নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত (প্রথম অধ্যায়)-৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

মনে একটা বিষণ্ন ভাব নিয়ে জাহিদ জাহাজে ফিরে এসে দেখে মিজান, মহসীন ওরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে সেলুনে বসে টিভি দেখছে, এরামকো চ্যানেলে একটা ডকুমেন্টারি ছবি চলছে, ওর প্রিয় ছবি কিন্তু আজ কোন আগ্রহ নেই। সেলুনে উকি দিয়ে দেখেই ফিরে এলো নিজের রুমে। পিছন থেকে মিজান ডাকল কিন্তু তার কোন জবাব দিল না। কাপড় বদলে গরম জলে ঝারা একটা গোসল দিয়ে খেয়ে দেয়ে এসে বসল সেলুনে। এর মধ্যে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।

সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওদের সাথে টিভি দেখলো। মহসীন বার বার জিজ্ঞেস করলো কি কি করলে, কোথায় গেলে কিন্তু তার কোন জবাব নেই। ওরা আর চাপাচাপি করলো না। জানে জাহিদ মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়, তখন হাজার ডাকাডাকি করেও ওকে ফেরান যায় না, আপন মনেই বিভোর হয়ে থাকে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত টিভি দেখে উঠে এলো। বারোটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি, ডিউটির পোষাক পরতে হবে।
তার পরে ওরা বাহরাইনে তিন দিন ছিল এর মধ্যে আর কোথাও যায়নি।

তৃতীয় রাতে সিতরা ট্যাঙ্কার বার্থের আউটার এঙ্কারেজে এসে নোঙ্গর করলো। আধা ঘন্টা পর পাইলট এসে জাহাজ জেটিতে নিয়ে গেল। এই জেটি কিনারা থেকে দশ মাইল সমুদ্রের দিকে। জেটিতে ভেরার পর ট্যাঙ্কে গ্যাস আছে কিনা বা পাইপ লাইনে কোন লিক আছে কি না, লিক করে সমুদ্রে তেল ভেসে যাবে কি না তা দেখার জন্য জেটি কর্তৃপক্ষের লোক জন এলো, তাদের সাথে হাই হ্যালো করে সাথে নিয়ে দেখাল। একটু পরেই আবার আসবে ইমিগ্রেশন, কাস্ট।মের লোকজন, তাদের অপেক্ষা। এই দেশে ওদের কোম্পানির হেড অফিস, তাছাড়া এখানে ওরা প্রায়ই আসে বলে কাস্টম ইমিগ্রেশন তেমন কোন ঝামেলা করে না। এখানে ওদের কোম্পানির বেশ ভালো প্রভাব

শুধু নিয়ম পালনের জন্য এসেই কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর করে চলে যায়। তবুও এই ফরমালিটি গুলি শেষ না হলে জাহাজ লোড শুরু করতে পারে না। এক সময় সব কিছু হয়ে গেলে জাহাজ লোডিং শুরু হোল, লোডিঙ্গের সম্পুর্ণ দায়িত্ব ওর। হাই স্পিড ডিজেল লোড করে আবুধাবি নিয়ে যাবে। লোডিং এবং তার পরে মাপজোক হিসাব নিকাশ ইত্যাদি ফর্মালিটিজ সারতে সারতে সকাল দশটা বেজে গেল। এখন পাইলটের অপেক্ষা। আধা ঘন্টার মধ্যেই পাইলট এসে ওদের জাহাজ জেটি থেকে বের করে আউটার এঙ্কারেজে পৌছে দিয়ে নেমে পাইলট লঞ্চে করে চলে গেল আর ওরা যাত্রা শুরু করলো আবুধাবির দিকে। বেশি না মাত্র পঁয়ত্রিশ ঘন্টার পথ।

জাহাজ চলছে, কিছুক্ষণের মধ্যে পিছনে ফেলে আসা মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন দিগন্ত রেখার সাথে মিশে গেল। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, অথৈ নীল সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলেছে। এই সময় সাধারনত সাগর কিছুটা উত্তাল থাকে কিন্তু আজ বেশ নিরব শান্ত। সাগর কি জাহিদের মনের কথা জানতে পেরেছে? পারার তো কথা, সেদিন বার বার করে সাগরের বালুকা বেলায় লিখা নাম মুছে দিচ্ছিল তখন কি আর পড়ে দেখেনি কার নাম মুছে দিচ্ছে? দুপুর বারোটা বেজে গেছে, জাহিদ ব্রিজে এলো।

ব্রীজ হোল জাহাজের সব চেয়ে উচু অংশ যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করে, এখানে নেভিগেশন সহায়ক নানা ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সাজান থাকে। হাই ফ্রিকুয়েন্সি রেডিও, ওয়ারলেস, ম্যাগনেটিক কম্পাস, জাইরো কম্পাস, স্টিয়ারিং ইন্ডিকেটর, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, রাডার, থার্মোমিটার, হাইগ্রোমিটার, আর থাকে লঙ্গিচুড ল্যাটিচুড মেপে জাহাজের অবস্থান দেখার জন্য ডেকা নেভিগেটর, জিপিএস, নেভিগেশন লাইটের ইন্ডিকেটর, চার্ট(সামুদ্রিক ম্যাপ) ইত্যাদি নানা কিছু। জাহাজ চলন্ত অবস্থায় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় তার পজিশন দেখে চার্টে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয়, এতে তার গতি সম্পর্কেও জানা হয়ে যায় বিগত এক ঘন্টায় কত দূর ক্রুজ করেছে এবং সাথে ডানে বা বামে কোন দিকে ড্রিফট করছে কি না তাও বোঝা যায়। ওদের জাহাজে ওরা পাচ জন বাঙ্গালি এবং এই পাচ জনই একই প্রতিষ্ঠান থেকে নেভিগেশন বিদ্যা শিখেছে। ওদের সাথে আছে দুই জন ইরানি, পাচ জন ইন্দোনেশিয়ান এবং তিন জন বৃটিশ।

জাহিদ ডিউটিতে এসে চিফ অফিসার সুধাংশুর কাছ থেকে সব কিছু বুঝে নিলো। অভ্যাস মত এক বার রাডারে পর্দা দেখে নিলো, চার্টে এক নজর চোখ ঘুড়িয়ে আনল। রুটিন মাফিক যা যা দরকার সব দেখে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে তারেককে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর যেয়ে বসল। সব ঠিক আছে। আশে পাশে ৫০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে কোন জাহাজ নেই।

স্টিয়ারিং করছিলো তারেক। স্কুল থেকে নেভিগেশনের সাথে দায়িত্ব বোধ, কঠিন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, মার্জিত আচড়ণ, পরিচ্ছন্নতা সব কিছুই শিক্ষা পেয়েছে স্কটিশ আলস্টার ক্যাম্পবেল, নেভিগেশন বিশেষজ্ঞ সাবেক সাউদি নেভীর সিএনসি ইংলিশ মার্টিন, সীম্যানশীপ বিশেষজ্ঞ ডাচ হ্যাগওয়েল এর কাছে। অনেক কিছুই শিক্ষা পেয়েছে। তারা প্রত্যেকেই এখন দক্ষ নাবিক, কদিন পরেই হবে এই রকম কোন এক জাহাজের কর্ণধার বা ক্যাপটেন, পরিচালনা করবে জাহাজের সার্বিক দায়িত্ব। সবাই বয়সে তরুণ মনে রঙ্গীন স্বপ্ন। জাহিদের মনে আবার একটু ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন।

সে ভাবে কি ভাবে মানুষের জন্য, দশের জন্য, দেশের জন্য কিছু করা যায় বড় কিছু, অনেক বড়। নিজের না হোক মানুষের মঙ্গল হবে এমন কিছু। ও ভাবে এক সময় এই পথে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা শুধু মাত্র একটা ড্রাই কম্পাস সম্বল করে আকাশের সুর্য তারা নক্ষত্র আর দিগন্ত রেখা দেখে অনুমান করে নিজের অবস্থান নিরুপণ করে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উপর ভিত্তি করে পালের জাহাজ নিয়ে কি ভাবে এই সাগর পাড়ি দিয়েছে? আজ আমরা জিপিএস ব্যবহার করেও হিম সিম খাচ্ছি। যে জিপিএস মাত্র তিন মিটার এদিক সেদিক হয়। এই বিশাল কুল কিনারা বিহীন সাগরের মধ্যে তিন মিটার এমন কিছু নয় তবুও কেমন দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ ক্যাপ্টেন কুক কি ভাবে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছাল, কলম্বাস কি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছাল? জাহিদের কাছে এ এক বিস্ময়।

আমাদের দেশের কেউ যদি এই ভাবে কোন দেশে পৌছাতে পারত তাহলে আমরাও আজ বিশ্ব জুরে রাজত্ব করে বেড়াতাম। কি জানি তারা কেউ কি এভাবে চিন্তা করেছিলো? মন হয় না। কারন ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আমাদের দেশের কোন নাবিক টেন্ডল বা সারেঙ্গের উপরে যেতে পারেনি। তাদের কারো কি ক্যাপটেন হবার সাধ জাগেনি? জাগলে কি আর এমন হতো? নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। হঠাত্ করেই ওর ভাবনার তার ছিড়ে যায়, এতক্ষণে কফি শেষ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ খালি কফির কাপ স্ক্রিনের এক পাশে না নামিয়ে রেখে হাতেই ধরে বসে সামনে তাকিয়ে ভাবছিল।

ঘড়ির দিকে তাকাল পরবর্তী পজিশন নেয়ার সময় হয়েছে। এবার উঠে এলো। রাডারের পর্দায় চেয়ে দেখে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে সামনের পাচ ডিগ্রি ডানে একটা জাহাজের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে আবার সময় দেখে চার্ট টেবিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে নিল, জাহাজ কোন দিকে ড্রিফট করেনি। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে জাইরো কম্পাসের মনিটরে তার নিজের হেড দেখে নিলো জাহাজ কত ডিগ্রী কোর্সে চলছে, কোর্স ঠিক আছে, একটু পরে আবার রাডারের পর্দা, যে জাহাজ দেখা গিয়েছিল সেটা তাদের স্টার বোর্ড(ডান) সাইড দিয়ে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকের মত ছয়টা বেজে গেল আবার সুধাংশু এলো।

তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল, তার এই সময়ের মধ্যে জাহাজ তেমন কিছু ড্রিফট করেনি, শান্ত সাগর ড্রিফট করবেই বা কেন? তা ছাড়া তারেক ভাল স্টিয়ারিং করে। নিজের রুমে এসে পোষাক বদলে গোসল দিয়ে চলে গেল সোজা কিচেনের পাশে ডাইনিং রুমে। খেয়ে দেয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য সেলুনে বসল, সাগরের মাঝে কোন টিভি চ্যানেল পাবে না, জাহাজ চলছে সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত নয়ত ঘুমে। সেলুনে দাবা, তাস বা সময় কাটাবার মত অনেক কিছুই আছে ওগুলি সে কোনটা পছন্দ করে না। কোন রকমে এক বোর্ড খেলেই আর দাবার চাল দিতে পারে না কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় ঘোড়া চালিয়ে দেয় সোজা কিংবা নৌকা চালায় ঘোড়ার মত আড়াই ঘর পাশে আর তাস দেখলেই মাথা ঘুরে।

প্রজেক্টরে একটা সিনেমা চালাল কিন্তু, বেশিক্ষণ বসা যাবে না নাইট নেভিগেশন আছে। চলন্ত জাহাজে ডিউটির সময় ঝিমানোর কোন উপায় নেই। তারা তারি ঘুমুতে হবে। বিশ পঁচিশ মিনিট দেখে এসে শুয়ে পরলো। কখন যে কি কি সব আজগুবি ভাবনা কোথা থেকে যে উড়ে এসে মাথায় ভীড় করে কে জানে, তারপর আবার নতুন যোগ হয়েছে লাল পাড় নীল শারি। মনে হচ্ছিল গভীর নীল সাগরের পাশ দিয়ে লাল স্রোতের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই মেয়েটি, যার জন্য শাড়িটি কিনেছে তাকে এই শাড়িটা কি বলে দিবে?আদৌ কি দেয়া হবে? তাই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে।

রাত পৌনে বারোটায় মিজান এসে ডেকে দিল। জাহাজে এই নিয়ম। পরবর্তী ডিউটির লোকদের ঘুম থেকে ডেকে দেয়া। উঠে চোখ মুখ ধুয়ে ডিউটির পোষাক বদলে হাতে একটা সোয়েটার নিয়ে এলো রাতের খোলা সাগরে শীত লাগতে পারে। তারেককে নিয়ে এক সাথে ব্রজে এলো। ওদের দেখে সুধাংশু’দা হেসে ইয়ার্কি করে বললো গুড মর্নিং ক্যাপটেন জাহিদ, ওরা দুই জনেই এক সাথে তার জবাবে বললো
গুড মর্নিং টু ইউ, ওকে নাউ ইউ ক্যান গো টু বেড এন্ড হ্যাভ এ গুড ড্রিম।
সুধাংশু’দা জাহিদের সিনিয়র কিন্তু হাসি তামশা ইয়ার্কি ফাজলামি সমানে চলে। তারেক এগিয়ে গেল মিজানের স্টিয়ারিং সিটের পাশে। মিজান চলে গেল। তারেক ওর সিটে বসল স্টিয়ারিং হুইল ধরে।
নাও দেখ চার্ট দেখে নাও বলে সুধাংশু’দা চার্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো ঘন্টা খানিক পর কোর্স চেঞ্জ করতে হবে।

চার্টে রুট প্ল্যান দেখে জাহিদ বললো আচ্ছা ঠিক আছে। কোর্স কত চলছে?
বলেই কম্পাসের দিকে দেখে নিলো।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন, নাকি একটু কফি খেয়ে যাবেন?
তুমি যা বল না! এখন যাবো ঘুমাতে আর তুমি বলছ কফি খেতে।
তাতে কি, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখবেন জাহাজ আবুধাবিতে নোঙ্গর করে আছে, আচ্ছা গ্রে আবুধাবিকে আমাদের ইটিএ (এস্টিমেটেড টাইম অফ এরাইভ্যাল) জানিয়েছেন?
হ্যা সে তো কাল বাহরাইন থেকে ছাড়ার সময় বলেছিলাম।
ওরা তো জাহাজ না পৌঁছা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, একটা মজার ব্যাপার কি জানেন কাল আমার ডিউটিতে একবারও ডাকেনি।
এখনো আমি ডাকিনি ওরাই ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো।
ইটিএ কত দিয়েছেন?
ভোর সাড়ে পাঁচটা, আর পণ্ডিতি করতে হবে না সময় মতো জাহাজ পৌছে দিও, আমি যেন উঠে দেখি জাহাজ নোঙ্গরে। এখন জাহাজ চালাও আর কফি খাও আমি চললাম বলেই ব্রিজ ছেড়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল।

জাহিদ যথারীতি রাডার, জাহাজের হেড এর পজিশন, কোর্স সহ সব কিছু রুটিন চেক আপ করে ইলেকট্রিক জগে কফির পানি গরম দিল। কালো কফি। কাল কফির পোড়া পোড়া গন্ধটা জাহিদের দারুন ভালো লাগে সাথে সামান্য চিনি, মিষ্টি বেশি খায় না ভালো লাগে না। রাতে চলন্ত জাহাজে ব্রিজের এই ডিউটিতে কালো কফি এক দারুন জিনিস। কে যে এই কফি আবিষ্কার করেছিলো তাকে পেলে অন্তত একটু শুকনো ধন্যবাদ জানান উচিত। কফি বানিয়ে এক কাপ তারেকের হাতে দিয়ে নিজে একটা নিয়ে আবার তার প্রিয় সেই স্টার বোর্ড সাইডের সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর বসল। এতক্ষণে ব্যস্ততার জন্য লক্ষ করেনি এখন চোখ পরলো সামনের সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে জেগে উঠছে বিরাট চাঁদ। চাঁদ থেকে চকচকে একটা রূপালী মেঠো পথের মত এসে পৌচেছে ওদের জাহাজের সামনে।
তারেক চাঁদটা দেখেছ?
হ্যা তাই দেখছি।
কি সুন্দর তাই না?
হ্যা।

ইস আমি যদি এখন এই পথ দিয়ে হেটে যেতে পারতাম!
মনে মনে এই পথ বেয়ে চলে গেল অনেক দূরে। হাতের কফির কাপে এখনো একটা চুমুক ও দেয়া হয় নি। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে কাপটা হাতেই ধরা রয়েছে। রাতের এই তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে সাগর বুকে চাঁদ থেকে বয়ে আসা এমন পথে কার না একটু হেটে বেড়াতে ইচ্ছা করে?জাহিদের কী দোষ? সে তো এমন দায়িত্ব জ্ঞ্যান হিন না। সে যতই ভাবুক হোক না কেন কাজের দিকে তার পুরো খেয়াল। সাগর যতই উত্তাল মাতাল হোক না কেন তার ডিউটির সময় জাহাজ এক আধ মাইলের বেশি ড্রিফট হবে না। লোড আন লোডের সময়? তখন তো পাইপ লাইন, পাম্প, প্রত্যেকটা ভাল্ব, জয়েন্ট লিক করছে কি না, টেম্পারেচার ঠিক আছে কি না, পাম্পিং প্রেসার ঠিক আছে কি না, কোন গ্রেডের তেল কোন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে, এক ট্যাঙ্কের তেল লিক করে ভিন্ন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে কি না সব তার নখ দর্পণে।

এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে টর্চ থাকবেই, আর পকেট? তার বয়লার স্যুটের পকেটে আস্ত এক ওয়ার্কশপ। বার বার করে তার চোখ সব কিছুর উপর দিয়ে ঘুরছে। সে নিজে ঘুরছে ডেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। কখনো কোন গাফিলতি বা অবহেলা বা অমনোযোগ নেই সম্পুর্ণ দায়িত্ব সচেতন। তবে খোলা সাগরে ব্রিজে ডিউটির সময় কিংবা অবসর সময় কিংবা বহির্নোঙরে নোঙ্গর করে থাকার সময় যখন ডিউটি করে তখন তার বিস্মিত চোখ অবাক হয়ে বারবার নতুন সব দৃশ্য দেখে নেয় আর ভাবে বিধাতার কি অপূর্ব সৃস্টি যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কত কঠিন।

এখন জাহাজ চলছে এখন কোন অবস্থায় সাগর বুকে চাঁদের বিছান পথে কোন ভাবেই বেড়ানো চলবে না। আবার জাহাজে ফিরে এলো, কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার পানি গরম দিল, তারেককে জিজ্ঞেস করলো খাবে? না জাহিদ ভাই আমি এখন আর না। আচ্ছা বলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে এবার ব্রিজের ভিতরে বসল। বাইরে ঠান্ডা লাগছে। বসে তারেকের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ। কখনো নিজ দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, দেশি খাবার, প্রেম ইত্যাদি। হঠাত্ করেই একেক প্রসঙ্গ আসে আবার তা হঠাত্ করেই মিলিয়ে যায়।
দেখলাম কাল তোমার চিঠি এসেছে তা বাড়ির কি খবর?
না জাহিদ ভাই তেমন কোন বিশেষ খবর নেই, এই কেমন আছ, আমরা ভালো আছি এই সব যা গতানুগতিক তাই।

হ্যা তাইতো হবে, তুমি আর কি চাও?
কেন এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না?তাই আর কি। আচ্ছা জাহিদ ভাই ফরিদাকে (একটা জাহাজের নাম)একটু ডেকে দেখেন তো পান কিনা, শুনলাম ওরা নাকি আবুধাবিতে আছে।
তাই নাকি?
হ্যা, আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন আমি শুনেছি ওরা গ্রে বাহরাইনের সাথে কথা বলছিল।
আচ্ছা দাঁড়াও এখনি ডাকছি।
বলে উঠে এসে রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকতে শুরু করলো
‘ফরিদা ফরিদা দিস ইস প্যাসিফিক ম্যারিনার কলিং’

সাগর বুকে ইথার এর মাধ্যমে রহমানের কণ্ঠে ভেসে এলো ফরিদার জবাব
‘ইয়েস প্যাসিফিক ম্যারিনার দিস ইস ফরিদা প্লিজ কাম ডাউন টু চ্যানেল ১৯’
চ্যানেল পরিবর্তন করে ১৯ এ এসে আবার ডাকল ফরিদাকে। ওপাশ থেকে এলো রহমানের কণ্ঠ
কিরে জাহিদ তোদের ইটিএ আমি জানি তা তোরা কি শিডিউলে আছিস নাকি চেঞ্জ হবে?
না

আজ সী খুবই শান্ত কাজেই আমরা একেবারে কাটায় কাটায় পৌছাতে পারবো এইতো আর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে আছে, আবুধাবির লাইট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আবার সুধাংশু’দা বলে গেছে তাকে যেন সকালে ব্রিজে আসতে না হয় তার আগেই যেন আমি নোঙ্গর করে রাখি। তাছাড়া আমরা যে ইটিএ দেই তা সাধারনত মেইনটেইন করি, আমরা তোদের মত নাকি?মনে নেই ওই যে রাস্তানুরাহ থেকে ফেরার পথে কি কাণ্ড করেছিলি?
না রে সে তো হঠাত্ একটা দুর্যোগের কারনেই হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা শোন, মনির কি ফ্লাই করতে পেরেছে খবর পেয়েছিস?
হ্যা ও এতো দিনে বাংলাদেশে পুরোন হয়ে গেছে।
যাক ভালো হয়েছে, আমার সাথে মানামাতে দেখা হয়েছিল।
হ্যা বলেছে, ওরা যেদিন দুবাই আসছিল সেদিন আমরা কুয়েত থেকে এখানে আসছিলাম তখন আমার সাথে কথা হয়েছে।

তাহলে তোরা এখানে কত দিন যাবত আছিস?
এইতো আজ চার দিন হবে, তোদের ও এখানে আনলোড হতে দেরি হবে আমাদের পরে তোরা আনলোড করবি কাজেই তোরা সবাই আজ বিকেলে আসবি আমাদের জাহাজে।
জাহিদ আমতা আমতা করছে দেখে রহমান বলে দিল ভয় করিস না লাইফ জ্যাকেট পরে আসবি আর এক্সট্রা রেফট নিয়ে আসবি।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। তোরা কোথায় নোঙ্গর করেছিস?
আমরা একটু সাউথে আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, আমি তোদের কাছাকাছি এঙ্কর ড্রপ করবো।
হ্যা তাই করিস।
আচ্ছা শোন তারেক মনে হয় মোবারক ভাই এর সাথে কথা বলবে উনি কি ডিউটিতে?
হ্যা আছে দে ওকে।

জাহিদ গিয়ে স্টিয়ারিং ধরে তারেককে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারেকের কথা শেষ হলে বললো জাহিদ ভাই আপনি আরো একটু থাকেন আমার ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেয়ে আসছি।
শোন আমারও ক্ষুধা পাচ্ছে মনে হয় আমার জন্যও কিছু নিয়ে এসো।
কি খাবেন?
তুমি যা খাও তাই নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর তারেক গরম দুইটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে চার্ট টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো
দেন এবার আমার হাতে দেন আপনি খেয়ে নেন।
আবুধাবি আউটার এঙ্কারেজে পৌছে ফরিদাকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হোল না ফরিদার এক মাইলের মধ্যে ওদের দেয়া ইটিএ অনুযায়ী ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙ্গর করে রেডিওতে গ্রে আবুধাবিকে জানিয়ে দিল।

ব্রিজের টুকিটাকি কিছু গোছগাছ করতে করতে সকাল ছয়টা বেজে গেল। ব্যাস, এখনকার মত ওর ডিউটি শেষ। এবার নিজের রুমে গিয়ে পোষাক বদলে আবার গরম গোসল দিয়ে একটু আগে তারেকের বানানো বিরাট দুই স্যান্ডউইচ খেয়ে আর ক্ষুধা নেই বলে সরাসরি বিছানায়। এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম।
ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। উঠে সবাইকে ফরিদার নিমন্ত্রণের কথা জানালো।
সুধাংশু’দা বললো সবাই কি আর যেতে পারবো জাহাজ নোঙ্গরে রয়েছে জাহাজে থাকবে কে?
শুনে তারেক বললো আপনারা সবাই যান আমি থাকবো। মোবারক ভাইর সাথে আমার একটু দরকার ছিল তা রাতে রেডিওতে কথা বলে সেরে নিয়েছি।
আচ্ছা বেশ তাহলে তুমি থাক।

জাহিদ আবার এই সব সামাজিকতা নিয়ে বেশ সতর্ক। দেশে সব আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার কাজটা সে নিরলস ভাবে নিয়মিত করে যেত। এটা ওর কাছে একটা দায়িত্বের মত মনে হতো। কারো কোন নিমন্ত্রণে সময় মতো হাজির হতো, বলতো অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন, সমাজে বাস করি না?আমরা সামাজিক জীব না?এক জন আরেক জনের কাছে না গেলে কি হয়?অবশ্যই যেতে হবে।
বিকেলে জাহাজের ক্যাপটেনের অনুমতি নিয়ে নিল। দুপুরে খাবারের পর মিজানকে নিয়ে ওদের জাহাজে ইঞ্জিন চালিত রাবারের ডিঙ্গি পাম্প করে, ইঞ্জিনে তেল ভরে টেস্ট করে লাইফ জ্যাকেট, রেফট নিয়ে রেডি করে রেখেছিল। ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গি নামিয়ে তাতে করে ফরিদায় এসে পৌঁছল। তারেক রেডিওতে বলে দিয়েছিল। কাছে এসে দেখে ওখানকার সবাই এসে জাহাজে ওঠার জন্য সিঁড়ি নামিয়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আতাউর, মোবারক, রহমান সবাই।

রহমান এবার বল কি আয়োজন করেছিস।
আরে মাত্র এলি এখনি কি একটু ধৈর্য ধর দেখবি কি করেছি।
না তুই আগে বল, তুই তো জানিস আমার সমস্যা কোথায়, কত রিস্ক নিয়ে ডিঙ্গিতে করে এসেছি। শুধু তোদের ডিঙ্গি নেই বলে এসেছি না হলে কি আমাকে আনতে পারতি?
আরে বেকুব দেখ এই সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখ কোন কিনারা দেখা যায়?
নতুন করে আবার কি দেখতে বলছিস, আমি সাগরে বাস করি না কি আকাশে বাস করি?
আচ্ছা এখন বল এই কুল কিনারাহীন সাগরে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি?তুই যদি সাতার জানতি তাহলে সাতরে কোথায় যেতে পারতি?কোথায় গিয়ে উঠতি?
জ্ঞ্যান দিয়ে ভুলাতে পারবি না, মাস্টারি করিস না বল কি করেছিস।
আরে পাগল এখনি কি এখন একটু ড্রিঙ্কস খা খাবার সময় হোক তখনই দেখবি।
না তুই বল।

তাহলে চল গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) চল, নিজেই দেখ।
সত্যিই গ্যালিতে গিয়ে দেখেত জাহিদের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকির ঝুরি, রুপ চান্দা মাছ ভাজি, তাজা ম্যাকারেল মাছ ভুনা, মাংশ ভুনা আর পাতলা ডাল।
রুপ চান্দা কোথায় পেলি?
বলিস না কুয়েত থেকে আসার পথে দেখি জেলেরা ফিশিং ট্র্যাপ ফেলে রেখেছে, জাহাজ কাছে নিয়ে ক্রেন দিয়ে সেই ট্র্যাপ উঠিয়ে দেখি বোঝাই মাছ। সব নিয়ে এসেছি। এই ম্যাকারেলও। অনেক মাছ ছিল। তোরা যাবার সময় কিছু নিয়ে যাবি।
জাহিদ এবার একটু শান্ত হোল।
চল এবার সেলুনে চল।
কেক আর কোক খেতে খেতে হৈ চৈ, মিজান মহসীনের নাচা নাচি, টেবিল ঠুকে তবলা বাজিয়ে গান সবই হোল।
চল এবার খেতে যাই।
হ্যা যাবো তবে তারেক একা রয়েছে ওর জন্য আগে কিছু দিয়ে দে না হলে পরে মনে থাকবে না।
সত্যিই রহমান কয়েকটা প্যাকেটে করে তারেকের জন্য এই সব অমূল্য খাবার আর ফ্রিজ খুলে দুই বালতি ভরা মাছ ওদের ডিঙ্গিতে নামিয়ে রেখে এলো। এবার সবাই খেতে বসল। ফরিদার বাঙ্গালি কুক চিটাগাংয়ের আব্দুল হাই, চমৎকার সব রান্না করেছে নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার এক তরফা আড্ডা দিয়ে রাত নয়টায় জাহাজে ফিরে এলো।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to নির্বাক বসন্ত (প্রথম অধ্যায়)-৩

You must be logged in to post a comment Login