আল মামুন খান

ছোটগল্প: উরাস

ছোটগল্প: উরাস
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা ভেঙ্গে মাথায় খাবারের থালা-বাটি নিয়ে প্রায় আধামাইল হেঁটে আসতে হয়েছে।

ফ্রক পড়া আট বছর বয়সী মেয়েটি নদীর পাড়ে এসে বাবাকে ডাকে।, বাজান, ওওও… বাজান। ভাত আনছি, তাড়াতাড়ি আও।’ যাকে ডাকছে সে পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর অগভীর পানিতে আরো কয়েকজনের সাথে ‘খুচন’ (হাতে ধরা নেট জাল) দিয়ে গলদা’র রেণু সংগ্রহ করছে।এই কাজে তাঁর সাথে তাঁর পুরো পরিবার-ই আছে। বাবুল শেখ তাঁর সবচেয়ে ছোট মেয়েটির ডাক শুনলেও সহসা কাজ থেকে ফারাক হতে পারে না।

এখন সিজন চলছে। বিশখালি নদীর এই অংশে গলদা চিংড়ির ডিম থেকে পোনা যাকে রেণু বলে, প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে। বাবুল ওর ছেলে ধলু এবং দুই মেয়ে নাজমা ও পারুলকে সকালের ভাত খেয়ে আসার জন্য পাড়ে অপেক্ষারত কুসুমের কাছে পাঠায়। ওরা খেয়ে নিলে সে আর তাঁর বউ মর্জিনা খেয়ে আসবে। আরো কয়েকটি পরিবার সেই ভোর রাত থেকেই একটানা পানিতে হাতে টানা নেট জাল দিয়ে রেণু ধরছে। কয়েক দফা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন নেই। নদীর পানি যদিও তেমন ঠান্ডা না, তবে ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে থাকার কারনে সবাই-ই কাঁপছে। পুরুষেরা কিছুক্ষণ পর পর কষে বিড়ি টানছে। তাতে যদি শরীরে একটু উত্তাপ আনা যায়। মেয়েদের তো এই সুযোগটাও নেই। তবে এই এলাকার মহিলারাও বিড়ি টানে। এখন এটা সকলের চোখেও সহনীয় হয়ে গেছে।

দীর্ঘক্ষণ পানিতে থেকে থেকে ওদের সবার পায়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। ওরা বলে ‘ঘা হইছে’। এজন্য পানিতে নামার আগে সরিষার তেল ভালোভাবে হাতে পায়ে মেখে নেয়। তবে এরা এতোটা গরীব যে সব দিন তা-ও লাগাতে পারে না। তাঁদের ক্ষুধা নিবারণের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকেই তো তাঁরা পায় না। সেখানে তেল লাগানোর বিলাসিতা কি তাঁদের মানায়?

বাবুল শেখের ছোট মেয়েটিকে সে এখনো পানিতে নামায় নি। তবে ক’দিন আর না নামিয়ে পারবে জানে না। সে এখন সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে শাক জাতীয় এটা ওটা কুড়ায়… শুকনো ডালপালা জোগাড় করে… আর ওদের মা ভোর রাতে যা রান্না করে রাখে, সেই খাবার আনা-নেওয়া করে।

ছেলে আর দুই মেয়ের খাওয়া শেষ। ওরা পানিতে নেমে আসতেই বাবুল বউ এর দিকে তাকায়। মর্জিনা নীরবে তাঁর পিছু নেয়। কাজ করতে করতে এরা যেন বোবা প্রানীতে পরিণত হয়েছে। ঠিক যেন এক একটি রোবট।

স্বামী স্ত্রী গোগ্রাসে গিলতে থাকে। সকালেই তাঁরা গরম ভাত খেতে পারে। দুপুরে তো পানি ভাত খেতে হয়। কারন মর্জিনাকে ভোরে রান্না করতে হয়। তবে রাতের খাবার সবাই মিলে এক সাথে মজা করে খায়। মজা এই কারণে যে তাঁরা নিজের বাড়িতে বসে শুকনো অবস্থায় খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়।

খাওয়ার এক পর্যায়ে দেখে মেয়ে কুসুম বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু লজ্জা পায় বাবুল। নিজের থেকেই বলে, ‘ মা রে, একটু জোর লাগাইয়া না খাইলে পানিতে নামতে পারমু না। দেরী হইবো। দেরী হইলে মাছও কম পামু।’ মেয়ে বিজ্ঞের মত হাসে। যেন কত বুঝেছে সে। বাবুল নিজের থালা থেকে আলু ভর্তা-ডাল দিয়ে মাখানো ভাতের এক দলা মেয়ের মুখে তুলে দেয়। মর্জিনা মেয়ে-বাবার সোহাগ দেখে মনে মনে আনন্দ পায়। ওর চোখ ভিজে আসে। সে-ও নিজের থেকে এক দলা মাখা ভাত মেয়েকে খাওয়ায়। বাবা আবার দিতে চাইলে মেয়ে না করে। মাথা পিছনে সরিয়ে নেয়।

খাওয়া শেষ হল… মর্জিনা সমস্ত এঁটো থালা-বাসন নদীর পানিতে কাঁদা দিয়ে ঘসে ধুয়ে দেয়। বাবুল মেয়েকে বলে, ‘ মা, সোজা বাড়িত যাইবা। আর বৃষ্টি লাগাইবা না।’ মেয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। এরপর যেভাবে এসেছিল, সেই পথে ফিরে যায়। এভাবেই চলছে সিজনের দিনগুলো। সবসময়েই এদের জীবন এরকম। ছোট্ট মেয়েটির গমন পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক অসহায় পিতা! ভাবে, এই বয়সে ওর হেসে খেলে সময় কাটাবার কথা! নদীর দিকে তাকায়। সেখানে বয়সের আগেই বুড়িয়ে যাওয়া ওর সন্তানদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায়। ওদেরও তো খেলাধুলা করার কথা… অন্যদের মত স্কুলে যাবার কথা। পাটকাঠীর মাথায় জিগারের আঠা মাখিয়ে বনে বাদারে ফড়িং ধরার কথা… পুটি মাছের ফাঁদ পেতে কানি বক ধরে উল্লাসে গ্রামের রাস্তা দিয়ে মায়ের কাছে ফেরার কথা! ওদের দুরন্তপনায় গাছের তেঁতুল পাকবারও সময় পাবে না… ডোবার ব্যাঙ অতিষ্ট হয়ে যাবে বর্ষার এই সময়ে ঢিলের আঘাতে আঘাতে! আর আজ কিনা ওদেরকে এই পানির ভিতরে পোকা সদৃশ রেণু সংগ্রহ করতে হচ্ছে…কাঁপতে কাঁপতে! রোদে পুড়ছে… বৃষ্টিতে ভিজছে… এই কি জীবন?

পাথরঘাটার যে এলাকায় এখন ওরা থাকে, সেটা বাবুলের আদি বাড়ি না। নদী ভাঙ্গনে ওপাড় থেকে ওরা সব হারিয়ে কয়েক ঘর পরিবার এই পাড়ে এসেছে। দরিদ্র্যদের ভিতরেও তাঁরা হত-দরিদ্র্য। মহাজন আনিস মোল্লার কাছ থেকে দাদন নিয়ে এই কাজে নেমে পড়েছে। বছরে সিজন চলে সব মিলিয়ে ছয় মাস। এই ছয় মাসের জন্য আনিস মোল্লার কাছে ওরা সবাই বিক্রী হয়ে যায়। এখান থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে রাখে বছরের বাকি সময়টার জণ্য। সেই সময়ে বাবুল খেতে কামলা দেয়, মর্জিনা গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করে। এভাবেই বেঁচে আছে ওরা।

গলদার যে রেণু ওরা মহাজনের আড়তে হাজার বিক্রী করে ছয় হাজার টাকায়। সেগুলো মহাজনের আড়ত থেকে পাইকাররা দশ থেকে সাড়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নেয়। আর ঘের মালিকেরা সেই রেণু বারো হাজার টাকা হাজার প্রতি দাম দেয়। অনেক টাকা দিয়ে প্রতিবারই নদীর ডাক নেয় ওদের মহাজন। এজন্য তাঁর কাছ থেকে দাদন না নিয়ে কেউ নদীতে মাছ ধরতে পারে না।

মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে বাবুল স্বপ্ন দেখে! দেখে সে একটি বিশাল শান্ত নদীর কূলে একা একা ইচ্ছে মত রেণু ধরছে… সেগুলো সরাসরি নিজে গিয়ে ঘের মালিকের কাছে বিক্রী করছে… ফেরার পথে ছেলের জন্য নতুন সার্ট-লুঙ্গী-গামছা, তিন মেয়ের লাল ফ্রক… আর বউ এর জন্য লাল শাড়ি। ছোট মেয়ের অনেকদিনের একটা শখ… প্লাস্টিকের খেলনা পুতুল আর একটা বাঁশী- মনে করে নিজের ঝোলার ভিতরে আগেই ভরে নিয়েছে। এখন নদীর ওপাড়ে খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে… ওই তো, মাঝ নদীতে চলে এসেছে। আর কিছুক্ষন! এরপর সে…

চৌকির ওপরে ছেড়া কাঁথার সামান্য পুরুত্ব… সেখানে বসবাস শ’য়ে শ’য়ে উরাসের (ছারপোকা)। ওগুলোর কামড়ে বাবুলের ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। সাথে সাথে স্বপ্ন ও… ঘুম থেকে ঊঠে হ্যারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দিতেই অনেকগুলো উরাস দৌড়ে পালায়। ইচ্ছে করলে হাত দিয়ে পিষে ওগুলোকে সে মারতে পারে। কিন্তু কি জন্য যেন সে মারে না। ভাবে, ওগুলো আর ওর থেকে কতটুকু রক্ত খাচ্ছে? মহাজন যে হারে দিন-রাত ওদের সবার রক্ত শুষে নিচ্ছে! তাতে আগে ঐ মহাজনকে পিষে মারতে হয়।

সে ইচ্ছেটাকে এক্সিকিউট করে শুধু মনে মনে। তাঁর স্বপ্নরা প্রতি রাতে তাঁর কাছে আসে… আবার ছারপোকার কামড়ে মিলিয়েও যায়। সে মনের গভীরে এক স্বপ্ন নিয়ে বউ-ছেলেমেয়েকে ডাকে। নতুন একটি দিনের জন্য জলে অবগাহনের প্রস্তুতি নিতে তৈরী হতে বলে।

নতুন একটি সূর্য উঠে…

কিন্তু বাবুলদের জীবনে কি নতুন কোনো আশার আলো নিয়ে আসে? না আনবে?

মনের ভিতরে ওর বিছানায় পালিত কিছু উরাসের জন্য মমতা আর সত্যিকারের কিছু উরাস মানবকে পিষে মারার অদম্য ইচ্ছেটাকে লালন করেই চলে সে… সুবহে সাদিক থেকে পরবর্তী সুবহে সাদিক পর্যন্ত।।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login