রাবেয়া রব্বানি

গল্প-নিনাদ

গল্প-নিনাদ
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

নিনাদ

(১)
কয়েকদিন ধরেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। কখনো জোরে কখনো টিপটিপিয়ে পড়তেই থাকে সারাদিন। হালিমা ঘর থেকে বের হয়ে কাজে যাবে কি যাবে না ভাবতে লাগল। সে থাকে শেখেরটেক সাত নম্বর এর শেষ মাথার একটি বস্তিতে আর বাসাটা দশ নম্বর এ। যেমন বৃষ্টি,তাতে যেতে যেতে পুরোটাই ভিজতে হবে বলেই মনে হচ্ছে তার। কিন্তু মাত্র তিন মাস হলো কাজটা নিয়েছে সে।এরকম লেগে থাকা বৃষ্টিতে না গেলে কাজটা কি থাকবে? সাত পাঁচ ভেবে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল হালিমা। কোলের মেয়েটিকে একটা নীল ভারি পলিথিন দিয়ে ঢেকে তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। বস্তি থেকে বের হতে একটা নোংরা খাল পার হতে হয়। খালটায় এলাকার যাবতীয় আবর্জনা আর ময়লা মিশে এত ঘন কালো মিশ্রণ হয়েছে যে এটাকে পানি হিসাবে এখন আর চেনা যায় না। পারাপারের বাঁশের সাঁকোটাও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে বেশ পিচ্ছিল। সে খুব কৌশলে একহাতে মেয়ে আর এক হাতে বাঁশ ধরে ধরে সাঁকো পার হল।
সাঁকো পার হয়ে রাস্তায় নেমেও আর এক ঝঞ্ঝ্বাটে পড়ল সে। এই বর্ষায়ও রাস্তার জায়গায় জায়গায় খোদাই করে মাটি উঁচু করে রাখা হয়েছে। পিচ্ছিল ভেজা কাঁদা মাটিতে রাস্তার পিচ আর দেখা যাচ্ছে না। হালিমা আল্লাহর নাম নিতে নিতে বাকি রাস্তাটুকু অতিক্রম করে নির্ধারিত বাড়িতে গিয়ে পৌঁছুল। তাকে দেখেই প্রথমে ইফফাত আরার কপাল বিরক্তিতে কুঁচকে গেল,
-আরে তুমি আসছো ? আমি তো ভাবছি আর কাজে আসবা না বুঝি। তোমাদের ছুটা বুয়াদের তো কোন স্টেশন নাই। বলা নেই কওয়া নেই দুই দিন ধরে আসোনা। তোমাদের কাজে নেয়াও এক বিপদ।
-বৃষ্টি ছিলো তো আফা।
-বৃষ্টির জন্য কি ভাত খাওয়া বন্ধ রাখো? যত্তসব ধান্দাবাজি।
মালিকের কথায় হালিমা কিছুটা আহত হলেও মুখে কিছু বলল না। কোলের শিশুটার মাথা থেকে পলিথিন নামিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। শিশুটি মুক্তি পেয়ে ও ও করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। ইফফাত আরার হঠাৎ খেয়াল হল হালিমার পুরো শরীর ভেজা। নিজের রাগ ঝড়ানো ক্থায় কিছুটা লজ্জা পেল সে।
-ঠিক আছে ভেতরে আসো। একটা রিকশা নিয়ে চলে আসতে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে হেঁটে এলে কেন?
হালিমা হাসার চেষ্টা করল। মেয়েটাকে কোল থেকে নামিয়ে রান্না ঘরের এককোণে বসাল। ইফফাত আরা একটা শাড়ি এনে হালিমাকে পড়তে দিল। হালিমা শাড়ী পালটে এসে দেখল তার মেয়ে হেনার হাতে একটি বিস্কুট। সে কৃতজ্ঞ মনে কাজ শুরু করে দিল। কাজ একটু এগুলে ইফফাত আরা আবার একটু ঝালিয়ে নিতে চাইল হালিমাকে,
-শোন বৃষ্টি হলেও আসবা। রিকশা করে এসো। টাকা আমি দিয়ে দেব। কিন্তু না বলে কয়ে ছুটিছাটা নিলে কিন্তু অন্য লোক দেখব।
-ঠিক আছে।
হালিমা যেন বিনা বাক্যে মেনে নেয়। হালিমার মলিন মুখের নিরবতায় ইফফাত আরার কিছুটা অস্বস্তি হল। ব্যাপারটা হাল্কা করতে সে আরো কথা জুড়ে,
-মেয়েটাকে ভিজিয়ে আনলে? তোমরা পারোও। এতটুকু শিশু ঠাণ্ডা লেগে কি হবে বুঝতে পারো?
-আল্লাই দেখবো। পোলা দুইডাতো রইদ্দে বানেই বড় অইলো। কিছু অয় না।
-কি বলো। এই বয়সে আরো দুটা আছে!
-হ।হ্যারা জমজ। বয়স পাঁচ।
-বাচ্চা হওয়ানো ছাড়া তোমাদের কি আর কোন কাজ নেই?!
এই কথায় হালিমা দাঁত বের করে হাসে। ইফফাত আরার মুখেও হাসি আসে।
-স্বামী কি করে?
-হে দিন না কইলাম রিকশা চালায়!
-ওহ ভুলে গেছি। বদ স্বভাব নাই? নষ্টামির জন্য তো পুরুষ মানুষের আবার কোন ধনী-গরিব লাগে না।
-কথা ঠিক। আছে টুকটাক তয় এত বেশি না। এর মধ্যে ঠাং এ জোড় নাই।
-ক্যান।
-মাইয়া মাইনষে লুভ নাই কিন্তু হ্যার আবার ইট্টু জুয়ার দিকে টান। লাইসেন্স ছাড়া রিকশা কম ভাড়ায় পাওন যায়, হেল্লিগা বাড়তি টেকাও কামান যায় হেই টেকা দিয়া জুয়া খেলে। হেমুনি একদিন বেশি টাকা পাওনের লোবে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি লইয়া বাইরওইছে আর পুলিশে চোক্ষে ও পইড়া গেছে।
-তারপর
-পুলিশ রিকশা জমা কইরা ফালাইছে দেইক্ষা হ্যায় গেছে হাত-পা ধইরা ছুডাইয়া আনতে। পকেটে টেকা না নিয়া গেলে পুলিশ কি মানুষ থাকে কন? হ্যাগোর হাত পা দুয়াইলে কি মায়া তইয়ার অইবো?
-তারপর।
-তারপর আর কি? হাডুতে বাইরাইয়া ফাডায় লাইছে। অনেক খচ্চা কইরাও ভালা অয় নাই। এহনো পায়ে বল নাই।
-চিন্তা করো অবস্থা। পকেটে নাই টাকা আবার জুয়ার নেশা! উচিত শিক্ষা হয়েছে।
-হ্যার কি অইছে? অইছে সে আমার। দেহেন না পোলা দুইডা থুইয়া কামে আয়ি।
-এরা থাকে কই? হারায় টারায় গেলে।
-গরীবের মাল আল্লায়ই দেহে। ভাত খাওয়াইয়া বস্তির অন্য পোলাপানের লগে থুইয়া আয়ি।
-তোমাদের সাহস আছে।
-না আফা। প্যাডে খিদা আছে।
ইফফাত আরা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেল। হালিমাও কথা ছেড়ে আদা বাটায় মনোযোগী হল।

(২)

হালিমা হেনাকে ঘুম পাড়িয়ে তার স্বামী আলমের পাশে শুইয়ে দিচ্ছে,
-দেইক্ষো কইলাম চকিত তে পইড়া যাইবোগা কিন্তু।
আলম একটু বাড়তি গম্ভীরতা নিয়ে প্রশ্ন করল,
-মাইয়া ফালাইয়া থুইয়া দুফুর বেলা কই যাছ?
-সরকারি টিরাক বলে আইজকা চাইর নম্বর বড়রাস্তায় আইছে। চব্বিশ টেকা কেজি। আগে তো প্রত্যেকদিন একখানে আইতো। কয়দিন ধইরা কহন আয়ে কই আয়ে ঠিক নাই। দেহি গিয়া পাই নি। একবারে পাছ কেজির বেশি তো আবার আনন যায় না।
-হুম। রমজান মাসে প্রত্যেকদিন আইবো হুনছি। তয় চাইল ভালা না।
-চাইলের ভালা আর খারাপ কী! পেট ভরন দা কতা। বেয়াল্লিশ টাকা দামের চাইল খাইলে দিন যাইব?
আলম আরো গম্ভীর ভাব করে মেয়্বের পাশে শুয়ে পড়ল। হালিমা বের হতে গেলেই দুই ছেলে বকর আর আলি মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকল,
– আমগোরেও নিয়া যা।
-নাহ চুপচাপ ঘরে শুইয়া থাক।
ছেলেদুটো মায়ের কথা শুনল না। তারা হালিমা পিছু নিল। হালিমা কিছুক্ষণ তাদের তিরষ্কার করে হাল ছেড়ে দিল। পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধা গেন্দার মাও হালিমার সাথে পথ ধরল। বড় রাস্তায় এসে বকর আর আলির উচ্ছলতা আরো বেড়ে গেল। টেরাকের কাছে আসতেই তারা দেখল নানা বয়সি মহিলায় ইতিমধ্যে লাইনটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। দেরি না করে লাইনে দাড়িয়ে পরল হালিমা আর গেন্দার মা। বকর আর আলি মার হাত ছেড়ে রাস্তার ঢালু জায়গায় জমে থাকা পানির দিকে ছুটে গিয়ে একজন আর একজনের গায়ে ময়লা পানি ছিটিয়ে খেলতে লাগল। হালিমা হাত ইশারা করে তাদের চড় দেখায়। ছেলেদুটো তবুও থামে না। গেন্দার মা সে দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,
-তোর পোলা দুইডা বড় ইতর।
-হ।ঠিক কইছেন চাছি।
-তা জামা পড়ায় আনছ নাই কেল্লিগা? নাদুশ-নুদুশ পোলা যে না হেয় নজর দিবো।
ছেলেদুটার দিকে তাকায় হালিমা। এত কিছু সামলে তার মনেই ছিল না ব্যাপারটা। সে তার ছেলেদুটোকে কাছে ডাকে। বকর আর আলি পানি ছেড়ে এরমধ্যে ফুটপাতে আমড়া ওয়ালার আমড়া কেটে ফুল বানানোর কৌশল মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মায়ের ডাক তারা কানে নেয় না। গেন্দার মা হাহাকার করে উঠল হঠাৎ,
-হায় হায়। চাইল শেষ মনে লয়। দেখতো হাইলমা।
হালিমা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে গেন্দার মার কথাই ঠিক। কিছু মহিলা উচ্চস্বরে ঝগড়া করছে।
-চাইল শেষ কইলেই হইবো। ওই যে বস্তা দেহা যায়।
একটা কুচকুচে কালো লোক হাতের লাঠি ঘুরিয়ে বলল,
-ওইগুলি বিক্রি হইয়া গেছে।
-কইলেই হইলো। পাছ কেজির বেশি একজনের কাছে বেচার নিয়ম নাই। এত বড় বস্তা বেচা কেমনে অইলো?
-ওই মাতারি কতা কম। পরশুকা সক্কালে আইছ।
লোকটা লাঠিটা এলোপাতাড়ি চালিয়ে লাইন ভাঙ্গতে লাগল। হালিমা আর দাঁড়াল না। শুকনা মুখে ফিরে এসে বলল,
-চাইল বেচা আজ বলে বন্ধ। আবার পরশু সকালে।
গেন্দার মা বিলাপ জুড়ে দিল। হালিমা চিন্তায় পড়ে গেল পরশু সকালে সে আসবে কিভাবে? তার তো কাজ আছে। গেন্দার মা বা অন্য কারো কাছে টাকাটা দিয়ে যাওয়ার ভরসাও পায় না সে। সবাই অভাবী। এমন সময় ছেলেদুটো মায়ের আচল টানতে শুরু করল,
-মা আমড়া খামু। মা আমড়া খামু।
প্রতিদিন এমন অনেক বায়না ধরে দুজন। গরীব মায়েরা সন্তানের যত্রতত্র বায়নার সময় অন্যমন্সক থাকে। এরকম একটানা ঘ্যানঘ্যান তাদের চিন্তাকে আরো গতি দেয়। হালিমাও তেমনি বিরক্ত না হয়ে অন্যমনস্ক ভাবে তাদের হাত ধরে বস্তিতে ফেরার পথ ধরল।

(৩)

-মা এইডা কি।
-এইডা গলা চকলেট মুখে দিলে গইল্লা যায়। বাজানরা মুখে দাও।

বকর আর আলি মুখে দিল। সত্যি কি নরম! তারা বিস্মিত। দু ভাই মাকে জীভ বের করে দেখাল। হালিমার খুব মজা লাগল। সে আঁচলের গিট খুলে আরো দুটো চকলেট বের করে দিল। বকর আর আলি সাথে সাথে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। ছোট্র হেনার মুখেও দিল তারা। হেনা জিভ নেড়ে সচেতন হয় আরো খাবার জন্য এগিয়ে এল। হেনাকে আদর করে আলি। সে মুখ থেকে একটু বের করে দিচ্ছে বোনকে। ছেলেমেয়ে তিনজনকে খুশি দেখে মনটা ভরে গেলো হালিমার। আজ ইফফাত আরাকেও অনেক খুশি করতে পেরেছে সে। করনীয় কাজের চেয়ে অনেক বাড়তি কাজ নিজ থেকে করায় কালকের দিনের জন্য ছুটি দিতেও রাজি হয়েছে ইফফাত আরা। হালিমা শুধু কাল বেতন নিয়েই চলে আসবে। আর অতিরিক্ত কাজ এ পুরোনো জিনিসে নাড়া পড়ায় তার বেশ লাভ ও হয়েছে। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস হালিমাকে দিয়ে দিয়েছে ইফফাত আরা।আর তার সাথে ফ্রিজের বাসি কিছু খাবার আর কিছু চকলেট। খাবারের মধ্যে মুরগীর তরকারীও আছে। হালিমা সেটা এখন ভালো করে জ্বাল দিয়ে নিচ্ছে। ঘরটা তাই ধোঁয়ায় ভরে গেছে।
হঠাৎ আলমের বন্ধু রমিজের গলার আওয়াজ পেয়ে হালিমা মাথায় কাপড় দিল।
-ভাবীসাব মুরগীর সালুনের গব্ধ পাই।
হালিমা রমিজের কথায় উত্তর না দিয়ে চোখ মুখ কালো করে স্বামীর দিকে তাকাল।
-কই গেছিলা? বৃষ্টির দিন তিনজনরে সামলাই ক্যামনে?
আলম উত্তর দিল না। বাঁশ দিয়ে বানানো ক্র্যাচ রেখে ছোট চকিটায় বসল। রমিজ আলমের পাশে বসে গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,
-আমার বন্ধুর ভাগ্যডা ভালোই। বইয়া বইয়া বউএর কামাই খাইতাছে।
বন্ধুর রসিকতায় আলম হাসতে চেয়েও হালিমার দিকে তাকিয়ে হাসল না। হালিমা তার শরীরে শাড়িটা একটু ভাব নিয়েই জড়িয়ে নিয়ে ঘোমটাটা আরো লম্বা করল যাতে আলমের মাথায় কিছু ঢুকে। অসুস্থ স্বামীর বন্ধুদের আলগা খাতির খুব বুঝে সে। কিন্তু আলমের নির্বুদ্ধিতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখতে সে আবারো আলমকে তাড়া দিল,
-ভিজা জামা না খুইল্লা চকিত বইলা কে। চাদ্দর নষ্ট অইলো না?
পাত্তা না পেয়ে রমিজ একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে চলে গেল। রমিজ চলে যেতেই হালিমার মুখে হাসি ফিরে এল। হালিমার মুখে অনেকদিনপর হাসি দেখে আলমেরও খুব ভালো লাগল। সে জামা খুলে ছেলেমেয়ের পাশে বসল। অনেকদন পর সবাই একসাথে খুশি মনে রাতের খাবার খেল।

বকর, আলি আর হেনা ছোট্র চকিতে পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। আলম মাটিতে পাতা পাটিতে শুয়ে আছে । হালিমার হাতে একটি ছোট্র মশারির টুকরা সে এটা নিয়ে জানালায় তার দিয়ে বাঁধছে। তাতে আলম অবাক হয়,
-কিরে কি করছ?
-এইডা জানালায় লাগাই।
-ক্যান?
-যাতে বাতাস ও ঢুকে আর মশাও না আয়ে।
-বউ তোর ম্যালা বুদ্ধি।
হালিমা হাসে। জানালার কাজ শেষ হলে সে একটা কাঁথা নিয়া বসে। আলম একটু বিরক্ত হয়,
আবার খেতা নিয়া বইলি!
হ মুন্নি আফা তাড়া দিয়া গেছে। এই নকশি কাতাডা অইলে পনেরোশো টেকা পামু। বেত্ন পাই দুই হাজার টেকা হের মধ্যে বারোশো টাকাতো ঘর ভাড়াই দিয়া দেই আর চাইলের দামই তো ম্যালা বাকি বাদ বাদ দিলাম। চলতে অইবো না?
আলম শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। মনের ইচ্ছাটা বলল না। পায়ের সমস্যা হয়েছে পর থেকে হালিমার কামাইএ সংসার চলে। কিন্তু নিজের আচরনে সে এখনো উন্নত থাকতে চায়। বউএর গলগ্রহ যাতে না হতে হয় এ ব্যাপারে খুব সচেষ্ট সে। তাই মনে মনে ইচ্ছে হলেও বউকে কাছে ডাকছে না সে। হালিমারও আলমের দিকে মন নেই। সে বলে চলছে,
-তুমি সুস্থ অইলেও আমি কামডা ছাড়মু না। কাথা সেলাই ও না। তোমার আমার কামাইএ পোলাপানগুলিরে ভালা মন্দ খাওয়াইতে পিন্দাইতে পারমু। ঈদে বাড়তি খচ্চা করতে পারমু। স্কুলে পড়াইতে পারমু।
হালিমার চোখ চকচক করছে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সামনের সুন্দরদিনগুলো। হারিকেনের আলোয় নকশীকাঁথার মত স্বপ্নগুলোও যেন সে সেলাই করে যাচ্ছে সুন্দর নকশায়।

(৪)

সকাল দশটায় বস্তিতে হইচই পড়ে গেছে যে আট নম্বর বাজারে চালের ট্রাক এসেছে। হালিমা হেনাকে আলমের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে একটা ছোট চটের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হল।বকর আর আলি উৎ পেতেই ছিল। সাথে সাথে মার পিছু নিতে চাইল।বকর বলল,
-মা আমগোরে লইয়া যা।
সাথে সাথে আলিও বলল,
-হ লইয়া যা।
-না বাবারা আজ ঘরে থাক।
-নিবিনা।
-না। ভাত রান্দা আছে। তুমরা বাহের লগে থাইক্কো। বেশি দূরে যাইও না। আমি খালি যামু আর আমু।
-না আমরাও যামু তর লগে।
বকর তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে হালিমার শাড়ি ধরে টান দিল। সাথে সাথে আলিও। হালিমা তাতে রেগে গিয়ে চটাচট চড় বসিয়ে দিল দুই জনের গালে। দুই ভাই কানের পর্দা ফাটানো স্বরে কাঁদতে লাগল। ছোট্র হেনাও ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল। আলম কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সে হেনাকে কোলে নিয়ে শান্ত করতে থাকল। হালিমা আর দেরি না করে মাথায় কাপড় টেনে বাইরে বেরুল। গেন্দার মা তৈ্রিই ছিল হালিমাকে দেখে সেও পা চালায়।
-অই হাইল্মা। আজকা চাইল না পাইলে?
-ডরাইয়েন না। আজকা মনে অয় পামু।
-আইচ্ছা সরকারী গাড়ি আর দুহানের চাইলের দামের ফারাক ক্যান?
-জানিনাতো চাছি।
-তাইলে চাইলের দাম বাড়ায় কেডা? নুন দিয়া যদি দুইডা ভাতই না খাইতে পারি তাইলে কিয়ের সরকার আর কিয়ের ভোডাভুডি? ভোডে আমগো লাভ কি? আমগোর খোড়াকি তো দিন দিন আরো কমতাছে।
-এইডাও জানিনা। এত চিন্তা ক্যামনে করমু। দমই ফালাইতে পারি না।
-হ ঠিগই কইছস।আমার বুইড়া মাতায় খালি চিন্তা আইয়ে?মেসে বইয়া বইয়া রান্ধি আর হুদা চিন্তা করি।
হালিমা হেসে ফেলে। গেন্দার মার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ট্রাকের কাছে চলে আসল সে। লাইনে প্রায় ধস্তাধস্তি করে চাল পেয়েও গেল। চালটা গেন্দার মার হাতে দিতে দিতে বলল,
-চাছি চালটা বকর-আলির বাহের হাতো দিও। আর হেগোরে দেখলে একটু দেইক্ষ্যা রাইক্ষো। আমি কামে গেলাম।
-তোর ইতর পোলা দুইডারে আল্লার ফেরেস্তাও দেইক্ষা রাখতে পারবো না। আমার মাথা খাইয়া ফালাইবো।
গেন্দার মার ভীত চেহারা দেখে মজা লাগল হালিমার। সে হাসতে হাসতে দশ নম্বর শেখেরটেকের পথ ধরল। আজ ছুটি আর শুধু বেতন নিয়েই চলে আসবে সে তাই মনে আলাদা একটা আনন্দও তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল। একছুটে চারতলায় উঠেই হাঁপাতে থাকল সে।
-কি ব্যাপার কি হয়েছে?
-ট্রাকের চাল আনতে যামু কইছিলাম না? যা ভীড় আফা। যুদ্ধ করাও মনে অয় এর চেয়ে সহজ। দেড় ঘন্টা লাগল।
ইফফাত আরা হালিমাকে একগ্লাস পানি দিয়ে তার হাতে পাঁচশো টাকার চারটা নোট ধরিয়ে দিল। প্রতিমাসের মত হালিমার সারা শরীরে রিমঝিমে একটা আনন্দ দুলে গেল। টাকাটা নিয়ে সে কৃতজ্ঞ স্বরে ইফফাত আরাকে বলল,
-আর নাগা দিমু না আফা। ঈদের সময়ও ছুটি নিমু না আজকা আপনের কষ্ট অইছে না।
-আরে না।
ইফফাত আরা হাসে।
তয় জাইগা।
হালিমা ফেরার পথ ধরে। তার চলার গতি এখন আরো বেশি। পথে নেমেই তার ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে পড়ল। সাত নম্বর মোড়ের থেকে বকর আর আলির জন্য বিস্কিটের একটা প্যাকেট নিল। তারা এটা দেখলে কী খুশি হবে ভাবতেই হালিমার চোখ ছলছল করে উঠল আনন্দে। সাত নম্বর শেষ মাথায় যেতেই দেখল খালের পাড়ে একটু ভিড়। ভিড় দেখে মনে মনে বিরক্ত হল সে। আর একটু এগুতেই গেন্দার মার বিলাপ শুনতে পেল ,
পিছামাড়নিরে কইছিলাম তোর পোলাদুইডারে গেয়ে জামা-কাপর পড়াইছ। কিন্তু হে হুনে নাই। এহন খালের দেওডা তো হ্যাগোরে ঠিকি নিছেগা। প্রত্যেক বছর একটা নেয় এইবার নিল দুইডা। ইয়া আল্লাহ এই বুড়া চোক্ষে আর কত দেখমু?
হালিমা ঝিম ধরে এগুতে থাকে। এবার একটা পুরুষ কন্ঠ পেল সে।
-ছেলেদুটো পড়ল তো কেউ দেখল না!
-না ক্যামনে দেখব? দুই ভাই হাউক্কার উপরে উইঠঠা মারামারি করতে করতে পইড়া গেছে বলে। লগের পোলাপাইনরা বাইত গিয়া কইতে কইতে আর হ্যার বাফে খবর পাইয়া পানিত নামতে নামতেই শেষ বুচ্ছেন পুলিশ সাব। পোলাপাইনের দমদাই কট্টুক?
হালিমা এক ছুটে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকল। তার চোখ যাদের খুজল তারা মাটিতে নিষ্প্রাণ শুয়ে আছে।তাদের পাশে আলম শূন্য চোখে হালিমার দিকে তাকালো ।গেন্দার মার কোলে অবুঝ হেনা মাকে দেখে হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। হালিমার কোন বোধ কাজ করল না সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

বিকেল হয়ে আসছে। হালিমাকে ধরাধরি করে ঘরে এনে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। হেনার কান্নাকাটিতে গেন্দার মা তাকে মায়ের দুধ খেতে সাহায্য করে। সারাদিনের ক্ষুধার্ত হেনা খেতে পেয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে। আর হালিমার চেতনা ফিরে আসতে থাকে।
হঠাৎ ঘরের ভিতর মুখ দিয়ে কেউ একজন চিৎকার করে বলল,
-আলম ভাই নিজের পায়ে ডাশা দিয়া পিডাইয়া রক্ত বাইর কইরা ফালাইছে। হেরে ধইরা রাহন যাইতাছে না।
হালিমার কানে কথাগুলো ঠিকঠাক মত না গেলেও তার জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে আসল ।সে এক চিৎকার দিয়ে ঊঠে বসে বুক চাপড়াতে থাকল,
-আমার বাজান দুইডা। আমার কইলজার টুকরা দুইডা।
কান্নার পানি তার সারা শরীর নিংড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইল ,চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় ভাগ্যকে না মেনে নেওয়ার ক্ষোভ কিন্তু একফোটা পানি ফেলতে অক্ষম হালিমা খিচুনি দিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গা ছোট শিশুটি আবার প্রচন্ড ক্ষুধায় উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। চলতে লাগল ক্ষুধার অতি পরিচিত অতি পুরোনো নিনাদ।

………………………………………

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


18 Responses to গল্প-নিনাদ

You must be logged in to post a comment Login