গল্পঃ একলা (পর্ব-১)
বাইরে বৃষ্টি, বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমে বন্ধ জানালার কাঁচটি ঘোলা হয়ে আছে। বুবুন তাতে আঙ্গুল ঘুরিয়ে তার নাম লিখছে আর আড় চোখে তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।মায়ের মনোযোগের অপেক্ষায় তার সকল ইন্দ্রিয় সজাগ কিন্তু তার কানে ভেসে আসছে শুধু ‘হুম’, ‘তাই’!, ‘তারপর’, ‘আর’ এরকম টুকরো টুকরো শব্দ আবার কখনো এতটাই জড়ানো যে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।বুবুনের মা রুমা, ইজি চেয়ারে বসে নিচু স্বরে সেল ফোনে কথা বলছে।সে তার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে না, তার দৃষ্টি কখনো মাটিতে, কখনো হাত-পায়ের নখে, আঁধা ফাটা চুলের ডগায় আবার কখনো সিলিংএ।
আজ ছুটির দিনে ঘরবন্দি বুবুনের বেশ অস্থির লাগছিল তাই সে বার বার রুমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল আর রুমাও সেল ফোনে হাত চাপা দিয়ে বলছিল ‘একটু পর যাই, বৃষ্টি কমুক’ ইত্যাদি। কিন্তু বার বার এমন তাড়া দেওয়ায় বিরক্ত রুমা হঠাৎ ধমকে উঠেছিল,তখন থেকেই সে তার মার কাছে যায়নি শুধু রাগ রাগ ভাব নিয়ে আশেপাশে ঘুরছে।
দেড় ঘন্টা ধরে রুমা কথা বলছে, বুবুন তার হাতের ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হিসেব করল। বৃষ্টিটাও কমল না আর দুপুরও হয়ে এল তার বাইরে যাওয়ার আশা এখন কমতে কমতে এক চিলতে। ঘোলা জানালার কাঁচে লেখা বাংলা নামের পাশে সে এবার তার নাম ইংরেজীতেও লিখল, জানালায় খুটখাট শব্দ করল, কয়েকটা কাশি দিল, সরাসরি তাকাল তার মার দিকে কিন্তু রুমা মুখ নিচু করে হাতের আঙ্গটিটা অন্যমনস্ক ভাবে খুলছে আর পড়ছে বুবুনকে সে দেখতেই পাচ্ছে না যেন।বুবুনের রাগটা দলা পাকিয়ে কান্না হয়ে বুক ঠেলে বের হতে চাইল কিন্তু তা চেপে রাখায় কষ্ট হয়ে গেল। কষ্টটা তাকে যতটা সাহসী করে তুলল, তাতে সে ভ্রু কুচকে জানালাটা খুলে ফেলল। শীতের শুরুর নিম্নচাপ জনিত বৃষ্টির ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপ্টা দুই লাগছে তার গায়ে তবুও সে নড়ল না মার প্রতি অভিমানে নিঃশ্বাস ভারি হয়ে তার ছোট্ট বুকটি ফুলে ফুলে উঠছে।হঠাত তার মায়ের খিলখিল হাসি ভেসে এল এবার সে আর তাকাল না ,জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল।
-বুবুন!
অনেকক্ষন যে যার একাগ্রতায় মগ্ন থাকায় বুবুন রুমা দুজনেই চমকে উঠল।বুবুনের নানি রেহানা বেগম দৌড়ে এসে তার নাতিকে শাড়ির আঁচলে মুছতে থাকল।সে অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-কিরে! তুই দেখতে পাসনা বিবুন ভিজতেছে।
কথাটা বলতে বলতে রুমার হাতের সেল ফোনে রেহানা বেগমের দৃষ্টি যায়। সে আর কিছু বলল না। রুমা পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল আসলেই তো সে ছেলেটাকে খেয়াল করেনি।রেহানা বেগমের এভাবে সেল ফোনে তাকানো আর নিশ্চুপ হয়ে যাওয়াটা হঠাৎ তাকে খুব ছোট করে ফেলল। সে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টায় বুবুনকে শাসন করতে এগিয়ে এসে বলল,
তুমি এমন করলা কেন বুবুন? তোমারনা ঠান্ডা?
-ভালো করেছি।
একটু আগের প্রাপ্ত লজ্জায় একটু বিহবল রুমা ছেলের বেয়ারা উত্তরে আরো লজ্জা পেল।মূহুর্তের অস্বাভাবিকতায় সে চট করে বুবুনের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল।এবার বুবুন বেশ শব্দ করেই কেঁদে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় রেহানা বেগম অবাক হয়ে তার মেয়ের দিকে তাকিয়া রইল,রুমা যেন নিজের কাছ থেকে পালাতেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল,
-আসো নানা ভাই।সে নাতীকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়।তার চোখেমুখে অসন্তোষ।নাতির কান্না সামলাতে সামলাতে সে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল।মেয়ের ভাল করতে সে কি নাতির খারাপটাই করল?রুমা আর শুভর এই সম্পর্কের সঞ্চালক তো সে নি্জেই।রুমার দ্বিতীয় বিয়ে কি তবে বুবুনের জন্য অমঙ্গলই ডেকে আনছে?আজ তো এমনই একটা ইংগিত পেল বলে তার মনে হল।রেহানা বেগমের ভারি মন তার ভারি শরীরকে আরো ভারি করে দিল।কিন্তু তার কোলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখা বুবুনের কান্নার গতি হঠাৎ করেই কমে এল।বুবুনের শারীরিক কষ্টটা এখন তার মানসিক কষ্ট ছাপিয়ে জানান দিচ্ছে।নানীর শক্ত বাহুবন্ধন থেকে সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে হাল্কা মোচড় দিল।কি যেন কি বুঝে অন্যমনস্ক সে তার নাতিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
(চলবে)
30 Responses to গল্পঃ একলা (পর্ব-১)
You must be logged in to post a comment Login