অরুদ্ধ সকাল

চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক.

অপলা ভিজবে বলেই বসে আছে।
সিড়ির শেষ ধাপটা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। সে দাড়িয়ে আছে কখন পানি এসে তার পায়ের গোড়ালিটাও ডুবিয়ে দেবে।
সাদা পেড়ে শাড়িটার রং ধুয়ে হয়ে গেছে হালকা। তার পায়ের রঙ করা আলতাটার রঙ ফুরোতে শুরু করেছে। আর নুপুর জোড়া চিকচিক করে উঠেছে বজ্রপাতের সাথে সাথে।
অপলা আনমনে বৃষ্টি দেখছেই; বৃষ্টির ফোটা ওর শরীরে ঝাপিয়ে পড়ে শুধু ক্ষান্তই হয়নি একটা তরল-গরম স্রোত হয়ে পা-অব্দি বয়ে চলেছে। আর সেই সাথে উষ্ণতার ভাগ বসাতে গিয়েছে বৃষ্টির ফোটাও।
এই বর্ষনেও অপলার চোখ টলেনি, মুখ খোলেনি। সে নিরবতাকে পাশবন্ধনে বেধে বসে আছে।
একটানা বয়েই চলেছে বৃষ্টিটা। যেন শত বছরের জমে থাকা কান্নার ঢল আজ নামিয়েছে আকাশটা। দুরের মাটির উপর দিয়েও স্রোত ধারা বয়ে চলেছে প্রকৃতির ভেজা জলসায়। ভেজা হওয়ার, এই শীতল হাওয়ার দিনে। অপলা তাই বসে আছে আনমনে।

তার ঠিক উল্টোপাশে একটু দূরে জানালার পাশে যেখানেটায় দেবদারুর বন সে পাশটায় বসে আছে অমিত; অপলার বৃষ্টি ভেজা দেখছে। ও আজ বলেছিলে এসো না দুজন গল্প করি এই বৃষ্টিভরা জোছনামাখা সন্ধ্যেয়। অপলা বলেছে না আজ বৃষ্টিতে ভিজবো।

দুই.

দমকা হাওয়াটা বারবার জানালার ডানা ঝাপটিয়ে দেয়। বৃষ্টির ছাট গায়ে এসে পুরোনো স্মৃতিকে আজ নাড়া দিয়ে যায়।
ভুলে যাওয়া সেই স্মৃতি কে নাড়া দিয়ে যায়। সেই বৃষ্টি; সেই টিনের চালের এক রকম ঝিমধরা শব্দ।
বারান্দায় বসে সবার অলক্ষ্যে কখনো বা বৃষ্টির পানিতে হাতরাখা সেই সব স্মৃতিরা খালি খালি ঘুরপাক খায়।
দোতলার জানালা থেকে কচি কন্ঠের ডাক অমিত চল বৃষ্টিতে ভিজি ?
অমিতের ভিজতে চাওয়া মনটা ছলকে উঠে তাপ্পর আবার থমকে যায় বলে না,রে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে।
আহার সংগ্রামী বাবার সামর্থ তো কড়িআনার মতো। বড় রকমের অসুখ বাধালে চিকিৎসা করাবে কে; অমিতের বৃষ্টি ভেজার ভাবনা মনের ভেতরেই গুমরে মরে।

সেই স্কুলের পাশেই লম্বা লেকের ধারে কজ’ন মিলে এক ডিঙ্গিতে।
অপলা বলে আমায় নৌকা চলানো শেখাবি অমিত ?
কি,যে বলিস তুই? রাজকুমারি চালাবে নৌকা তবেই হয়েছে; রাখাল বালকের কি হবে রে তবে !!
রাগে তেড়ে আসে ও, বলে ধাক্কা দিয়ে নৌকা থেকে ফেলে দেব কিন্তু। আমি ডুবে মরবো যে; বলে হেসে উঠে অমিত। না,রে মরবি না।

তিন.

বৃষ্টি পড়ছেই; থামবে না,কি আজ !
উৎকন্ঠা অপলার;
বাড়ি ফিরবে কি করে! ছাতা নেই যে; রং চত্বরেও রিকসা নেই। ঠায় দাড়িয়ে থাকা।
কতক্ষণ থাকা যায় এভাবে।
দূরে বিদ্রুপের সুর ভাজছে পঙ্গপালের দল। কলেজ ক্যান্টিন বিচ্ছিরি আজ। বাসা ফিরে ঘুমের ঘোরে ডুবে যাবার তালে সব কলেজ ছাড়ছে।
সেলফোনের বাটনে ডায়াল…..অমিত তুই কোথায় রে; আমায় একটু নিয়ে যা, না।
ফোনটা ব্যাগে ফেলে ও তাকায় দূর বাইরে। কি,সুন্দর বৃষ্টি!!
ভিজতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু কাল যে এক্সাম আছে তাপ্পর জ্বর-টর হয়ে গেলে। সে এক কেলেঙ্কারী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাকভেজা হয়ে অমিত সামনে দাড়ায় ; সে,কি,রে তুই একা কেন ? চলে গেছে সব ক’টা ?
– হ্যা সবক’টা ঘুম দেবীর কাছে গেছে।
অপলা আবার বলে উঠে সে, কি,রে গাধা ছাতা একটা কেন; আমি গেলে তুই যাবি কি করে ?
-কেন ভিজে ভিজে
– ফাজলামো করিস না,তো
অপলা চলে যায়।
অমিত ঠায় দাড়িয়ে ভিজছে। সেই একা থাকা একটা বোকা কিন্তু সুন্দর রকমের চাঁদের মতো । অমিত খুজতে চায় মন তারপর করবে সমর্পন আবার অজান্তেই বলে উঠে দুর ছাই কি,যে হয়ে যায়না আমার।
বোকা কি সাধে ও।
আসলেই গাধা। টিলা কখনো পাহাড় হয়; সাগর কখনো ছুটে কি নদীর বুকে। একা একাই হেসে চলে অমিত বৃষ্টিতে ভিজে।

চার

টরে-টক্কা টাইপের একটা প্রেম পেলে ভালো হতো। চলতো সেটা রেসের মতো। তবে সে আশায়ও গুড়ে বালি।
ভরা নদী হাওয়া পেলে দুলে উঠে খুব; শূন্য নদীর কখনোই হয়না সে সুখ।
তবু নদী; নদীই তার তুলনা সে নিজেই। অমিত জানে এই মনের সুপ্ত আশা, যতই দেখাক ভালোবাসা কিছুতেই টিকে থাকা যাবেনা যন্ত্রনার দেয়ালে।
অপলা বলে প্রেম হবে, প্রেমের মতো চাইবো যা এনে দিতে হবে আকাশা ফুঁড়ে। এ যেন উচ্চ বিলাসী ভাব।
অমিত তাতে অক্ষম ।
তবুও কি প্রেম বোঝে এ-সব। তবে যা বোঝে তা হলো, না পাওয়ার আকাশেও চাঁদ উঠতে পারে তবে সেটা অমাবস্যার ঘোর কাটবার পরই।
আর তাই সব বুঝে নিয়ে তাকেই ভালোবাসতে চায় সে যে তাকে দিতে পারে এক ব্যাথার অরণ্য।

পাচঁ

একটা ঝুপঝাপ বর্ষা। কদ্দিন ঢেলেই চলেছে বৃষ্টি। আকাশটাও ক্লান্ত, সেই সন্ধ্যেয় অমিতের ঘরে অপলা এসে হাজির।
অমিত দেখ দেকি, কি কান্ড ঘটে গেলে বলতেই লজ্জা লাগছে। কাল আমার বিয়ে পাত্র পক্ষ হুট করেই বলে বসলো, সময় নেই হাতে।
তাই; তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সেই ছোট্টবেলা থেকেই। তাই নিজে এসে নেমন্তন্ন করলাম; আসবি কিন্তু । তুই না এলে বিয়ের সাজই পড়বো না।
আচ্ছা কতোটা দহন হলে বুকের ভেতরটা দুমরে-মুচরে গুড়িয়ে যায়; সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় অমিত নকল হাসি হেসে বলে আমি আসবো; এখন সন্ধ্যে হয়ে এলো তুই বাড়ি যা।

পরদিন সে কি, বৃষ্টির বাবা !
সারা সকাল দুপুর ভিজে ভিজে বিয়ে বাড়িতে থেকেছে অমিত। ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির বিয়ে।
একদিন কপট হাসি হেসে ও বলেছিলো অপলা তুই আমার আরাধ্য দেবী হবি।
অপলা তো হেসেই খুন; বলে কি বোকা; মানুষ কখনো দেবী হয়। বুকের ভেতর অত ভালোবাসা রাখতে নেই রে বোকা; কাদঁবার জায়গা টুকুও রাখতে হয়।
সত্যিই আজ কাঁদবার ফুরসত টুকু পাচ্ছেন অমিত।
ঝুপঝাপ বৃষ্টির সন্ধ্যেয় চলে গেল বর-কনে নিয়ে চলে গেল সবাই।

ছয়.

যে কথা বলা হয়নি কোনদিন।
খুব করে একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছিলো তাও হয়নি। বৃষ্টির মতো করে কাঁদতেও পারেনি সে। সে শুধু ভালোবেসেছে
চুপিচুপি। আজ এই বৃষ্টির রাতে বসে দুর থেকে তাকিয়ে আছে সেই আরাধ্য দেবীর পানে।
তার মুক্তোজমা ভালোবাসার দেবীর কপালটা খুব ছোট তিনশত পয়ষট্টি দিন পেরুবার আগেই পতিদেবতার দেহবসান ঘটে যায় কোন এক অজ্ঞাত কারণে তারপর থেকেই এই ক’বছর পুরোনো আবাসে। অমিত কাছে যেতে চেয়েও থমকে গেছে বেশ ক’বার পাছে লোকের মুখ বন্ধ করে রাখা তো দুস্কর।
এভাবেই চলতে চলতে সব জড়তা একসময় কেটে গেছে তাপ্পর আজ এই বর্ষা রাতে……….
সব কথা ছাড়িয়ে মনের ভেতর থেকে ডাক আসে। উঠে দাড়ায় অমিত জড়তা ভেঙ্গে বলেই ফেলে অপলা চল বৃষ্টিতে ভিজি ?
সব ব্যাবধান ঝেড়ে ফেলে উঠে আসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তারপর,
নুপুর বাজিয়ে এসে অপলা বলে চল ভিজি…….

সেই উঠোন; দুজনে দাড়িয়ে।
কোন দিন কাছে আসা হয়নি এভাবে। কোন দিন বলা হয়নি ভালোবাসি। প্রাণ খুলে ব্যার্থতার, ব্যর্থ মুখে কাদাঁ হয়নি আজ সব হবে।
অপলা ভিজতে থাকা শরীরে উষ্ণতা ছাড়তে বলে অমিত হাতটা ধর। কেপে উঠা হাতটা ধরতে চেয়েও পারেনা ও। কেউ দেখবে; দেখবে না। অবশেষে হাতটা ধরে অমিত; সেই শীতল হাত।
অপলা বলে উঠে আচ্ছা অমিত তুই আমাকে ভালোবাসিস?
-হুম
-কতখানি
-অনেক বেশি
এবার আর দু চোখের পানি ধরে রাখা যায়না তাই বোধহয় এই বরষায় নোনা পানির স্রোত পড়তেই থাকে গা গড়িয়ে ভেজা মাটিতে।

____________সমাপ্ত_______________

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


20 Responses to চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে

You must be logged in to post a comment Login