নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব] পর্ব-১১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

নিরু কিছু বলতে চেয়েছিল কি না তা নিশাত কোন দিন বুঝতে পারেনি। তবে নিরুর মনে নিশাত বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে এটা নিশাত বুঝতে পারে কিন্তু কত টুক তা বোঝার মত ক্ষমতা নিশাতের নেই। সে কথা বোঝার মত কোন গুরুর সন্ধান এখনো নিশাত পায়নি। নিরুও বুঝতে পারে নিশাত তার টানেই এ বাড়িতে আসে। কেউ কারো কাছে প্রকাশ হতে পারে না। নারীর লজ্জা ভূষণে পরিবেষ্টিত হয়ে নিরু কোন দিন কিছু বলতে পারে না। শুধু মনে মনে নিশাতকে দোষারোপ করে। এই তো আর কয়েক দিন পরেই চলে যাবে। আগের সেই চঞ্চলতা এখন নিরুর মধ্যে নেই, অনেক কমে গেছে। বাড়ির সব চেয়ে দুরন্ত মেয়ে এই নিরু হঠাৎ করে রাতারাতি নীরব নিস্তব্ধ যেন রাশভারী কোন মহিলা হয়ে গেছে। আগের সে হৈ চৈ নেই, দৌড়া দৌড়ী নেই, আগের সাথীদের এখন নিতান্ত ছেলে মানুষ বলে মনে হয়। আগের চেয়ে অনেক ধীর শান্ত হয়ে গেছে। তবুও হঠাৎ করেই সঙ্গীদের ছেড়ে আসতে পারে না। যারা কোন বিচার সালিশ নিয়ে আসে তাদের বিকেলের কোন সময় দিয়ে দেয়। সময় মত বিচার করে দিয়েই রান্না ঘরে মা চাচীর পাশে বসে থাকে, রান্নার যোগার এগিয়ে দেয়। বারেকের মাকে দিয়ে বাড়ির রাখাল সর্দার জয়নুলকে ডেকে এনে বাড়ির আশে পাশে সবজী লাগাবার নির্দেশ দেয়। বাবার মত কোন জমিতে কিসের চাষ করেছে তার খবর নেয়, কোন জমির নিড়ানি হচ্ছে, আজ কোন রাখাল কোথায় কি কাজ করছে সে খবর রাখে। জয়নুল মিয়া সিরাজ ভাইর এই মেঝ মেয়ের কাছে হিসেব দিতে পছন্দ করে। সিরাজ ভাই কিছু জিগ্যেস করলে বলে দেয় মেঝ মাকে বলে এসেছি, ও জানে। সিরাজ মাতব্বর অবাক হয় নিরু আবার এসব কবে থেকে শুরু করল। মনে মনে তার মায়ের কথা মনে করে স্বস্তি পায়, যাক মেয়েটা তা হলে দাদির মত হবে।

এক দিন নিশাত এসে দেখে যুঁই বা শিহাব ওরা কেউ নেই। শিহাবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় নিরু সামনে এসেই নিশাতকে দেখে থমকে গেল।

নিশাত অনেক সাহস করে বলে ফেলল তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।

কি কথা?

চল ঐ পুকুর পাড়ে যাই।

না এখানেই বলেন।

কেন, চল না ওখানে।

আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

কেন মাথা খারাপের কি হলো?

ওখানে কেউ দেখে ফেললে কি হবে জানেন?

কি হবে?

আপনি কি ছোট মানুষ কিছু বুঝেন না? এটা আপনাদের শহর না, এটা গ্রাম। এখানে সবাই সব কিছু মেনে নিতে পারে না।

, হ্যাঁ তা হতে পারে, কিন্তু এ যে কিছু একান্ত কথা যা এখানে বলা যায় না!

তা হলে চলেন ভিতরে চলেন।

হ্যাঁ তাই ভালো।

আগে নিরু শিহাবের ঘরের ভিতরে গেল, পিছনে নিশাত। নিশাত একটা চেয়ার টেনে বসল নিরু একটা খুটিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল।

এবার বলেন কি বলবেন।

আচ্ছা নিরু, তোমার মনে আছে, ওই যে তুমি বকুল ফুলের মালা গাঁথছিল আর আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।

কবে?

সে অনেক দিন আগে, ওই তোমাদের ঈদগাহের বকুলতলায়।

না, আমার কিছু মনে পরছে না। দাদু, যুঁই আপা, বড় আপা, মা এরা সবাই বলেছে আমি নাকি আপনাকে ছোট বেলায় দেখেছি কিন্তু ছোট বেলায় আপনাকে কোন দিন দেখেছি বলে আমার কিছুই মনে পরছে না। অনেক চেষ্টা করেছি খুঁজে পাইনি। হঠাৎ আজ এ কথা কেন?

না হঠাৎ না, সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তখন আমার মন বলছিল আমি যেন তোমাকে চিনি, আমার অনেক চেনা তুমি। কিন্তু কোথায় দেখেছিলাম তা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। বেশ কয়েক দিন ভাবার পর হঠাৎ করেই মনে এলো তোমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে যাবার পথে বকুল ফুলের গন্ধ পেয়ে কেন যেন একটু এগিয়ে গেলাম আর ওখানে তোমাকে দেখলাম তুমি কুড়ানো ফুলের মালা গাঁথছ। আমার মনে হয় তুমিই সেই, সময়ের হিসেব করে মিলিয়ে দেখি তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।

কি যে বলেন, কত জনে অমন মালা গাথে। আর কিছু দিন থাকলে দেখে যেতে পারতেন। যখন ফুল ফোটে কত জন এসে কুড়িয়ে নিয়ে যায়।

না নিরু, কত জন আর আমার মনে আঁকা ছবির মধ্যে অনেক ব্যবধান সে তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বল?

এ কথা শুনে নিরু এই বয়সেই যেন সেই সুদূরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কিসের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে দিয়ে ভবিষ্যৎ হেঁটে যাচ্ছে আর নিরু তাকিয়ে তাই দেখছে। নিশাতকে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা কি বলতে চায় কিছু বুঝতে পারে না।

আপনারা কবে যাবেন?

সামনের মঙ্গল বারে।

আবার কবে আসবেন?

কি জানি, আব্বা কবে ছুটি পায়।

আপনি কি এখানে থেকে পড়তে পারেন না? আপনার দাদি আছে তার কাছে থাকবেন।

আমি থাকলে কি তোমার ভালো লাগবে?

এবার আর নিরু জবাব দিতে পারলো না, লজ্জা এসে ঘিরে ধরল। মাথা নিচু হয়ে গেল, হাত দিয়ে অযথাই ওড়নার আঁচল আঙ্গুলে জড়াচ্ছে। নিরু যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। মনে মনে ভাবছে সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে?

দেখি আব্বা আম্মাকে বলে দেখি যদি উনারা রাজি হয়।

এমন সময় শিহাব এসে পড়ায় ওদের কথা ওখানেই থেমে গেল। ওই দিন বাড়িতে ফিরে রাতে খাবার পর নিশাত বাবাকে তার এখানে থেকে যাবার কথা বলতেই তা সাথে সাথে নাকচ হয়ে গেল। যাবার আগের দিন নিরুর সাথে দেখা করতে এলো। প্রথমে শিহাবের সাথে দেখা হলো। শিহাবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বলল

চল দাদি আর চাচীদের সাথে একটু দেখা করে যাই।

যা তুই যা আমি আসছি।

নিশাত ভিতর বাড়ি গিয়ে দাদিকে সামনে পেয়ে বলল দাদু আমরা কাল চলে যাচ্ছি।

আবার কবে আসবে?

জানি না, আব্বার ছুটি না হলে আসা হবে না,

আচ্ছা ঠিক আছে ভালো ভাবে থাকবে, মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।

চাচীরা কোথায়?

দেখ তো রান্না ঘরে না কি?

নিশাত এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় নিরু ওর ঘরে থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। নিশাত ডাকল

নিরু চাচীরা কোথায়?

সবাই রান্না ঘরে। আপনারা তাহলে কালই যাবেন?

হ্যাঁ নিরু, কালই যাচ্ছি, চল চাচীদের একটু বলে যাই।

আসেন। মা, নিশাত ভাই এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে, উনারা কাল চলে যাবে।

নিরুর চাচী রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে নিশাতকে ডাকল,

এই যে বাবা আমরা এখানে।

চাচী আমরা কাল যাচ্ছি।

আচ্ছা বাবা ভালো ভাবে থাকবে মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।

ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে নিরু জিগ্যেস করল

সত্যিই আপনারা কাল যাবেন?

হ্যাঁ নিরু, আমি যেগুলি দেখিয়ে গেলাম সেগুলি মন দিয়ে পড়বে, না বুঝলে যুঁইকে জিজ্ঞেস করবে। আচ্ছা যুঁই কোথায় ওকে দেখছি না।

আপা পুকুরে।

পুকুরে কি করে একটু ডাকবে ?আমি ওকে তোমার পড়া দেখার জন্য বলে যাব।

আপনি যান মেঝ ভাইয়ের কাছে বসুন আমি ডেকে আনছি।

একটু পরেই যুঁই এসে বলল কি রে নিশাত তোরা তা হলে কাল যাচ্ছিস?

হ্যাঁ তাই বলতে এলাম। শোন তুই কিন্তু নিরুর পড়াটা একটু দেখবি, ও তো ভাল ছাত্রী মনে হলো, তা তুই একটু দেখলেই ওর অনেক সাহায্য হবে। দেখবি।

হ্যাঁ তোর বৌকে তো দেখে রাখতেই হবে, আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। এই নিরু এখন থেকে আমার কাছে নিয়ম করে বসবি। একা পড়বি না, আমার সাথে বসবি। মনে থাকে যেন।

নিশাতের দিকে তাকিয়ে, দেখলি তোর সামনেই কেমন অর্ডার দিয়ে দিলাম?

 

এর পরের দিন নিশাতরা ওই অত টুক নিরুর মনে গভীর একটা দাগ দিয়ে চলে গেল। নিরুর মনে যে দাগ কেটে গেল, নিরুর মনের যে জানালা খুলে দিয়ে গেল সে আর কিছুতে বন্ধ হবার নয়। সে তো ভিন্ন জগতের অনুভূতি, ভিন্ন সে ধ্যান, ভিন্ন জ্যোতি, ভিন্ন আকুতি। এত দিন যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এ যে কি এমন এক ব্যথা, এমন এক যাতনা যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখান যায় না। নিজের বুকের ভিতর তুষের আগুনের মত জ্বলতেই থাকে। নিতান্ত চেপে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। শুধু চোখের জলেই যার সমাধান। আশা পথ চেয়ে দিন যায়, রাত আসে। এক দিন ফিরে আসবে সে আজ হোক বা কাল। ফিরে যে তাকে আসতেই হবে, এই এক সান্ত্বনা বুকের গভীরে পুষে রেখে নিরু নিজেকে নিশাতের জন্য প্রস্তুত করছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। নিরুর কাছে মনে হয় যেন একটা যুগ যাচ্ছে। ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা, যুঁইয়ের কাছে পড়া, সংসারের কিছু তদারকি এতেই দিন চলে যায়। ভাবে এমন হয় কেন, ও আমার কে? ওর জন্য এমন লাগে কেন? এক জন পুরুষ মানুষের প্রতি এমন টান কেন হয় কিছুতেই এর কোন জবাব খুঁজে পায় না। এই টান কোথা থেকে আসে, এই কি নিয়ম, যদি তাই হয় তা হলে ও কিছু বলে গেল না কেন? আবার ভাবে সেদিন তো বলেছেই আমি থাকলে তোমার ভালো লাগবে?”এর চেয়ে কি আরও একটু খুলে বলতে পারত না? না, আমিই তো ওকে নিয়ে গেলাম না ও তো পুকুর পাড়ে যেতে চেয়েছিল। ওখানে গেলে কি বলত? না কি আমি যা ভাবছি ও তেমন করে ভাবছে না। তাই বা কি করে হয়, যুঁই আপা যখন অমন করে বলত তখন এত লজ্জা কি জন্! এই নানা ধরনের বিচিত্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুর ঘুর করে কোন ফাঁকে যেন চোখ দুইটা বন্ধ করে দেয়।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর চলে গেল নিশাতদের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুর মনে যখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে তার ছোট্ট হৃদয়ের মাঝে নিশাতের জন্য একটা গভীর সাগর বানিয়ে ফেলেছে তখন দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। তারপর মুক্তি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন এক দিন সত্যিই নিশাতরা কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে এসে হাজির।

এক দিন সকালে নিরু বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য কুয়ায় মাত্র বালতি ফেলেছে এমন সময় সামনে তাকাতেই দূরে নিশাতদের বাড়ির ওদিক থেকে দুই পাশে ধান ক্ষেতের মাঝে বাধানো উঁচু রাস্তা দিয়ে শার্ট প্যান্ট পরা কে এক জনকে আসতে দেখে একটু থেমে গেল। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু! হ্যাঁ তাই তো, বুকটা কেপে উঠল। হ্যাঁ সেই, যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা, যার জন্য পথ চেয়ে কল্পনার জাল বুনে, দিন রাত যন্ত্রণা সয়ে এক উত্তাল সাগরের উন্মত্ত ঢেউ বুকে নিয়ে এতো গুলো দিন কেটেছে এ সেই। মানুষটা কেমন! একটা খবরও কি দিতে নেই? এমন কেন? আনমনা হয়ে কত কি এলো মেলো ভাবনা এসে জড়িয়ে গেল। হাত পা সব যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলো। বালতির রশি হাতেই ধরা রইল।

কি নিরু, কেমন আছ?

কণ্ঠ শুনে নিরুর ভাবনা থেমে গেল। বুকে এক অজানা কাঁপন অনুভব করল, গলা জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কি নিরু কথা বলছ না কেন?

কোন রকম একটু ঢোক গিলে বলল

কবে এলেন?

কই আমি যে বললাম, কেমন আছ তার কিছু বললে না?

হ্যাঁ ভালোই আছি, আপনি?

হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, প্রায় চেনাই যায় না।

নিরু এতো দিন যার পথ চেয়ে দিন রাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে, নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু যার জন্য তৈরি করেছে আজ এই তাকে এমন হঠাৎ দেখে হত বিহ্বল হয়ে গেছে। মনে মনে বলল আমি কেমন আছি সে তুমি বুঝ না? তোমার পথ চেয়ে আমার দিন গুলি কি ভাবে গেছে সে বোঝার শক্তি তোমার কবে হবে, না কি কোন দিন হবে না? একটু স্থির হয়ে বলল

যান, ওই যে বাড়ির পিছনে মেঝ ভাই বাঁশ কাটছে ওখানে যান।

আমি এসেই তোমাকে দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি। তোমাদের কি সৌভাগ্য কি সুন্দর পরিবেশে তোমরা থাক। তোমাদের এই কুয়ার পাড়টা কি সুন্দর, ও পাশে পুকুর পাড়ে ঝোপে পাখি ডাকছে, সামনে ধান ক্ষেতের বিশাল সবুজ প্রান্তরে বাতাসে ঢেউ তুলছে। আচ্ছা ওই যে ওটা কি পাখি?

নিরু নিশাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকিয়ে বলল ওটা মাছ রাঙ্গা।

কি চমৎকার পরিবেশে থাক তোমরা, চারি দিকে উঁচু নিচু ঝোপ ঝাঁর, তাতে নানা রঙের পাতা ফুল কত সুন্দর এ দেশ আর আমরা যেখানে থাকি শহরে সেখানে শুধু ইট লোহা কাঠ পাথরের দালান কোঠা আর তার সাথে মানুষের মনও তেমন হয়ে যায়!

এখানে আসার সময় তাই দেখলাম রাস্তার পাশে কি সুন্দর পানিতে ধানের ক্ষেত গুলি মনে হচ্ছে যেন ভাসছে। এই সবুজের মধ্যে থেকে থেকে তোমার মন কত সরল।

আমার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলেননি কি করে জানলেন আমার মন সরল, এ সব আপনার বানানো কথা।

না নিরু, আমি বানিয়ে কথা বলতে পারি না, যা সত্যি মনে হয় তাই বলি, বানানো কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না। এই যদি এখন বলি এ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগে তোমাকে, এটাও সত্যি এবং মোটেই বানানো নয়। তোমার দুরন্তপনা, তোমার চঞ্চলতা আর তোমার এই হাসি ভরা মুখটা আমি এক দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি, তা কি তুমি জান?

তাই যদি হবে তবে এতদিন পরে আসলেন কেন নাকি যুদ্ধ শুরু না হলে আর আসতেন না?

কি যে বল তুমি!

নিরুর চোখ কুয়োর নিচে একেবারে গহীনে পানির উপরে স্থির হয়ে আছে। ওর কানে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে। ও পাশে রাখালরা আসা যাওয়া করছে এদের মধ্যে যারা নিশাতকে চিনে তারা এসে একটু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কবে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথার জবাব দিচ্ছে। নিরুর কানে কে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে, এই টুকু শোনার জন্যই এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আমার সাধনা যেন পূর্ণ হতে চলেছে, আমার মনের কথা শুনতে পেয়েছে। নিরু ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে গেছে, তন্ময় হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের মনে হলো নিরু ওর কথা শুনছে না কি!

কি হলো তুমি আমার কথা শুনছ না?

লজ্জায় নিরুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। কোন রকম পিছনে ফিরে

ওই যে মা ডাকছে আমি যাই।

বলেই কুয়োয় বালতির রশি ছেড়ে এক দৌড়ে ভিতর বাড়ি। নিরুর যাবার পর নিশাতের মনে হলো তাইতো এটা গ্রাম, এভাবে একটা ছেলে একটা মেয়র সাথে খোলা কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কারো নজরে এলে ফলাফল নিশ্চয় খুব একটা সুখের হবে না। নেহায়েত তারা গ্রামে থাকে না বলে হয়তো আপাত কেউ কিছু বলবে না তবে এর আগের বারে নিরুর মুখেই এই কথা সে শুনে মনে রেখেছে।  কিন্তু নিরু? মুনি ঋষিরাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে নিশাত আর কি! নারী হৃদয় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তবুও নিশাত হতভম্বের মত কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়েই রইল। নিরুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া কি শুধুই লোক লজ্জা না কি ভিন্ন কিছু? এমন করে কিছু না বলেই চলে যাবে? কিছুটা বোকার মতই দাঁড়িয়ে রইল। এ কথা কাউকে জিগ্যেস করা যাবে না। কেন, সরাসরি কিছু বলে গেলে কি হতো? কেন এমন হয়? লজ্জা, নাকি অন্য কিছু? তা হলে সে অন্য কিছু কি? আর কি হতে পারে? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে আস্তে আস্তে নিরুর দেখানো বাড়ির পিছন দিকে যেখান থেকে বাঁশ কাটার শব্দ আসছে সে দিকে চলে গেল।

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

 

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login