নীল নক্ষত্র

বিলাতের সাত সতের-৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

টেমস নদী

ফিরোজের বাসা থেকে টিউবে সেন্ট্রাল লাইনে এসে ইলিং ব্রড ওয়ে নেমে ডিস্ট্রিক্ট লাইনে এক্টন টাউন থেকে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে হিথ্রো ৪ নম্বর টার্মিনাল যেতে হবে। ইলিং ব্রড ওয়ে থেকে ডিস্ট্রিক্ট লাইনে উঠেছি, সামনে মাত্র একটা স্টেশন পরেই এক্টন টাউনে নেমে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে উঠার কথা কিন্তু অন্যমনস্ক ছিলাম বলে কখন এক্টন টাউন ফেলে টোটেনহেম গ্রীনে চলে গেছি তা আর খেয়াল করিনি। স্টেশনের নাম দেখে হঠাৎ খেয়াল হোল কি ব্যাপার এখানে এলাম কি করে?তারা তারি নেমে আবার নিচের আর এক প্ল্যাটফর্মে যেয়ে পিকাডেলি লাইনের অপেক্ষা করছি এমনিই সময় কম, মন অস্থির তারপর আবার উলটো পথে এসে সময় আরো কমিয়ে দিলাম। নিজেই নিজেকে কিছু ক্ষন বকলাম। কি, হয়েছে কি তোমার, এ আবার কোন ধরনের ভুল?তোমার মত সাবধানি মানুষের এমন ভুল হলে কি মানায়?আরে বাবা ভুল কি এমনি এমনি করেছি নাকি হঠাৎ হয়ে গেছে, খুকুর কথা ভাবছি বলেই না হয় মন একটু উতলা হয়ে একটু ভুল করেই ফেলেছি তাই বলে কি এমন গালাগালি করবে না কি?পরের যে স্টেশনে থেমেছে জানালা দিয়ে সে স্টেশনের নাম আর ট্রেনের জানালার উপরে তার চলা পথের ম্যাপ থাকে তা মিলিয়ে আরো নিশ্চিত হয়ে নিলাম। এবার আর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।

কেন যেন মনে হচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে চলছে। আরো একটু স্পিড বাড়ালে কি এমন ক্ষতি হয়?এত আস্তে গেলে কখন পৌঁছাব কে জানে। পথ একে বারে কম না। এখান থেকে ১১টা স্টেশন। সময় মত যেতে পারব তো? ঘড়িতে দেখি তিনটার বেশি বাজে। খুকু বের হবার আগেই পৌঁছা দরকার ও যেন বের হয়েই আমাকে পায়। না পেলেও ক্ষতি নেই অন্তত চাচা চাচীকে পাবে।
ওরা একটা ফোনও করলো না, আমার সাথে আলাপ করেনি বলে আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি। সেই পিটারবোরো থেকে আসছিস ভাল কথা, তা আমাকে একটু জানাবি না?যাক আসবি যখন ভালই হবে অনেক দিন আমিও দেখি না অন্তত এই সুযোগে একটু দেখা হবে। তবুও মন মানছিল না। মনে হচ্ছিল ও যেন বের হবার আগেই আমি দেখতে পাই আমার খুকু আসছে।

চার নম্বর টার্মিনালে কোন দিন যেতে হয়নি বলে এখানে যাত্রীরা কোথা দিয়ে বের হয় জানি না যদিও গেলেই দেখে নিতে পারব। তবুও মনে হচ্ছিল দেরি হয়ে যায় নাকি। এই সব ভাবতে ভাবতে ট্রেন হান্সলো ইস্টে এসে পরেছে। ঘড়িতে দেখি সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। মনে মনে যা ভাবছি তাই বুঝি হয়। ঠিক পৌনে চারটায় যেখান দিয়ে যাত্রীরা বের হয় সেখানে এসে একটু দূর থেকে দেখি যা ভেবেছি তাই খুকু দাঁড়িয়ে চাচার সাথে কথা বলছে পাশে হাফিজের মেয়ে। আমাকে দেখেই এক দৌড়ে এসে হঠাত্ করে এ পাশে জমে থাকা কোন বাধ ভেঙ্গে গেলে জল ধারা যেমন প্রবল বেগে ছুটে যায় তেমনি করে বুকে আছড়ে পরলো। কত দিনের জমে থাকা পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত খুকু শুধু আব্বু বলে বুকে মাথা রেখে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মনে হচ্ছিল যেন ওর বাবাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে আর তাই বাবাকে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে। কোন কথা বলতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম কখন এসেছ?কোন জবাব নেই। সাহারার বুকে অজস্র ধারা বইলে যেমন সম্স্ত পানি শুষে নেয় তেমনি ঘড়ির কাটার হিসেবে আমি নিজেও জানি না এ ভাবে কত ক্ষন কেটে গেছে। হাফিজ এসে যখন বলল চলেন গাড়িতে উঠি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি চোখে স্রোত বইছে। গায়ের জ্যাকেটের হাতায় চোখ মুছে আমার খুকুর মাথাটা টেনে ভেজা কণ্ঠে বললাম চল আব্বু। পাশে দেখি হাফিজের বউ এক কাপ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুকু চাচীর হাত থেকে কাপটা নিয়ে আমার হাতে দিল। বলল নাও, তুমি আসার আগে আমরা খেয়েছি।

হাফিজকে জিজ্ঞেস করলাম তোরা কখন এসেছিস?
প্রায় ঘন্টা খানিক হবে, আপনাকে কয়েক বার ফোন করলাম কিন্তু ‘আউট অফ রিচ’ রিপ্লাই পেয়ে বুঝলাম আপনি হয়ত টিউবে রয়েছেন। আমরা আসার আধা ঘন্টা পরেই ও বের হয়েছে।
তোরা আসবি আমাকে একটু বলবি না?এ খবর জানলাম ঢাকা থেকে। আমি আরো আগে আসতে পারতাম বলে উলটো পথে যাবার কাহিনী বললাম।
এ নিয়ে একটু হাসা হাসি হোল।
হাফিজ বলল গত রাতে ওরা যখন বের হয় তখন আমি ঢাকায় ফোন করে ভাবিকে বলেছিলাম।
বেশ করেছিস, তা ও এসেছে তা জানিয়েছিস?
হ্যা এইতো, আপনি আসার একটু আগে জানিয়েছি।
চল, গাড়ি কোথায়?
পার্কিং এ রেখে এসেছি।
ওরা আগেই সব মালামাল একটা ট্রলিতে উঠিয়ে রেখেছিল। সেটা নিয়ে বাইরে এলাম। হাফিজ আমাদের দাড়াতে বলে গাড়ি আনতে গেল।

হাফিজরা বরাবরই লন্ডনের বাইরে থেকেছে বলে লন্ডনের পথ ঘাট খুব একটা ভাল চিনে না বলে প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল স্টেপনি গ্রীনে পৌছাতে। গাড়িতে থাকতেই ফিরোজের স্ত্রী ফোন করে জেনে নিল মেয়ে পৌচেছে কি না। আমি আবার খুকুর মাকে ফোন করলাম, আরিফের বৌকে ফোনে জানালাম।
বাসায় পৌছে হাফিজরা নেমে একটু বসল এই ফাকে খুকু ওর মা ওর সাথে আচার, মোরব্বা বানিয়ে দিয়েছিল ওগুলি বের করে কিছু দিয়ে দিল। বেশি ক্ষন বসল না। আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে বলে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল যেন ক্লাশ শুরু হবার আগেই ওদের ওখানে গিয়ে ঘুরে আসে।
ওরা বের হয়ে যাবার পর খুকু বলল আব্বু গোসল করব।
আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর দেখি আগে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করে নাও। দেখলাম ওর চেয়ে একটু বড় এক মেয়ে আছে এ বাড়িতে সকালে যখন এসেছিলাম তখন কাজে গিয়েছিল বলে দেখিনি। নাম সুমি, লাল মাটিয়া কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে আবার ছায়া নট থেকে নজরুল সঙ্গীত শিখেছে। খুকুও লাল মাটিয়া এবং ঢাকা সিটি কলেজের ও ছায়ানটের নজরুল সঙ্গীতের ছাত্রী জেনে বেশ আন্তরিকতার সাথেই গ্রহন করে নিল। আমিও বললাম যাক ভালই হোল তুমি এক সাথে মুরুব্বি এবং সাথী দুইই পেলে। সুমি ওকে নিয়ে বাড়ির সব কিছু দেখিয়ে দিল।

গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে এসে ঘরটা একটু গুছিয়ে বিছানা পত্র বিছিয়ে বসা মাত্রই আরিফ এলো ওর বউকে নিয়ে। কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে কাল ওদের বাসা চিনিয়ে দেবার কথা বলে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পরেই খুকু শুয়ে পরল আমি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর বাড়ির কথা আলাপ করছি। দেখি ওর কথা জড়িয়ে আসছে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বুঝলাম জার্ণির ক্লান্তিতে আর পারছে না কখন যেন ঘুমিয়ে পরেছে আর আমি কথা বলেই যাচ্ছি। হঠাত দেখি ওর কোন জবাব নেই, ওমা ও দেখি ঘুমিয়ে পরেছে। যাক এদিকে রাত হয়ে গেছে আমিও প্রায় সারা রাত জেগে এসেছি বলে শুয়ে পরলাম।

সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করে এলাম। খুকু তখন অঘোরে ঘুম। ওর ঘুমের ভাব দেখে আর ডাকতে ইচ্ছা হোল না, পাশে বসে রইলাম। দশটায় একবার ডাকলাম, না কোন সারা নেই। বারোটা বেজে যায় তখন গভীর ঘুম। না এখন আর না ডাকলে চলছে না। ডেকে তুললাম। না আব্বু আমি আরো ঘুমাব। ওঠ এখন বেশি ঘুমালে রাতে ঘুম হবে না তখন আরো খারাপ লাগবে বলে টেনে টুনে উঠিয়ে দিলাম। কিছু খেয়ে নাও তারপর চল তোমার আরিফ কাকু আর ফিরোজ কাকুর বাসা চিনে আসি। আমি কিন্তু শুধু আগামী পরশু পর্যন্ত আছি পরশু রাতেই চলে যাব। যা করার এর মধ্যেই সব দেখে চিনে নাও। খুকু চমকে উঠল, কেন আব্বু, তুমি আর কদিন থাকবে না?না বাবা উপায় নেই। আর কদিন থাকলেই বা কি সর্বক্ষণ তো আর থাকতে পারবো না, তোমাকে একাই থাকতে হবে। শুনেই ওর মুখ অন্ধকার কাল হয়ে গেল। প্রবোধ দিলাম, তবুও তোমার ভাগ্য ভাল তোমার বাবা, চাচা চাচী সব আছে তারপর আরিফ, ফিরোজ কাকু এরা আছে আবার এ বাসার সুমিকে পেয়েছ। বাবার সাথে লন্ডনের অনেক কিছু দেখে চিনে নিতে পারছ। কলেজে গেলে হয় তো দেখবে তোমার স্কুল কলেজের কোন বান্ধবীকে ও পেয়ে যেতে পার। অন্য যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখবে কয় জনকে তাদের বাবা চাচা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করেছে।

দুপুর দুইটার দিকে বের হয়ে বাসার পাশের ওই কুইন্স মেরি ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে এসে মাইল এন্ড থেকে ফিরোজের বাসায় এলাম। টিউবে টিকেট করা, টিউব ম্যাপ দেখে জায়গা খুঁজে বের করা, কোন ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে সেটা খুঁজে বের করা সব দেখিয়ে দিলাম। ফিরোজ ওকে আগে ঢাকায় দেখেছে কিন্তু ওর স্ত্রী ওকে আগে দেখেনি। সালাম করল। একটু পরে ফিরোজ এলো।
কি শারমিন লন্ডন কেমন লাগছে?
না চাচা এখনো বুঝতে পারছি না।
বুঝবে কি ভাবে, ও তো কাল সন্ধ্যায় এসে পৌচেছে ততক্ষণ বাবা, চাচা চাচীর সাথে ছিল, তার পর যে ঘুম, এই তোমাদের এখানে আসার আগে ঘুম থেকে টেনে তুলে এনেছি।
ফিরোজের সাথে কথা বলার সময় ভাবী চা নাস্তা নিয়ে এলো। ভাবী রাতে খেয়ে যাবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করল।

বুঝিয়ে বললাম, ভাবী, এসেছে যখন এখন অনেক সময় পাবে, ছোট খাট ছুটি ছাটায় এখানে এসে ২/১ দিন থেকে যাবে তখন অনেক খাবার সময় পাবে। এখানে আপনাদের কাছেই থাকবে, আমি থাকব কত দূরে, কখন কি হয় না হয় আপনারাই দেখবেন। তার চেয়ে এখন আমি যতটা পারি চিনিয়ে দিয়ে যাই। কাল কলেজে নিয়ে যাব। ওদিকে আবার কাল রাতে আরিফরা এসেছিল ওর বৌ বলে গেছে আজ রাতে ওদের ওখানে খেতে।
ঠিক আছে তা হলে, তুমি যখন যে কোন অসুবিধায় পর সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বলবে আমি বা তোমার চাচা গিয়ে নিয়ে আসব, কোন চিন্তা কোর না। বাবা মা কি আর সব সময় কাছে থাকতে পারে?তুমি এখন বড় হয়েছ, আর তা ছাড়া তোমার বাবা থাকে কত দূরে, সে তো আর সব সময় আসতে পারবে না। তোমার চাচাও কাছে থাকে না। তুমি আমার সাথে যোগা যোগ রেখ।
আচ্ছা চাচী।

ভাবি দুই সেট জামা কাপড় এনে রেখেছিল তা বের করে দিল।
তা হলে ভাবী আজ উঠি।
এর পর সোজা আরিফের বাসায়। আরিফের বৌ অনেক কিছু রেঁধেছিল। খেয়ে দেয়ে কিছু ক্ষন গল্প সল্প করলাম। এখানেও আরিফ আরিফের বৌ একই রকম উপদেশ পরামর্শ দিল। রাত ১১টা বেজে গেল বাসায় ফিরতে। কাল কি করব সে প্ল্যান করে শুয়ে পরলাম।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


5 Responses to বিলাতের সাত সতের-৩

You must be logged in to post a comment Login