শাহেদুজ্জামান লিংকন

গল্প: সহযোদ্ধা

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

চতুর্থবারের মতো রিকশার চেইন পড়লো। বৃদ্ধ রিকশাচালক পূর্বের মতো তার ফোকলা দাঁতের হাসি দেখিয়ে চেইন তুলতে লাগলো। তার হাসিতে সে বুঝানোর চেষ্টা করছে- আপনি অন্য রিকশায় যাইয়েন না। এর চেয়ে ভালো রিকশা পাবেন কোথায়? স্বাধীন ঘড়ির দিকে তাকায়। এখনো বেশ সময় আছে। এখান থেকে টিভি অফিস যেতে ৭-৮ মিনিট লাগবে। তার প্রোগাম শুরু হবে আরো এক ঘন্টা পরে, বিকাল পাঁচটায়। রিকশাচালক আরো কয়েকবার খায়েশমতো চেইন ফেলুক তাতে সমস্যা নেই।
উদীয়মান উপস্থাপক হিসেবে স্বাধীনের নাম এখন সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলো তাদের নানা অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীনকে ডাকছে। স্বাধীনের হাস্যোজ্জল বাচনভঙ্গিতে সকলে আকৃৃষ্ট হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে টকশোগুলোতে চ্যানেলগুলো স্বাধীনের বিকল্প কাউকে ভাবছে না। প্রত্যুৎপন্নমতি স্বভাবের জন্য তার এই জনপ্রিয়তা। সে যে কোনো সময় নেতাদের প্রশ্ন করে হতবুদ্ধ করে ফেলতে পারে। তাই তার উপর অনেক নেতা রুষ্ট। তাকে উপস্থাপক হিসেবে না নেওয়ার জন্য চ্যানেলগুলোর উপর অনেক নেতা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে দেখার জন্য চ্যানেলগুলোতে ফোন করে অনুরোধ জানাচ্ছে।
রাহেলা বেগম টিভি অন করে বসে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাধীনের উপস্থাপনায় ‘জনগণের দ্বারপ্রান্তে’ নামক ধারাবাহিক টকশোটি শুরু হবে। বর্তমানে এই টকশোটি বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন অঞ্চলের নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে এই টকশোটি গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে আছে স্বাধীন। সাধারণত তিনি স্বাধীনের উপস্থাপনায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো মিস করেন না। তাছাড়া বর্তমানে তার তেমন তাড়া নেই। বাসাতেই কিছু মহিলাদের নিয়ে তিনি কাজ করান। পাটজাতদ্রব্য তৈরি করে বাজারজাত করেন। কাজটা আগে তিনি একা করতেন। ধীরে ধীরে পুঁজি বাড়ায় এখন তিনি ৭ জন মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন। চোখের সমস্যা থাকায় তিনি এখন আগের মতো কাজ করতে পারেন না। এখন পাটজাতদ্রবের বেশ চাহিদা আছে। এখানকার আয় দিয়ে তার সংসার ভালোভাবেই চলে। তারপর এখন স্বাধীন উপস্থাপনার মাধ্যমে কিছু উপার্জন করছে।
প্রোগ্রাম শুরু হলো। স্ক্রিনে স্বাধীনের মুখ দেখা যাচ্ছে। স্বাধীন দর্শকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের অতিথির নাম ঘোষণা করার সাথে সাথে ক্যামেরা সেদিকে চলে গেলো। রাহেলা বেগমের বুকটা ছাৎ করে উঠলো। স্ক্রিনে দেখানো মুখটা তার বেশ চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ক্যামেরা সরে যাওয়ায় তিনি ভালোভাবে দেখতে পারলেন না। স্বাধীনের প্রথম প্রশ্নের পর ক্যামেরা আবার আজকের অতিথি তথা এমপির দিকে গেলো। এবার তার চোখের সামনে চেহারাটা আরো স্পষ্ট হলো। মুখটিকে চিনে নিতে কোনো সমস্যা হলো না তার। রাহেলা বেগমের শরীর ঘামতে লাগলো। তিনি আর টিভির দিকে চোখ রাখতে পারছেন না। বুকটা চিনচিন করছে। তিনি বুকে এক হাত দিয়ে কষ্ট করে বিছানা থেকে নামলেন। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। তবু তার গলাটা শুকিয়ে আসছে । ওদিকে টিভিটা চলছে। তিনি টিভিটা বন্ধ করার জন্য সেদিকে এগুতে লাগলেন। চোখে অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। তিনি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। ধপাস করে পড়ে গেলেন। তার পা লেগে একটা চেয়ার পড়ে গেলো। সেই শব্দ শুনে পাশের রুম থেকে কর্মরত মহিলারা ছুটে আসলো। একজন রাহেলা বেগমকে কোলে করে বিছানায় শোয়ালো। একজন পানি এনে তার চোখে-মুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো। একজন পাশের ফার্মেসির হাতুড়ে ডাক্তারকে ডাকার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। তারা সকলেই রাহেলা বেগমকে অনেক ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে তার জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তার একটা ঘুমের ঔষধ দিলেন। ঔষধ খাওয়ার পর রাহেলা বেগম ঘুমিয়ে পড়লেন।
মহিলাগুলো সাধারণত সন্ধাবেলা বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু আজ তারা যেতে পারলো না। রাহেলা বেগম এখন ঘুমাচ্ছেন। স্বাধীন না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। স্বাধীনকে খবর দিলে সে চিন্তা করবে তাই তাকে খবর দেয়া হলো না। মহিলাগুলো গ্রাম থেকে আসলেও শহুরে পরিবেশে এসে নানান ঝড়-ঝঞ্ঝাট মোকাবেলা করতে করতে পরিস্থিতি সামাল দিতে শিখেছে।
স্বাধীন যখন ফিরলো তখন রাহেলা বেগমের ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি একদম কোনো কথা বলছেন না। চুপচাপ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। স্বাধীন তার মায়ের এই অবস্থার পরও খবর না দেওয়ায় মহিলাদের উপর রাগান্বিত হলো। সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো হঠাৎ এমন হলো কেন? তার মা বললো মাথাটা ভিষণভাবে ধরে আসছিলো। স্বাধীন বললো, চোখের সমস্যাটা বেড়েছে বোধ হয়। কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। রাহেলা বেগম বললেন, না না তেমন কোনো সমস্যা না। এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে। স্বাধীন তার মায়ের কথায় কোনো পাত্তা দিলো না। কাল তার কোনো প্রোগ্রাম নেই। কালকেই যেতে হবে। বাড়িতে পড়ে থেকে রোগ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।
হালকা কিছু খেয়ে তারা ঘুমাতে গেলো। মায়ের এই অসুস্থতায় স্বাধীনের রুচি উবে গেছে। সে পাশের রুমে থাকে। আজ তার ঘুম হবে না। সারা রাত জেগে থাকবে। কখন কি হয় না হয় বলা যায় না। সে কিছুক্ষণ পর পর উঠে মায়ের রুমের কাছে গিয়ে দেখলো তিনি ঘুমাচ্ছেন কিনা। রাত দুটার দিকে যখন এলো তখন দেখলো তার মা তার বাবার ছবিটার কাছে দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে আছে। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ পেলো। এবার সে একটু আশ্বস্ত হলো। ধারণা করলো তার মায়ের তেমন কিছু হয় নি। হয়তো প্রয়াত স্বামীর কথা মনে পড়ে তার মনে কাঁদছে। স্বাধীন তার বাবাকে দেখে নি। তার মা বলেছে তিনি মারা গেছেন তার বয়স যখন এক বছর। বাবার মৃত্যুর পর তাদের তেমন কেউ ছিলো না। ছোটবেলা থেকে সে এই ঢাকা শহরে বড় হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ নেই। সে ভাবতে লাগলো আজ হঠাৎ বাবার কথা ভেবে মা কাঁদছে কেন? আজ তো তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী না। নাকি এই দিনে তাদের বিয়ে হয়েছিলো? ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে সে ঘুমাতে গেলো।
সারাদিন রাহেলা বেগমের মন বিষন্ন। স্বাধীনের চোখে তো বটেই মহিলাগুলোও সহজে তা বুঝতে পারলো। তিনি আজ কাজ বুঝিয়ে দিতে এলেন না। সারাদিন ঘরের মধ্যে শুয়ে কাটালেন। রাতের বেলা রাহেলা বেগম বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আকাশটাও ভালো করে দেখার জো নেই। দালানের পর দালান তুলে মানুষ আকাশ ঢেকে রেখেছে। এমন সময় স্বাধীন এলো। রাহেলা বেগম শুরুতেই তার ছেলের উপস্থিতি টের পেলেন। ও তুই? আয়। দেখ না মানুষ কেমন যন্ত্র হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে ওখানে তিনটা মেহগনি গাছ ছিলো। আজ দেখি নেই। স্বাধীন বুঝতে পারলো তার মা নিজের মনের অবস্থাটাকে আড়াল করার জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করেছে। তার বাবার কথা মনে পড়েছে এটা ধারণা করার পর সে আজ আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা তোলে নি। এখন তাকে জানতে হবে তার মায়ের কি হয়েছে।
– মা তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে কি?
– কই কিছু হয় নি তো। রাহেলা বেগম নিচের দিকে মুখ করে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলেন।
– কিছু না হলে মন খারাপ করে আছ কেন?
– তুই কি মন বিশারদ হয়ে গেলি? এই দেখ আমি হাসছি। রাহেলা বেগম হাসতে গিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। তাপর তিনি রুমের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন।
পরিস্থিতি স্বাধীনের কাছে অবোধগম্য ঠেকলো। সে তার মায়ের পিছু পিছু রুমে ঢুকলো। তার মা বিছানায় বসে আছেন নিচের দিকে মাথা করে। সে পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। মায়ের মুখটা উঁচু করে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে আবার জিজ্ঞাসা করলো, মা তোমার কি হয়েছে?
– তোকে আমি বলবো রে। আজ তোকে বলবো।
– হ্যাঁ বলো তো মা তোমার কি হয়েছে? স্বাধীনের চোখে-মুখে তখন উৎসাহ।
রাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। স্বাধীন মেঝেতে ভালো করে বসে পড়লো। তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। তার মা মুখ নিচের দিকেই করে আছে।
– তোর বাবা… বলতে গেয়ে থেমে গেলেন তিনি।
– হ্যাঁ বাবা! কি হয়েছে বাবার? স্বাধীনের বুকটা ধুক ধুক করে ওঠে।
– স্বাধীন তুই তো জানিস না আমি তোকে একটা ধোকার মধ্যে রেখেছি। কথার মোড় অন্যদিকে ঘোরান রাহেলা বেগম।
– ধোকা? কিসের ধোকা? স্বাধীনের অবাক দৃষ্টি।
– হ্যাঁ ধোকা। তোকে আমি একটা ধোকার মধ্যে রেখেছি । কোনোদিন হয়তো এটা তোকে বলতাম না। কিন্তু আজ আমাকে বলতে হবে। রাহেলা বেগমের কণ্ঠে একটা প্রতিবাদী সুর ভেসে আসে।
– কি সেটা? স্বাধীনের কৌতুহলী প্রশ্ন।
– তুই যাকে তোর বাবা বলে জানিস সে তোর বাবা না।
– মানে? স্বাধীন হতবাক।
– হ্যাঁ তোর কোনো বাবা নেই।
– এটা কি ধরণের কথা মা? তুমি তো কোনো অতি মানবী নও যে… স্বাধীন কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।
– যার ঔরসে তোর জন্ম তাকে তো আমি তোর বাবা বলতে পারি না। শোন তাহলে আমি থাকতাম আমার খালার বাসায়। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করায় খালা আমাকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। খালার ছিলো একটিমাত্র ছেলে। খালা আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। কিন্তু নুরু ভাইকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। নুরু ভাইও আমাকে ভালোবাসতেন কিন্তু মুখে প্রকাশ করতেন না। শুধু বলতেন, রাহেলা তোকে অনেক ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেব। একদিন শুনলাম তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু নাকি রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। শুনছিলাম যে কোনো মুহূর্তে দেশে যুদ্ধ শুরু হবে। জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য তিনি এই ভাষণ দেবেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর নুরু ভাই অনেকটা বদলে গেলেন। তিনি আর আমার কথা শুনতে চান না। তিনি বলতেন, তোর ভালোবাসার কথা এখন রাখ তো। দেশ স্বাধীন করতে হবে। এবার ওদের সাথে কোনো আপোষ করবো না। হয় মুক্তি, নয় তো জান। আমি শুনে আতকে উঠেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, যুদ্ধ শুরু হলে কি আপনার যুদ্ধ করতেই হবে। দেশের আরো কতো লোক আছে তারা যুদ্ধ করুক। তিনি বলেছিলেন, স্বার্থপরের মতো কথা বলিস না তো রাহেলা। আগে দেশ স্বাধীন হোক কথা দিচ্ছি স্বাধীন হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তোর বিয়ে হবে। আমি প্রশ্ন করলাম, বিয়ে হবে মানে? কার সাথে? বলেই চলে এলাম। কিছুদিন পর শুনলাম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখনও আমাদের গ্রামে মিলিটারি আসে নি। কয়েকদিন পর নুরু ভাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কথা বলে বাড়ি থেকে সেই যে বের হলেন আর ফিরলেন না। খালা অনেক নিষেধ করা সত্তে¦ও তিনি শুনলেন না। খালু কোনো বাধা দেন নি । বরং তিনি তাকে উৎসাহিত করতেন। নুুরু ভাই মাঝখানে একবার খবর দিয়ে জানিয়েছিলেন তিনি কোথায় আছেন। সেখানে নাকি তিনি ভালোই ছিলেন। মাসখানেক পর আমাদের বাসায় মিলিটারি এলো। তাদের সাথে ছিলো আমাদের গায়ের মাতব্বর আজগর মিয়া। আমি তখন পানি নিয়ে ফিরছিলাম। দেখি তারা খালা-খালুকে আঙ্গিনায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, নুরু কোথায়? কেন তাকে যুদ্ধ পাঠানো হলো? তারপর তারা গুলি করে খালা-খালুর বুক ঝাঝড়া করে দিলো। আমি কলসি ফেলে খালা-খালুর দিকে ছুটে গেলাম। অমনি ওরা আমাকে ধরে গাড়িতে তুললো। তারপর তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেলো। সেখানে দেখলাম আরো কয়েকজন মেয়েকে তারা ধরে এনেছে। রাতের বেলা তারা আমাদের নাচাতে বাধ্য করলো। তারপর আমাদের ব্যবহার করলো। আমি শিকার হলাম মাতব্বরের। পরদিন রাতে আমি পালাতে সক্ষম হলাম। একজন লোকের সহায়তা নিয়ে চলে গেলাম নুরু ভাইয়ের ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে শুনি নুরু ভাই ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতে গেছেন। বাড়িত ফিরে এলাম। এই এলাকায় থাকা আমার জন্য নিরাপদ নয় ভেবে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে কিছু কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা আর নুরু ভাইয়ের ঐ ছবিটা নিয়ে বের হলাম টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে। ওখানে উঠলাম এক দুঃসম্পর্কের মামার বাসায়। ভালোই ছিলাম সেখানে। কিছুদিন পর সকালে বমি আর মাথাব্যথা শুরু হলো। মামী সন্দেহ করে বাসা থেকে বের করে দিলেন। তারপর ঢাকায় চলে আসি। সেখানে নানা বাসায় কাজ করতাম। অনেক কষ্টে কেটেছে ৯ মাস। ’৭২ এর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে তোর জন্ম হয়।
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাহেলা বেগম। স্বাধীন তন্ময় হয়ে কথাগুলো শুনছিলো।
– আমি আজ বাধ্য হলাম কথাগুলো বলতে যখন দেখলাম সেই রাজাকার মাতব্বর এমপি নির্বাচিত হয়েছে আর তুই তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিস। ছি! ছি! এরা যদি দেশ চালায় তাহলে তো নুরু ভাইদের সংগ্রাম বৃথা হয়ে গেলো। তাদের অবমাননা করা হলো। বলে কেঁদে ফেললেন তিনি।
– তারপর তোমার নুরু ভাইয়ের কি হলো?
– আমি তার আর কোনো খোঁজ পাই নি। আর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টাও করি নি। এমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার সামনে কিভাবে আমি দাঁড়াব?
– কিন্তু তুমি তো কোনো অপরাধ করো নি। তুমি নিজেকে এভাবে শাস্তি দিলে কেন? দেখ আমি ঠিকই তাকে খুঁজে বের করব। আর সেই রাজাকার আজগর মিয়ার মুখোশও আমি উন্মোচন করে দেব।
– যা বাবা তুই এখন ঘুমাতে যা। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করিস। অপরাধীর মতো বলে ওঠে রাহেলা বেগম।
স্বাধীন রুমে এসে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুচোখে ঘুম আসে না। তার শরীরে রাজাকারের রক্ত বইছে এটাকে সে কি করে মেনে নেবে? তার রক্ত ফুঁসে ওঠে। সে একটা ব্লেড বের করে হাতের তালু কেটে দেয়। শব্দ চেপে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে পারে না। উঃ বলে চিৎকার করে ওঠে। রাহেলা বেগম ছুটে আসেন। এসে দেখেন স্বাধীনের হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।
– একি করেছিস তুই? রাহেলা বেগম কপালে চোখ তুলেন।
– রক্তগুলো বের করে দিচ্ছি মা। আমার শরীরে কোনো রাজাকারের রক্ত থাকতে পারে না।
– কে বলেছে তোকে এগুলো রাজাকারের রক্ত। আমি তো তোকে পেটে ধরেছি। আমার রক্ত তোর শরীরে বইছে। বোকা ছেলে কোথাকার? বলতে বলতে তিনি একটানে শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে ফেলেন। তারপর আঁচল দিয়ে কাঁটা অংশটা বেঁধে দিলেন।
– মা আমার মনটাকে কিভাবে শক্ত করবো তুমি বলো? বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদো কাঁদো স্বর স্বাধীনের।
– তোর তো ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তোকে আরেকটি নতুন যুদ্ধ শুরু করতে হবে। তুই মুখোশধারীদের মুখোশ খুলে দিবি। এ যুদ্ধে তোকে জয়ী হতে হবে। আর আমি জানি তুই পারবি। তুই তো মুক্তিযোদ্ধা নুরুর ভাগ্নে। কি পারবি না? মুখে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন রাহেলা বেগম।
– হ্যাঁ মা পারবো। আমাকে পারতেই হবে। স্বাধীনও তার মুখে একটা করুণ হাসি ফোঁটায়।
রাহেলা বেগম ছেলেকে বুকে টেনে নেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। অলিখিত এক যুদ্ধে যাবার পূর্বমুহূর্তে এক নারী এভাবেই এক যোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ দিয়ে নিজেও একজন যোদ্ধা বনে যান। বলিষ্ঠ পুরুষের দেহ কাঁপতে থাকে। বন্ধন ভেঙে, মায়ার জাল ছিন্ন করে এবার সে বেরিয়ে পড়বে নিজেকে মুক্ত করার ব্রত-সংগ্রামে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to গল্প: সহযোদ্ধা

You must be logged in to post a comment Login