রিপন কুমার দে

আমি আজ অনেকটাই বদলে গেছি, প্রভু

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ডিসক্লেইমার: শুদ্ধ বানান খুঁজে পাওয়াটা দুরহ কাজ হতে পারে!!!
————————————————————————-

গভীর রাত। ঘুম আসছে না। হাতে কফির মগ নিয়ে জানালার ধারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছি, ক্যাসেট প্লেয়ারে হালাকা ভলিউমে চয়নের গান বাজছে,

“মন তোমারে খুঁজে বেড়াই, বসে নিরালায়, যাইও না যাইও না অবেলায়”।

বাইরে প্রবল স্নো পড়ছে। তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। বেশ মোটা চাঁদ উঠেছে আজ। তবু আকাশ কেমন যেন গুমোট ছায়ায় ঢাকা। বড় থালার মত চাঁদ উঠলে স্নো ঢাকা আকাশ ছাড়িয়ে এমন মুহুর্তে চাঁদ যতটুকু মায়াবী সৌ্ন্দর্য, পাগলকাড়া রূপের ডালি আকাশের গায়ে ঢেলে দেওয়ার কথা, ততটুকু এই পোড়ার দেশের রুক্ষ চাঁদ কখনই দেয় না। তাই আমার নিজ দেশের মত ভরা পূর্ণিমায় এখন আর ছুটে চলে যাই না ছাদে, অবাক চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি না এখন আর, ভাল লাগে না। মুহুর্তে মনে পড়ে যায় সেই সময়ের কথা, যে সময়ে রাতের পর রাত অপেক্ষায় থাকতাম, চান্দি পসরের সেই মায়াবী আলোয় স্নান করবার, যে আলো সারা শরীরে মাখিয়ে দিয়ে যায় এক নতুন উন্মাদনার প্রলেপ, এক গভীর ভাললাগার স্পন্দন।

কিন্তু আমার এই মনে পড়া, ক্ষনিকের জন্য, বেশিরভাগই বাইরের জগতকে আমার আলগা কবি-হৃদয় দেখানোর জন্য। আমি এখন পুরোদস্তুর যান্ত্রিক মানুষ হয়ে গেছি। হৃদয়ের চারপাশে এক লৌহ নির্মিত আবরণের ব্যাড়াক দিয়ে দিযেছি। সেই ব্যাড়াক পেরিয়ে স্থায়ীভাবে এখন আর কোন মূছর্নার রস বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারে না, এই রিকন্ডিশান হৃদয়ে!

তাই প্রভুকে বলি,

হে প্রভু,
আমি আজ বদলে গেছি!!
আমি আর স্বপ্ন দেখি না, সবুজ ধানের তপ্ত মেঠো আল দিয়ে চপল পায়ে খামোখাই হেটে বেড়ানোর।আমি স্বপ্ন দেখি না, আকাঁবাকাঁ ছোট্ট খালের পাড়ে বসে পড়ন্ত বিকেলে বড়শী দিয়ে মাছ ধরার। এ গেঁয়ো দেশ ভাল লাগে না আর। আমি আজ স্বপ্ন দেখি, ফিটফাট বাবু হয়ে সাজানো ঝকঝকে রাস্তা ধরে যান্ত্রিক স্থলযানের পিঠে চড়ার! অথবা সুনসান নীরবতার কোন আকাশযানে গা এলিয়ে দেওয়ার।

আমি আর স্বপ্ন দেখি না, নরেন বাবুর কাঠাঁল বাগান থেকে সন্ধ্যায় সবার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঠাঁল খাওয়ার, অথবা স্কুলের পাঠ শেষে শিমুলবাগান দিয়ে আসার সময় উত্তরপাড়ার অমিতের বাসার চালে ঢিল ছুড়ে মারার। আমি আজ স্বপ্ন দেখি, ভদ্রতার লেবাশ পড়ে স্যুটেড বাবুদের আড্ডায় দিয়ে আধুনিক বিলাশীতার রকমারী আহার গলাধকরন করার।

আজ তাই তো বাজানের ধানী জমির বদলে আমি কিনি বিদ্যার ডাল (শিক্ষা), জোৎস্নার আলো গায়ে পড়ার চেয়ে পড়ি নীল ব্লেজার গাউন; শুকনো পাতা পড়ার শব্দের বদলে শুনি মদের বোতল খোলার মাদকতার ধ্বনি!

আমি আর স্বপ্ন দেখি না, দুরের মানশ্রী বিলে গিয়ে শাপলা আর সজনে ডাটার ফুল তোলার, অথবা গভীর জঙ্গলের মাধবীলতা গাছের চূড়াঁয় বসে থাকা কাকতাড়ুঁয়া পাখিকে ফাদঁ পেতে ধরে ফেলার! আমি আজ স্বপ্ন দেখি, কেউ দরদ দেখালে আবেগবিবর্জিত “ধন্যবাদ” বলার; নিজের অজান্তে কারো অশ্রু ঝড়ালে, তাকে ভাবলেশহীন গলায় “sorry” বলার। যে sorry -তে না থাকুক, ভেতরের ছটফটানো আবেগ। কিন্তু সেখানে তো আছে, এক অন্যরকম শব্দশুশ্রী, আছে তো ভদ্রতার এক ভিন্নরকম শিষ্ঠতা। সেই তো বেশ!!

আমি এখন আর বাঙ্গালী নই! আমার আর ভাল লাগে না, ম্লান উচ্ছলতায় শীরশীরে উদাস চোখ দুটির তপ্ত ধূসর উঠোনপানে কিছুক্ষন নিরিবিলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার, সন্ধ্যামালতী গাছের গায়ে দেলান দিয়ে বসে বর্নীল সূর্যাস্ত দেখার, ভালবাসার পঙ্খিরাজে উড়ে বেড়ানোর, অথবা মায়াবী কিশোরীর মায়াভরা মুখ কল্পনায় সুতায় বুনার। গ্রামের কিশোরী মেয়ের প্রেমাতুর চাহনী, আমাকে এখন আর আন্দোলিত করে তুলে না। আমার আজ ভাল লাগে, স্বল্পবসনা নারীর সাথে প্রথম দেখাতেই গরম বিছানায় নিয়ে যাওয়ার, ভাল লাগে যখন ইচ্ছা তার গর্ভে বেড়ে উঠা বাড়তি ঝামেলা সার্জন ডেকে সূচ দিয়ে খুচিয়ে মাটিতে মিশিয়ে ফেলার!

শান্ত পাকানো ছোট্ট নদীর পানির কলকলানি গান আর এখন ভাল পাই না। আমার আজ ভাল লাগে, শাকিরার ম্যাটাল মনমাতোনো ক্লাসিকে কান পাতার। আরও ভালো লাগে না, আকাশ কালো করে ঘনিয়ে আসা দামাল বাতাসের কালবৈশাখী ঝড় অথবা সেই ঝড়ো বাতাসে অনাবৃত শরীর এলিয়ে দেওয়ার, বরং ভাল লাগে স্ফটিক জানালার কাঁচের ধারে নিরাপদে বসে মৃদু শুভ্র স্নো পড়া দেখার।

কোন ভুতুরে রাত্রিতে ঠাকুরের কোলে বসে ঠাকুরমার ঝুলি শোনার আজ আর আমার স্বপ্নে জাগে না. অথবা জাগে না মায়ের কোলে বসে আনারস আর শীতলী পিঠা থাওয়ার। বরং স্বপ্নে জাগে, ম্যাকডোনাল্ডের ক্যাবিনে বসে কোকসমেত বার্গার চিবানোর। অথবা টিম হর্তনের দামী কফির পেয়ালায় আরামসে আলতো চুমুক দেওয়ার।

আমি এখন শহুরে আদলে গড়া অন্য এক পরিপূর্ণ মানুষ। আমি এখন শুধু স্বপ্ন দেখি ক্রিস্লার সিভিক গাড়ি কিনে বড় রাস্তায় চড়িয়ে নেওয়ার, স্বপ্ন দেখি দুতলা ফাউন্ডেশনের শুভ্রসাদা এক বাড়ি কেনার।পেছনে ভুলে গেছি কুঁড়ে ঘরে পচে মরা আমার বাবার জীবনভর লড়াইয়ের হাহাকার। অথবা মমতাময়ী মায়ের শাসনভরা চোখেরাঙ্গানী আর আমাকে নিত্য সুন্দরের মাঝে আড়াল করে রাখা দিনগুলির আকুতি।………. এই তো!

আমি আজ অনেকটাই বদলে গেছি প্রভু। অনেকটাই।

খুব কি অন্যায় করে ফেলছি প্রভু!

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


27 Responses to আমি আজ অনেকটাই বদলে গেছি, প্রভু

You must be logged in to post a comment Login