এ লে ফ্লে দ্যু মাল ১
ইউটিউব ভিডিও, সেরাহ ব্রাইটম্যানের \”এ লে ফ্লে দ্যু মাল\”
১
এই প্রথম জলাশয়ের পাশে বসে আছে শায়ান। এখন বিকেল। দূরে বিস্তৃত পাহাড়, তার উপর মেঘ। ভেসে যেতে থাকে তার গভীরতা নিয়ে। কিন্তু শায়ানের মনের গভীরতা বোঝার উপায় কি? একটু আগে ট্রেনটা তার গতিতে শব্দস্বরে এগিয়ে গেছে। শায়ানকে সামান্যই নাড়া দিতে পেরেছে। সেই শান্ত ধীর জলাশয় ঘিরে প্রকৃতিতে কেমন এক স্বর্গীয় সরসতা। এতে মরে গেলে কি হয়! কত মানুষই তো মরেছে! কীভাবে মরে মানুষ! রোগ শোকে কাতর হয়ে? না, এ মৃত্যু শায়ানের নয়। এখানে শোকও নেই। তবে কি? হারানোর বেদনা আছে, না আছে পাবার যাতনা। সেরাহ ব্রাইটম্যানের আরাবিয়ান নাইটস নয়, একেবারে এ লে ফ্লে দ্যু মাল (the flower of evil)। শায়ান উঠে দাঁড়ায়। একবার পেছনে ফেরে। তার চোখ বাষ্পায়িত হয়ে আছে। সামনে তাকায় সে। রেল লাইনের পরে দূর আকাশ। সেদিকে বাষ্পমাখা অসহায় কাঁদন। থর থর করে কাঁদতে থাকে শায়ান। সে ঘুরে বসে আবার জলাশয়ের ধারে। জলাশয়ের স্বচ্ছ শীতল জল তাকে প্রাণপনে ডেকে যেতে থাকে। পানিগুলোও থর থর করে কেঁপে কেঁপে এগিয়ে চলে। শীতল জলাধারের পাড়ে বসে পড়ে শায়ান। শক্ত হাইকিং বুট তার পায়। পা-টাকে জলে নামিয়ে আনে কিছুটা। বসে থাকে পা ছাড়িয়ে হতাশ। তারপর হাঁটু ভাজ করে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনে ছুরি, যেটা জ্যাক নাইফ। ছুরির ফলাটা টেনে বের করে। তারপর কোন কিছু না ভেবেই একটানে বাঁ হাতের মাঝের মাস্যল থেকে কব্জির উপর অবধি ধারালো ফলা দিয়ে কেঁটে যেতে থাকে সমানে। রক্ত বেরুতে থাকে অনবরত। কাঁটা অংশটার যতটুকু পারা যায়, তা ডান হাতে চেপে ধরে এবার স্বচ্ছ জলাশয়ের পাড়ের পানিতে নামিয়ে আনে। সাথে সাথে হাতের আশ-পাশের জলাশয়ের পানি লাল হয়ে উঠে। রক্তিম পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশে মিশে দূরে মিলিয়ে যায়। কতক্ষণ রক্ত আটকানোর প্রচেষ্টায় জলের তলে হাত চেপে বসে ছিল শায়ান জানে না। সে জানে একটু পরে পশ্চিম আকাশ লালিমায় লাল হয়ে উঠবে, তার শোণিতের ছাপে সারা উদার আকাশ ভরে যাবে। মেঘের কোন আলাদা অস্তিত্ব থাকবে না। মেঘের পরে মেঘ জমবে না।
উঠে পড়ে শায়ান। জলাশয়কে পেছেন ফেলে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার এই আঁধারি-তে ভূতের মত ট্রেন ছুটে যায়। কিছুটা ঝিমিয়ে থাকা শায়ান বাষ্পরুদ্ধ ভাবটাকে ভাসিয়ে দিতে পারে না কিছুতেই। তার মাথায় বাজতে থাকে,
Is it you I keep thinking of?
Should I feel like I do?
I’ve come to know that I miss your love
While I’m not missing you
We run ’til it’s gone
Et les fluers du mal
Won’t let you be
You hold the key to a open door
Will I ever be free?
কাটা হাতটাকে এখনো চেপে আছে আগের মত সে। একসময় আলো অন্ধকার হয়ে যায়।
২
সাদা ঘরে খুব নীলাভ হালকা আলো। আঁধার রাস্তার ওপার থেকে দেখা যায়, কাঁচের ওই ঘরের মাঝে। কালো উঁচু লম্বাটে টেবিলে বসে আছে এক দীপ্তিমান যুবক, এখন সে নিস্তেজ নয়। টেবিলটা শাদা কাফন কাপড়ে মোড়ানো হলেও একপাশ থেকে কাপড় উঠে গিয়ে তার কালো রঙ ঠিকই চোখে সাদা কালোর মিশ্রণ ঘটিয়ে দিয়েছে। তার হাত শ্রশ্রুষায় রত এক ধ্যাণমগ্ন নারী। কাটা হাতটা যতদূর পারা যায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতে ব্যান্ডেজ বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই হাতে ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে কি যেন ঠিকরে বের হচ্ছে শায়ানের চোখ থেকে! নিরুত্তর চারপাশ অথবা আশপাশ।
৩
এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এই জলাশয়ের দূরে অন্য এক প্রান্তে ঠিক আকাশের বিপরীতে বাঁশ, কাঁঠ ও মাটির সম্বন্বয়ে নির্মিত একটি চমৎকার দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বাড়ি। এইটাকে পিকচার পারফেক্ট বলা যায়, কেননা এর আশে পাশে আর কোন বসত ভিটা নেই। এর পাশ দিয়ে জলাশয়, তার পর সুবিস্তৃত আকাশ। ডান পাশে অতি দূরে উঁচু পাহাড়। এই বাড়িটি শায়ান কিছুদিন আগে নির্মাণ করেছিল। এই বাড়িতেই আলিশাকে সে এনেছিল। আলিশা শহরে বেড়ে উঠছিল। শান্ত স্নিগ্ধ ধীরলয়ের শহর। এই শহরেই আলিশাকে মানাতো। কিন্তু একসময় শায়ানের চোখে তাকে মানানো মনে হয় নি। আলিশার প্রকৃতি কী যেন মিস করছিল। সেই মিসিং লিংকটা পেতে এই বাড়ি। তারপর আলিশা, ১৭ -কে এই বাড়িতে নিয়ে আনা। আলিশার চোখ হরিণী। আলিশা শকুন্তলা। আলিশা পাহাড়ী ঝর্ণা। আলিশা জলাশয়ে পা বিছিয়ে প্রকৃতির বনে হারিয়ে যেতে জানে। শায়ানের এই আলিশাকেই চাই।
শায়ান বিদেশ ফেরৎ। সেখানে পাহাড় ও প্রকৃতি জড়াজড়ি করে থাকে। সেখানে লেকের জলে শ্বেত উর্বশীরা উড়ে উড়ে ভেসে থাকে। সেখানে যে কোন পুরুষকে উর্বশীরা স্বপ্নীল পুরীর চাবি দিয়ে দেয়। কেউ তা রাখে, কেউ তা হারিয়ে ফেলে, কেউ দুয়ার খুলে তলিয়ে যায়। শোনা যায়, উর্বশীরা সেই পুরুষের অপেক্ষা করছে, যে এই চাবিতে দুয়ার খুলে উর্বশীদের সাথে তালে তালে উড়ে বেড়াবে। ওখানকার বুড়ো পুরুষেরা বলে, এমন পুরুষ না কি এখনো মিলে নি।
আলিশা কালো। গোলাপও না কি কালো। আলিশা ধবল নয়। হৃদয় তার ধবল। আলিশার ডানা নেই, কিন্তু উর্বশীদের মত উড়ার পাখা গজিয়েছিলো তার। কারো চোখে পড়েনি। শায়ানই তা প্রথম দেখে। তাই শায়ান এই কালো উর্বশীকে এই জলাধারের বনানীতে নিয়ে আসে। সে জানে, সেই একমাত্র পুরুষ যে এই উর্বশীর সাথে তালে তালে উড়ে বেড়াবে। তখন জগত স্বপ্নীল মায়াবী যাদুর পুরীতে রূপান্তরিত হবে।
এখন এই বেলায় তার বানানো বাড়িটায় লেলিহান শিখা আকাশের বিপরীতে দীপ্র হয়ে উঠেছে। শায়ানের হৃদয়ের আগুন ঠিকরে বেরিয়ে এই বাড়িটা দাউ দাউ জ্বলে উঠেছে। আগুন বের হতে দেখে দূর পাহাড়ের ওপার থেকে লোকজন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে। ছুটে এসে তারা চমকে যায়, যখন দেখে শায়ানের বুক মুখ থেকে উত্থিত আগুনের শিখা বাড়ির দিকে ছুটে এসে পুরো বাড়িটাকে ছেয়ে ফেলছে। কেউ কেউ জলাশয় থেকে পানি নিতে চেয়েছিল। কিন্তু জলাশয়ের শীতল পানি এখন তাপিত হয়ে আছে। শায়ান সে পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর তার চতুর্পাশ্বের জলাশয়ের পানি থেকে বাষ্প উত্থিত হচ্ছে। লোকগুলো তা দেখে একটু দূরে বনানীর বড় এক গাছের আড়ালে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে। শায়ানের খালি পা পানিতে। শায়ানের হাতে সাদা গজের ব্যান্ডেজ।
[৬ পর্বে সমাপ্ত। সাথে থাকুন প্লিজ। আপনার মতামত আমার প্রয়োজন। ধন্যবাদ।]






সেরা বাংলা ব্লগ পুরস্কার পেলো -শৈলী














15 Responses to এ লে ফ্লে দ্যু মাল ১
You must be logged in to post a comment Login