রিপন কুমার দে

“সৌদি আরবের অপার্থিব এক ভিন্ন জগৎ”

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কারাগারের এক কোনায় নিস্তব্ধ বেঞ্চিতে ঝিম ধরে বসে আছে ফারুক। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ ঝিম ধরা ফারুকের মুখে একটু হলেও আনন্দ খেলা করেছ। কারন আজ রাতে দেশের বাড়িতে কথা বলতে পারবে সে। কারাগার কর্তৃপক্ষ প্রতি বৃহস্পতিবার দেশে ফোন করার সুযোগ করে দেয় সকল আসামীকে। মায়ের সাথে মনের সকল কথা বলবে ভাবতেই ভাল লাগছে তার। অনেক কথা জমা হয়ে আছে। ফারুক সৌদি আরবে এসেছে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। দেশের প্রায় সকল জমি বিক্রির টাকা দিয়ে বদিউজ্জামান ভাইয়ের কাছ থেকে ভিসার ব্যবস্থা করে ফারুক। ভিটেটাই শুধু অবশিষ্ট রেখে এসেছিল দেশে। দারিদ্রতা তার চারপাশ আকড়ে ধরে থাকলেও এক স্বতস্ফূর্ত আনন্দ ছিল তার জীবনে। কিন্তু একটি ঘটনায় তছনছ হয়ে গিয়েছে তার সাজানো জীবন!

এই নতুন দেশে এসে অমানুষিক খাটুনি খাটছিল ফারুক এই ক’বছরে, এতটুকু সুখে আশায়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এদেশে এসেছিল সে। স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দেশে গিয়ে বিয়ে করবে, এমনি পরিকর্পনা নিয়ে নিয়েছিল প্রায়! কিছুদিন পরেই সুন্দর ছোট্ট একটি সংসার হবে তার। বিয়ের টাকা-পয়সা, গয়না-গাটিও প্রায় জমিয়ে ফেলেছিল সে। তাছাড়া বোনকে বিয়ে দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। মাযের চিকিৎসা, অনেক দায়িত্ব তার কাধে! টাকার নেশায় পেয়ে গিয়েছিল ফারুকের মনে একসময়। আরও সাতজনের একটি সৌদি গ্রুপে মিশে গিয়েছিল ফারুক। গ্রুপটি ভাল ছিল না কোনভাবেই। আগে সে বুঝতে পারেনি সেটি। কিন্তু এ দলে ভিড়ে আর বেরুতেও পারছে না সে । একদিন একটি খারাপ সিদ্ধান্ত নিল তার দলের মিশা ভাই। ডাকাতী করার সিদ্ধান্ত নিল তারা। ফারুক কোনক্রমেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। এ কাজে কোনভাবেই যুক্ত হতে চায়নি সে। সরে যাওয়ার উপায় নেই এখন। একদিন ভোরে ডাকাতী কর্ম সের ফেলল সবাই মিলে। ধস্তাধস্তীর সময় কেয়ারটেকারের পেটে ছুড়ি চালিয়ে দিল মিশা ভাই। কিন্তু বিশ্বাস কর, মিশা ভাইও এ খুন করতে চায়নি কখনই। ফারুক জানে সে তো এ খুনের জন্য দায়ী নয় কোনভাবেই। অনেকবার বারনও করেছিল সে এসব কাজ করতে মিশা ভাইকে। কেন যে এমন হয়ে গেল! কিছুই এখন সুষ্টুভাবে চিন্তা করতে পারছে না ফারুক। সবই কেমন যেন এলোমেলো। মাথাটা প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে ফারুকের। তীব্র পানির পিপাসা পেয়েছে।

কারাগারের হাওলাদারের ধমমকানি শুনে সম্বিত ফিরল তার। হাওলাদার একটি মোবাইল ফোন এগিয়ে দিল হাতে। ফারুকের চোখ চকচক করে উঠল তখন। তীব্র এক ভাললাগা শিরদাড়া বেয়ে নেমে গেল। গত ছয়দিন ধরে মায়ের সাথে কথা হয়নি। আজ কথা বলবে। মনের সাধ মিটিয়ে কথা বলবে। ১০ মিনিটে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে হবে এখন। মায়ের কথা, বাবার কথা পরীর কথা, টিয়াপাখির কথা, সব। মনে মনে সব গুছিয়ে নেয় সে তার সব কথা, যাতে এই অল্প সময়ের মধ্যে তার সকল কথা বলে ফেলতে পারে। যতবার ফোনের রিং বাজছে, প্রতিবার তার হৃদপৃন্ডে বিকট শব্দে ঢকঢক করছে।। মায়ের নিশ্বাস শোন যাচ্ছে অপাশে।

-কেমন আছিস বাবা, তুই এখন? সন্ধ্যা থেকে অপক্ষো করছি তোর ফোনটার জন্য।

-আছি মা। তুমি এখন কেমন আছ?

-ভাল না বাবা, সারাক্ষন তোর কথা মনে পড়ে বাবা! তুই কবে ছাড়া পাবি? চিন্তা করিস নে তুই! তোর চাচাকে বলেছি আমাদের বাড়িটা বন্ধকের ব্যবস্থা করতে। তোর চাচা খোজ নিচ্ছে। এখান থেকে পাঁচ লাখ টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলে সেই টাকা দিয়ে তুই যে বলেছিল একজন উকিল নিয়োগ দিতে, সেটা হয়ে যাবে দেখিস!

-মা, এ টাকা দিয়ে উকিল নিয়োগ দেওয়া যাবে না, মা? কমপক্ষে কোটি টাকা দরকার তাতে। মিছামিছি বাড়ি বিক্রি করতে যেও না! এত টাকা আমরা পাব না মা! তবে, তুমি চিন্তা করো না মা! সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখ! শুধূ দোয়া কর মা আমার জন্য। কাল শুক্রবার। শুক্রবার আসলে খুব ভয় করে মা। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাযের পরে ওরা আসামী কাটে মা। তবে তুমি আমার জন্য ভেব না তো, আমি ঠিকই ছাড়া পেয়ে যাব, দেখে নিও।– মাকে স্বান্তনা দেয় ফারুক। পাগল মাকে এভাবে না বললে তো কেঁদে কেঁদে আর রোগ বাধাবে, এটা ভালই জানে এখন ফারুক।

-তাই যেন হয় বাবা, তাই যেন হয়! মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে! জানিস, তোর পাখিটা এখন কথা বলে রে। প্রতিদিন আমি ওর সামনে গিয়ে “ফিরে আয় বাবা” বলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কথা বলতাম। আজ সে কখাটি বলা শিখে ফেলেছে রে। পাখিদের কথা আল্লাহ শুনে। তুই মন খারাপ করিস নে। তুই কোর্টে সব সত্য কথা বলবি? সব তাদের ভাঙ্গিয়ে বল, তারা বুঝবে।

আমি তাদের কথা বুঝতে পারি না মা, তাদের ভাষা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারিনি যে!! বাদ দেও মা এসব এখন। কিছুক্ষন পরই লাইন কেটে ফেলবে। পরি, কেমন আছে মা?

-ভাল রে, তোর কথাটি প্রায়ই বলে রে……..!

বাকি কথাগুলো শুনতে পায় না ফারুক। ১০ মিনিট শেষ হয়ে গেল যে। ফোন আপনাতেই বন্ধ হয়ে গেছে। অপাশ থেকে কোন শব্দ আসে না আর। তীর্থের কাকের মত কান পাতিয়ে বসে থাকে ফারুক, আরেকটু শুনার আশায়। হাওলাদার রুটি রেখে গেছে বেঞ্চিতে সেই কখন। খেতে পারে না ফারুক। তার সত্যি কেমন লাগছে আজ! কেমন যেন বিশ্রী এক অনূভতি হচ্ছে। কাল জুম্মা। মনে আবারও এক ভয়! আবার কি কথা বলতে পারবে সে মায়ের সাথে কখনও। পরীকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। মাকেও খুব। চোখে পানি টলমল করছে। এক ভয়ানক বিস্বাদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরে আছে। রাতে ঘুম হয়না তার এখন। চোখের নিচে কালি জমে আছে অনেক দিন ধরে। আবার বেঞ্চিতে গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে ফারুক। রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দেয় সে প্রতিদিনের মত আজও।

ভোর হয়ে এল! ভোরের এক চিলতে আলোর ছটা কারাগারের ছোট্ট জানালা দিয়ে মেঝেতে গলে গলে পড়ছে। যে আলো একসময় দেখতে অন্যরকম ভালো লাগত তার, অন্যরকম এক অনুভুতি হত। সেই আলো এখন দেখতে ঘেন্নায় মনটা থিতিয়ে যাচ্ছে। একটু পরই জুম্মা। আল্লার কাছে আজও করজোড়ে প্রাথর্না করবে সে। মুক্তির প্রার্থনা। আবার দেশে ফিরে যেতে চায় সে, সেই সোধা মাটির ঘরে।

জুম্মার নামাযের সময় হয়ে গেছে। আজ দুইজন সাদা আলখেল্লাধারী তাকে মসজিদে নিতে আসল কেন সে বুঝে উঠতে পারল না। তাহলে কি আজ কিছু ঘটতে যাচ্ছে? তাদের কথার অবাধ্য হয়না ফারুক। তাদের নির্দেশমত তাদের সাথে মসজিদে যায় সে। নামাজ শেষ হয়ে এল প্রায়। তীব্র এক ভয় জড়িয়ে রইল তাকে সারাক্ষন। নামাযের পরে আরও চারজন তার পাশে এসে দাড়াল। তাকে একটি খোলা ময়দানে নিয়ে গেল তারা। তার চোখ আর মাথা একটি কালো কাপড় দিয়ে বেধে ফেলল একজন। একজন ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল, ঘাড়টা একটু নুয়ে রেখ, তাতে তোমারি সুবিধে হবে!! একজন তার হাত-দুটি কোরবাণীর গুরুর মত ধরে রাখে। ক্ষিণ স্বরে “আল্লাহ-আকবর” ধ্বনি শুনতে পায় সে। তার চোখ বাঁধা এখন। পারিপাশ্বিক কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। সেই না দেখার মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পেল সে, তার মমতাময়ী মাকে, তার আদরের বোনকে। ওই তো মা, মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। দুরে বোনটি খেলা করছে। মা মাথায় বিলি কেটে যাচ্ছে। গুনগুনিয়ে গানও গাচ্ছে মা। শুনতে কি যে ভাল লাগছে! অপাথির্ব এক জগত থেকে স্বর্গীয় কোন সুর যেন ভেসে আসছে তার কর্ণকুহরে। সেই সুরের মুর্ছনা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আধ্যাত্বিক কোন এক ভুবনে! যে ভুবন থেকে কেউ পেছনে ফিরতে পারে না কখনও!

[পরিশিষ্ট: এই গল্পটিতে অন্যায়কে কোনভাবেই ছোট করে দেখা হয়নি। শুধূ, যে কোন অন্যায়েরই চরম শাস্তি মৃত্যদন্ডকে অমানবিক হিসেবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে! বিনা বিচারে ক্রসফায়ারও সমদুষ্টে পড়ে]


সন্তানের ছবি নিয়ে এ প্রতিক্ষা কি কখনো শেষ হবার??

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to “সৌদি আরবের অপার্থিব এক ভিন্ন জগৎ”

You must be logged in to post a comment Login