ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ২)
দুই
ওলি আজকে বেলা করে উঠেছে। সকাল থেকে বেশ বৃষ্টি হয়েছে, ঘুমটাও হয়েছে বেশ। বারটার দিকে একটা ক্লাস আছে, তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। চিংটু স্যারের ক্লাস। উনার আসল নাম আসলে আব্দুল মজিদ কিন্তু তার স্বভাবের কারনে চিংটু স্যার নামে পরিচিত। স্যারের কাজ, ক্লাসে এসে ছাত্রীদের সামনে অশ্লীল গল্প করা। ভ্যাবদা মার্কা ছাত্রগুলো সেটা নিয়েই বেশ মজা করে। সেদিনের কথায় ধরা যাক। ক্লাসে এসেই স্যার বলতে লাগলেন, তিনি মেয়েদের শাড়ি পড়া পছন্দ করেন না। শাড়ি পড়লে নাকি পেট দেখা যায়, বাতাসে বুক বের হয়ে আসে। প্রথম প্রথম অসহ্য লাগত ওলির। আজকাল গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। স্যার যদি বলে, মেয়েরা সামনের দিকে ঝুঁকে আসলে ছেলেদেরকে নিজের অর্ধ বুকটা দেখানোর জন্যে। তবু ওলি কিছু মনে করবে না। সবই সহ্য হয়ে গিয়েছে। বরং আজকাল স্যার যেটা এসে বলে, সেটাই ওলি বেশি বেশি করার চেষ্টা করে। চিংটু স্যারকে চিংটামি করেই শাস্তি দেওয়া দরকার।
আজ নেট নেট পাতলা একটা শাড়ি পড়েছে ওলি। এমনিতে সে শাড়ি পড়ে না কিন্তু আজকে কেন যেন সকালে উঠেই ঠিক করেছে, আজ শাড়ি পড়বে। ওকে দেখতেও বেশ লাগছে, কবিদের ভাষায় লাল নীল পরী। মধ্যরাতের পরিবর্তে ভুল করে এই সকাল বেলাতেই নেমে এসেছে আসমান থেকে। যেন কেউ ডেকেছে তাকে, এক বিশেষ কারনে এই আগমন। কারন অবশ্য একটা আছে, আসলে ওর এক বান্ধবীর গায়ে হলুদ আজ। সে হিসেবে ওর একটা হলুদ রংযের শাড়ি পড়া উচিত ছিল কিন্তু সে পড়েছে লাল শাড়ি। ফর্সা শরীরে রংটা বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে, বীর বিক্রমে জানিয়ে চলেছে সবাইকে। হঠাৎ করে কেউ দেখলেই যে কারও বুকে চিন চিন ব্যাথা হতে বাধ্য। যারা প্রেমিক পুরুষ তাদের কাছে এই চিন চিন ব্যাথা বেশ সুপরিচিত।
ওলির বান্ধবীর গায়ে হলুদ, তার খুশি হওয়া উচিত কিন্তু সে খুশি না। বরং ওর মন বেশ খারাপ। এই শেষ বর্ষে এসে একে একে ওর সব বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। যেন এখন বিয়ে হলেই জীবনটা পরিপূর্ণ হবে। ওলিকে নিয়েও আজকাল বাসায় কথা চলছে। মায়ের কথা, মেয়ে্ বড় হয়েছে এবং বিয়ে্ দাও। বাবা এদিক দিয়ে অবশ্য নিশ্চুপ। উনি আবার মেয়ে্র মায়ের চেয়ে মেয়ের উপরই নির্ভর করেন বেশি। তাই এত সহজে মেয়ে্কে পর করে দিতে চান না। আর ওলি এই সুযোগটাই নিয়েছে, এই কয়েক মাসেই কতগুলো বিয়ে ফিরিয়ে দিল সে। বুয়েটের টিচার, কানাডা ইমিগ্র্যান্ট, গ্রামীনফোনের ইঞ্জিনিয়ার, আরও কত কি। ওলি ভেবে পাই না, মানুষ কেন পেশা দিয়েই পরিচয় দেয়। যেন অন্য কোন পরিচয় দিলে সবাই ছোট হয়ে যাবে। অবশ্য বাবাকে সে বলেছে, পরিচয় হবার পর ভাল লাগলেই কিছু হতে পারে নাহলে নয়।
মেয়েকে দেখে জাহানারা বললেন,
-কিরে? না খেয়েই কোথায় চললি?
-ক্লাস আছে মা। ক্লাসে যাব।
-তাই বলে না খেয়ে যাবি। খেয়ে যা।
-বাইরে কিছু খেয়ে নিবনি। এখন যাই।
-বাইরে খেয়ে আবার অসুখ বাঁধাবি তো।
-হলে হবে।
ডান হাত উঁচিয়ে মুখটা বেশ কায়দা করে উত্তর দেয় ওলি।
জাহানারা রাগে গর গর করতে থাকেন। আজকাল কিছু হলেই ওলির বাবার মুন্ডুপাত করতে থাকেন তিনি। এখন যেমন বিড় বিড় করে বলছেন,
-যেমন বাপ তেমন মেয়ে, লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে অবাধ্য করে ফেলছে। আমি কে?
মিষ্টি হেসে ওলি বলে,
-হ্যাঁ মা তুমি কে?
-কথা বলবি না। সকালের নাস্তা দুপুরে, দুপুরের খাবার সন্ধ্যায় এই করে বেড়া। অসুখ হলে আমাকে ডাকবি না।
-আচ্ছা মা ডাকব না।
এবার শব্দ করে হাসতে হাসতে লিভিং রুমের বারান্দায় আসে ওলি। করিম চাচাকে চিৎকার করে গাড়ি বের করতে বলে। তারপর মেঝেতে হাই হিলের ঠক ঠক শব্দ করতে করতে দরজা খুলে লিফট দিয়ে নিচে নামতে থাকে।
ভার্সিটিতে এসেই লিপির সাথে দেখা হয়ে গেল ছবি হাটের সামনে, মেয়েটা দিন দিন আরো মুটিয়ে যাচ্ছে। আজ লিপিও শাড়ি পড়ে এসেছে। লাল শাড়ি নয়, টকটকে হলুদ রংয়ের শাড়ি যেন শরীরের রংই হলুদ হয়ে গিয়েছে। গাড়ি সেখানেই পার্ক করিয়ে রাস্তায় পা রাখে ওলি। হেঁটে হেঁটে লিপির পাশে এসে কথা বলা শুরু করে।
-কিরে মুটি আক্তার? কেমন আছিস?
লিপি ওলির কথা গায়ে মাখে না। উত্তরে বলে,
-চল ক্যান্টিনে যাই। ভীষন খিদে পেয়েছে।
অন্য সময় হলে ওলি লিপির এ কথার জন্যে ওর মাথায় একটা গাট্টা মারতে ছাড়ত না। কিন্তু ওলিরও খিদে পেয়েছে, সকালে নাস্তা করেনি ও।
ক্যান্টিনের সামনে বাইরে বেঞ্চিতে বসে দুজন। ক্যান্টিন বয় জামাল তাদের বিশেষ পরিচিত। ওরা এখানে বসলেই যত কাজই থাক সব ফেলে চলে আসবে। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল,
-কি দিব আফা কন? স্যান্ডুউইচ, সিংগারা, সামুচা নাকি চিকেন রোল?
-যা দুইটা করে স্যান্ডুউইচ আর চিকেন রোল নিয়ে আয়। লিপি বলে।
-আইচ্ছা।
জামাল চলে যায়। লিপি ওলিকে বলে,
-আজকে ক্লাস করবি?
-হুম।
-তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই বেশে গেলে আজ চিংটু মিয়া আমাদের আস্ত রাখবে আর?
-না রাখুক।
-বাদ দে তো ক্লাস।
-চল আজিজ মার্কেটে যাই।
-ঐখানে আবার কি?
-বাসায় পড়ার জন্যে গেঞ্জি কিনব।
-গেঞ্জি কিনতে আজিজে যাওয়া লাগবে কেন? বসুন্ধরা সিটি চল।
-ধুর। তোরে যেটা বলি সেটাই না করিস কেন?
-না কই করলাম। সাজেশন দিলাম।
-খ্যাতা ভুরি তোর সাজেশনের। আজকে ক্লাস করব না বুঝলি। ফাইনাল।
-আচ্ছা যা চিংটু স্যারেরটা করব না কিন্তু কমল স্যারেরটা করব। স্যার যা পড়ায় তাই পরীক্ষায় আসে।
-এই জন্যে তো ঐ ক্লাস করারই দরকার নাই। কারো কাছ থেকে ক্লাসনোট টুকে নিলেই হবে।
জামাল এসে খাবার দিয়ে গেল। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ওরা দুজন। ওলি বলল,
-আজকে কেমন বৃষ্টি হয়েছে দেখেছিস? ঠান্ডাও পড়েছে, শীতের দিনে বৃষ্টি আমার জঘন্য লাগে।
-কেন? জঘন্য লাগবে কেন? জানিস আজকে বৃষ্টিটা আমার জন্যে কত সৌভাগ্যের ছিল।
-কেন? সৌভাগ্যের কি পেলি?
-তোকে বলা যাবে না।
-বলিস না যাহ।
ভ্রুকুটি করে বলল ওলি। তারপর ঘোষনা করল,
-শোন। আমরা এখন আজিজ মার্কেটে যাব। এরপর কমল স্যারের ক্লাসটা করব এবং টিএসসিতে গিয়ে আড্ডা দিব কিছুক্ষন।
আজিজ মার্কেটে যাওয়ার কথা শুনে লিপি আর প্রতিবাদ করল না। তবে চিমটি কেটে বলল,
-টিএসসিতে আড্ডা দিবে কেন? রফিকের জন্যে অপেক্ষা?
-ওকে রফিক বলবি নাতো। কেমন সেকেলে সেকেলে লাগে। আহমেদ বল।
-আচ্ছা যা আহমেদ রফিক।
-হুম।
দুজনেই হেসে উঠে। তারপর ক্যান্টিনের বিল মিটিয়ে রিক্সা করে আজিজ মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দেয়।
6 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ২)
You must be logged in to post a comment Login