা করতে চাই,নৌকা নিয়ে ভেসে যেতে চাই পানির দেশে।নদীতে গোসলের সময় কাঁদা ছোড়াছুড়ি,ফড়িং ধরা,ব্যাপারী চাচার আমবাগানের আমচুরি,ক্ষেত থেকে শসা চুরি-এসবই আবার করতে চাই।আর হ্যা, জ্যোৎস্নারাতে খড়ের পালায় দুজন পাশাপাশি শুয়ে তাঁরা গুণতে খুব করে চাই।জানি তখন তাঁরা আসলে কি সেটার কোনো জ্ঞান ছিল না।কিন্তু তবু এক বিস্ময়কর বস্তু হিসেবে আমাদের খুব প্রিয় ছিল।পড়াশোনার পর জানতে পারলাম সেগুলো আসলে মহাজাগতিক গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জ,আছে আমাদের চেয়ে অনেক দূরে।আচ্ছা নাসু, তোর মনে আছে, আকাশে মিটমিট করা তারা নিয়ে আমরা ঝগড়া করতাম?আমি বলতাম,তারারটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, তুই বলতি তোর দিকে তাকিয়ে হাসছে।সত্যি, ছেলেবেলার কিছু কথা থাকে যেগুলো বড় হলে হাস্যকর লাগলেও হৃদয়ের গভীরে দাগ কাটার ক্ষমতা রাখে।ইশ, আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে হয় দিনগুলোকে খুব করে।   

“যে দিন আসিয়াছি ফেলিয়া,     সেই অতীতের সোনার দিনগুলোই আবার চাই ফিরিয়া।     কিন্তু হায়!পৃষ্ঠা ছেড়া হইয়া গেলে নাহি লাগানো যায় জোড়া।     

তবু পাইবার আশ্বাসই মোরে যে রাখে বাঁচাইয়া। “ইতিতোর নুহাশ “চিঠিটা খামে পুরে রেখে দিলাম।তারপর অতি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য কিছু জিনিস একটা ব্যাগে তুলে রাখলাম। কাল সকালে ট্রেন।আমার তর আর সইছে না।কখন যে রওনা দিব, যাব সেই চিরচেনা ভালোবাসার প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যায় অন্ধকার হতে না হতেই ঝড়ো হাওয়া কোথা থেকে ছুটে এল।কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো।জানালা লাগিয়ে দিলাম।জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটায় আবছা হয়ে এসেছে।এখানে তো বৃষ্টির কাঁচ ভেজানোটুকুই টের পাওয়া যায়। শব্দ পাওয়া যায় না।আগে গ্রামে যখন বৃষ্টি হত, টিনের চালে ঝমঝম শব্দ পাওয়া যেত।বৃষ্টির অনুভূতি পাওয়া যেত।আমি আর নাসু আম কুড়াতে যেতাম, বৃষ্টিতে ভিজতাম,খেলতাম- এসব ভাবতেই জানালার কাঁচের মত আমার চোখও আবছা হয়ে এল।চোখটা চশমার ফাঁক দিয়ে মুছে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।আজ খেতেও ইচ্ছে করছে না।গিন্নি থাকলে আগে কোনো না কোনোভাবে খাইয়ে ছাড়ত।এখন সেও নেই।আমি যা ইচ্ছা করতে পারি।কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করতেই রাজ্যের ঘুম চলে এল চোখে।আমিও তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।সকালে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াতেই চারদিকে ঝড়ের বিধ্বংসী রুপ দেখতে পেলাম।

চারপাশের গাছগুলোর কোনো কোনোটা উপড়ে গেছে,কোনোটার ডাল ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।একটু নাস্তা পানি মুখে দিয়েই তৈরী হয়ে নিলাম সেই চিরচেনা সবুজের মাঝে রওনা হওয়ার জন্য।সকাল সাড়ে নয়টায় ট্রেন।গ্রামে পৌছাতে বেশ কয়েকঘন্টা লাগবে।পৌছুতে পৌছুতে প্রায় বিকেল হয়ে আসবে।ট্রেনে উঠে আমার সিটে গিয়ে বসে পড়লাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝকঝক শব্দ করে ট্রেন চলা শুরু হল।দুলতে দুলতে রওনা হলাম।জানালার পাশের সিট আমার বরাবরই ভালো লাগে।গাছপালা, বাড়িঘর সব পেছনে চলে যাচ্ছে, ঠিক যেমনভাবে আমার অতীত,আমার সঙ্গীরা আমায় ছেড়ে গেছে।সামনের সিটে বসা কয়েকজন তরুণ তরুণীর মধ্যে গিটার হাতে ছেলেটা গান ধরল-” পুরানো সেই দিনের কথা ভূলবি কিরে, হায় ও সে চোখের দেখা প্রাণের কথা-সে কি ভোলা যায় “আমার অনেক প্রিয় একটা গান।আমি রবীন্দ্রনাথের তেমন ভক্ত না হলেও এই গানটা আমায় খুব টানে।একদম নিরস বাস্তবতা আর হৃদয় দিয়ে স্মৃতিচারণে ঘেরা।গানটা শুনতে শুনতে হারিয়ে গেলাম পুরানো সেই দিনেতে।সেই গায়ের মেঠোপথ ধরে হাঁটা, নদীর স্নিগ্ধ পানিতে গোসল আর কাঁদা ছোড়াছুড়ি;এক ডুব দিয়ে কে কতদূর যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা, বর্ষার দিনে নৌকায় করে বিলের ভেতর শাপলা তোলা,ফড়িং ধরে বোতলে আটকে রাখা,শীতের সকালে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহানো, মায়ের হাতের পিঠা।আহা! মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখে পানি এসে গেল।কতদিন দেখি না মাকে।মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আজ ২০-৩০ বছর গ্রামেই যাই না।ছেলেবেলায় বাবার সাথে হাটে গেলে বাবা কত কি না কিনে দিতেন।তখন মাথার ওপর একটা ছায়া ছিল।এখন নেই। ভাবলেই চোখের পানি আর থামতে চায় না।ইশ!কত তাড়াতাড়ি সময় চলে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে ট্রেন থামার শব্দে হুশ ফিরল।পৌঁছে গেছি।যাত্রীরা সবাই নামছে।আমিও তাদের ভিড়ের মাঝেই নেমে গেলাম।এখান থেকে কয়েক মিনিট হাটলে আমার গ্রাম।গাড়িও যায় অবশ্য।একটা ভ্যান ঠিক করতে হবে।-“এই বাবা যাবে?”-“কনে যাবেন চাচা?”আহ!আবার কতদিন পর সেই গ্রামের ভাষা শুনলাম।-“ঝুমঝুমপুর গ্রামে।”-“হ যাইব।উঠেন।”উঠে গেলাম।ভ্যান চলতে শুরু করল।-“কার বাড়ি যাইবেন চাচা?”-“অ্যাহ?কার বাড়ি?” সত্যিই তো।আমি যাচ্ছি কার বাড়ি?২০-৩০ বছর আসি না গ্রামে।বাবার ভিটাও মনে হয় এতবছরে দখল হয়ে গেছে।তারপর মনে হলো আমি তো কারো বাড়ি যাচ্ছি না।আমি তো যাচ্ছি নাসুর সাথে দেখা করতে,নদীর পাড়ে।-“কি অইলো চাচা?চুপ কইরা রইলেন যে?”-“আমি যাচ্ছি আমার আপন নীড়ে।কেন?”-“না আপনারে কুনোদিন দেহি নাই তো তাই কারো বাড়ি যাইতেছেন?”-“ওইযে বললাম। আপন নীড়ে।”ছেলেটা আর কিছু বলল না।হয়ত আমার কথার মানে খুঁজছে।-“আচ্ছা তোমার বয়স কত বাবা?”

-“বাইশ-তেইশ হইব চাচা।ক্যান?”-“না এমনি।জানতে ইচ্ছে হলো।”বাইশ-তেইশ বছর?তারমানে তার জন্মের আগেই আমি এ গ্রাম ছেড়েছি।সে আমায় দেখবে কি করে?গ্রামে পৌঁছে গেলে আমায় নামিয়ে দিল সে।ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে আমিও চলা শুরু করলাম।আজ কতবছর পর আবার গ্রামে আসলাম। পাল্টে গেছে গ্রামটা।শহর শহর ভাব এসে গেছে।রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা দালান বাড়ি হয়েছে। রাস্তা চিনতেও কষ্ট হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, নদীর ধারের সেই গাছটা এখনো আছে তো?নাকি কেটে ফেলেছে?গ্রামের পথ ধরে হাঁটছি আর গ্রামের সেই চিরচেনা সোঁদা গন্ধ নিচ্ছি।গোবরের গন্ধ, বিভিন্ন গাছের পাতা,ফুলের গন্ধ, ডোবার গন্ধ -এসবই যেন আমার নিজের সাথেই নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে নতুন করে।গ্রামের রাস্তায় কত নতুন মুখ।চেনামুখ একটাও পেলাম না।ছোট ছেলেপেলেরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে অচেনা বলে।বাড়িগুলোও একেক জায়গায়।চিনতে পারলাম না।কিছুদূর হাটতেই নদীর ধারের সেই গাছটার দেখা পেলাম।স্বস্তি পেলাম।আছে তাহলে।গ্রামের অন্যসবকিছুর পরিবর্তন হলেও এই জায়গাটা আগের মতই আছে।না না।গাছটাও আমার মত একটু বুড়ো হয়েছে।কাছে গিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই গাছের সাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।গাছের নিচে বসলাম।হঠাৎ মনে হলো, এই যা, চিঠির খামে তো ঠিকানা লেখা হয় নি।নাসু তো সবসময় সবকিছু সম্পূর্ণ চাইত।তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে চিঠিটা আর একটা কলম বের করলাম।প্রেরকের ঠিকানা লিখে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে গিয়ে হাত থেমে গেল।কি ঠিকানা লিখব এখানে? মৃত্যুর দেশের কোনো নাম আছে কি? নাকি সেখানে কোনো ডাকব্যবস্থা আছে?নাসু যে আমায় ছেড়ে সেই কত বছর আগে চলে গেছে না ফেরার দেশে।হ্যাঁ।আমরা যেদিন উচ্চ মাধ্যমিক শেষে শহরে কলেজে ভর্তি হতে আসব সেইদিনই ও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।নিয়তি আমাদের জীবনের মত আলাদা করে দিল সেদিন।অনেকদিন ওর শোকে ঠিকমত কিছু করতে পারতাম না।

তারপর একদিন মনে হলো এভাবে থাকলে তো আমার স্মৃতিতেও মরে যাবে।ও তো মরেনি।আমার মধ্যে চিরদিন বেঁচে থাকবে।ও নেই তো কি হয়েছে? আমাদের কাজগুলো আমি করব।আমরা সাময়িকের জন্য আলাদা হয়েছি মাত্র।আবার পুনর্মিলন হবে জীবনের শেষে।খামটা নিয়ে গোরস্থানে গিয়ে ওর কবরের ওপর রেখে আসলাম।পাল্টে গেছে সব।অনেক খোঁজার পর পেয়েছি ওর কবরটা।ওর কবরের ওপর জন্মানো ফুল গাছটায় ফুল ফুটেছে, ঝলমল করছে পাতাগুলো, ফুলগুলো আরো রঙিন দেখাচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে নাসুও অধীর অপেক্ষায় ছিল আজকের দিনটার।বললাম-“হ্যা রে নাসু, আমি এসেছি। আমি কথা রেখেছি।”তারপর গিয়ে নদীর ধারের গাছটায় গিয়ে বসলাম।বিকেল হয়ে এসেছে।খুব ক্লান্ত লাগছে।সারাজীবনের সব দায়িত্ব শেষ আমার।নেই কোনো পিছুটান।অনেকটা হালকা লাগছে।চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।খুব ঘুম পাচ্ছে। নদীর পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। চোখ বন্ধ করতেই সব অন্ধকার হয়ে এল।একটু পরে আবার আলো ফুটে উঠল। দেখতে পেলাম নাসু এসেছে। হাত বাড়িয়ে আমায় ডাকছে।নিজের দিকে খেয়াল করে দেখলাম আমিও সেই আগের ছোট্ট নুহাশ হয়ে গেছি।চোখ ছলছল করে উঠল।

হাত বাড়িয়ে দিয়ে নাসুর হাতে হাত রাখলাম।তারপর ওর সাথে চলতে শুরু করলাম।এরপর কি ঘটল কিছুই মনে নেই। তাহলে কি আমার জীবনের গল্প এখানেই শেষ? এটাই আমার শেষ বিকেল?পরেরদিন সকালে -ঝুমঝুমপুর গ্রামে নদীর ধারের গাছটার নিচে অনেক মানুষের জটলা।একজন বৃদ্ধ মরে পরে আছে আর সবাই দেখছে।ভীড় ঠেলে এক ষাট বছরের বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এল।দূর থেকে চেনা চেনা লাগছিল।কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতেই তার চোখে পানি চলে এল।কান্নায় ফেটে পড়ল-“ওরে! এ যে আমার নুহাশ ভাই। সেই কতকাল আগে গেরাম ছাড়ছিল। এই মরার সময়ে গেরামে আসলি ভাই? আমার লগে একবার দেখা করলি না?” আর্তনাদ করতে লাগল।সবাই মিলে কবর দিল তাকে। কাকতালীয়ভাবে নাসেরের কবরের পাশেই নুহাশের কবর হলো। যেন দুই বন্ধু হাতে হাত রেখে পাশাপাশি কবরে শুয়ে নিজেদের যতকথা বলছে।এ যেন এক আত্মার টান।

নামঃ উর্মিলা ইসলাম সেতু  ঠিকানাঃ শালগাড়িয়া, গোলাপবাগ,পাবনা

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login