FILE - In this March 31, 2001 file photo, Swedish poet Tomas Transtromer poses for a photograph in his home in Stockholm, Sweden. The 2011 Nobel Prize in literature was awarded Thursday, Oct. 6, 2011 to Tomas Transtromer, a Swedish poet whose surrealistic works about the mysteries of the human mind won him acclaim as one of the most important Scandinavian writers since World War II. (AP Photo/Jessica Gow, File) SWEDEN OUT

 সুমাইয়া হানি

স্বপ্ন ছিল অভিযাত্রী হওয়ার – টোমাস

স্বপ্ন ছিল অভিযাত্রী হওয়ার – টোমাস
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

Sweden Nobel Literatureট্রান্সট্রয়মারের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ৭ এপ্রিল আমেরিকার লিন্ডা হোর্ভাথের সুউচ্চ ভবনের অ্যাপার্টমেন্টে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় লিন্ডার সঙ্গে ছিলেন তান লিন নেভিল, কুইন ও পওয়েল।

সাক্ষাৎকারটি প্রথমে ফিলাডেলফিয়ার সাহিত্য পত্রিকা Painted Bridge Quarterly-এর বিশেষ অনুবাদ সংখ্যায় ১৯৯০ সালে ছাপা হয়। তবে আমাদের উৎস এর ইন্টারনেট সংস্করণটি। সাক্ষাৎকারটি বেশ দীর্ঘ, অতএব স্থানাভাবের কারণে কেবল এর বিশেষ কিছু অংশ পাঠকদের জন্য হাজির করা হলো বাংলা অনুবাদে-

হোর্ভাথ: আমার মনে হয়, আপনার প্রথম বইটি বেরিয়েছিল ২২ বছর বয়সে। জানি না, আপনি এরপর থেকে বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন—এমনটা বোধ করেন কি না।
ট্রান্সট্রয়মার: সে রকমই মনে হয়…(হেসে)। তবে, এর মূল্যায়ন করা কঠিন। আমার নতুন বই বেরোনোর সময় সমালোচকেরা প্রায়ই যেটা বলে, তা হলো সেই একই জিনিস অথবা আমার বিকাশটা নাকি খুবই ধীরগতির। তারা একটা কন্টিনুম (continuum) খুঁজে পায়। তারা আমার প্রথম বইটা দেখে আর আমার পরবর্তী লেখাগুলোর মধ্যেও নাকি আগের জিনিসই পুনরায় দেখতে পাচ্ছে।

হোর্ভাথ: নির্বাচিত কবিতা (Selected poems) পড়ে আমার যা বলতে ইচ্ছে করছে তা হলো, আমার মনে হলো, সময় নিয়ে আপনার কবিতাগুলো আরও জটিল হয়ে পড়েছে।

ট্রান্সট্রয়মার: এটা সত্য হতে পারে, তবে আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন ভাষিক স্তরে আমি অনেক বেশি জটিল ছিলাম। এটা অনুবাদের ক্ষেত্রে সামনে আসে না, তবে আগের কবিতাগুলো ছিল অনেক বেশি ঘনীভূত আর এখনকার তুলনায় তাতে অনেক বেশি ঐতিহ্যবাহী ছন্দরীতি ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে হয়, আগের এই কবিতাগুলো অনুবাদ করা অনেক বেশি কঠিন। ইংরেজি অনুবাদে আপনি আসলে একটা সরলীকৃত রূপ পাচ্ছেন। পরের কবিতাগুলো অন্তত ভাষিক স্তরে—অনুবাদ করা অনেক সহজ। একটা পার্থক্য হচ্ছে…
আঁধার ও আধেয় নিয়ে কথা বলতে আমি ঘৃণা বোধ করি—তবুও বলি (হেসে)। আমার মতে, পরবর্তী কবিতাগুলো অনেক বেশি জটিল। কারণ ওগুলোতে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন আমার বয়স ৫৭। সেই ২৭ বছরের মানুষটির সঙ্গে আজকের ৫৭ বছরের মানুষটির একটা বড় পার্থক্য আছে। সমগ্র জীবন, সমাজ—এ সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে আমার পরের কবিতাগুলোতে রয়েছে। প্রথম বইটিতে আমি ছিলাম একেবারেই তরুণ, আর আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল প্রকৃতি আর শৈশবের সঙ্গে। তবে সেটা ছিল সীমাবদ্ধ বহির্জগৎ।

হোর্ভাথ: আপনার কাজের যে বিষয়টি আমাকে আকর্ষণ করে, তা হলো আপনার বৈশ্বিক (Global) সচেতনতা। আপনার বিশ্ববেদনা বোধের অনুভূতিটা আমি পাই। ‘Sketch in October’ কবিতায় আমি ব্যাঙের ছাতার রূপকটি দ্বারা খুবই অভিভূত হয়েছিলাম: ‘the Fingers, stretching up for help of some one who has long sobbed to himself in the darkness down there’—শান্তির জন্য এক জরুরিত্বের অনুভূতি আমার হয়েছিল। কবিতা যদিও রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং তা মানবিক। আপনি কি এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

ট্রান্সট্রয়মার: আপনি সুন্দর কিছু বিষয় বলেছেন। আপনাকে আমি বাধা দেব না (হাসি)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমি বেড়ে উঠেছি। এটা আমার জন্য সাংঘাতিক রকমের প্রবল অভিজ্ঞতা। সুইডেন যদিও নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল, তবে জার্মানি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল—নরওয়ে অধিকৃত অবস্থায় ছিল। ডেনমার্কও তাই। সুইডেন স্বাধীন ছিল, তবে একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নও ছিল। সুইডেনের জনগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল—একদল ছিল মিত্রশক্তির পক্ষে, অন্য দল জার্মানদের পক্ষে। শৈশবে এই মানসিক চাপ প্রবলভাবে অনুভব করেছি। মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয় এবং আমি মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়স্বজন ছিল। তারা ছিল খুবই হিটলারবিরোধী, আর আমি ছিলাম মিত্রশক্তির জঙ্গি সমর্থক। আমি তখন ক্ষুদ্র অধ্যাপকের মতো এক ছোট্ট বালকটি ছিলাম—যেমনটা ওই বয়সের বালকদের হওয়ার কথা নয়। সারাক্ষণ আমি লোকজনকে লেকচার ঝেড়ে যেতাম। আমি সংবাদপত্র পড়ে যুদ্ধের ঘটনাবলি নিবিড়ভাবে লক্ষ করতাম।

আমার স্বপ্ন ছিল অভিযাত্রী হওয়ার। আমাদের হিরো ছিলেন লিভিংস্টন ও স্ট্যানলির মতো লোকজন। কল্পনায় আমি সব সময় আফ্রিকা এবং পৃথিবীর অন্য সব অঞ্চলে চলে যেতাম। কিন্তু বাস্তবে আমি থাকতাম স্টকহোমে, আর গ্রীষ্মকালগুলোতে আমরা চলে যেতাম আর্কিপেলাগোতে সেসব দ্বীপপুঞ্জে, যা ছিল আমার স্বর্গ। যুদ্ধের পর আমি অবশ্যই যেতে চাইতাম বাইরে, পৃথিবীকে দেখতে। আমার মা সারা জীবনে বাইরে কোথাও যাননি, কিন্তু আমি যেতে চাইতাম। স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গে ১৯৫১ সালে আইসল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আমি যখন ফিরে এলাম, তখন আমি গরিব, কপর্দকহীন। ১৯৫৪ সালে আমার প্রথম বইটি বের হয় এবং একটি পুরস্কারও জুটে গেল। পুরস্কারের টাকাগুলো প্রাচ্য ভ্রমণে ব্যবহার করেছিলাম—তুরস্ক, নিকট প্রাচ্য। এই দেশগুলো সে সময় মোটেই পর্যটক-দেশ ছিল না; বিশেষ করে, তুরস্ক তো নয়-ই। আমার কাছে ওটা ছিল সত্যিকারের এক অভিযান। আজকাল তরুণেরা পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে—যেমনটা আমি করেছিলাম। এখন তো এটা একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। পৃথিবীর সঙ্গে মোলাকাত করাটা আমার কাছে ছিল খুবই প্রবল এক অভিজ্ঞতা। আমার দ্বিতীয় বইয়ে ওই সময়ের কিছু কবিতা আছে। একটির নাম ‘Siesta’, আরেকটির নাম ‘Izmir at three O’clock’। ১৯৫৪ সালে আমি তুরস্ক ও গ্রিসে ছিলাম। ’৫৫ সালে ছিলাম ইতালি ও যুগোস্লাভিয়া, ’৫৬ সালে ছিলাম মরক্কো, স্পেন আর পর্তুগালে। তখন থেকেই আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। তবে ইদানীং কেবল নিমন্ত্রিত হলে যাই, কিছু করার থাকলে যাই। রাজনীতিতে আমার খুবই আগ্রহ আছে, তবে তা আদর্শগত ধরনের চেয়ে বরং মানবিক ধরনেই বেশি।

নেভিল: আপনি যে নিজেকে পর্যটক বলে মনে করেন—এই অনুভূতিটা আমি আপনার কবিতা থেকে পাই না। আপনি পুরোপুরি শেকড়ায়িত, সুইডেনে এর আবহাওয়ায় ইত্যাদিতে। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?

ট্রান্সট্রয়মার: মনে হয় আমি ভূদৃশ্য, প্রকৃতি, অভিজ্ঞতাগুলোতে প্রোথিত…। আপনি আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা যারা কবিতা লিখি, তাদের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর সুইডেনে আমাদের সবার কাছেও তা গুরুত্বপূর্ণ। খুবই অদ্ভুত আলো। আমরা বেশ উত্তর দিকে অবস্থান করছি, তবে গাল্ফ স্ট্রিমের কারণে আবহাওয়া বরং কোমল, কিন্তু আলো সুমেরু ধাঁচের, যা কেবল পৃথিবীর এই অঞ্চলেই দেখা যায়। আমাদের গ্রীষ্মগুলো পুরোপুরি আলোকোজ্জ্বল, আর শীতকালগুলো নিবিড় অন্ধকারে ছাওয়া।

নেভিল: হ্যাঁ, দীর্ঘ এবং অন্ধকার। আপনার চমৎকার কিছু গ্রীষ্মকালীন কবিতা আছে। গ্রীষ্মের স্বস্তিমূলক অনুভূতিটা খুবই প্রবল। আপনি এর আগে বলেছিলেন, আপনি যখন বেশ তরুণ, তখন মূল বিষয় ছিল সুইডেনের প্রকৃতি আর বহির্জগতের সঙ্গে একটা খুবই ভালো সম্পর্ক। আপনার কবিতায় আমি আপ্লুত ছিলাম—যদিও সেগুলো ব্যক্তি বা অন্তর্গত জীবনকে ঘিরেই অনেক বেশি গড়ে উঠেছে। তার পরও এর মধ্যে বেশ বহির্মুখী গুণও আছে। আসলে আপনার কবিতাগুলোয় অভ্যন্তরীণ বিষয় খুব কমই। ‘Vermeer’ হচ্ছে আপনার সেই অল্পকিছু কবিতার একটি, যেটাতে মনে হয়, আসলে আপনি অন্তর্গত, এক স্টুডিও এবং পানশালার মধ্যে। কিন্তু আমার ধারণা, ‘Elegy’-তে, এমনকি আপনি যখন ঘরের মধ্যে হাঁটছেন, আপনার মনোযোগ তৎক্ষণাৎ চলে যাচ্ছে ঘরের বাইরে, জানালার দিকে কিংবা উদ্যান-পথ এবং পথের ভিড়ের দিকে। আপনি কি এ নিয়ে কিছু বলবেন? এটা আমাকে অদ্ভুত রকমে আকৃষ্ট করেছে যে আপনার আগ্রহ অভ্যন্তরের দিকে, কিন্তু আপনার দৃষ্টি সব সময়ই বাইরের দিকে।

ট্রান্সট্রয়মার: আমার ক্ষেত্রে সম্ভবত ওভাবেই অনুপ্রেরণা কাজ করে—একই সঙ্গে দুই জায়গায় অবস্থান করার অনুভূতি বা সচেতন হওয়ার এই অনুভূতি যে আপনি যেখানে আছেন তা খুবই আবদ্ধ, কিন্তু আসলে সব সময়ই উন্মুক্ত। জানি এটা অস্বচ্ছ, তবে এটা সামগ্রিক অনুপ্রেরণার ব্যাপার, যা আমার জন্য কবিতার জন্ম দেয়।

নেভিল: আমি যে ব্যাপারটায় কৌতূহলী ছিলাম, তা হলো আপনার নেপথ্যে এমন কী ছিল, যা আপনাকে প্রত্যাহার, আত্মজ্ঞানবাদ ও বিচ্ছিন্নতার বিপদ থেকে পালাতে সাহায্য করেছে?

ট্রান্সট্রয়মার: (দীর্ঘ সময় চুপ থাকলেন) আমি খুব ভালো মা পেয়েছিলাম (হাসলেন)।

নেভিল: আমি আশা করেছিলাম, আপনি এ রকমই কিছু বলবেন।

ট্রান্সট্রয়মার: হ্যাঁ, আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিন ছিলেন প্রাথমিক (Elementary) স্কুলের শিক্ষিকা, আর ছিল চমৎকার দাদা-দাদি। দাদা ছিলেন জাহাজের পাইলট। তাঁরা আমার খুব ঘনিষ্ঠ। হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমার প্রতি মূল সমর্থনটা ছিল। আবার একই সঙ্গে আমি ছিলাম খুবই নিঃসঙ্গ। আমিই ছিলাম একমাত্র শিশু, আর আমার আগ্রহগুলোকে বিকশিত করার জন্য তাঁরা আমাকে সারাক্ষণ উৎসাহিত করতেন। আমার প্রায়ই মনে হয়, বিশেষ আগ্রহসম্পন্ন ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে, কারণ মা-বাবা চান, তারা যেন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তারা যেন অন্য সব শিশুর মতোই হয়ে ওঠে, খেলাধুলা করে ইত্যাদি।
শৈশবে আমি বয়স্ক সরল ছেলেমেয়েদের দ্বারা আহত হতাম। আমি নিজেকে বেড়ে ওঠা শিশু ভাবলেও আমাকে ওরা সেভাবে মেনে নিত না। ওরা আমাকে শিশুভাবেই আচরণ করত, আর আমি তাতে অপমানিত বোধ করতাম। তবে আমার ঘনিষ্ঠজনেরা, যাঁরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা আমার ব্যক্তিত্বকে সব সময়ই খুব সহ্য করে নিতেন। অবশ্য স্কুলটা কঠিন ছিল। কিছু শিক্ষককে আমি ভালোবাসতাম, আবার কিছু শিক্ষক ছিলেন যাঁদের আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। আমার শৈশব মনে হয় মোটের ওপর সহজ ছিল না। তবে আমি অতটা খারাপও ছিলাম না। ১১-১২ বছর বয়সে আমার মধ্যে প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো পোকামাকড় সংগ্রহের। জীববিদ্যা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সব সময়। বিশেষ করে গুবরেপোকা সংগ্রহ করেছিলাম—বেশ বড় একটা সংগ্রহ ছিল আমার। প্রজাপতি ধরার জাল নিয়ে সারাক্ষণ বাইরে কাটাতাম।

নেভিল: আপনার কবিতায় প্রচুর প্রজাপতি, তবে খুব বেশি গুবরেপোকা বা অন্য পোকামাকড় আছে বলে মনে হয় না।
হোর্ভাথ: The Golden wasp?

ট্রান্সট্রয়মার: মনে হয় এটার মধ্যে গুবরেপোকা আছে—অবশ্যই আছে। On the humming electricity post a beetle is sitting in the sun, Beneath the shining wing covers. Its wings are folded up ingeniously as a parachute by an expert. (The clearing) এই তো একটা গুবরেপোকা।

আপনি যদি পোকামাকড় সংগ্রহে আশপাশে ছোটাছুটি করেন, আর প্রকৃতির সবকিছুর দিকে তাকান, তাহলে তো এক সুখী অস্তিত্বের বোধ চলে আসবে। প্রকৃতি কেবল মেজাজ ফিরে পাওয়ার জায়গা নয়, এটা সেই জায়গা, যেখানে আপনি গভীর অনুসন্ধান চালাবেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য—ঝিনুক, পোকামাকড়, পাখপাখালি আমি শৈশবেই পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি একে সুন্দর হিসেবে দেখিনি, কারণ আমি নিজেকে বিজ্ঞানী মনে করতাম (হাসি)। যা-ই হোক, এটা আমার মধ্যে ঢুকে গেছে।

হোর্ভাথ: আপনার কি অন্য বিশেষ কোনো আগ্রহ আছে?

ট্রান্সট্রয়মার: হ্যাঁ, ইতিহাসে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। প্রচুর ইতিহাস পড়েছি। এখনো পড়ি। ১৩-১৪ বছর বয়সে সংগীত আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংগীতে দুর্দান্ত আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।…এখনো সেটা ধরে রেখেছি।

নেভিল: নিজে বাজান?

ট্রান্সট্রয়মার: হ্যাঁ, আপনার পিয়ানো আছে কি না তা দেখছিলাম…।

হোর্ভাথ: বুঝতে পারছি না কীভাবে আপনি আপনার কবিতার চমৎকার চিত্রকল্পগুলো পেয়ে যান।
ট্রান্সট্রয়মার: চিত্রকল্পগুলো প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে। আমি যখন কোনো একটা বিষয় নিয়ে কাজ করি, তখন চেষ্টা করি পাঠকের কাছে তাকে যথাসম্ভব স্পষ্ট করার। স্বপ্ন দেখার মতো, এ ধরনের বিষয়গুলো সব সময়ই চলে আসে।

হোর্ভাথ: স্বপ্নগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার চেষ্টা করেন?

ট্রান্সট্রয়মার: হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে। প্রচুর স্বপ্ন দেখি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সবকিছুই খুব দ্রুত ভুলে যাই।

হোর্ভাথ: তাহলে ওগুলো লিখে রাখার জন্য ঘুম থেকে রাতের বেলা জেগে ওঠেন না?

ট্রান্সট্রয়মার: না, ওটা করার স্বভাব আমার নেই। আমি ঘুমাতে চাই (হাসি)। তবে, যেটা হয় তা হলো, স্বপ্নগুলো এতই প্রবল যে আমি ওগুলো দেখে যেতে থাকি। পরে তারা কবিতা হয়ে ওঠে।

কুইন: আপনার প্রকাশিত কবিতার কোনোটি কি এ পর্যন্ত পরিবর্তন করেছেন?

ট্রান্সট্রয়মার: না, সুইডিশ ভাষায় মুদ্রিত গ্রন্থে নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে আর এ রকম নেই।

কুইন: মৃত্যুশয্যায় নিজের রচনাসমগ্র সংশোধনকারী ইয়েটসের কথা ভাবছিলাম।

ট্রান্সট্রয়মার: নাহ্। ওটা করতে আমি ঘৃণা করব। পুরোনো কবিতাগুলো হচ্ছে পার হয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের মতো। এত দূরের কবিতা সশব্দে পড়ার প্রেরণাও আমার খুব কম।

কুইন: রবার্ট ব্লাই সম্প্রতি তাঁর নির্বাচিত রচনাসমগ্র কবিতাগুচ্ছকে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জানি না, আপনি এ রকমটা কখনো ভেবেছেন কি না।

ট্রান্সট্রয়মার: না, না। এ তো ভয়ংকর ভাবনা (হাসি)।

পওয়েল: সে ক্ষেত্রে ওসব পুড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে আপনার কী মত? বোর্হেস তো বছরের পর বছর তাঁর আদি রচনাগুলো পুড়িয়ে ফেলছিলেন।

ট্রান্সট্রয়মার: পোড়ানো ঠিক আছে (হাসলেন)। কিন্তু ২৫ বছর আগে লেখা কবিতা নিয়ে আবার শুরু করা—এটা পাগলামি।

টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা

অনুবাদ: আজীজ রহমান

জনমানববিহীন সুইডিশ বাড়িগুলো

কুয়াশার ঘোমটা পরা জ্যোৎস্নার নিচে
জঙ্গলের আঙুলের ফাঁকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে
দু-চারটা ছিমছাম বাড়ি
আশপাশে কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই

রৌদ্রাঘাতে শিশির ভাঙতে থাকে, সেই শব্দে
ঘুম থেকে জেগে কোনো অশীতিপর
যতক্ষণ না কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা জানালা
একটু খুলে দেবে আর সেই ফাঁকে
বেরিয়ে যাবে এক নিশাচর পেঁচা

অল্প দূরে একটা সদ্য নির্মিত বাড়ি
ফিটফাট সেজেগুজে বেড়াতে বেরিয়েছে
সারা রাত নাক দিয়ে
সে কেবল ছাড়ছিল ধোঁয়া
পথের দুই ধারে বুড়ো গাছ ঝিম ধরে
অপেক্ষা করছে কখন আসবে কলের করাত

তখন গ্রীষ্ম আসবে সঙ্গে নিয়ে এলোমেলো ঝড়
এলোকেশী বৃষ্টি আসবে শ্যামল ধারায়
বিদ্যুৎ চমকালে চঞ্চল হবে পালিত কুকুর
ভেজা মাটি চিরে উঁকি দেবে নতুন অঙ্কুর

উচ্চকিত কণ্ঠস্বর, হাসি কলরব
রুদ্ধদ্বার খুলে উড়ে যাবে দেশান্তরে
টেলিফোনে তারে ও ইথারে
নদীতীরে, দ্বীপের ওপরে পরিত্যক্ত বাড়ি
ভিত ভেঙে দাঁড়াবে উঠে
অরণ্যের গোপন দলিল পুড়ে ধোঁয়া হয়ে মিশে যাবে মেঘে
পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির ধারা
বাড়ির শরীরে দেবে প্রচণ্ড নাড়া

হেমলাইটার পা ফাগেন (গোপন কথাটি, ১৯৫৮) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

প্রবাসী বন্ধুকে

তোমাকে আমি লিখি কদাচিৎ। কিন্তু যা লিখতে পারি না
সে সব কথা আমার ভেতরে ফুলতে থাকে, বেলুনের মতো,
ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শেষে আমাকে নিয়ে যায় নৈশ আকাশে।


আমার চিঠিটা সেন্সরের হাতে। এখন সে জ্বালিয়েছে বাতি
যার তীব্র আলোয় আমার শব্দগুলো শুধু লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে
লোহার খাঁচায় বন্দী শাখামৃগদের মতো একই প্রক্রিয়ায়
কিচিরমিচির শব্দ করছে, থামছে, আবার দাঁত মুখ খিঁচছে।


লাইনের ভেতরে পড়ো। আমাদের দেখা হবে ২০০০ বছর পরে
যখন অবশেষে হোটেলের দেয়ালে লুকানো মাইক্রোফোনগুলো
চুপ হয়ে যাবে, ঘুমিয়ে পড়বে কিংবা পরিণত হবে কোনো
প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ফসিলে।

স্টিগার (পথ চলা, ১৯৭৩) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to স্বপ্ন ছিল অভিযাত্রী হওয়ার – টোমাস

You must be logged in to post a comment Login