জুলিয়ান সিদ্দিকী

একজন ইজাজুল কিংবা একটি স্বপ্ন

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বেশ কয়েক বছর আগে দু এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে স্বপ্নটা দেখতো ইজাজুল। ঠিক ফজরের আজানের খানিকটা আগে দিয়ে দেখতে পেতো, ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে বলছে, আব্বু!

ইজাজুল তাকিয়ে থাকতো মেয়েটির দিকে। দুষ্টু দুষ্টু হাসিমুখ করে মেয়েটি আবার বলতো, আব্বু!

স্বপ্নের ভেতর ইজাজুল উঠে গিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলেই সে ছুটে পালাতো। আর ঠিক সে সময়ই তার ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পেতো দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুললিত ধ্বণি। কিন্তু অনেক ভেবেও এ স্বপ্নের কোনো মাহাত্ম্য আবিষ্কার করতে পারেনি সে। অফিসে কাজের ভেতর ডুবে থাকা অবস্থায়ও মাঝে মাঝে শুনতে পেতো মেয়েটি যেন ডাকছে তাকে। অথচ এত কম বয়সের কোনো বাচ্চাকে সে কথা বলতে বা হাঁটাচলা করতে দেখেনি।

পাশের টেবিলেই বসে কৃষ্ণা বড়ুয়া। তার একটি মেয়ে আছে স্বপ্নে দেখা মেয়েটির বয়সের। একদিন কোন কারণে যেন বাচ্চা নিয়েই অফিসে এসেছিলো সে। ইজাজুল তখন জিজ্ঞেস করছিলো, বাবুটা কথা বলতে পারে?

কৃষ্ণা বড়ুয়া হেসে উঠেছিলো প্রশ্ন শুনে। তারপর বলেছিলো, আপনিও না! মাত্র আটমাস বয়স, কথা বলবে কি? ঠিক মত দাঁড়াতেও শিখেনি!

এরপর কথা আর না এগোলেও সে দিনটির পর থেকে মাঝে মধ্যে মুন্নির সঙ্গে কথাচ্ছলে তাকে ঠেস দিয়ে নানা কথা বলতো কৃষ্ণা। তখনই একবার তাকে বলতে শুনেছিলো, সময় মত বিয়ে না করলে ছেলেগুলো কেমন গাধার মতো কথা বলে না, শুনলে খুব বিরক্ত লাগে!

বুঝতে পারলেও তাদের দুজনের কথার মাঝে নাক গলানোর আগ্রহ বোধ করেনি ইজাজুল। মুন্নি আড় চোখে তাকে দেখছিলো হয়তো তার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হয় কি না তাই যেন অনুসন্ধান করেছে তার অবয়বে। কিন্তু ইজাজুলের মনের অবস্থা চেহারায় কখনো ছাপ ফেলে না।

একবার মহসিন হলে মাঝরাতে পুলিশ রেইড দিয়েছিলো। আর্মির সঙ্গে ফুটবল খেলা নিয়ে ছাত্রদের কী সব হাঙ্গামা হয়েছিলো তার জানা ছিলো না। কিন্তু মাঝরাতে রুমে পুলিশ ঢুকতে দেখে তার রুমমেট ফয়সালের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিলো। আর তা দেখেই সন্দেহ করে বসে পুলিশ। কিন্তু ভয়ের ছাপ তার চেহারায় ফুটে না উঠলেও কম ভয় পায়নি সেদিন। ছোটবেলা থেকেই কুকুর আর পুলিশ দেখলে ভীষন ভয় পায় সে। সেদিন মাঝরাতে রুমে পুলিশ ঢুকতে দেখে নিদারুণ ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। যদি সে রাতে তাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হতো তাহলে ঠিকই ব্যাপারটা পুলিশের চোখেও পড়তো। ভাগ্যিস, পুলিশ ফয়সালকে বেরোতে বলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

কদিন আব্বু আব্বু শোনার কারণে তার কাজের বেশ ক্ষতি হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিলো। মন বিক্ষিপ্ত থাকায় ভুল করে সে দশ হাজারের জায়গায় এক লাখ পিস সূতার রোলের অর্ডার তৈরি করে ঠিক ফ্যাক্স পাঠানোর আগে শেষবারের মত অর্ডারটায় চোখ বোলানোর সময়ই ভুলটা ধরা পড়েছিলো। কেউ দেখে ফেলার আগেই অর্ডারটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে নতুন অর্ডার প্রিন্ট নেয়। তারপর কী বুঝে সন্ধ্যার দিকে এক মনের ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলতেই ব্যাটা মহা পণ্ডিত দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে বলেছিলো, মেয়ের খুব শখ আপনার তাই না? তাহলে বিয়েটা সেরে ফেলছেন না কেন?

ডাক্তারের কথা শুনে খুব রেগে উঠে মনেমনে সে বলেছিলো, তোর মাথা আর আমার ঘণ্টা! শালা! মনের ডাক্তার হয়ে বসেছে!

পরের সপ্তাহে ফের যাওয়ার কথা থাকলেও আর যায় নি সে। বিয়ে নিয়ে যার মনে কোনো রকম ভাবনাই নেই, সে কিনা মনেমনে শখ করে মেয়ের বাপ হতে! যতসব ফটকার দল!

ঠিক পরের সপ্তাহেই তার উল্টো দিকের খালি চেয়ারটাতে এসে বসলো একজন পাহাড়ি মহিলা। পাহাড়ি মেয়েদের শারীরিক গঠনের কারণেই হয়তো বয়স অনুমান করা কঠিন। এর আগের অফিসে একজন মণিপুরি মহিলা ছিলেন। ইজাজুল প্রথম দিন সে ভদ্র মহিলাকে দেখে ভেবেছিলো তার বুঝি বিয়েই হয় নি। কদিন পর সে মহিলার মুখেই শোনা গেল যে, তার মেয়ে আইনে মাস্টার্স করছে।

কিছুক্ষণ পর নবাগতা উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো, হাই কমরেডস!

ইজাজুল চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়েছিলো। চোখে চোখ পড়তেই সে হেসে উঠে বললো, আমি জাসিন্তা চাকমা! আজকেই জয়েন করলাম। ওয়ার্ড প্রসেসর!

এখন টাইপরাইটারের জায়গায় এসেছে ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার। কম্পিউটার। টাইপিস্টের পোস্ট হয়ে গেছে ওয়ার্ড প্রসেসর। তারপরই সে মাপা হাসি দিয়ে বললো, আপনারা? তারপরই ইজাজুলের দিকে আঙুল তুলে বললো, আগে আপনি!

ইজাজুল কেমন ঘাবড়ে গিয়ে কয়েকবার তো তো করে থেমে গিয়েছিলো। মহিলা বিব্রত ভঙ্গীতে কৃষ্ণার দিকে ফিরে বললো, আপনি ম্যাডাম!

আমি কৃষ্ণা বড়ুয়া। আর ও মুন্নি। তারপর ইজাজুলের দিকে হাত তুলে বলেছিলো, এ হচ্ছে ইজাজুল ক্রিম!

জাসিন্তা যেন বুঝতে পারে নি এমন ভাব করে বলে উঠেছিলো, সরি?

কৃষ্ণা ফের বলেছিলো, ইজাজুল করিম!

ইউ নটি গার্ল! বলে খানিকটা এগিয়ে এসে কৃষ্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বলেছিলো, প্রথমবার ক্রিম বলেছিলেন না?

কৃষ্ণাও হাসতে হাসতে বলছিলো, করিম কথাটা স্পিডে বললে ক্রিম শোনায়। বারেক কে ব্রেক!

এভাবে প্রথম দিনই রুমের ভেতর নিজেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছিলো জাসিন্তা।

জাসিন্তা এখানে আসার পর অফিসের চেহারাও দিন দিন পাল্টে যেতে লাগলো। ম্যানেজারকে কিভাবে বলে বলে অফিসের পুরোনো আসবাব সবই বদলে ফেললো। অথচ ইজাজুল বলে বলে শেষতক হাল ছেড়ে দিয়েছে। তবু ভালো। কোনোরকম অন্যায় পথ অবলম্বন ছাড়া প্রত্যাশা পূরণ হলেই সে খুশি। কৃষ্ণার সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করতে করতে মুন্নি হঠাৎ ইজাজুলের দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা, ইজাজ ভাই, আপনার কি মনে হয় না যে, জাসিন্তা আমাদের চেয়েও কিছুটা বেশি স্মার্ট?

ইজাজুল সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলো, এ কথা কেন মনে হলো?

মুন্নি বললো, বুঝেও কেন ভান করছেন?

আমি তো বুঝতেই পারছি না! বলে, কাঁধ নাড়ে ইজাজুল। তারপর কৃষ্ণাকে দেখিয়ে বললো, দালাইলামাকে জিজ্ঞেস করেন না!

কৃষ্ণা ক্ষেপে উঠে বললো, আবার কেন ওসব বলছেন? ফাজলামো না করলে আপনার ভালো লাগে না?

ইজাজুল ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা করে। তবু ভাব করে যে অভ্যাস বশে ভুল করে ফেলেছে। কৃষ্ণা ক্ষেপে গেলে একটা সুবিধা হয় তার। সেদিন আর কথা বলে না। কৃষ্ণা কথা না বললে তার কাজেও কোনো ভুল হয় না। কথাটা সে বলতে পারে অবশ্য যে, কৃষ্ণা, আপনি কথা বললে আমার কাজে সমস্যা হয়।

এতে হয়তো তার নিজের সুবিধা হবে। কোম্পানিরও সুবিধা হবে। কিন্তু কৃষ্ণা হয়তো আর কথাই বলবে না। পাশের টেবিলে কেউ একজন মন খারাপ করে বসে থাকলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। অন্য কেউ এড়িয়ে যেতে পারলেও ইজাজুলের পক্ষে অসম্ভব। তাই সে নিজে সতর্ক থাকতে চেষ্টা করে কাজের সময়। তবু তাকে চরম সত্যটা কখনো বলতে চায় না।

কৃষ্ণা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই পরিবেশটাকে ফের হালকা করতে সে বললো, মন খারাপ করছেন কেন? এ কথায় যে আপনি রাগ করেন সেটাই তো ভুলে যাই! অভ্যাস, বুঝলেন? অনেক দিনের অভ্যাস কিনা! এই কান ধরছি! আজ আর ভুল হবে না!

মুন্নি বলে উঠলো অভ্যাস বলছেন কেন? কৃষ্ণাকে তো প্রায়ই এ কথা বলেন!

বুঝলেন না, কয়লা! কয়লা! কয়লার টুকরো সাবানের পানিতে লক্ষ বছর ফেলে রাখলেও সাদা হবে না!

কয়লা বলছেন কেন? হলুদ বলতে পারেন না? এটারও তো রঙ বদল হয় না! বলেই হেসে উঠলো কৃষ্ণা।

ইজাজুলের মনে হয়, মেয়েরা যতটাই পাণ্ডিত্য অর্জন করুক না কেন, মনের দিক থেকে কেউ কেউ জীবন ভর মেয়েই থেকে যায়। নিজকে দর্শনীয় করতে, অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে তাদের চেষ্টাগুলো যে কতটা স্থূল হয়ে ফুটে ওঠে তা যেন বুঝতেই পারে না।

ইজাজুল কী বলতে পারে তাই ভাবছিলো। ঠিক তখনই জাসিন্তা একগাদা কাগজ-পত্র দুহাতে বুকে চেপে ধরে খানিকটা বিরক্ত মুখে ইজাজুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে মুখ তুলে বললো, আমি কি দেখতে খারাপ?

কেন, এ কথা কেন?

বিভ্রান্ত ইজাজুল মুন্নি আর কৃষ্ণার দিকে একবার তাকিয়ে জাসিন্তাকে আবার বললো, কে বললো আপনি দেখতে খারাপ?

তা হলে কি? বোলে, জাসিন্তা তার টেবিলে কাগজ-পত্র প্রায় আছড়ে ফেলে বললো, রফিক সাহেবের রুমে যতদিন গেছি, ততদিনই দেখলাম আমার দিকে ভুলেও তাকান না!

জাসিন্তার কথা শেষ হতেই কৃষ্ণা হেসে উঠলো।

হাসছেন কেন? বলে, খানিকটা রাগ নিয়েই হয়তো কৃষ্ণার দিকে ফিরলো জাসিন্তা।

পাশের টেবিলে হাসনা ম্যাডামকে দেখেছেন?

তাকে তো সব সময়ই দেখি!

দেখতে কেমন তিনি?

ওফ! ভদ্রমহিলার দিকে তাকালে আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় কখন জানি চেয়ার ভেঙে ফ্লোরে পড়ে যান! এতটুকু বলে জাসিন্তা আবার বলে, প্রতিদিন কী খান উনি? আমাদের দেশে এত মোটা মানুষ দেখি নি!

কৃষ্ণা আরেকটু এগিয়ে এসে কিছুটা নিচু স্বরে বললো, আপনি বললেন না যে, হাসনা ম্যাডামকে দেখলে আপনার দম বন্ধ হয়ে আসে? রফিক সাহেব তাকে বিয়ের পর থেকেই দম বন্ধ অবস্থায় আছেন। অন্যদিকে তাকানোর সময় পান না!

তা হলে দুজনে…? কথা শেষ করে না জাসিন্তা। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে নিজের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে।

মুন্নি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জাসিন্তার কাঁধে দুহাত রেখে বললো, ম্যাডাম, আপনারও কি দম বন্ধ হয়ে গেলো?

নাহ! ভাবছি! তারপরই সে ইজাজুলের দিকে ফিরে বললো, রফিক সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন! আর সে কথা শুনেই কেমন চোখ-মুখ শুকিয়ে যাওয়ার মত দেখায় তাকে।

কি হলো? জাসিন্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইজাজুলের দিকে।

আমার চাকরিটা আর নেই! কেমন হাহাকার করে বলে উঠলো ইজাজুল।

এবার অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মুন্নি আর কৃষ্ণাও। দুজনের মুখেই প্রায় একই সময় ধ্বনিত হয়, কেন?

কথায় কথায় অর্ডারটা বানাতে ভুলে গেছি!

এত ভয় পাচ্ছেন কেন? অন্য কোনো ব্যাপারও তো হতে পারে!

জাসিন্তার কথায় ভরসা পায় না ইজাজুল। বললো, আমাকে দেখা করতে বলার আগে কোনো আলাপ শুনেছেন?

তেমন না। জাসিন্তা জানালো। তবে চিটাগাং যাওয়ার ব্যাপারে বাস-ট্রেনের কথা জানতে চেয়েছিলেন।

হয়তো টিকেট আনতে পাঠাবে। পাশ থেকে বলে উঠলো মুন্নি।

তাহলে দেখি, কপালে কী আছে! বলে ইজাজুল এমডি রফিক উল্লাহর দরজায় বার কয়েক টোকা দিয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে টানে। তারপর দরজার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলে, আসবো স্যার?

আসেন! বলে, রফিক উল্লাহ আবার বলে উঠলেন, হাতে কোনো পেন্ডিং কাজ আছে?

জি স্যার! অর্ডারটা শেষ হয় নি।

ওটা করার দরকার নাই। ডবলু পিও কে আরেকটা কপি দিয়েছি। আপনি বরং এখনি চিটাগাং চলে যান। সি-কাস্টম অফিসে গিয়ে হোসেন আলিকে খুঁজে বের করবেন। বলবেন ফোন ধরছে না কেন? আমাদের শিপমেন্ট এখনো আটকে আছে কেন? আমজাদ তাকে কত টাকা দিয়েছে? যান, দেরি করবেন না!

প্রায় ঝড়ের বেগে এমডির রুম থেকে বের হয়ে আসে ইজাজুল। আর তখনই দেখতে পায় কেমন উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে তিন নারী সহকর্মী। সে তাদের বললো, ভয় নেই। চাকরিটা আছে। এক্ষুনি চিটাগাং যেতে হচ্ছে! আসি!

ইজাজুল আর দেরি করে না। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভাবে, এখন কি বাস-ট্রেন পাওয়া যাবে? পকেট থেকে সেলফোন বের করে সময় দেখলো সময় মাত্র দশটা। চারটার আগে কি পৌঁছুনো যাবে?

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় লাফিয়ে নামতে নামতে সে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। একটি সিএনজি ক্যাব দেখতে পেয়ে হাত তোলে। সেটা পাশে এসে থামতেই ড্রাইভারকে বললো, সায়দাবাদ!

চলেন!

মিটার আছে?

খারাপ! ঠিক করানের সময় পাই নাই!

কত নিবা?

একশ দিয়েন!

মাথা খারাপ নাকি?

ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয় পাম্পে। তার বাদে আছে জমা-খরচ-সার্জেন্ট! বেশি না লইলে খামু কি?

ইজাজুল ভাবে সময় বাঁচাতে হলে গচ্চা দিতেই হবে। তখনই লোকটি তাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো, আইচ্ছা, আশিট্যাকা দিয়েন!

যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। তবু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগলো খুব বেশি ঠকে গেলো কিনা।

এ সময় যানজট কিছুটা কম থাকে বলে সায়দাবাদ পৌঁছুতে বেশি সময় লাগে না।

টার্মিনালে ঢুকতেই দুপাশ থেকে দুজন লোক এগিয়ে এলো। একজন বললো, কই যাবেন? এসি বাস না নন-এসি?

আমার টিকেট করা আছে। বলে, দালাল দুজনকে এড়িয়ে কাউন্টারের দিকে যায়। আগেও সে কয়েকবার চিটাগাং গেছে। যে কারণে তাকে বেশি একটা ভাবতে হয় না। টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়তেই বাস ছেড়ে দিলো। মনে হলো, বাসটা যেন তার অপেক্ষাতেই ছিলো। নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পেছনের দিকে তার সিট নাম্বার পাওয়া যায়। এতেই সে খুশি। বসতে বসতে ভাবে, সময় কিছুটা পাওয়া যাবে।

বাস জার্নি তার কাছে মোটেও আরামের মনে হয় না। বাসের দুলুনিতে সিটে বসার কিছুক্ষণের ভেতরই ঘুমিয়ে পড়ে। গত রাতে বিদ্যুৎ ছিলো না বলে গরমে ঘুমাতে পারে নি। এখন সেই অপূর্ণ ঘুমটা পুষিয়ে নিতে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বোজে সে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলো বলতে পারে না সে। মনে হচ্ছিলো দূর থেকে কোনো একটি বাচ্চা মেয়ে তাকে ডাকছে, আব্বু! আব্বু! তখনই হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লেগে ঘুমটা ভেঙে যায় তার। কিন্তু চোখ মেলতেই মনে হয় সব কেমন অন্ধকার। শ্বাস ফেলতে গিয়ে কেশে উঠলো কয়েকবার। আর সঙ্গে সঙ্গেই কয়েক ঢোক পানি ঢুকে গেলো তার পেটে। পানি খেয়ে তার হুঁশ হয় যেন। হাত-পা ছড়িয়ে ভেসে উঠতে গিয়ে টের পায় বাঁ পাটা নাড়াতে পারছে না। এক পায়ে ভর দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মাথার উপরের দিকে আলো দেখতে পায়। সেদিকে এগিয়ে যেতেই সে বাসের খোলা জানালা পথে ভেসে উঠে বুক ভরে দম নেয়। শুনতে পায় অনেক লোকজনের চিৎকার। কেউ বললো, আরেকজন উঠছে!

পানি ছেড়ে শুকনো ভূমিতে উঠেই বোধশূন্য হয়ে সে কাত হয়ে পড়ে গেল। টের পাচ্ছিলো কেউ তার পকেট হাতড়ে একে একে বের করে নিচ্ছে সেল ফোন, ওয়ালেট, খুচরো টাকা। আরেকটি হাত তার গলার কাছে হাতড়ালো কিছুক্ষণ। তারপরই টান পড়লো সোনার চেনটিতে। সবই বুঝলো সে। অসাড় হাত-পা নাড়াতে পারছিলো না কিছুতেই।

বেশ কিছুক্ষণ পর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে সে শুনতে পেলো, আশপাশেই কোনো একটি বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে, আব্বু! আব্বু! আব-বু-ঊ-উ-উ!

চোখ মেলতেই ইজাজুল নিজকে আবিষ্কার করে রাস্তার ঢালুতে পড়ে আছে। উঠতে গিয়ে টের পায় পুরো দেহ ব্যথা করছে। বাঁ পাটা নাড়াতে পারছে না। হাঁটুর নিচ থেকে ভেঙে গেছে হয়তো। খানিকটা দূরেই মাটিতে শুয়ে বাচ্চা মেয়েটি কাঁদছিলো। গায়ের জামা-জুতো সবই রক্তে লাল হয়ে আছে। কোনো রকমে দু হাতে ভর করে এক পায়ে ছেঁচড়ে সে এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে। একটি হাত বাড়াতেই দু হাতে সেই হাতটি আঁকড়ে ধরে মেয়েটি বলে উঠলো, আব্বু তুমি কোথায়?

ইজাজুলের মনে হয় স্বপ্নে দেখা সেই মেয়ে শিশুটি। বয়সটা কিছু বেশি যেন। আর বাকি সব হুবহু মিলে যাচ্ছে। মেয়েটিকে তুলে বুকের সঙ্গে চেপে ধরতেই মেয়েটি গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আব্বু, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না!

ইজাজুল বুঝতে পারে না কি করবে। অসহায় দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সবার মনোযোগ পানিতে ডুবে থাকা বাসটির দিকেই। তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না কেউ।

৪-৩-২০১১।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


11 Responses to একজন ইজাজুল কিংবা একটি স্বপ্ন

You must be logged in to post a comment Login