রিপন কুমার দে

মুভি রিভিউঃ থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার

মুভি রিভিউঃ থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আজ সময় সুযোগ পেয়ে স্টেজভুউ তে দেখে নিলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার”। আপাতদৃষ্টিতে আমার ভাল লেগেছে সন্দেহ নাই। ছোট দাগে মানুষিক টানাপোড়েন আর অসহায় নারীর বাধ্য হয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করার কাহিনী নিয়ে ছবি “থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার”। মোশাররফ আর তিশার স্বভাবসুলভ ভালো অভিনয়। যথারীতি আবুল হায়াতের অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনয়। রুবার গায়ক বন্ধুর চরিত্রে বেমানান তপু। এ চরিত্রে আমার মনে হয় চন্ঞল মানাতো ভালো। হয়তো মেকার চরিত্রের চাহিদা থেকে বন্ধুবাৎসল্য এবং গানের কেমিস্ট্রিকে বেশি প্রায়রিটি দিয়েছেন। রুবার বোনের চরিত্রটি আমার কাছে সাবলীল মনে হয়েছে। কাহিনীবিন্যাসক দক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন নিসন্দেহে। বেশিরভাগ কারেক্টারের অভিনয় গতানুগতিক। কয়েকটি দৃশ্যে অযোচিত বাহুল্যের মেকি চেষ্টা। মুভির গানগুলো মানানসই হলেও আবহ সংগীতে তেমন বিশেষত্ব নেই। তবে বেশ কিছু সংলাপ চমৎকার। মুভির সবচেয়ে বড় দূর্বলতা নাটকসুলভ সিনেমাটোগ্রাফি। অন্যদিকে নতুনত্ব দেখাবার প্রচেষ্টা কল্পনার উপস্থাপনে। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “থার্ড পারসন সিঙ্গলার নাম্বার” ক্যনভাসে নিজের মুন্সিয়ানার পূর্ণ পরিচয় দিতে পারেননি যেরকমটা আমার প্রত্যাশা ছিল। হয়তো উনার মত খুব ভাল মেকারের কাছ থেকে আরও বেশি এক্সপেক্টশেন ছিল। অবশ্য সবমিলিয়ে বাংলা ছবির প্রেক্ষাপটে মুভিটি উপভোগ্য বলা চলে তবুও ধয্যং ধরানং আবশ্যকং!

প্রথমেই তথ্যসূত্র। গত ১১ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। ছবির কাহিনীকার আনিসুল হক, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, অভিনয়শিল্পী তিশা, মোশাররফ করিম, তপু, আবুল হায়াৎ ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্যান্য টীম। উল্লেখ্য যে  ফারুকী এবং লেখক আনিসুল হক যৌথভাবে ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের তথাকথিত মূলধারার চলচ্চিত্রের গতানুগতিক কাহিনী ও সিনেমাটোগ্রাফী নিয়ে মধ্যবিত্ত দর্শকের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। তবে তাদের রুল-রুচির সাথে মানানসই ভিন্নধারার শৈল্পিক ও বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রও আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না, তা না। ইদানীং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত দর্শক কোন কোন ছবি দেখার জন্য দল বেঁধে সিনেমাহলে ঢুকছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটি তার মধ্যে হয়তো একটি।

এটাকে চিন্তাশীল ও বিশ্লেষণী ছবি হিসেবে আখ্যায়িত না করলেও, ছবিটির বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর খুটিনাটি বিভিন্ন দিকের জন্য ভালো লেগেছে। ফারুকী মূলত ভোগবাদী সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এখানে অর্থাৎ বর্তমান পরিবেশে একজন অবিবাহিতা নারীকে যে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এই ছবিটির মধ্য দিয়ে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে প্রৌঢ়দের অসংযত আচরণের দৃশ্যগুলিতে রুরার কৌতুকপূর্ন অভিলাশ একজন বাস্বব অসহায় মেয়ের পরিস্থিতির গুরুত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। আবুল হায়াতের সিড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অনেকটা বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হয়েছে। রুবাকে মাঝেমাঝে সাহসী মেয়ে আবার পরক্ষনেই অসহায় মেয়ের কারেক্টার দিয়ে মুন্ডিয়ে দেয়া হয়েছে যা মুল থিমের সাথে বেমানান বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। ঠিক যেমন রুবার বাস্তবতাবিবর্জিত স্বচ্ছল এবং স্বস্তিপূর্ণ জীবন কামনা করিনি (তপুর পারসপেক্টিভ ঘটনা)। তাছাড়া একটি টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে যাওয়া অসহায় মেয়ের পরিশীলিত পোশাকশৈলী অপরিপক্ক বলে মনে হয়েছে। চলচ্চিত্রকে চিত্তাকর্ষক করতেই বোধহয় পরিচালক এই কাজগুলো করেছেন।

ছবিটির ভালো লাগা দিকগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। ছবিটিতে দু’জন সঙ্গীর (তপু এবং মোশাররফ) মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার ব্যাপারে রুবার মধ্যে মানসিক টানাপোড়েনটা প্রদর্শনের জন্য মাল্টিপল পাসোর্নালিটির এডিশনটা (সো আদতে থার্ড পারসন প্লুরেল নাম্বার) ছবিটিতে একটা ভিন্ন আঙ্গিক দেয় নিসন্দেহে। তিশার মৃত মায়ের সাথে তিশার পরলৌকিক যাপিত ছবি (যে সপ্ন টা দেখে পুকুরের পাশে দাড়িঁইয়ে) পরিচালকের ভিন্নধর্মী সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয়। প্রথমবস্তায় নিজের মায়ের সাখে কর্কশ ভাষায় কথা বলা রুবা শেষে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় মায়ের ভুমিকাকেই প্রতিষ্টা দিতে চায়। মায়ের সাথে ছাদে রুবার কথোপকথনের দৃশ্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে, মায়ের চরিত্র রূপদানকারী কারেক্টারের অপরিপক্ক আড়ষ্ঠ অভিনয় বিরক্তির উদ্রেকই করেছে শুধু। এই গুরুত্তপূর্ণ চরিত্রে মহিলার সাবলিল অভিনয় প্রত্যাশা ছিল।

মূল কাহিনী: ফারুকী’র এই চলচ্চিত্রে রুবা একজন অবিবাহিতা নারী, যে মুন্না’র সাথে বসবাস করতো। কিন্তু হঠাৎই খুন করার অভিযোগে মুন্নাকে জেলখানায় বন্দী হতে হয়, আর তখনই একলা নারীর জন্য এই সমাজ কতটা সমস্যাসঙ্কুল তা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রুবা’র কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রুবার পুরনো বন্ধু তপু এক সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, এবং ক্রমশ রুবা তপু’র প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে। রুবার মধ্যে মানসিক টানাপোড়েনটা প্রকাশ এবং পরিণিতি পায় মাল্টিপল পাসোর্নালিটির কথোপকথনের মাধ্যমে।

এক পর্যায়ে তপু-রুবা একই ফ্লাটে থাকছে, আলাদা আলাদা রুমে। রাতের বেলা প্রথমাংশের এই সব বৃদ্ধদের মতই মিলনের ইচ্ছায় তপু রুবার রুমের সামনে ঘোরা ঘুরি করে, মাঝে মাঝে দরজা নক করে। রুবা সবই বুঝে কিন্তু সরাসরি সম্মতি দেয় না। ঠিক পরের দৃশ্যে, একই উদ্দেশ্যে রুবাকেও ঘোরা ঘুরি করতে দেখা যায়। ঠিক এই মূহুর্তেই রুবার সামনে হাজির হয় তার ১৩ বছরের মন। রুবাকে তপুর প্রতি শারিরিক আকর্ষণ হতে দূরে রাখতে রুবার মনের এক অংশ সবসময় রুবার সাথে ঝগড়া করতে থাকে। এই সমস্যায় রুবা মানসিক চিকিৎসকেরও কাছে যায়। প্রথমে মাঝে মাঝেই রুবা মুন্নাকে দেখতে যেত। কিন্তু চাকরি এবং তপুর কারনে সেটা ধিরে ধিরে কমতে থাকে, একপর্যায়ে মুন্নাই আর রুবার সাথে দেখা করতে চায় নায়। তপু রুবাকে পাবার আকাঙ্খা বার বার প্রকাশ করে যায়। রুবা বোঝে এবং এটাকে সে কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্য বলে মনে করে না, যেমনটা সে প্রথমের বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মনে করত। উলটা রুবা নিজেই তপুর আহ্ববানে সাড়া না দেবার কারনে অস্বস্থি বোধ করে। এক পর্যায়ে রুবা তপুর আকাঙ্খাতে সম্মতি জানিয়ে তপুকে তার ঘরে আসতে বলে। তপু লাফাতে লাফাতে হাজির হয় রুবার ফ্লাটে। গিয়ে দেখে রুবা নাই। রুবা আবার তার ১৩ বছরের মনের প্রভাবে তপুর কাছে নিজেকে সমর্পনে অসম্মতি জানায়।

আমর ক্রমশঃই ধারণা হচ্ছে যে সিনেমাটোগ্রাফীতে ফারুকী তার নিজস্ব একটি গন্ডিবদ্ধ অবস্থানে আটকে যাচ্ছেন। তার এই সিনেমার কাহিনীতে আমাদের নাগরিক জীবনের প্রেক্ষাপটে কিছু পরীক্ষামূলক কাজ করার চেষ্টা করলেও সেগুলো তার স্টেরিওটিপিকাল কাঠামোর বাইরে যেতে পারেনি। ছবিটির শেষাংশের অন্য নাটক/মুভিগুলোর মত সম্পর্কগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি এ বিষয়কে আরো বেগবান করে।

ছবিটা যেভাবে শুরু হয়েছে পরবর্তীতে তা সেভাবে পূর্ণতা নিয়ে এগোয়নি। কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া একটা মেয়ে কেন মাঝ রাত্রে পথে নেমে পড়বে তা বোধগম্য নয়। রুবা শিক্ষিত, সংস্কৃত। তার উচ্চ পর্যায়ের বন্ধু-বান্ধবও আছে। তাদের কাউকে ফোন করে নিয়ে যেতে বললেই চলত। আমার মনে হয় দর্শকের কল্পনাকে উসকে দিতেই এই দৃশ্যগুলো সাজানো হয়েছে। বলাবাহুল্য মোশাররফ করিম এখন টাইপড। যেভাবেই হোক তাকে সে রকমই দেখাতে হবে- এই প্রবণতা হালের পরিচালকদের মধ্যে দৃশ্যমান। মোশাররফের বাবা নিরাবেগ রোবটের মত যে রকম যাত্রার ঢঙে শাসন করলেন তা কাহিনীবিন্যাসকে খাপছাড়া করে। হঠাৎ করে তপুর মত প্রতিষ্টিত কারো আগমন অনাকাঙ্খিত ও দৃশ্যত আরোপিত। সর্বোপরি ছবির আখ্যানভাগ বাস্তবতা বর্জিত বলেই আমি মনে করি।

সাম্প্রতিক তথ্য: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটির জন্য ফারুকী সেরা পরিচালকের পুরষ্কার পেয়েছেন। ৮৩তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) প্রতিযোগিতায় ‘বিদেশি ভাষার ছবি’ বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটি [সূত্র: প্রথম আলো]। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবার ছবিটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এবার তিনটি ছবি জমা পড়ে। ছবিগুলো হলো জাগো, গহিনে শব্দ ও থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। এর মধ্য থেকে নয় সদস্যের অস্কার বাংলাদেশ কমিটি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটিকে চূড়ান্ত করেছে।

টক শো:

ছবিটির একটি গান:

ফারুকীর ভাষ্য:

শেষকথা: যারা এখনও দেখেননি,  দেখার জন্য অনুরোধ করছি। লিংকটা নিচে দিয়ে দিলাম (তবে কপিরাইট আছে কিনা জানি না, ক্ষমা করবেন)। বলা যায়না আলসেমির জন্য আমার মত প্রথম প্রথম খোজাখোজির ঝামেলার মধ্যে নাও যেতে পারেন।

১. সম্পূর্ণ ছবি (হাই কোয়ালিটি)
২. সম্পূর্ণ ছবি
৩. ১২ মিনিটের সামারী

সর্বশেষে অযুত শুভাশিষ সকল শৈলারকে। ভালো থাকবেন।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to মুভি রিভিউঃ থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার

You must be logged in to post a comment Login