তৌহিদ উল্লাহ শাকিল

সমাধান

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

মাঠের পাশে ছোট একতলা পাকা বাড়ী। দূর থেকে মনে হয় ক্যাম্পের মত।আশেপাশে কোন ঘরবাড়ী নাই,জনমানব শুন্য, পথঘাট।মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী।দিনে দিনে এখানে সেখানে  নদীতে ‘চর’ পরে যাওয়ায় আগের মত স্রোতস্বিনী আর নাই।মাঝে মাঝে দুয়েকটা স্টিমার বালু আর সিমেন্ট নিয়ে আশে পাশের গঞ্জে যায়।বাড়ীর ভেতর থেকে তখন স্টীমারের ভট ভট শব্দ শুনা যায় অনায়াসে।

গ্রাম থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন তবে গ্রামের সাথে যোগাযোগ ঠিক আছে এই বাড়ীর কর্তা জুনায়েদ মাস্টারের। জুনায়েদ মাস্টার পাড়ার হাইস্কুলে রসায়নের বি,এস,সি অনার্স পাশ করা একমাত্র শিক্ষক। গ্রামের সবাই তাকে সন্মান করে। জুনায়েদ মাস্টারের দুই মেয়ে একছেলে।ঘর সামলান একমাত্র চাচাত বোন মমিনা খাতুন।ছেলেটাকে জন্ম দেবার সময় শীলা মৃত্যু বরন করেন শহরের হাসপাতালে।তখন বিধবা চাচাত বোন মমিনা’কে নিয়ে আসেন ছেলেমেয়েদের দেখা শুনার জন্য।

বড় মেয়ে রুপা এই বছর এস,এস,সি পাশ করে স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া করছে। ছাত্রী হিসাবে বেশ ভাল। চেহারা বেশ সুশ্রী , সু গঠিত গঠন।গ্রামে এবং কলেজে এক নামে সকলে তাকে চেনে। সেই হিসাবে ছোট বোন রুমী বিপরীত ধরনের। শ্যামলা গায়ের রঙ, চুপচাপ স্বভাবের এবং শান্ত। রুমী এই বছর দশম শ্রেনীতে উঠেছে । রুপার ছোট ভাই রাসেল এই বছর পঞ্চম শ্রনী থেকে বৃত্তি পেয়ে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে।

জুনায়েদ সাহেবের যা আয় হয় তাতে বেশ ভালভাবে তাদের সংসার চলে যায়। কিছু জমি বর্গা দেওয়া আছে । তা থেকে যে ফসল আসে তাতে অনায়াসে বছর চলে যায়। মাঝে মাঝে মৃত স্ত্রীর জন্য শোক ছাড়া তেমন কোন দুঃখ জুনায়েদ মাস্টারের নাই।

নিজেদের গ্রাম পেরিয়ে অন্য আর একটা গ্রাম পেরিয়ে রুপা কে কলেজে যেতে হয় পায়ে হেটে। মেইল দেড়েক হবে । গ্রাম থেকে আর দু একটা মেয়ে যায় কলেজে । তারা সবাই একত্রিত হয় দোকান পেরিয়ে বটগাছের তলায়। তারপর সবাই একসাথে হাটে কলেজ অভিমুখে। কখনও কখনও কারো দেরী হয়ে গেলে একাই চলে যায়। নিজেদের এলাকা তারপর চেনা পথ। রাস্তা চলতে মেয়েদের তেমন অসুবিধা তেমন একটা হয়না।

কলেজে যাবার কয়েকদিন পর থেকেই একটা ছেলে রুপাকে বেশ বিরক্ত করছে । কিন্তু রুপা কি করবে বুঝতে পারছে না । তাই সে নীরব রইল। কিন্তু দিনে দিনে সেই ছেলেটির যন্ত্রণা বেড়ে চলছে। কি করবে রুপা বুঝতে পারছে না ।

রাতে খাবার খেতে বসে রুপা তার বাবাকে ব্যাপারটা খুলে বলল। জুনায়েদ মাস্টার কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তার মেয়েকে রাস্তায় একটা বখাটে  ছেলে বিরক্ত করবে তা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। মেয়েকে সাবধান থাকতে বললেন। এছাড়া ব্যাপারটা তিনি দেখবেন বলে মেয়েকে ভরষা দিলেন। কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ঠ হতে পারলেন না । মনের মাঝে কেমন যেন একটা খচখচ করতে লাগল ।

পরদিন কলেজের অধ্যাপক সাহেব কে ব্যাপারটা জানান জুনায়েদ মাস্টার। অধ্যাপক তাকে অভয় দিলেন । বললেন

আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার।আমরা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখব।

ঠিক আছে । আপনার আছেন বলেই এখন ও  ভরসা পাই।আজ তাহলে আমি উঠি ।

কিন্তু ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিল। অধ্যাপক ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কে বলেন। পুলিশ প্রশাসন ছেলেটাকে ঢেকে নিয়ে সতর্ক করে দেন। থানা থেকে ফিরে এসে সুমন সোজা রুপাদের বাড়ীতে চলে আসে। রুপা তখন কলেজে।মমিনা খাতুন সব্জী কাটছিলেন ঘরের দাওয়ায় বসে। সুমন সোজা বলে উঠল

মাস্টার সাহেব কোথায় চাচী।

ঘরের ভেতর । উনি এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।তা তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না বাপজান।

চেনার দরকার নাই। আমি মাস্টার সাহেবের সাথে কিছু কথা বলব।(বেশ উচ্চস্বরে )

এমন সময় মাস্টার সাহেব বেরিয়ে এলেন।

কি হয়েছে এখানে এত চেঁচামেচি কিসের মমিনা।

মাস্টার সাহেব আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি , থানায় কেইস টেইস করে কোন লাভ নাই । আপনার মেয়েরে আমার ভাললাগে তারে আমি বিয়ে করুম।ভালোয় ভালোয় রাজী হয়ে যান । আর যদি ব্যাপারটা নিয়ে বেশী প্যাচান তাহলে এর পরিণতি বেশ খারাপ হবে। আজ আসি। আরেকদিন আসলে জামাই আদর কইরেন । সালাম।

ছেলেটার কথা শুনে মাস্টার সাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মমিনা এসে মাস্টার সাহেব কে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন । ভাইজান মাথা ঠাণ্ডা রাখেন । আপনি বেশী টেনশন করলে প্রেসার বেড়ে যাবে।

এতদিন জুনায়েদ সাহেব  তার ছাত্রদের আদর্শ আর নীতি শিখিয়েছেন ।তার এই কস্টের কি এই ফল। পিচকি এক ছোকরা এসে তাকে শাসিয়ে যায়। এতদিনে তিনি ভাবেন আসলে তিনি কতটা অসহায় এই সমাজে। তাকে এবং তার পরিবারকে এসব ছোকরা দের হাত থেকে কে রক্ষা করবে । না এত সহজে তিনি হাল ছড়বেন না । তিনি এর শেষ দেখে নেবেন। এত দিন মেয়ের অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু করেন নি। এখন যে সেই মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় লড়তে হবে। তিনি সমাজের কাছে এর বিচার চাইবেন। সমাজ বলে তো একটা কিছু আজো আছে। বিছানায় বসে বসে এসব ভাবছিলেন জুনায়েদ সাহেব । এই সময় রুপা এল ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা নিয়ে।

কি রে মা কি হয়েছে?

বাবা । সুমন রাস্তায় আমাকে শাসিয়েছে । অনেক হুমকী দিয়েছে। বাবা আমি এখন কি করব। বাবা কাল থেকে আমি আর কলেজে যাব না ।

এদিকে আয় মা । আমি আছি না । আমি দেখছি । তোর কিছু হবে না মা । এই দেশে বিচার আচার এখনো আছে।

যাও মা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া কর। আমি এদিক টা দেখছি ।

দুই গ্রামের সকল মান্য গন্য লোকদের নিয়ে স্কুলের মাঠে সধেকেছে ডেকেছেন মাস্টার সাহেব। সুমন কে ও আনা হয়েছে সালিশে। সুমন একটা রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। সেই দলের বেশ কিছু লোক ও এসেছে সালিশে।

মাস্টার সাহেব বিস্তারিত সব খুলে বললেন একে একে । সালিশের মানুষ গুলো এতক্ষণ মনযোগ সহকারে মাস্টারের কথা শুনলেন। মাস্টার সাহেব সন্মানী ব্যাক্তি তার কোন অসন্মান হওয়া মানে সকলের অসন্মান হওয়া ।

সালিশের সকলে সুমন কে ডেকে বেশ করে সতর্ক করে দিলেন এবারের মত। সুমন একেবারে সুবোধ বালকের মত কোন কথা না বলে চুপ করে থাকল। পরিশেষে সালিশে সুমন কে জুতা পেটা করার রায় ঘোষিত হল।

কিন্তু বেড়ালের গলায় কে ঘন্টা বাঁধবে । সে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। কিন্তু সুমনের গ্রুপের লোক এই বিচার মানে না বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। সুমনের গ্রুপে বেশ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী লোক সুমন কে মাস্টার সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে বিচার শেষ করে দিল।

সুমন ভেতরে ভেতরে জ্বলতে লাগল। কিন্তু জনসম্মুখে কিছুই বলল না । তার মনে তখন অন্য চিন্তা ।

কিছুদিনের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এল । রুপা আবার নিয়মিত কলেজে যেতে লাগলা। তবে গ্রামের মেয়েরা এখন রুপার সঙ্গ এড়িয়ে চলে অজানা আশঙ্কায়। রুপা সেটা বুঝতে পারলেও কিছু বলে না ।

আষাঢ় মাস গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। জুনায়েদ সাহেব স্কুলের একটা কাজে জেলা সুপারের কাছে চলে গেছেন সাত সকালে। রুমী সকাল থেকে কাঁথা মুড়ী দিয়ে শুয়ে আছে বাবা না থাকায়। রাসেল স্কুলের হোমওয়ারক করছে পড়ার টেবিলে বসে। রুপা কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজের রুমে।

একমিনিটের মাঝে গ্রামের দোকান পেরিয়ে বট গাছের তলায় এসে দেখে একটি মেয়ে ও আসে নাই আজ । ভাবল সবাই এসে বোধহয় চলে গেছে । একবার ভাবল বাসায় চলে যাবে আর একবার ভাবলো না কলেজে যাই । বিশ মিনিটের পথ নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে । দ্বিধান্বিত মনে কলেজের দিকে পা বাড়াল রুপা । সামান্য কিছুদুর যাওয়ার পর মোটর সাইকেল টা নজরে এল। মোটরসাইকেল আরোহির দিকে তাকিয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে ভয়ে। সুমন এবং তার এক বন্ধু বাইক চালিয়ে তার দিকে আসছে । একেবারে ফাকা রাস্তা , জনমানব শুন্য।

কোনদিকে না তাকিয়ে রুপা দ্রুত পা চালাচ্ছে । খপ করে কে যেন রুপার হাত ধরে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বাইকে উঠিয়ে ফেলল। রুপা কিছু বুঝে উঠার আগে। রুপা জোরে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তার চিৎকার শুনার জন্য এই নির্জন রাস্তায় কেউ নাই। শাঁ শাঁ করে দ্রুত মোটরসাইকেল রুপাকে নিয়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই।

বিকালের মধ্য রুপা যখন কলেজ থেকে ফিরে এল না । তখন চারদিকে তার খোজ পড়ল। থানা পুলিশ চারদিকে তন্ন তন্ন করে খোজ নিল কিন্তু রুপার কোন হদিশ মিলল না।

রুপার অসহায় বাবা জুনায়েদ মাস্টার পাগলের মত এর কাছে ওর কাছে ধর্না দিতে লাগলো মেয়ের আশায় । কিন্তু রুপার খোজ কেউ দিতে পারল না ।

পরিশেষে পুলিশ নিশ্চিত করল , সুমন এবং তার দল রুপাকে কিডন্যাপ করেছে । রুপা নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে সুমন কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । এদিকে মাস্টার সাহেব নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছেন। ঘরে ভীতি এবং শোকের থমথমে অবস্থা। রুমী স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। রাসেল বাড়ীর বাইরে বেরোয় না ।

একসপ্তাহ পরে পাশের জমিদার বাড়ীর সামনে অর্ধ মৃত রুপাকে খোজে পায় ঢাকা থেকে শিক্ষা সফরে আসা একটা দল। তারা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।

গত একসপ্তাহে রুপাকে উপরযপরি ধর্ষণ করে সুমনের বন্ধুর দল এবং সুমন। পুলিশ কেইস লেখা হয় । পুলিশ রুপার জবানবন্ধি নেয় । রুপার বাবা বাদি হয়ে থানায় একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। প্রধান আসামী করা হয় সুমন কে এবং আরো নাম না জানা তার চার বন্ধুকে ।

মামলা কোর্টে উঠে কিন্তু সেখানে সুমনের আইনজীবী সুমন কে এই ঘটনায় জড়ানোর জোর নিন্দা জানায় । সুমনের আইনজীবী এটা প্রমান করে যে সুমন সেই সময় সেই এলাকায় ছিল না । এছাড়া সুমন কে গ্রাম্য সালিশের পর রুপার সাথে খারাপ আচরন করতে দেখে নি। মাস্টার সাহেব সুমনের প্রতি সন্দেহ থাকায় প্রকৃত অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এরপর শুরু হয় রুপা কে জিজ্ঞাসা বাদ। একজন নারী একবার ধর্ষিত হয় সমাজের দুরবিত্তদের হাতে , এরপর ধর্ষিত হয় মামলা পরিচালনার সময় জিজ্ঞাসা বাদের সময়। উকিল সাহেব এমন কিছু প্রশ্ন করেন যার উত্তর দেওয়া কোন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। বিনা বিভারে কোর্ট থেকে একরাশ অপমান নিয়ে বাড়ী ফিরতে হয় রুপা এবং তার পরিবারকে।

লজ্জিত রুপা কার সাথে কথা বলে না । জুনায়েদ মাস্টার তার মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।

অন্যদিকে রুপা তার এই অপমানকর জীবনের জন্য মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় । নামে মাত্র সবাই সেই রাতে খাবার খায় । রুপার মনে চলছে এক চিন্তা , জুনায়েদ মাস্টারের মনে চলছে আরেক চিন্তা । কিন্তু দুজনে জানেনা দুজনের চিন্তাই এক সুত্রে গাঁথা ।

পরদিন সকালে মমিনা যথারীতি ভাইজানের ঘর ঝাড়ু দেবার জন্য যায় । কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় সে রুপার রুমে যায় । রুপার রুম ও ভেতর থেকে বন্ধ । অনেক ডাকাডাকিতে যখন দরজা খুলে না তখন মমিনা চিৎকার দিতে থাকে । রুমি এবং রাসেল এসে দরজা ভাঙ্গার চেস্টা করে এবং অবশেষে দরজা ভেঙ্গে দেখতে পায় ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত রুপাকে।

অন্য রুমে আরেক ফ্যানের সাথে ঝুলছে তখন জুনায়েদ মাস্টারের লাশ। দুজনে খুঁজে নিলেন জীবনের অপমান এবং গ্লানী থেকে মুক্তির চির সমাধান।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to সমাধান

You must be logged in to post a comment Login