জুলিয়ান সিদ্দিকী

উপন্যাস: নিক্বণ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


বুড়ো বয়সে এসেও নৌকার লগি ঠেলতে এতটুকু হাত কাঁপে না রহিমুদ্দির। তবু কখনো কখনো ইচ্ছে হয় স্রোতের মুখে নৌকার লগি তুলে পাটাতনের উপর চিত হয়ে শুয়ে থাকতে। নৌকা ভেসে যেতো আপন গতিতে আর সেই বিশাল আকাশটাকে দেখতে দেখতে হারিয়ে যেতো দূরে কোথাও। নৌকা ভেসে যেতো অন্য কোনো ঘাটে।

নৌকা নিয়ে সে যেখানেই যাক না কেন, সওয়ারি অথবা মাল আনা নেওয়ার কাজ সহজেই পেয়ে যাবে। তার শূন্য ঘর পড়ে আছে বিরান। যে কারনে তার ঘরে ফেরার তাড়া নেই। নেই দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবার উৎকন্ঠাও। কিন্তু ছাপ্পান্নতে পা দিলেও তার শরীরের গঠন এখনও অটুট। একটা দিন বিনা কাজে বসে থাকবার কথা ভাবতে পারে না সে। কাজ করা মানেই পয়সা। আর পয়সা মানেই খাবারের নিশ্চয়তা। খাবারের নিশ্চয়তা না থাকলে তার হাত পা থামতে চায় না। চোখ থেকে উধাও হয়ে যায় ঘুম। যেহেতু তিন কূলে তার কেউ নেই, যে তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে বা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করবে। এমন আশা সে করেও না। কোনোরকমে কাজে ঢিল পড়লেই তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ ক্ষুধাকে তার দারুণ ভয়। কিছুটা ঘৃণাও করে বুঝি। তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বলে যে, ক্ষুধার মত কষ্ট আর ভাতের মত সুস্বাদু জগতে কিছু নেই। তার ভাত হলেই চলে। কখনো কখনো ভাতের সঙ্গে লবন মরিচ জুটলে ভালো। কখনও তরিতরকারি থাকলে তা আরো উপাদেয়।

সেই ছোট বেলা থেকেই সে ক্ষুধাকে ভয় পায়। সে সাথে এটুকু বুঝতে শিখেছে যে, নিজের আহার নিজকেই জুটাতে হবে। অন্য কেউ যে সব সময় ভাতের নিশ্চয়তা দিতে পারবে তা কিন্তু নয়। সে এর কঠিন আর নিষ্ঠুর দিকটা ছোট বেলাতেই শিখে গিয়েছিলো। যেমন, একদিন তার বাবা কাজের সন্ধানে শহরে গিয়েছিলেন। ফিরতে দেরি হচ্ছিলো দেখে তার মা হায় আফসোস করছিলেন যে, ঘরে যে পরিমাণ ভাতের চাল আছে তাতে দুদিন ভালো মত চলবে না। মায়ের আশঙ্কার কথা শুনে রহিমুদ্দি ভয় পেয়েছিলো। দুদিন পর যদি বাবা ফিরে না আসে তাহলে তারা খেতে পাবে না। সেই ভয় পরদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো প্রায় পনের মাইল দূরে, চৌধুরীদের ইটের ভাটায়। কাঁচা বা পোড়া ইট মাথায় করে স্থানান্তরের কাজ।

ক্ষুধার ভয় তাকে এতটাই তাড়িত করেছিলো যে, ঘরে যদি খাবার না থাকে, তাহলে তার মাও না খেয়ে থাকবে; কথাটা একবারের জন্যও মনে পড়েনি। কিন্তু দিন দশেক পরে যখন তার এ কথা মনে হয়, তখন সে বুঝতে পেরেছিলো যে, বাবা ফিরে না এলে তার মাকেও ভাতের কষ্ট পেতে হবে। আর এ কথা মনে হতেই সে ম্যানেজারের কাছে ছুটে গিয়েছিলো।

ম্যানেজার রহিমুদ্দির কথা শুনে অবাক হয়ে বলেছিলো, তুই বাড়ি যাইস না দশদিন হইয়ে গেছে?

হয়।

আরে, এহানে যারা কাজ করতি আসে তিন দিন পার হইয়ে গেলেই বাড়ি যাবার জন্যি পাগল হইয়ে ওঠে। বাড়ি যাতি না পারলে কাজকর্ম বন্ধ কইরে শুইয়ে পড়ে।

রহিমুদ্দি একটুও সংকোচ না করে বলেছিলো,মা মনে কয় ভাতের কষ্ট পাচ্ছে!

তালি তুই বাড়ি যাবি ক্যান? ম্যানেজার অবাক হয়ে বলেছিলো, তুইও তো না খাতি পাইয়ে কষ্ট পাবি মায়েরে ট্যাহা-পয়সা দিয়েই চইলে আসবোনে!

এর পর ইটের ভাটায় আর যাওয়া হয়নি রহিমুদ্দির। বাড়ি ফিরে এলে বাবা মা দুজনেই তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন। শেষে তারা তাকে কিরে দিয়ে বলেছিলেন, আমাগেরে ফেলে কোনোদিন কুত্থাও যাবিনে! আমরা মইরে গেলে পরে যেহানে খুশি সেহানে যাইস!

এরপর বাবা মা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন রহিমুদ্দি কোথাও যায়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের বছর যেদিন গ্রামে মিলিটারি ঢুকে পড়েছিলো সেদিন তার বাবা মা দুজনেই তাকে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে বলেছিলেন।

এমন বিপদের দিনে বাপ মাকে ছেড়ে, অন্ত্বসত্তা স্ত্রী আয়শাকে ছেড়ে সে যেতে না চাইলে মা বলেছিলেন, আমাগের সামনে যদি তুই গুল্লি খেয়ে মরিস তালি হাশরের দিনে ঠেকা থাকবি!

রহিমুদ্দি অসহায় চোখ তুলে তাকিয়েছিলো আয়শার দিকে। আয়শাও তাকে হতাশ করে দিয়ে বলেছিলো, দেরি করবেন তো আমার মাথা খান!

এর পর সে আর দেরি করেনি সে। একছুটে পালিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে। কিন্তু সেই পালানোটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রাতের বেলা চুপি চুপি ফিরে এসে সে উঠোনে পড়ে থাকতে দেখেছিলো গুলি খাওয়া বিকৃত দুটি লাশ। আয়শাকে পায়নি সে। তার লাশও পায়নি। পরে শুনেছে যে আয়শাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো পাকবাহিনির লোকেরা।
সেই কঠিনতম রাতে কেউ যে তাকে সাহায্য করবে, এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। জানোয়ারের বাচ্চারা প্রতিটা ঘরেই আগুন দিয়েছিলো। আগুনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কিছুই। পোড়া ঘরের বাঁশ, কাঠের খাম্বাগুলোকে ধিকি ধিকি জ্বলতে দেখেছিলো। যেভাবে তার বুকের ভেতরও সর্বস্ব হারানোর শোকে জ্বলে উঠেছিলো চরম এক প্রতিশোধের আগুন।

অন্ধকারেই খুঁজে-পেতে একটি কোদাল সংগ্রহ করে আনে রহিমুদ্দি। তারপর একা একাই উঠোনের পাশে বড় একটা গর্ত খোঁড়ে। পুকুর থেকে মাটির কলস ভর্তি করে পানি এনে দুটো মৃতদেহের রক্ত ধুয়ে দিয়েছিলো। যদিও তারা অন্যায় ভাবে নিহত হয়েছিলেন। তাঁরা শহিদ হলেও তাঁদের ভাগ্যে কাফন জোটেনি। জোটেনি একটুকরো পরিষ্কার কাপড়ও। মায়ের পরনে যে কাপড়টা ছিলো, সেটা ছিঁড়ে দুটো টুকরো করে দুজনের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলো ভালো মত।

তারপর লাশ দুটো মাটি চাপা দেবার আগে অযু করে আসে রহিমুদ্দি। অযু বলতে কেবল হাত-পা মুখ ধোওয়া আর কুলকুচা পর্যন্তই। ওযুর দোয়া বা নিয়ম-কানুন তার জানা নেই। জানা নেই কিভাবে জানাজা দিতে হয়। তবু সে তার মৃত বাবা-মাকে সামনে রেখে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলেছিলো, পাক পরোয়ারদেগার, রহমানুর রাহিম আমি জানি না কোন দোষে পাকিরা আমার বাবা মায়েরে খুন কইরেছে বাড়ি ঘরে আগুন দেছে কোন পাপের শাস্তি তুমি তাগেরে অ্যাম্বা দিলা তাও শেষ কালে নিদানের বন্ধু তুমি আর তোমার হাবিবের কুদরতের কাছে আমার বাবা মায়েরে তুইলে দিলাম। আমার যতদিন সাধ্যে কুলোয়েছে তদ্দিন তাগের হেফাজত করতি চেষ্টা করেছি। এখন তোমরা তাগের হেফাজত কইরো তাগের ভেস্ত নসিব কইরো দুজনকে একই গর্তে নামিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো রহিমুদ্দি। পরে ফিরে এসে যাতে চিহ্ন-টিহ্ন খুঁজে বের করতে সমস্যা না হয় সেই জন্যে সে কবরের উপর একটি খেঁজুরের ডাল আর আট-দশটা জিগা গাছের ডাল পুঁতে দিয়েছিলো। কদিন পর খেঁজুরের ডাল শুকিয়ে গেলেও বেঁচে উঠবে জিগার ডালগুলো। এখানে কাছাকাছি কোন জিগা গাছ নেই বলে, একটা গাছ বেঁচে উঠলেই কবরের নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই সাথে কয়েক কলস পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিলো পুরো কবরের মাটি।
বাবা মাকে সমাহিত করার পর সে আর গ্রামে থাকেনি। ভোর হবার আগে আগে, অন্ধকার থাকতে থাকতেই সে সরে গিয়েছিলো আরো দূরে, গ্রামাঞ্চলের গভীরে; মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানায়। যেখানে পাকিরা পৌঁছতে পেরেছিলো তারও অনেক পরে। ততদিনে অবশ্য রহিমুদ্দি অস্ত্র চালাতে শিখে গিয়েছিলো। শিখে গিয়েছিলো কিভাবে দাঁতে কামড়ে গ্রেনেডের সেফটি পিন খুলে নিয়ে কতটা দ্রুত আর নিরাপদ কৌশলে শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া যায়।

যতদিন দেশে যুদ্ধ ছিলো ততদিন সে আসেনি তার পোড়া ভিটেতে। আসেনি বাবা মায়ের কবর দেখতেও। কিন্তু যুদ্ধ শেষে কাঁধে স্টেনগান নিয়ে সে বিজয়ীর বেশে গ্রামে ঢুকলেও তার ঝুঁকে পড়া মাথা আর উঁচু করতে পারেনি।
কিছুদিন এর ওর কাছে জানতে চেয়েছে স্ত্রী আয়শার কথা। কিন্তু কেউ হদিস দিতে পারেনি। কেবল অখিল কবিরাজ বলেছিলো, আয়শারে ওরা ধইরে নিয়ে গিয়েছে। দুপাশ থেইকে দুজন পাকি তার দুহাতে ধইরে টেইনে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো ইস্কুল ঘরের ক্যাম্পে। সঙ্গে চেয়ারম্যান ছিলো, এডাও অনেকে দেইখেছে। অখিল কবিরাজ কিছুক্ষণ কান্না দমনের চিষ্টা করে পরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, গিরামের যে কজন মেয়েকে পাকিরা ধইরে নিয়ে গিয়েছিলো পরে তাগের কারো লাশও পাওয়া যায়নি। কেউ বলে যে, সঙ্গে কইরে নিয়ে গেছে। কেউ বলে ইস্কুল ঘরের মেঝে খুঁড়ে সেখানেই মাটি চাপা দিয়েছে। কিন্তু ইস্কুল ঘরের পুরো ভিটের মাটি উল্টে ফেইলেও মানুষের একটা হাঁড় পাওয়া যায়নি নিখোঁজ আয়শার দলে অখিল কবিরাজের দুমেয়ে কাকলি আর কাজলিও ছিলো। রহিমুদ্দি কী সান্ত্বনা দিতে পারতো সেদিন? আর চেষ্টা করলেও পারতো না হয়তো। কারণ দুজনের হৃদয় যে একই রকম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। একই অগ্নিতাপে প্রজ্জ্বলিত।

চেয়ারম্যান ফজলুকে পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষ বলেছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা তার হাত-পা কেটে খালের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। তারও অনেক পরে গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে এমন হাত-পা কাটা একজনকে দেখেছে ভিক্ষে করতে। রহিমুদ্দির সন্দেহ হয়েছিলো যে, চেয়ারম্যান পানিতে ডুবে মারা যায়নি। কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিলো। এখন ভিক্ষে ছাড়া যে অনন্যোপায়।


সন্ধ্যা হয় হয় ঠিক এমন সময় রহিমুদ্দি গোঙ্গার হাটে এসে পৌঁছায়।

হাটবার বলে ঘাটে অনেক নৌকা একটার সাথে আরেকটা এমন ভাবে লাগিয়ে রেখেছে যে, রহিমুদ্দি সচরাচর যেখানে নৌকা ভিড়ায়, সেখানে এগিয়ে যেতে পারলো না। কিছুটা পেছনে সরে এসে দুটো নৌকার মাঝে সামান্য ফাঁক পেয়ে তার নৌকার মাথা প্রবেশ করায়।

তারপর আস্তে আস্তে লগিতে চাপ দিলে তার নৌকা এগিয়ে যেতে যেতে দুপাশের নৌকা ঠেলে নিজেই জায়গা করে নেয়। নিজের জায়গা নিশ্চিত করে লগিটা নিয়ে ঘাটে নেমে পড়ে। কিছুটা নরম কাদা দেখে লগিটাকে সেখানে জোর দিয়ে খুঁটির মত করে গেঁথে ফেলে। শেষে লগির সাথে নৌকার দড়িটাকে বেঁধে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে আসে।

এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে ধান কলের মালিক তালেব ব্যাপারির গদিতে এসে ব্যাপারির খোঁজ করে। কিন্তু মুন্সি আকবর আলি বললো, ব্যাপারি আইজ আসেনি।

তালি আমি যে চাইল নিয়ে আলাম!

ও নিয়ে তোমার মাতা গরম করতি হবিনানে খাতায় তুলে চালান লেইখে দেবানি, যাবার সুমায় নিয়ে যাইও।

রহিমুদ্দি কোমর থেকে গামছা খুলে হাতমুখ মুছতে মুছতে বলে, তোমার লোকজন কনে, আমার বস্তা তুলবে কেডা?

ও হবেনে! বলে, মুন্সি গদি থেকে উঠে ঘাটমুখো দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, তোমার নৌকো কোনডা?

ওই যে পাটের নৌকোর সাতেই!

কয় বস্তা আইনেছো?

সাতবস্তা। বরাবর তো এই কডাই আনি!

মুন্সি হয়তো নৌকার বস্তা গোনে। কেমন যেন মাথা ঝোঁকাতে দেখা যায়। তারপর বলে, ইবার কেমন জানি মনে হতিছে!

রহিমুদ্দি অবাক হয়ে বলে, কেমন মনে হতিছে?

ইবার পুরাপুরি মাপের চাইল হবেনানে!

কয়েন কি মুন্সি?

হয়।

পরতেকবার যে বস্তায় আনি, ইবারও তো তাই রয়েছে!

উঁহু!

টাকরায় জিভ লাগিয়ে চুকচুক শব্দ করে মুন্সি।

মুন্সির রকম-সকম দেখে রহিমুদ্দির খটকা লাগে। এর আগে যতবার এসেছে, প্রত্যেকবারই তালেব ব্যাপারিকে নৌকায় বস্তা দেখিয়ে হাটের ভেতর চলে যেতো রহিমুদ্দি। ওজন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। আয়নাল মিয়া বস্তা প্রতি পঁচাত্তর কেজি করে চাল মেপে বস্তার মুখ নিজ হাতে সেলাই করে দেয়। এখানে এসেও ওজনের হেরফের হয় না। কিন্তু মুন্সি কী বলছে এসব?

রহিমুদ্দি কিছু না বলে বাইরে বের হয়ে আসে।

তারপর নৌকায় এসে বস্তার উপর বসে বসে বিড়ি টানে। কিন্তু মুন্সির কথার আগামাথা খুঁজে পায় না। এক সময় তার মনে সন্দেহ জাগে যে, মুন্সি তালেব ব্যাপারির গদি দখল করে ফেললো কিনা কারণ, কত কর্মচারিই তো তার মালিকের সব কিছু লুটেপুটে একদিন নিজেই মালিক হয়ে বসেছে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তালেব ব্যাপারির লোকজন বস্তা নিতে আসে না। মনে মনে সে অস্থির হয়ে উঠতে থাকে। ঘাটে নৌকা ভেড়াবার সাথে সাথেই তার পেটে একটা আগুনে ক্ষুধা লাগে। চালের বস্তা কাউকে না বুঝিয়ে দিয়ে সে কোথাও বেশি সময়ের জন্যে যেতেও পারছে না এখন। এমন সময় আরেকটা নৌকা থেকে তালেব ব্যাপারিকে নামতে দেখা যায়।

রহিমুদ্দি বলে, সালামো আলাইকুম ব্যাপারি! কোনহানে গেইছলেন? গদিতে যাইয়ে পালাম না!

তালেব ব্যাপারি বলে, পুরান গদিতে গেইছলা?

হয়!

মুন্সির সাতে কতা হইয়েছে?

তাতো হইয়েছে!

ওডা আমি ছেইড়ে দিয়েছি কাইল। এহন বড় দেইহে আরেকটা নিয়েছি!

আমি তো ও খবর জানিনে!

আমার সঙ্গে আসো।

আমার নৌকা?

আমার মাঝি দেইহে রাখবেনে।

রহিমুদ্দি তালেব ব্যাপারির পেছন পেছন উঠে আসে। সত্যিই বড়সড় দালান ঘর। মেশিনও বসেছে বেশ কয়েকটা। রহিমুদ্দি দালানে প্রবেশ করতেই ব্যাপারি তার নতুন মুন্সিকে বলে, লোকজন পাঠায়ে বস্তা আনাবার ব্যবস্থা কর!

তারপর রহিমুদ্দিকে বলল, সাত বস্তাই আনিছাও?

হয়।

ব্যাপারি মুন্সিকে বলল, পঁচাত্তর কেজি কইরে সাতবস্তা চাইলের একটা চালান বানাইয়ে রহিমুদ্দিরে দিয়ে দেও দেহি!

মুন্সি গোলাম হোসেন বলে কাউকে ডাকলো। সঙ্গে সঙ্গেই একজন দরজায় মুখ বাড়ালে মুন্সি আবার বলে, ঘাটে আমাগের মাঝি রয়েছে। রহিমুদ্দির নৌকো থেহে চাইলগুলা তুইলে আনো। যাও!

তালেব ব্যাপারি মুন্সিকে বললো, রহিমুদ্দিরে মিষ্টি আইনে খাওয়াও!

রহিমুদ্দি অবাক হয়ে বলে, মিষ্টি খাতি কচ্ছেন ক্যান ব্যাপারি, ঘটনা কি?

ব্যাপারি হাসে। নতুন গদিতে এয়েছো, মিষ্টি খাওয়াতি হবে না? তা ছাড়া তুমি এতদিন ধইরে আমাগের সঙ্গে আছো, তোমাক বাদ দিয়ে কোনো আনন্দ হতি পারে?

ছোট্ট একটা কলাপাতার টুকরোতে দুটো মিষ্টি এনে রহিমুদ্দির হাতে দেয় মুন্সি। তারপর কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চালান তৈরি করে সে এগিয়ে দেয়।

টপাটপ মিষ্টি দুটো মুখের ভেতর চালান করে দিয়ে রহিমুদ্দি হাত বাড়িয়ে মুন্সির কাছ থেকে সাতবস্তা চালের চালান নেয়। চালান হাতে পেয়ে রহিমুদ্দির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।

তারপর ব্যাপারিকে সালাম দিয়ে গদি থেকে বেরিয়ে আসে।

দুটো মিষ্টি পেটে পড়তেই যেন তার ক্ষুধা আরো দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠে। সে প্রায় ছুটে যায় মন্টু মিয়ার ভাতের হোটেলে। হন্তদন্ত হয়ে সে হোটেলে প্রবেশ করে নিজে নিজেই টিনের থালায় ভাত নেয়। লবন আর দুটো কাঁচা লঙ্কা হলেই তার চলে।
কোনো কোনো দিন শুধু ডাল অথবা মাছ। খুব বেশি ইচ্ছে হলে এক বাটি গরুর গোস্ত নেয়। আজ সে দ্বিতীয় থালার সাথে রুই মাছের পেটি নেয়। গোস্তর চেয়ে মাছ বরাবরই তার পছন্দ।

খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে রহিমুদ্দি এক কাপ চায়ের কথা বলে। ভাতের পরে কখনো কখনো চা পান করা তার এক ধরনের বিলাসিতা। এ ছাড়া বাজে খরচ সে কখনোই করে না। বিল শোধ করে সে কালুর দোকানে এসে এক টকুরো শুপারি নিয়ে মুখে দেয়। সে সাথে এক প্যাকেট বিড়ি দিতে বলে।

কালু বলে, গত হাটবারে তো পয়সা ফেরত নিলা না!

তাতে হইয়েছে কি? পয়সা তো আর উইড়ে যাবে না!

কালু হাসে। বিড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে, বাকি দু পয়সা পরে দিও।

রহিমুদ্দি বিড়ির প্যাকেট হাতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিড়ি ধরিয়ে ভুস ভুস করে টানে আর মুখ ভরে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর গজেন্দ্র চালে বাজারটা চক্কর দিতে এগিয়ে যায়।


হাট বার বলে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও পুরো হাট জনশূন্য হয়ে যায় না। বিভিন্ন পসারি যার যার পসরা নিয়ে এখনো বসে আছে কেউ কেউ। পসরা গুটিয়ে ফেলার আগে দু একটা খদ্দের পাওয়া যায় কি না। কিছুটা দূরে দোনলা বাতি জ্বালিয়ে এক বেদেনী তার পসরা নিয়ে এখনও বসে আছে। রহিমুদ্দি দূর থেকে বেদেনীর হরেক রকমের পসরা দেখে।

চুড়ি, ফিতে, পুতির মালা, তাবিজ-কবজ সহ আরো অনেক নাম না জানা জিনিস। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এক সময় হয়তো নিজেরই অজান্তে এগিয়ে যায় সম্মোহিতের মত।

মাটিতে বিছিয়ে রাখা বেদেনীর পসরার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বেদেনী বলে, কোনডা নেবা, যাবার সোমায় দাম কম নেবানে!

একগাছি লাল কাচের চুড়ি রহিমুদ্দিকে প্রবলভাবে আকর্ষন করে। সে উবু হয়ে চুড়িগুলো হাতে নেয়। চুড়ির মসৃন আর পিচ্ছিল
গায়ে নিজের অজান্তেই হাত বুলায়। তারপর চুড়ির বেড়ের ভেতর চার আঙ্গুলের মাথা ছুঁইয়ে ভাবে, আয়শার হাতে লাল চুড়ি খুবই সুন্দর দেখাতো। হাতের রঙের কারনে লাল রঙটা আরো গাঢ় হয়ে ফুটে উঠতো। তার হাত খুব নরম ছিলো বলে মাপের চেয়ে কিছুটা ছোট চুড়িও গলে যেত অনায়াসে।

রহিমুদ্দি আয়শার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারে না। লাল রঙের প্রতি যার আকর্ষন ছিলো খুব। এ রঙের যাই হোক না কেন, তার কখনোই অপছন্দ হতো না। খুশিও হতো। এখন রহিমুদ্দির ঘরে এ চুড়ি পরবার মতো কেউ নেই। তবুও কেন জানি হঠাৎ সে বলে উঠলো, এক মুঠ কত নেবা?

লাও। সাত ট্যাকা দিয়ে দিও!

রহিমুদ্দি চুড়ি নেবে না। কিনবার ইচ্ছেও নেই। তবুও যেন মুখ ফসকে বলে ফেলে, তিন ট্যাকা দেবানে!

না। এই গিলান রেশমি চুড়ি। তিন-চাইর ট্যাকায় বিকাবার জিনিস লয়।

বেদেনেীর কন্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলে রহিমুদ্দি ফের উবু হয়ে চুড়িগুলো রেখে দেয়। যেন একটু শব্দ হলেই তারা ব্যথা পাবে। তারপরও কেন যেন চুড়িগুলোর প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

বেদেনী বলে, লাও লাও! দাম তো বেশি চাইনি!

রহিমুদ্দি কিছু বলে না।

বেদেনী বিরস মুখে বলে, চুড়ি নেবা না?

নাহ। বলে, অন্য দিকে তাকিয়ে বিড়ি টানে রহিমুদ্দি।

বেদেনী চুড়িগুলো হাতে নিয়ে রহিমুদ্দির দিকে বাড়িয়ে ধরে। লাও, পাঁচ ট্যাকা দিয়ে নিয়ে যাও!

রহিমুদ্দি রাজি হয় না। সে ফিরে যাবার মনস্ত করে।

বেদেনী কাগজ দিয়ে চুড়িগুলোকে মুড়িয়ে বলে, আচ্ছা, তিন ট্যাকাই দ্যাও! রাইত হইয়ে গেছে বইলে দিলাম!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রহিমুদ্দি চুড়িগুলো নেয়। এগুলো নিয়ে সে কী করবে জানে না। এমন কেউ নেই যাকে সে চুড়িগুলো দিয়ে দিতে পারে। তবু সে ওগুলো নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে। তারপর গলুইয়ের নিচে খুব যত্নে রাখে, যাতে ওগুলোতে কোনমতেই পানি লেগে না যায়।

কাদায় গেঁথে রাখা লগি থেকে দড়ির গিঁট খুলে সে লগি টেনে উঠিয়ে নেয়। তারপর বদর বদর বলে আস্তে ধীরে নৌকা ছাড়ে। চারিদিক ঘোর অন্ধকার মনে হয়। কেবল হাটের দিকে দু একটা আলো এখনো জ্বলছে। অবশ্য কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠলেই সব পরিষ্কার দেখা যাবে। অন্ধকারে কেবল পানির উপর দিয়ে অনুমান করে এগিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া বাইরের খোলা জায়গার অন্ধকার যতই গাঢ় হোক খালের পানি আবছা মত প্রায় সবটাই দেখতে পাওয়া যায়।

গোঙ্গার হাট পেছনে ফেলে মাইল খানেক এগিয়ে যাবার পর খালের পাড় ধরে দুজন মানুষকে এগিয়ে যেতে দেখে রহিমুদ্দি। নৌকার গায়ে লগি ঘষা লাগবার শব্দে বা পানি কেটে নৌকা এগিয়ে যাবার শব্দে মানুষ দুজন থামে হয়তো। একটা পুরুষকন্ঠ বলে, নৌকা যাবে কোহানে?

রহিমুদ্দি লগিতে ভর দিয়ে বলে, সিদ্দিশ্বরী।

আমাগেরে পঞ্চবটি নামায়ে দিতি পারবা?

তালি তো নৌকা অনেকটা পথ ঘুরাতি হবি!

আমাগের খুবই বিপদ! তোমার কষ্ট পোষায় দেবানে!

পুরুষ কন্ঠটা পরিচিত মনে হলেও রহিমুদ্দি অনুমান করতে পারে না যে ,লোকটা কে? তবুও রাত-বিরেতে অচেনা যাত্রী তোলাটা অত সহজ কাজ নয়। কার মনে কি অভিসন্ধি থাকে বলা মুশকিল সে পাড়ের কাছ ঘেঁষে নৌকা নিয়ে এগোবার সময় সতর্ক হয়ে দেখতে চেষ্টা করে। সঙ্গে একজন মেয়ে মানুষও রয়েছে। পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে সে বললো, সঙ্গে মেয়ে-ছাওয়াল রয়েছে দেখছি। তা এত রাইত হইয়েছে ক্যান?

লোকটা নৌকার মাথিতে পা দিয়ে বলে, সে অনেক কতা! তারপর সঙ্গের মেয়ে মানুষটাকে হাত বাড়িয়ে নৌকায় তুলে লোকটা বললো, এডা আমার বেটি। এরে নিয়ে নিজের বাড়ি পলায়ে যাচ্ছি

রহিমুদ্দি কন্ঠস্বরের সাথে মিলিয়ে তার সকল পরিচিতদের মাঝে মনে মনে অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু ঠিক মত ধরতে পারে না। সে বলে, আপনেরা ঠিক মত বইসেছেন তো?

হয়! বলে, পুরুষটি সম্মতি জানায়।

তালি নৌকা ছাড়ি?

ছাড়ো।

সামনের দিকে পাড়ে লগি ঠেকিয়ে রহিমুদ্দি নৌকাটাকে একবার পিছিয়ে এনে ঘুরিয়ে খাল বরাবর করে। তারপর পাশে লগি ফেলে ভর দিতেই নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদ উঠতে এখনো বেশ কিছুটা দেরি। তবুও খালের পানিতে কেমন একটা আবছা আলো ফুটে থাকে। রহিমুদ্দি চাঁদ উঠবার অপেক্ষায় থাকে। চাঁদের আলোতে সে দেখতে চায় পুরুষ চড়নদারটি কে? কন্ঠস্বর যার অতি পরিচিত মনে হয়।


পঞ্চবটি যাবার পথ খানিকটা ভিন্ন। সামনের ত্রিমোহিনী থেকে হাতের বাম দিকে যে খাড়িটা গেছে, সেটা এঁকেবেঁকে পঞ্চবটি গ্রাম ছুঁয়ে বিবির ছইয়াকে দু’ভাগ করে একটু বাঁক খেয়ে আবার ত্রিমোহিনীতে এসে পড়েছে। এখান থেকে নৌকা ঘুরিয়ে সোজা চালিয়ে যেতে হবে দক্ষিণে। পাকা সাড়ে তিন মাইল পথ। তারপর সে গিয়ে পুরোপুরি খালে পড়বে। তারপর নোয়াকান্দি আর গোলাকান্দি গ্রাম দু’টোকে দু’পাশে রেখে সোজা সিদ্ধেশ্বরী।

পুরুষ চড়নদারটি বলে, ‘মাঝির কাছে বিড়ি থাকলি দেও দিনি একটা!

রহিমুদ্দি কিছু না বলে একহাতে ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, সঙ্গে আগুন আছে না?

আছে! বলে, চড়নদারটি বিড়ি নিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন জ্বালায়। তারপর বিড়িতে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে বলে, বুঝছাও মাঝি, দুনিয়াডা এতই খারাপ অইয়ে গিয়েছে যে, কারু সঙ্গে ভালো থাহা যাবিনানে!

লগি ঠেলতে ঠেলতে রহিমুদ্দি বলে, দুনিয়ার আর দোষ কি বলেন, আসলে আমরাই দিন দিন খারাপ হইয়ে যাচ্ছি!

তাও কতা খারাপ কওনি!

রহিমুদ্দির কথায় যেন সায় দেয় সে। তারপর আবার বলে, তয় কাউ যদি তোমার পায়ে ইচ্ছে কইরে পা চাইপে ধরে, তালি তুমি কি তারে ছাইড়ে দেবা? অ্যাহেবারে চুপ মাইরে থাকবা?

তা কি আর অয়! লগিতে ভর দিতে দিতে নির্বিকার ভাবে বলে রহিমুদ্দি।

তো শালারা, মাইয়েডারে দিন-রাইত খাটায়ে খাটায়ে মারবি, তিন বেলা ঠিক মত খাতি দে! বছরে বেশি না হোক দুডো কাপুড় দে! না, তা করবে না! বলে কিনা, আমাগের বউ আমরা যেম্বা রাখবো এম্বাই থাকবে! এর আগের বার কলাম, মাইয়েডা যখন বেধবা অইয়েই গেছে, আমার সঙ্গে দিয়ে দেও- কয়ডাদিন থাইহে বেড়াইয়ে আসবেনে! শালারা তাও দিতি চায় না। বলে কি, সোয়ামী মইরেছে তো অইয়েছে কি, আমরাও কি মইরে গেছি? বউরে বাপের বাড়ি যাতি দেবো না কুনুদিন!

রহিমুদ্দি আনমনে বলে ওঠে, এযে দেখছি সাড়ে হারামজাদা!

কেবলি কি হারামজাদা? কও বেজন্মার বংশ!

রহিমুদ্দি কিছুক্ষণ চুপচাপ লগি ঠেলে। তারপর বলে, আর কিছুক্ষণের মদ্যি আমরা ত্রিমোহিনী পৌঁছ্যা যাবো। তার বাদে হাতের বামে ঘুইরে নৌকা চালাতি হবেনে।

চড়নদার বিড়ির শেষ অংশটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে রহিমুদ্দির দিকে মুখ তুলে বলে, মাঝির গিরামের নাম সুরেশ্বর না কি বইলেছিলা?
সিদ্দিশ্বরী।

সিদ্দিশ্বরী তো চিনি। কোন বাড়িডা তোমাগের কও দিনি!

জোড়া শহিদ বাড়ি।

ওই দুই শহিদ আমার মামুতো ভাই আর তার বউ।

সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে যায় রহিমুদ্দির কাছে। সোৎসাহে সে বলে ওঠে, তাই তো কই, আপনের গলা শুইনে কেম্বা জানি চিনা চিনা মনে হতিছিলো। তালি আপনে ছমেদ কাকা?

আমারে চেনলা কেম্বা? লোকটির কণ্ঠস্বরেও যেন বিস্ময় ঝরে পড়ে।

আমি রহিমুদ্দি।

অ, রহিমুদ্দি! অন্ধকার বইলে তোরে চিনতে পারিনি বাপ! তা, তুই নৌকার কাজ আর ছাড়িসনি, লয়?

ছাড়বার সময় পালাম না কাকা! তা সঙ্গে ইডা কুলসুমি না ফাতুনি?

তুই কুলসুমিরে চিনতে পারিসনি?

এডা কুলসুমি?

তারপরই রহিমুদ্দি হেসে ওঠে। তার মনে পড়ে যায় যে, ছোটো বেলা সবাই কুলসুমি লো কুলসুমি, তোর কান দুডো ছিড়মুনি! সুর করে বলে বলে তাকে ক্ষেপাতো। সে কুলসুমির দিকে তাকায় কিন্তু মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না। বলে, তোর কি মনে আছে কুলসুমি, তোরে কি বইলে ক্ষেপাতাম?

কুলসুমি হেসে ওঠে। তার কণ্ঠে যেন জলতরঙ্গ বাজে। তা কি ভুইলে যাবার কথা?

তারই সঙ্গে সঙ্গে যেন তার মুখর কৈশোরও একটু উঁকি মেরে যায়।

রহিমুদ্দি ছমেদ মিয়াকে বলে, তা কাকা, ফাতুনি কেম্বা আছে? ছাওয়াল-পাওয়াল কয়ডা?

ফাতুনি ভালই আছে। কিন্তু মিয়্যাডার মনে অয় বাচ্চা-কাচ্চা হবেনানে। অনেক বছর তো হইয়ে গেল!

রহিমুদ্দি এ কথার পিঠে কি বলতে পারে বুঝতে পারে না। সে চুপচাপ লগি ঠেলে। দূর আকাশে চাঁদ মুখ বাড়ায়। বড়, গোল রূপার থালার মত চাঁদ। তবে এ থালার ছাল বাকল উঠে গেছে অনেকটা। যে কারণে একে দেখায় অনেক পুরোনো আর ক্ষয়ে যাওয়া।

ছমেদ মিয়া বলেন, তোগের বাড়ি যাই না পেরায় আঠার বিশ বছর হইয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে তোর কহনো দ্যাহা পাইনে বলে আর যাবার গরজ হয় না। তা পরে বিয়ে করিছিলি কোহানে?

ওডা আর হইয়ে ওঠেনি কাকা!

তো এম্বা একলা একলা আর চলবি কতদিন?

রহিমুদ্দি মনেমনে বলে, এমন কইরে চলতি তো আমারও মন চায় না। কিন্তু করবোডা কি? আমার এহন যা বয়স, এ বয়সে কাইরে কিছু কবার তো সাহস পাই না।

ছমেদ মিয়া নড়ে চড়ে বসে বললেন, এহনও সুমায় আছে ব্যাটা! কতি গেলে আমি ছাড়া তো তোর কাউ নাই! তাই কতিছিলাম যে, আমি বাঁইচে থাকতি থাকতি কিছু একটা কর!

ছমেদ মিয়ার শেষ দিকের কথাগুলো শুনতে পায় না রহিমুদ্দি। সে ভাবছিলো যে, যুদ্ধের বছরই বিয়ে হয়েছিলো কুলসুমির। ওর শ্বশুর বাড়ির দিকে পাকিরা যেতে পারেনি। তাই অনেকদিন ওরা যুদ্ধের খবর পায়নি। তাহলে কুলসুমি বিধবা হয়েছে বেশিদিন হয়নি। বছর পাঁচেক আগে একজন সরকারি লোক নিয়ে গিয়েছিলো সেদিকে। ফিরে আসবার সময় সে দেখা করেছিলো কুলসুমির সাথে।

সে বলে, কাকা, তালি কুলসুমির সোয়ামী মইরেছে কতদিন?

তা ও তো পেরায় চাইর বছর হইয়ে গেল!

এর মদ্যি একবারও পঞ্চবটি আসেনি?

আসতি দেয়নি রে!

ছমেদ মিয়ার কন্ঠে হাহাকার ফুটে উঠলো। আর এ জন্যিই তো ইবার মেইয়ে নিয়ে পলাইয়ে এয়েছি!

রহিমুদ্দি মনেমনে ভাবে, এর চাইতে শরমের আর দু:খের কী থাকতি পারে? শ্বশুর বাড়ি নামের জেলখানা থেইকে মুক্তির জন্যি বাপের বাড়ি পলাইয়ে আসতি হয় যেই দেশে, সেই দেশের নাম কি? আর এই মুক্তির জন্যি অন্ধলুলা সমাজের সঙ্গে যে যুদ্ধ তারই বা কী নাম?


ত্রিমোহিনী পেরোতে রহিমুদ্দি খানিকটা সময় নেয়। চাঁদের আলোয় চারদিক থৈথৈ করছে। আচমকা রহিমুদ্দির গান গেয়ে উঠতে মন চায়। কিন্তু সে তা করে না। একা থাকলে হয়তো গানে টান দিতে কোন সমস্যা হতো না। তবে এও ঠিক অন্য সময় হলে তার গান গাইবার ইচ্ছে হতো কি না কে জানে। জগতের যাবতীয় আনন্দের উৎস হচ্ছে নারী এবং শিশু। এ মুহূর্তে তার নৈাকায় পরিচিত একজন নারী রয়েছে। আর সেই নারীর উপস্থিতিই তার মনে দোলা লাগাবার হেতু বোধ হয়।

রাতের পথ বলে তেমন তাড়াহুড়ো করে না রহিমুদ্দি। যেহেতু দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিতে হবে, সে জন্য তাকে বেশি ক্লান্ত হওয়া চলবে না। এভাবে হালকা চালে নৌকা বেয়ে গেলে তার পরিশ্রমও কম হবে।

ত্রিমোহিনীর বাঁক পেরিয়ে রহিমুদ্দি বললো, কাকার বয়স তালি আশি পারাইল মনে তো হয়।

এ কথা শুনে ছমেদ মিয়া বললেন, আর তোর ও তো ষাট পেরোইছে লাগে।

নাহ কাকা। লগিতে একটি জোর ধাক্কা মেরে বললো, ছাপ্পান্ন চলতিছে!

এ বয়সেও তুই নৌকা ঠেলতি পারছিস?

রহিমুদ্দি ঝরঝরে কন্ঠে বলে, আমার তো কোন অসুবিধে হচ্ছে না কাকা! এহনো গায়ে যথেষ্ট বল রয়েছে তা ছাড়া মানুষ তো দুর্বল হয় অসুখে আর না খাতি পেয়ে।

তাও কতা মিছে না

ছমেদ মিয়া যেন রহিমুদ্দির যুক্তি উপেক্ষা করতে পারেন না।

ক্ষিদেরে আমার জব্বর ভয়! আমার খাওয়া ঠিক রাখতি যেইয়ে আইজও লগি ছাড়িনি! আপনেগের দোয়ায় গত তিরিশ বছরে তিনডে হাঁচি দিয়েছি বইলে তো মনে পড়ে না!

তালি বিয়েডা করলিনে ক্যান? সুমায় তো কম গড়ায়নি!

ছমেদ মিয়ার কন্ঠে আক্ষেপের সুর বাজে যেন।

আমারে মেয়া দিয়ে কেডা বিপদে পড়তি চাবে কন কাকা? তা ছাড়া অনেক বছর ধইরে একলা একলা থাইকে কেমন জানি হইয়ে গেছি। বিয়ের কতা আর মনে অয় না!

পুরুষ মানুষ হইয়ে এডা একটা কতা কলি?

ছমেদ মিয়ার হতাশ কন্ঠস্বরে যেন কোনো একটা প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত থাকলেও রহিমুদ্দি তা ধরতে পারে না। বলে, ঠেকায় পড়লি মানুষের অনেক কিছুই মাইনে নিতি অয়। তা ছাড়া কোনোদিন খাটাখাটনি বেশি হইয়ে গেলে মাঝে মদ্যি গা-হাত-পা ব্যথা করে। তহন দু একবার মনে অয় কেউ থাকলে…।

রহিমুদ্দি কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই ছমেদ মিয়া আবার বলে উঠেন, বিয়ে না করলি, তোরে শেষ কালে দেখবে কেডা? একলা ঘরে মইরে থাকবি, ইট্টু পানিও জোটবে না!

কাকা, বাপ মা তো দোকলা ছেলো, তাও তো তারা একই সময় চইলে গিয়েছে!

অমনডা আর কয় জনের ভাগ্যে জোটে? এই যে কুলসুমি বেধবা হইয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেলো, তহন মনে কষ্ট পেয়েছি এক রহম, এহন বেধবা মেয়ে ঘরে তুইলেও আরেকটা কষ্ট মনে থাকবে। এর বিয়ে দিতি না পারলে মইরেও শান্তি পাবো নারে রহিমুদ্দি! বাপের কান্ধে বিয়ের যুগ্যি মেয়ার বোঝা ছাওয়ালের লাশের চাইয়েও ভারি !

বাবা!

কুলসুমি রহিমুদ্দির কান এড়িয়ে কন্ঠস্বর চেপে ছমেদ মিয়াকে সতর্ক করতে চায়। বলে, এত কথার কাজ কি?

বাইরের একজন লোকের সামনে নিজের মাথা হেঁট হতে দেখে কুলসুমি। শোনে, কন্যা দায়গ্রস্ত নতজানু এক পিতার অন্তর্গত হাহাকার।

মেয়ের কথায় ছমেদ মিয়ার কষ্টের আগুনে যেনো তেল পড়ে। তিনি আরো অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে উঠেন, মারে, তুই তো বাপ হইসনি, কী করে বুঝবি বাপের কষ্ট?

চাঁদের পরিষ্কার আলোতে এখন কুলসুমির মুখ স্পষ্ট দেখতে পায় রহিমুদ্দি। গোলাকার, ভারাট মুখ। কিছুটা বুঝি চাঁদের মতও। হঠাৎ করেই তার বুকটা কেমন চিনচিন করে ওঠে। আর তখনি অসাবধানে লগিটা হাত ফসকে পানিতে পড়ে যায়। সাথে সাথে উবু হয়ে সে পানি থেকে লগিটা তুলে নেয়। ফের লগি ঠেলতে ঠেলতে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। হাত থেকে লগি ছুটে যাওয়া মানে তার ভষ্যিতের অন্নকষ্টের আভাস। এমন অলক্ষুনে কান্ড গত ত্রিশ বছরের ভেতর ঘটেনি। এ ভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে রহিমুদ্দির কপালে চিকন ঘামের ফোঁটা বড় হতে থাকে। সে কুলসুমির দিকে তাকাতে সাহস পায় না।


অনেকটা পথ এঁকেবেঁকে এগোতে হয় রহিমুদ্দিকে। সামনের গ্রামটাই পঞ্চবটি। কিন্তু খালের পানি কেমন যেন ম্যাদাটে মনে হয়। আশপাশে পানির নিচ থেকে ভেসে ওঠা উঁচু নিচু মাটির ঢিবি দেখা যায়। নৌকার শব্দ পেয়ে চাঁদের আলোয় স্নান রত ব্যাঙেরা ঝুপঝাপ লাফিয়ে পড়ে পানিতে।

কিছুটা পথ ভালোই এগোতে পারে রহিমুদ্দি। কিন্তু কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে নৌকাটা হাঠাৎ কেমন ঝাঁকি খেয়ে থেমে যায়। তলায় মাটি ঘষা খাওয়ার এক ধরনের ভোঁতা শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।

ছমেদ মিয়া বললেন, নৌকা আইটকে গেল নাহি?

হয় মনে কয়!

রহিমুদ্দি নৌকা থেকে নেমে পড়ে। এখানে পানির উচ্চতা হাঁটুরও নিচে। তার ওপর তিনজন মানুষ নৌকায়। তলা তো মাটিতে ঠেকবেই। সে নৌকাটাকে সামনের দিকে প্রাণপণে ঠেলতে থাকে। কিন্তু নৌকা সরে না।
সে সামনে এগিয়ে গিয়ে পানির উচ্চতা পরিমাপ করে। এখানে অনেক পানি। ঠেলে নৌকাটাকে একটু এগিয়ে দিতে পারলেই মনে হয় ভেসে উঠবে। সে আবার ফিরে আসে নৌকার পেছনে। এবার কাঁধ লাগিয়ে হেঁইয়ো শব্দে ধাক্কা লাগায়। কিন্তু জড়বস্তু একটুও নড়ে না।

আমাগের কি নামতি হবি?

নৌকায় উঠবার পর এই প্রথম রহিমুদ্দির সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কুলসুমি।

কুলসুমির আশঙ্কা এবং সঙ্গে মিশে থাকা তাচ্ছিল্য যেনো রহিমুদ্দির পৌরুষে প্রবল কষাঘাত করে। সে কিছুটা অস্থিরভাবে বলে, না না। নামতি হবে ক্যান? আমি থাকতি যদি চড়নদারের পানিতে নামতি অয় তো এই মুখ দেহাবো কেম্বা?

কুলসুমির কন্ঠস্বরে তার বার্ধক্যের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা যৌবনের অমিত তেজ যেন হঠাৎ করেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। কোনো রকম শব্দ ছাড়াই নৌকাটাকে ঠেলে বাধা মুক্ত করে পানিতে ভাসায় রহিমুদ্দি। তারপর দ্বিগুণ তেজে লগিতে ভর দিয়ে নৌকার গতি বাড়িয়ে দেয়। লগিতে ভর দেবার ফাঁকে ফাঁকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন কুলসুমির ওপর চোখ পড়ে তার। কেমন অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে কুলসুমি। মুখ উঁচু করে তাকানোর ফলে মাথা থেকে তার ঘোমটা পড়ে গেছে অনেক আগেই, সে দিকে তার খেয়াল নেই কোনো।

এক সময় রহিমুদ্দির কথায় কুলসুমির চমক ভাঙে। কোহানে নামাতে হবে কইস কলাম কুলসুমি! বাড়িডা তো ঠিক চেনবো না!

কুলসুমি মাথা ঘুরিয়ে পাড়ের দিকে তাকিয়েই বলে, থামান, থামান! আমাগের বাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে!

রহিমুদ্দি হঠাৎ করেই চলন্ত নৌকা থামাতে পারে না। সামনের দিকে লগি ফেলে গতি রুদ্ধ করলেও আরো বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে নৌকা থামে।

তারপর নৌকা ঘুরিয়ে কুলসুমির কথামত জায়গায় এনে থামায় রহিমুদ্দি।

নৌকা থামতেই ছমেদ মিয়া বলেন, এতডা বছর পর দেখা, তুই একবার বাড়ি যাবি না?

রহিমুদ্দি বললো, উজানে আমার অনেকটা পথ যাতি হবে। আপনের বাড়ি গেইলে আমার ফিরে যাতি দেরি হবেনে!

ছমেদ মিয়া বলেন, আমার তো বয়স হইয়েছে, কোন দিন টুক করে মইরে যাই তাতো কেউ কতি পারিনে! বাড়িডা চিনলি, আমাক মাটি দিতি না আসতি পারিস, খবর পালি কবরডা দেখতিও তো আসতি পারবি!

কুলসুমি হঠাৎ ছমেদ মিয়ার বাহু ধরে বলে, উঠেন বাবা, নেইমে পড়ি!

তারপর রহিমুদ্দিকে কিছুটা রুক্ষ্ম স্বরে বলে, একটা বুড়ো মানুষ তার মেয়াক নিয়ে রাইত বিরেতে একাএকা যাবে, পথের বেপদের কতা কি কওয়া যায়? ভোর হতি আর কতক্ষণই বাকি আছে? তা ছাড়া কী হবে ভোরভোর উইঠে ফিরে গেলে? এমন তো না যে, বাড়িতে বউ-ছাওয়াল বইসে আছে!

রহিমুদ্দি অবাক বিস্ময়ে কুলসুমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার সময় কুলসুমির নাকের নোলক ঠোঁটের উঠানামার সঙ্গে দোল খায় আর চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠে বারবার। বিধবা হলে মেয়েরা কোনো অলঙ্কার পরতে পারে না। কিন্তু কুলসুমির নাকে ঠিকই ঝকমক করছে সোনার গয়না।

কুলসুমির কথা শেষ হলে রহিমুদ্দি ছমেদ মিয়ার পাশে এসে বলে, আমিও কি যোয়ান ছাওয়াল নাহি? বয়স আমারও ছাপ্পান্ন চলতিছে তোর বয়সও পোনারো ষোলো লয়!

কুলসুমি চকিতে একবার দেখে রহিমুদ্দিকে। তারপর খানিকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, মেয়া মানুষ রাতির বেলা বাইরে বারালি তার বয়স কত ওডা বড় কতা লয়! বেপদ যে কোন সুমায় হতি পারে!

রহিমুদ্দি কথাটা অস্বীকার করতে পারে না। বলে, আচ্ছা, আচ্ছা, আগায় দেবানি কিছুডা পথ!

নৌকা থেকে নেমে নৌকার মাথা ধরে টেনে কিছুটা পাড়ের দিকে শুকনাতে তুলে রাখে রহিমুদ্দি। এতে করে নৌকা ভেসে যাবার ভয় থাকে না। তারপর সে ছমেদ মিয়ার পেছন পেছন এগিয়ে যায়। পাশাপাশি খানিকটা দুরত্ব রেখে এগোয় কুলসুমিও।

রহিমুদ্দি আড় চোখে কুলসুমির দিকে তাকিয়ে মনেমনে হিসেব কষে বের করে যে, কুলসুমির কম করে হলেও এখন বয়স চলছে একচল্লিশ। সে নিজে যেমন ছাপ্পান্নতে এসে ফুরিয়ে যায়নি, তেমনি কুলসুমি চল্লিশের কোঠা পেরিয়েও দেখতে বেশ! এ কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রহিমুদ্দির। সেই শব্দ বুঝি কুলসুমিকেও বিচলিত করে। হঠাৎ কেমন চমকে উঠে ঘাড় ফেরায় সে।


হেমন্তের জোৎস্নালোকে পথ চলতি তিনজন মানুষের ছায়া হালকা শিশিরের ব্যুহ ভেদ করে যাবার সময় তাদের ঘিরে কেমন একটা অস্পষ্ট রঙধনু রঙের বলয় সৃষ্টি হয়। রহিমুদ্দি সেই বলয়ের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পথ চলে। তার এই আনমনা ভাব কুলসুমিকেও কেমন যেন নিরব করে দেয়।

ছমেদ মিয়া বলেন, বুঝলি রে রহিমুদ্দি, আমার একটা ছাওয়াল নেই। শেষ বয়সে চলতি ফিরতি না পরলে আমাগের দেখবি কেডা? তাই কতিছিলাম, তুই একা মানুষ, আমাগের সঙ্গে থাইকে গেলেও তো পারিস!

রহিমুদ্দি ভাবে, তার নিজের ঘরবাড়ি রয়েছে। যেখানে আছে বাবা মা দুজনেরই কবর। তা ছেড়ে সে পড়ে থাকবে পরের বাড়িতে? পরের আশ্রয়ে থাকার অর্থ গলায় শিকল বাঁধা কুকুরের মত কাল কাটানো। সে ছমেদ মিয়ার কথার জবাবে বলে, এডা কেম্বা হয়?

ছমেদ মিয়া বললেন, তোর বাপ মা বাইচে থাকলি তাগের সঙ্গে থাকতি না তুই?

তা কি আর মানা করা যেতো?

তালি?

ছমেদ মিয়ার শেষ কথার কোনো জবাব দিতে পারে না রহিমুদ্দি। মনেমনে কথা হাতড়ালেও কী বলবে ভেবে পায় না।

তারপর বেশ কিছুটা পথ নিরবতা অবলম্বন করেই হেঁটে চলে ওরা।

বাড়ির ঢাল বেয়ে উঠবার সময় ছমেদ মিয়া রহিমুদ্দিকে ফের আহ্বান করেন। কিন্তু রহিমুদ্দি রাজি হয় না। বলে, আরেক দিন আসবোনে কাকা! আইজ অনেকটা পথ যাতি হবেনে!

রহিমুদ্দির গোয়ার্তুমিতে ছমেদ মিয়ার হয়তো রাগ হয়। তিনি একবার দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকান। কিছুটা কন্ঠ চড়িয়ে বলেন, কুলসুমি, ওক তুই নিয়ে আয়!

তারপর তিনি ঢাল বেয়ে উঠে যান বাড়ির উঠোনে।

কুলসুমি কেমন কাতর কন্ঠে রহিমুদ্দিকে বলে, আপনে ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই চইলে যায়েন। না করবো না! আলো ফুটতি আর কতক্ষণই বা বাকি আছে!

আমাক অনেকটা পথ ঘুইরে যাতি হবেনে!

রহিমুদ্দির বলার ধরনে জোর থাকলেও কুলসুমি গ্রাহ্য করে না। বলে, কিছুক্ষণ জিরোয়ে ভোর হলি নৌকা নিয়ে যাতি কষ্ট হবেনা নে!

রহিমুদ্দি তবুও আপত্তি জানায়, তুই বুঝতি পারতিছিস না ক্যান কুলসুমি?

ছমেদ মিয়া আড়ালে চলে গেলে কুলসুমি হঠাৎ রহিমুদ্দির হাত ধরে বলে, বুড়ো হয়েছেন এখনো ছাওয়াল পাওয়ালের মত এত লজ্জা কিসের?

তারপর রহিমুদ্দিকে প্রায় টেনে নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে থাকে কুলসুমি।

রহিমুদ্দি টের পায়, কুলসুমির বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলে কি হবে, ওর গায়ে এখনো যথেষ্ট জোর-বল আছে।

নিজের অসহায় অবস্থা দেখে আত্মসমর্পণের আগে হেসে ফেলে রহিমুদ্দি। তারপর বলে, তুই এহনো তেমনি পাগলীই রইয়ে গেলি!

পাশাপাশি দুটো বড় টিনের ঘর। কিন্তু একটার দরজায় বড়সড় তালা ঝুলতে দেখা যায়। রহিমুদ্দি কুলসুমির পেছন পেছন চলতে চলতে বলে, ও তালা দেওয়া ঘরডা কাগের?

কুলসুমি গতি শ্লথ করে বলে, আমাগেরই।

তারপর রহিমুদ্দির হাত ছেড়ে দিয়ে আবার বলে, ও ঘরে থাকবার মানুষ নেই। শুনিছি মাঝে মদ্যি কামলারা থাকে বলে, তারপর আরেকটি ঘরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে, বাবা আর মা এ ঘরেই থাকে।

কাকি বাড়ি আছে? রহিমুদ্দি কণ্ঠস্বর নামিয়ে জানতে চায়।

কুলসুমি খানিকটা উচ্চস্বরে জানায়, মনেকয় ঘুমোচ্ছে। আপনে ঘরে আইসে বসেন!

ঠিক তখনই খাদিজা বিবি বড় মেয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে এগিয়ে এসে মারে তুই এয়েছিস?বলেই কেমন উদভ্রান্তের মত কুলসুমিকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে বিলাপ শুরু করলেন। হয়তো কুলসুমিও কাঁদে। কিন্তু তার কান্নার শব্দ পাওয়া যায় না। তবুও ফোঁপানোর শব্দ কর্নগোচর হয় রমিুদ্দির। দীর্ঘদিন অদর্শনের পর মাতাকন্যার এ মিলনদৃশ্য রহিমুদ্দির বিশুষ্ক চোখকেও দীর্ঘকাল পর সজল করে তুললো।

সে বুঝতে পারে যে, এমন একটি অবস্থায় তার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে তারা বিস্মৃত হবে। তাই সে বিড়ালের নৈঃশব্দে আরো কিছুটা সরে গিয়ে নিজকে অন্ধকারে আড়াল করে।

মাতা-কন্যার কান্নাপর্ব সমাপ্ত হলে খোঁজ পড়ে রহিমুদ্দির। দরজায় মুখ বাড়িয়ে সিক্ত কন্ঠে কুলসুমি বললো, কনে গেলেন আপনে?

খাদিজা বিবি অন্ধকারের দিকে উঁকি দিয়ে বললেন, তুই অন্ধকারে কেন? ঘরে আয়!

রহিমুদ্দি এগিয়ে এসে বলে, ভালো আছেন কাকি?

তুই কেম্বা আছিস বাজান? অ্যাদ্দিন পর আমাগের কথা মনে পড়লো?

কুলসুমি আরেকটি কুপি জ্বালিয়ে এনে রহিমুদ্দিকে কাঠের জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে বলে, বসেন!

খাদিজা বিবি বললেন, অতদূর থেকে এয়েছিস, দুডো ভাত চুলোয় দিয়ে দে কুলসুমি। আমার খুব কাহিল লাগতিছে। শুয়ে পড়ি।

তুমি খাবা না? কুলসুমি খানিকটা অবাক হয়ে শুধায়।

নারে মা!

সারাদিন তিনি কুলসুমির কথা ভেবে ভেবে এক ধরনের উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। মেয়েকে দেখার পর সারাদিনের উদ্বেগ এখন ক্লান্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই তিনি শুয়ে পড়লেন। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লেন।

রহিমুদ্দিকে বসতে দিয়ে কুলসুমি ছমেদ মিয়াকে বললো, আমি ভাত বসাচ্ছি বাবা, না খেয়ে ঘুমোয়ে পইড়েন না!

ছমেদ মিয়া বললেন, ভাত হলি পরে আমাক ডাইকে দিস!

ছমেদ মিয়া হয়তো শুয়ে পড়লেন।

কুলসুমি এক হাতে চালের হাঁড়ি আর অন্য হাতে কুপিটা নিয়ে খানিক ইতস্তত করে রহিমুদ্দির দিকে তাকায়।
তারপর স্মিত মুখে রহিমুদ্দিকে বলে, ইট্টু আমার সঙ্গে পুকুর ঘাটে আসতি পারবেন? আপনের হাত-মুখ ধোয়া লাগবি। লাগবি না?

কুলসুমি ঘর থেকে বের হলে রহিমুদ্দি তার পেছন পেছন যায়।

কুলসুমি পুকুর ঘাটে গিয়ে কুপিটা এক পাশে নামিয়ে রেখে নামতে নামতে হাঁটু সমান পানিতে দাড়িয়েঁ চাল ধোয়। পানি বদলায়। সেই সাথে পানিতে ঢেউ উঠে, ভাঙে। ঢেউয়ের বুকে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেই ঢেউ নেচে নেচে এগোয়। কিন্তু ঢেউ পানিতে মিশে গেলে চাঁদের চমকও হারিয়ে যায়। রহিমুদ্দির বুক চিড়ে অকারণেই আবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আর ঠিক তখনই কুলসুমি চাল ধোয়া শেষ করে দাঁড়ায়।

তারপর এক হাতে চালের হাড়ি অন্য হাতে কুপি নিয়ে উঠে আসতে পা বাড়ায়। কিন্তু ঘাটের এবরো থেবেড়ো পথে তার পা হড়কায় কি হড়কায় না, তবুও কেমন যেন দুলে উঠে তার সমস্ত শরীর।

রহিমুদ্দি চকিতে এগিয়ে গিয়ে কুলসুমির হাত থেকে কুপিটা নেয়। তারপর বাড়িয়ে দেয় আরেকটা হাত।

সামান্য দ্বিধা। কিন্তু কুলসুমি হাসিমুখে সে হাত অবলম্বন করে উঠে আসে।

তারপর রহিমুদ্দির কাছ থেকে কুপি নিয়ে বলে, আমি দাঁড়াচ্ছি। আপনি হাতমুখ ধূয়ে লেন!

রহিমুদ্দি নেমে গিয়ে হাত মুখ ধূয়ে উঠে এলে কুপি হাতে এগোয় কুলসুমি। পেছন পেছন এগোয় রহিমুদ্দিও।

কুপি আর চালের হাঁড়ি হাতে রান্নাঘরে ঢোকে কুলসুমি। তারপর চুলোয় হাঁড়ি বসিয়ে একমুঠ পাটশোলায় কুপি থেকে আগুন ধরিয়ে তা চুলোয় দেয়। পাটশোলায় ভালো মত আগুন ধরে উঠলে চুলোর ভেতর শুকনো খড়কুটো ঠেলে দিয়ে আগুনের আঁচ আরো বাড়িয়ে দেয় সে।

রহিমুদ্দি সসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে থাকলে কুলসুমি তাকে পাশে বসতে বলে। তারপর জানায়, ভাত রান্দা হলি বেগুন ভর্তা করবো আর আপনের জন্যি একটা ডিম তেলে দিয়ে দেবানি!

খড়কুটো টেনে রহিমুদ্দি মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ে বলে, ভর্তা হলি আর ডিম দিয়ে কি হবে? কোনো কোনো দিন তো কেবল নুন কাঁচা মরিচ দিয়েই ভাত খাওয়া সাইরে ফেলি!

কুপির আলোয় রান্না ঘরের চালে, বেড়ায় বড়বড় অদ্ভূত ছায়া নাড়াচড়া করে। রহিমুদ্দি দৃষ্টি ফিরিয়ে অবাক হয়ে যায়। আগুনের আঁচে কুলসুমির মুখ কেমন লালচে আর রহস্যময় মনে হয়। রহিমুদ্দি সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময় হয়ে।

কুলসুমি একবার আড় চোখে রহিমুদ্দিকে দেখে। দেখে তার দৃষ্টির মুগ্ধতা। তারপর হাসিহাসি মুখে আস্তে আস্তে চুলোর মুখে খড়কুটো ঠেলে দিতে থাকে।

রহিমুদ্দি হঠাৎ নড়েচড়ে বসে বলে, কুলসুমি, অনেক বছর হইয়ে গেল, আমি মেয়াছৌলের রান্দা খাতি পাইনি।

কুলসুমি এ কথা শুনে কেমন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রহিমুদ্দির মুখের দিকে। মনেমনে বলে, আপনে আমাগের কাছে থাইকে যান, বাকি জেবন আমি রান্দা কইরে খাওয়াবোনে।

কিন্তু সব কথা কি মানুষ মুখ ফুটে বলতে পারে? তার ওপর কুলসুমি একজন নারী। শুধু নারীই নয়, পরিপক্ক একজন সংসারাভিজ্ঞা রমণীও বটে। যে কারণে কথাগুলো তার বুকের কন্দরেই ঘুরপাক খায়। তবুও সে তার মনোভাব কিছুটা ঘুরিয়ে প্রকাশ করে। বলে, তাই তো জোর কইরে ধইরে নিয়ে আলাম!

রহিমুদ্দির বুকটাও যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। সে ভাবে যে, আরো বিশ কি পঁচিশ বছর আগে যদি এমন করে কেউ তাকে সামান্য জোর করে হলেও সংসারের গণ্ডিতে টেনে নিতো, তাহলে তার জীবনটা হয়তো এমন যাযাবরের মতো থাকতো না। কিন্তু সে মুখে বললো, এমন কি আর সব সুমায় হয়?

কুলসুমি রহিমুদ্দির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকায়। তারপর মনেমনে বলে, আমি তো আছি। ইচ্ছে তো হয় বাকি জেবনডা আপনেরে দেহেশুনে রাখি!

রহিমুদ্দির বুকের দেয়ালে বুঝি কুলসুমির অন্তর্গত বাসনা প্রতিধ্বণিত হয়ে স্ফুরিত হয় রহিমুদ্দির মাঝে। আর সে কারণেই বুঝি অকস্মাৎ সে কুলসুমির একটি হাত ধরে বলে, কুলসুমি, দুনিয়ায় আমি অনেক একলারে!
মাঝে মদ্যি রাইতে ঘরে ঢুকলি মনে হয় য্যান কবরে ঢুকিছি! তুই আমাক ফিরায়ে দিস না! তোক নিয়ে আমি আবার সংসার সাজাবো! আমাগের সংসার উজালা হইয়ে উঠবেনে! আমরা ফির নতুন কইরে সব শুরু করবো!

ভাতের চাল ফুটতে থাকে বিচিত্র শব্দে। তেমনি বিচিত্র শব্দে চুলোয় পুড়তে থাকে শুকনো খড়-কুটো, লতাপাতা। কুলসুমি রহিমুদ্দির মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা না করে মায়াভরা চোখ দুটো আরও মায়াময় করে রহিমুদ্দির চোখে স্থির রেখে বলে, ভোর বেলা বাবারে কথাটা বইলেন।

কাকা রাজি হবে?

বিষম খাওয়ার মত ছটফট করে ওঠে রহিমুদ্দি।

তারপর আরো শঙ্কিত কন্ঠে বলে, বুড়ো বইলে দূরদূর করে যদি?

নাহ, তা করবে না! বরাভয় দেওয়ার মত করে হাসে কুলসুমি। আমি জানি, এ কথা শুনলি বাবা খুশি হবে! নৌকোয় কি কচ্ছিলো শোনেন নি?

তারপরই যেন কুলসুমির চোখে মুখে একরাশ লজ্জা এসে ভর করে হয়তো। সে মুখ নামিয়ে নিজের হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে চুলোর ভেতর আরও খড়-কুটো ঠেলে দিতে দিতে যেন আনমনে বলে, বাবা রাজি না হলিও আপনেরে আমি যাতি দেবো না!

সত্যি কতিছিস? রহিমুদ্ধি অকস্মাৎ চমকে ওঠে। কুলসুমি, আমি যে ঘর পোড়া গরু!

তারই সঙ্গে সঙ্গে রহিমুদ্দিকে কেমন বিভ্রান্ত মনে হয়। সহসা কুলসুমির কথাগুলো বিশ্বাস করা যেন কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। তার শরীর কেমন যেন থরথর করে কাঁপে। আর তাই দেখে মুখ তুলে হাসিমুখে তাকায় কুলসুমি। নিষ্পলক দুটি চোখ মেলে রাখে কিছুক্ষণ রহিমুদ্দির দৃষ্টির সমান্তরাল। কিন্তু কিছু না বলে কেবল মাথা দোলায়।

মুহূর্তেই যাবতীয় দ্বিধার ঝোঁপ-ঝাড় ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে রহিমুদ্দি। কুলসুমির অসম্পূর্ণ কথাগুলোও যেন মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে তার মানসলোকে। তার ইচ্ছে হয় চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দেয়- দেখ, ছাপ্পান্নতে এসে রহিমুদ্দি এখনো ফুরিয়ে যায়নি কুলসুমি তাকে কথা দিয়েছে। তার আবার সংসার হবে। আবার তার ঠিকানা হবে। পাকিরা তার বাবা মাকে মেরে ফেলেছে। আয়শাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তাকে বঞ্চিত করতে পারেনি জীবনের আহ্বান থেকে, পারেনি তাকে একবারেই নিঃস্ব করে দিতে।
সে মুগ্ধ চোখে কুলসুমিকে দেখে। দেখে চুলোয় কুটো-কাটা ঠেলে দেওয়ার সময় তার সুন্দর দুটি হাতের ছন্দায়িত আলোড়ন। হঠাৎ তার মনে পড়ে, হাট থেকে যে চুড়িগুলো কিনেছিলো, সেগুলো কুলসুমির হাতেই ভালো মানাবে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় যে, কুলসুমির দুহাত ভর্তি অনেকগুলো লালচুড়ি। যেগুলো হাতের নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভূত এক মিষ্টি শব্দে মুখরিত হয়ে উঠছে। আর সেই শব্দের মাধুর্য রহিমুদ্দিকে কেমন বিহ্বল করে দেয়। ধীরে ধীরে একটি ঘোরে আচ্ছন্ন হতে হতেও থেকে থেকে যেন সে শুনতে পায় রেশমী চুড়ির মিষ্টি আর মিহি টুংটাং। কিন্তু সে বুঝতে পারে না সেই বলয় নিক্বণ সত্যিই নাকি কল্পনা।
(সমাপ্ত)

***আগে ভিন্ন একটি ব্লগে প্রকাশিত।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


27 Responses to উপন্যাস: নিক্বণ

You must be logged in to post a comment Login