রাবেয়া রব্বানি

গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব

গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব
প্রথম পর্ব


(৪)
“শাড়িটা বের করে তৈ্রি হচ্ছে মৌরি তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈ্রি হচ্ছে কিছু বৈরীতা।আয়নায় নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মৌরি শুনতে থাকে দরজার বাইরের চিৎকার আর দেখতে থাকে জানালার প্রতিবিম্বে আকাশে মেঘেদের জড়ো হতে থাকা,তাদের দ্রুত কালো হতে থাকা”।

-ওহ আপা কারিগর বাড়িত গেছে হঠাৎ। কাল নিয়েন।
মৌরী স্বপ্নভাঙ্গা মানুষের মত ফ্যালফ্যালে তাকাল, যেন সে কিছু বুঝতে পারছে না। যেন লোকটা দুঃস্বপ্নে তাড়া করা একটা চরিত্র। লোকটা আবার গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,
“আপা। কাল নিয়েন”।
মৌরি আর কিছু বলতে পারল না। হতাশায় বুদ হয়ে দোকান থেকে বেরুল। তার স্বপ্নের পাশাপাশি তিনদিনের টানা পরিশ্রম পুরোটাই মাটি হয়ে গেছে। কী ঝঞ্ঝাট করেই না সে গত দুই দিন দোকানে ঘুরে ঘুরে সাদা জলছাপ শাড়িটা কিনেছে !তার উপর ঘন্টা দুই ব্লাউজের জন্য দরজি পাড়ায়-পাড়ায় হন্যে দিয়েছে। এক দিনে কেউই ডেলিভারী দিতে রাজি হচ্ছিল না। তাও যা একজন রাজি হয়েছিল আজ এসে জানতে পারল সেটাও কিনা ভেস্তে গেছে আর শাড়িটার সাদাটাও একটু ম্লান।কেনা ব্লাউজের সাথে ঠিক যাবে না। রিকশায় ফিরতে ফিরতে নিজেকে আবার নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তার মাপের ব্লাউজসহ শাড়ি আপাতত শুধু একটাই আছে তবে সেটাও আবার লাল। দেখা করার মিষ্টি আমেজটা এখন দুঃশ্চিন্তা হয়েই হানা দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে তপুকে তাড়া দিয়ে কী ভুলটাই না সে করেছে।
বাসায় পৌছে কোন মতে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে শাড়িটা বের করল মৌরি। টকটকে না হলেও বেশ লাল!সন্ধ্যের পর হলে কিংবা ইন্ডোর হলে খারাপ লাগতো না। ধানমন্ডি লেকের খোলা প্রকৃতি তার উপর জুন মাসের বিকেল পাঁচটা,তার উপর তাজা রোদ সবমিলিয়ে লাল শাড়ি একেবারে খাপছাড়া লাগবে। এত বলে কয়ে সে কিনা নিজের মনের মত একটা শাড়িই পড়ে যেতে পারবে না! প্রথমদিন নিজেকে তপুর কল্পনার মত সাজিয়ে যেতে না পারার ব্যাপারটা সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছে না। একে একে নানান ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে মনে। আনমনে সে জামার উপরই শাড়িটা জড়িয়ে নিজেকে দেখতে চায়।

-কি রে!কি করিস!
মাকে দেখে মৌরি একটু চমকে উঠে।থতমত খেয়ে বলে,
-একটু দেখছিলাম শাড়িটা ভালো লাগে কিনা?
-মানে!বুঝতে পারছি না। তুই বাইরে থেকে এসেই শাড়িতে নিজেকে দেখছিস!
-হুম। আজ বেরুবো।
মৌরির মা রেবেকা সুলতানা হাতে সরবত নিয়েই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিস্ময়ে মেয়েকে তা দিতে ভুলে গেছেন।
-তুই বেরুবি মানে? এটা কেমন খাপছাড়া কথা? কোথায় যাবি?
-ওই যে। আমরা বান্ধবীরা মিলে একসাথে বাইরে বেড়াতে যাব বিকেলে।
-এই গরমে! আর তোদের না পরীক্ষা নেক্সট ওইক এ? কে কে যাবি?
-তুমি জেড়া করছো মা!
-হ্যা করছি।
মৌরি কোন উত্তর দেয় না। মায়ের হাত থেকে সরবতটা নিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলে,”চিনি বেশি হয়ে গেছে” আরো এটা সেটা। রেবেকা সুলতানা কিছু বলেন না ,মেয়ের কথাও কিছু শুনেনও না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নতুন করে দেখতে থাকেন মৌরিকে। সাড়া শরীর চোখ দিয়ে ময়ণাতদন্ত করে যেন বুঝতে চাইছেন মেয়ের মন। নিজের অশুভ সন্দেহের সাথে তাল রাখতে না পেরে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে মেয়ের ঘরের টুকটাক গোছাতে লাগলেন। লাল শাড়িটা ভাজ করে হ্যাঙ্গারে টানিয়ে রাখতে রাখতে আলমারিতে নতুন সাদা শাড়িটাও এবার তার চোখে পড়ল,
“এটা!”
“আমি কিনেছি। আমার জমানো টাকা থেকে”।
তিনি এবার আর কোন প্রশ্ন করলেন না,তাকালেন না পর্যন্ত মেয়ের দিকে। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ উলটে পালটে দেখলেন শাড়িটা তারপর বিছানায় কোনরকম ছুড়ে ফেলে বললেন,
“না মার্স্টাস পরীক্ষা ছেলেখেলা না। তুমি কোথাও যাবে না”।
রেবেকা সুলতানা তার বিস্ময়ে,জেড়াটায়, তাকানোটাতে, সব কিছুতে একটা ঘেন্নাটে ভঙ্গি রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন!আস্তে আস্তে সত্য আর সুন্দর একটি দিন কেমন পাংশু হয়ে গেল দেখে আরো হতাশ হয়ে গেল মৌরি। তার আর তপুর ভালোবাসাটা কত শুদ্ধ, কত সুন্দর!কত দীর্ঘসময়ে তিল তিল করে সাজানো! মায়ের একদিনের অমতে আর জেড়াতেই পুরো ব্যাপারটা কিনা চুরি চুরি হয়ে গেল। তাছাড়া মায়ের অমতে তার চোখের সামনে দিয়ে যাবেই বা কি করে আর না যেতে পারলে তপুকেই বা কি বলবে। তপুর মোবাইল নাম্বারটা কাল রাতেই নিয়েছে সে। চাইলে এখনি মানা করা যায় কিন্তু কোন কিছুতেই মন ঠিকঠাক সায় দিচ্ছে না।চিন্তার ভারে সারা শরীর জুড়ে আলস্য নেমে এলো তার।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ছে পড়ছে। বিকেল সাড়ে তিনটা। মৌরি বিছানায়ই শুয়ে আছে।বিছানা বরাবর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পুব দিকের জানালা সহ আকাশ মুখ দেখছে। সেখানে মেঘেরা জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে। তপুও হয়ত তৈরি হচ্ছে।মৌরি তবুও অস্থির মন নিয়ে নিশ্চল।একটা সিদ্ধান্তই যেন আজ লাগামহীন ঘোড়া সারা দুপুর এর পেছনেই ছুটেও সে ঠিক ধরতে পারছে না। কিন্তু সময়তো আর তার মনের মতো অস্থির নয় সেটা তার অবধারিত পথেই এগিয়ে চলছে এক পা এক পা করে।টিকটিক শব্দটাও তার কাছে এত জোড়ালো লাগছে যেন শেষ প্রহরের ঘন্টা ধ্বনি।
এতক্ষণ মায়ের ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে যাও কিঞ্চিৎ আশাবাদী ছিল মৌরি কিন্তু দেখা গেলো অন্যসব ছুটির দিনের মত তার মাও আজ ঘুমাননি। থেকে থেকে ভেসে আসছে কাজের মহিলার প্রতি তার চিৎকার আর উচ্চস্বর,মৌরির ঘরের বাইরে স্যান্ডেলের অহেতুক শব্দ তুলে পায়চারী। যেন মৌড়ীকে অদৃশ্য তালা বন্দি করে রাখতে চাইছেন তিনি।কিন্তু মৌরির ভাবনায় এখন সবচেয়ে বড় কথা হলো তপুর নতুন চাকরী, গেলে ছুটির দিনই তো যেতে হবে। এই সমস্যাটার চেহারা সব সময় একি রকম থাকবে। মুখ থুবড়ে পড়া সাহসটা নিয়ে সে কি পারবে এই বিশেষ তালাটা ভাঙ্গতে।ভাবতে ভাবতেই ঘড়িটা যথারীতি ঢং করে জানালো চারটা বেজে গেছে। মৌরি উঠে বসল।পনের নাম্বার থেকে ধানমন্ডি আট খুব দুরে না হলেও রিকশা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় আর তার তৈরি হতেও কিছুটা সময় নিবে।আসলেই আর সময় নেই,খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে তার। এতদিন দেখা করার ব্যাপারটায় তার নিজের ঝোক ছিল ষোল আনা। এখন তপুকে রাজি করিয়ে “আজ যেতে পারবো না” এই কথাটা সে বলবেই বা কিভাবে আর মায়ের সাথেও এই ছোট্র যুদ্ধে তার যেতেই হবে আগে পড়ে। নিজের মনের সাথে দ্বন্দ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দ্বিধাটা পাতলা পর্দার মত ক্ষিণ হয়ে এলো আর সেটা দুলতে দুলতে একটা চশমা পড়া মায়াবী মুখ ভেসে উঠতেই বাকিটাও মিলিয়ে গেল।
নিজের ঘরের ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিতে দিতে মৌরি শুনতে পেল রান্না ঘরে কিছু ভাঙ্গার শব্দ।

-থাকুম না।
এবার সালমার মার গলাটাও বন্ধ দরজা ভেদ করে কানে আসল। মায়ের জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার। নিজের স্বপ্নহীন জীবনের সবচেয়ে বড় শিকার এই বাড়ির কাজের মানুষ তাই এরা দুদিনেই বিদেয় হয়। তবে আজ তার প্রতি আক্রোশটাতে রাগ হয় না মৌরি। সন্তানের ক্ষেত্রে সব মাই নিজের ইচ্ছার দাবী করার অধিকার রাখেন। আজ যাওয়ার সময় সেও হয়ত মায়ের হিংস্রতায় আহত হবে তবু চেষ্টাটা তাকে আজই করতে হবে।
ঘড়িটা চারের ঘর পার করে ফেলেছে এর মধ্যে। শাড়িটা বের করে তৈ্রি হচ্ছে মৌরি তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈ্রি হচ্ছে কিছু বৈরীতা।আয়নায় নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মৌরি শুনতে থাকে দরজার বাইরের চিৎকার আর দেখতে থাকে জানালার প্রতিবিম্বে আকাশে মেঘেদের জড়ো হতে থাকা,তাদের দ্রুত কালো হতে থাকা।ব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নিজেকে আর একবার দেখে হতাশ হয় সে,তাড়াহুড়োয় কাজলের ধারগুলো মোটা হয়ে গেছে।কিছুই আর মনের মত হলো না। তবুও এই হতাশা আপাতত চাপা পড়ে গেল বাড়ি থেকে বের হবার দুঃশ্চিন্তায়। দু-এক মূহুর্ত নিঃশ্বাস নিয়ে বুক দম নিয়ে দরজা খুলে বের হয় সে।সকাল থেকে প্রকৃতি যেন মালা গাথার মতো পর পর বাধা সাজিয়ে রাখছে তপুকে প্রথম দেখার স্নিগ্ধ আবেশটাতে।এখন করিডোর পেরোতেই সবচেয়ে প্রকট বাধার মুখোমুখি হতে হল তাকে।
রেবেকা সুলতানা ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। তিনি ঘাড় ঘুড়িয়ে মেয়েকে দেখে বললেন,
-মৌড়ি এখানে এস বস।
-এখন না এসে কথা বলি। এখন সময় নেই।
-না।এখন।
সে জানে মার কাছে গিয়ে বসলে তার আজ আর যাওয়া হবে না। মৌরির এক হাত দরজার হাতলে আর এক হাতে মোবাইল কানে দিয়ে ব্যস্ত ভাব করল। রেবেকা সুলতানা টেবিল ছেড়ে উঠছেন মেয়েকে হয়ত ধরে ফেলবেন এই ইচ্ছায়। মৌরি ভীষণ ভয় পেল। ভয়টা তাকে বিদুৎগতিতে দরজা খুলিয়ে নিচে নিয়ে এলো। নিচে নেমেও তার হাত-পা হাল্কা কাপছে।একটা দুটো পিছুডাক সে শুনতে পেয়েছিল কিনা এখন মনে করতে পারছে না। মায়ের ভয়ে কিছু মূহুর্ত মৌরি নিশ্চল হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। ফিরতে তো তাকে হবেই, আর তখন যে কী ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে তা ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। আবার তপুর মুখটা মনে হতেই এক জীবন সাহস মাথা উঁচু করে ভাবলো,বাড়ি ফিরে মায়ের যেকোন বিচার,শারীরিক আঘাত ও সে সহ্য করতে পারবে কিন্তু তপুর চোখে স্বপ্ন একে তা ধুয়ে দিতে পারবে না।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে তবু একটু এগুতেই রিকশা পেয়ে গেলো সে।পলিথিনটি ধরিয়ে দিয়েই রিকশাওয়ালা ফাঁকা রাস্তায় হাওয়ার বেগে ছুটে চলল।বাতাসের তোড়ে কিছুটা পতপত করে উড়তে থাকলো নীল পলিথিন সাথে বৃষ্টি ধারা পতনের নানান তালের শব্দ,তবু সব শব্দ ছাপিয়ে নিজের হৃযন্ত্রের আওয়াজ ই কেবল শুনতে পাচ্ছে এখন মৌরি।আট নম্বর ব্রীজের কাছাকাছি আসতেই তার বুকের ধুকপুক টা ধরাস ধরাসে পরিণত হলো। সে ব্যাগ থেকে আয়না বের করে দেখলো আদ্রতায় তার চুলের নিচের দিকে কিছুটা ঢেউ খেলে গেছে । তাড়াহুড়ায় চুল আয়রন করা হয়নি আর সবচেয়ে বড় কথা তপুর জন্য কেনা রোলেক্সের ঘড়িটাই সে আনেনি। এবার সত্যি কান্না চলে আসলো তার। পরিকল্পনা মাফিক আর কিছুই হলো না। এত সুন্দর ভাবনাগুলো যেন বাতাসেই মিলিয়ে গেল। তার এখন মনে হলো তপু ঠিকই বলে, পৃথিবী নামক জগতে মানুষের ইচ্ছা সবসময় প্রকৃতির পায়ের তলায় প্রার্থনারত”।

(৫)
“রিকশা ঘুরাও” কথাটা তার জিবের আগায় উসখুস করতে থাকে। তবু রিকশা ধানমন্ডি লেকের দিকে এগুতে থাকে। চশমার কাঁচে পানির ফোঁটার নকশা বদলাতে থাকে। তপুর দুরুদুরু বুক থমথমে হয়ে আরো কিছু বৈরীতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। হয়তোবা মৌরি তাকে কল্পনার সাথে মিলাতে পারবে না। হয়ত সে তাকে দেখেই চলে যাবে।”

তপুকে ঘিরে গুঞ্জন বাড়ছে কমছে। সে তাকিয়ে আছে তার ছোট্র হাত আয়নাটিতে। সকালে সেভ করতে গিয়ে কেটে যাওয়া জায়গাটা বিকেল গড়াতে কালসিটে পড়ে গেছে। বেছে বেছে আজকের দিনই গাল কেটে যেতে হবে!তার দীর্ঘনিঃশ্বাসে আয়নার কাচ ঘোলা হয়ে গেল। এখনি মৌরির কথা মনে হতেই তার বুকে একশো হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে,কন্ঠনালীর লালা শুকিয়ে যাচ্ছে,হাটুর কাছে একটা দূর্বল অনুভূতি আর একটু পর সে সত্যি সত্যি দাঁড়াতে যাচ্ছে তার পাশে এটা ভাবতেই ভয়ের বৃক্ষের ঢালা-পালা গুলো আজ আবার ঝড়ো হাওয়ায় মাথা দুলাচ্ছে।
চলতে থাকা গুঞ্জন চরম আকার ধারন করে থেমে গেল। সিদ্ধান্ত হলো তপু পাঞ্জাবীর নিচে একটা ভারী হাফ হাতা গেঞ্জি পরে যাবে যাতে তাকে দেখতে এতটা হাংলা না লাগে আর বড় সাইজটা কিছুটা হলেও আড়াল করা যায়। তপুর বারনে তারা টললো না বরং আরো চেপে যুক্তি দিল।”তুই তো আর ঠকানোর জন্য কাজটা করছিস না।ভালোলাগার জন্য।এখানে দোষের কি”!।ইত্যাদি বলে তারা তপুর ঘোর লাগা মনের অবসন্ন শরীরটাকে বিয়ের বরের মত সাজিয়ে গুজিয়ে সিড়ির মুখে একরকম ঠেলে দিল।
যন্ত্রচালিতের মতো রিকশার উঠে বসে তপু। আপাদমস্তক এখন নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে তার। আসলে সে কি সজ্ঞানে মৌরির কাছে যাচ্ছে!দ্বিধা আর দ্বন্ধ রিকশাওয়ালার মতই জোড়ে প্যাডেল ঘুরায় কিন্তু তাদের গতি ঘোরের সাথে পেরে উঠে না। দ্বিধা আর ভয়টুকু শুধু পাক তুলে ঘোরটাকে আরো ঘোলাটে করে যাচ্ছে। আশেপাশে কিছুই তার চোখে পড়ছে না। ঘুমে চলা বা ভূতে পাওয়া মানুষের মত তার চিন্তা জড় হয়ে আসছে। কি হতে যাচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না সে। বুকের ধুক-পুক বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন কেমন অসাড়-নিঃসাড় বোধ।
এর মধ্যে রোদ তাড়িয়ে কখন আকাশ মেঘের দখলে চলে গেছে কখন বৃষ্টির প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে খেয়াল করেনি তপু।এখন টুপটাপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা তবু প্যাডেল টানায় ব্যস্ত। তপু তাকে পলিথিনের জন্য তাড়া দিয়ে নেমে দাড়ায়। সাথে সাথেই যেন বৃষ্টিটাও ঝমঝমে মুষলধারের রূপ নিল। হাত দিয়ে কোনাকুনি বাড়ি দিয়ে ছিট আলগাকরণ আর রিকশাওয়ালার বিরক্তমুখে পলিথিন বের করে আনতে কিছু সময় যা লাগল তাতেই তপু ভিজে চুপশে। রিকশায় উঠে বাকি পথটায় আর পলিথিনটা ধরে রাখার কোন কারন আছে কিনা সে বুঝেত পারছে না। মোবাইলটা কি আছে না শেষ তাও তার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রকৃতি তার কিছু সন্তানের সাথে বেশি বাধা-বাধা খেলে,আর সে যে তাদেরই একজন এটা অনেক আগেই সে মেনে নিয়েছে,নতুন করে আজ তাই অবাক হতে হলো না। ক্ষত-বিক্ষত শহুরে রাস্তায়, রিকশার প্রবল ঝাকুনিতেও তার মুখে পাথরের মূর্তির মত অভিব্যক্তিহীন।

তাজমহল রোডের মাথায় ফুলের দোকান দেখতেই নেমে পড়ে সে। দোকানটায় নানা জাতের ফুল একান্তিক ভাবে গন্ধ ছড়াচ্ছে। মূহুর্তে তার মন ভালোলাগায় ভরে গেলো। সব রঙ্গের গোলাপ মিলিয়ে একশোটা ফুল নিল।সাথে দু-গুচ্ছ সাদা দোলনচাপা,এটা মৌরির খুব প্রিয় ফুল ।কেমন বুনো মাতাল গন্ধ,প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিল সে।পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে দেখল ফুল বিক্রেতা ছেলেটি ফিক ফিক করে হাসছে ছেলেটির চোখ অনুসরণ করে তপু নিজের দিকে তাকায়। পাঞ্জাবী ভিজে স্বচ্ছ হয়ে আছে।আর তাতে মেরুন রঙ ছাপিয়ে সাদা গেঞ্জিটা প্রকট হয়ে ফুটে আছে। নিজের প্রতি চরম মমতা বোধ করল সে। এতকিছু স্বত্তেও সে কিনা মৌরির মত মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে!এটা নিঃসন্দেহে তার দুঃসাহস। ফুল নিয়ে রিকশায় উঠতে উঠতে সে আর এক চোট ভিজল। সাদা গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে খুব লজ্জা লাগতে লাগল এখন তার। মনে হলো প্রকৃতি যাকে এমন দিনে উপহাসের পাত্র বানায় তার এত দুঃসাহস মানায় না।তপুর ইচ্ছে হয় রিকশা ঘুরিয়ে মেসে ফিরে যায়। কিন্তু মৌরি হয়ত তাকে প্রতারক ভাববে। এবার দ্বিধাটা ভেজা রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলা রিকশার চেয়েও জোড়ে প্যাডেল ঘুরায়। “রিকশা ঘুরাও” কথাটা তার জিবের আগায় উসখুস করতে থাকে। তবু রিকশা ধানমন্ডি লেকের দিকে এগুতে থাকে। চশমার কাঁচে পানির ফোঁটার নকশা বদলাতে থাকে। তপুর দুরুদুরু বুক থমথমে হয়ে আরো কিছু বৈরীতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। হয়তোবা মৌরি তাকে কল্পনার সাথে মিলাতে পারবে না। হয়ত সে তাকে দেখেই চলে যাবে।
একসময় রিকশা ধানমন্ডি আট নম্বর ব্রীজএ এসে থামে। ভাড়া মেটাতে মেটাতে তপুর চোখ মৌরিকে খোজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেখানটায় দুজনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানটা ফাঁকা। আর এমনিতেও বৃষ্টির কারনে খোলা জায়গাগুলোতে এখন কেউ নেই। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে সেটা নিস্পন্দ হয়ে আছে। সে অস্ফুট উচ্চারনে নিজেকে বলে ”কই যাবি গোপাল সঙ্গে যাবে তোর কপাল”।এখন তাহলে যোগাযোগের উপায় ও বন্ধ নিজের প্রতি উপহাসে ঠোট বেকে যায় তপুর। দূদার্ন্ত নাটকের শেষ অংক তেমন দূদার্ন্ত লাগছে না কেমন করুন আর ম্লান হয়ে গেছে।
বৃষ্টি একটু কমলেও এখনো ধারা চলমান। তপু আশ্রয়ের জন্য এদিক ওদিক গেল না।পাঞ্জাবীর নিচে সাদা গেঞ্জিটা নিয়ে আর ভাবিত হলো না। চশমাটা খুলে পকেটের নির্জীব মোবাইলটির পাশে রেখে দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।


ঠিক তখনি মৌরি আর তপুর জন্য পৃথিবী নামক জগতের এই ভীষণ বিকেলে অনুভবের জগতের দরজা খুলে গেল। সবকিছুতে অপার্থিব একটা মাত্রা যোগ হলো। ওরা যেন রাস্তায় ঝড়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও বেশি লাল আর পার্কটা যেন স্বর্গের বাগান।দুজন দুজনের হাত ছুতেই পেল প্রথম মানব-মানবী হওয়ার স্বাদ। এক মহান সঙ্গীতের কম্পন শুরু হলো সব বস্তুতে।

রিকশা ছেড়ে কৃষ্ণচূড়া গছটার দিকে তাকাতেই মৌরির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সেখানে একটা মেরুন পাঞ্জাবী পড়া ছেলে। তপুর মত আবার তপুর মত না। তাছাড়া চোখে চশমা নেই। চুল একটু ছোট। চেহারাও এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু মূহুর্ত ভেবে মৌরি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই এক দুপা করে এগিয়ে যেতে থাকে।
আর তপু দেখল লাল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মৌরির মত আবার মৌরির মত না। মৌরিকে ছবিতে যেমন দেখেছে তার চেয়ে একটু বড় চুল,মাঝারি গড়ণ,গায়ের রঙ আর একটু চাপা। চেহারা এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি তাকেই খেয়াল করছে। হয়ত এটাই মৌরি। তপুর মনে হলো পৃথিবীতে নিজের হৃপিন্ডের শব্দই সবচেয়ে প্রলয়ংকারী রূপ নিয়েছে। ফুসফুস বাতাস ধরে রাখতে পারছে না। সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানতে থাকে।
তারপর দুজন সামনা-সামনি। তপুর মুখ থেকে একটা শব্দই বের হয়েছে মৌরি। আর মৌরির মুখ থেকে তপু।
মৌরি রাস্তা ছেড়ে গাছটার নিচে তপুর সমান্তরাল দাঁড়ালো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার হাত-পা সামান্য কাঁপছে। সে শাড়ি সামলানোর ছুতায় নিচের দিকে তাকানো। আর তপু নিস্পন্দ মোবাইলটা চালু করায় ব্যস্ত। দুজনে দুজনাকে সামনে পেয়েছে ব্যাপারটা তাদের কাছে শরীরের কোথাও হঠাৎ কেটে যাওয়া জায়গার মতই সাময়িক অনুভূতিহীন।
কিছু সময় মৌরি নিজের শাড়ি,ভিজতে থাকা চুল সামলাতে ব্যস্ত থাকে আর তপু তার চশমা আর মোবাইলের কার্যহীনতার প্রতি। বেশকিছুক্ষণ পর তপুর মনে হয় ফুলগুলো সে এখনো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৌরির মুখের দিকে না তাকিয়েই নিঃশব্দে সে ফুলগুলো এগিয়ে দিল।হঠাৎ মৌরির খিলখিল হাসিতে সে অবাক হয়ে তাকায়
-এই যাও!তুমি পাঞ্জাবীর নিচে হাফ হাতা গেঞ্জি পড়েছ কেন!মাথা খারাপ ছেলে।
মৌরির নির্মল হাসি দেখে তপুও হেসে ফেলে।
তারা হাসতে থাকে,ভুলতে থাকে আজকের সব বৈ্রীতা।এই বৃষ্টি ভেজা আলো-আধারির বিকেলে লাল শাড়িতে মৌরিকে আর মাতাল-ক্ষ্যাপাটে ভালোবাসার মতই পাঞ্জাবির নিচের হাফ হাতা সার্টে তপুকে বেশ মানিয়ে গেলো।
তপু দেখতে থাকে মৌরির মুখে বৃষ্টির হিরক কুচি,ছড়ানো কাজলে পটলচেড়া চোখ,বাম গালে ছোট্র টোল, ভেজা চুল। আর মৌরি দেখতে থাকে তপুর কেটে যাওয়া গালের নীলচে কালসিটে, চশমা ছাড়া বৃষ্টি ধোয়া মুখ,থুতনির টোল আর নিস্পাপ সুন্দর হাসি।
ঠিক তখনি মৌরি আর তপুর জন্য পৃথিবী নামক জগতের এই ভীষণ বিকেলে অনুভবের জগতের দরজা খুলে গেল। সবকিছুতে অপার্থিব একটা মাত্রা যোগ হলো। ওরা যেন রাস্তায় ঝড়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও বেশি লাল আর পার্কটা যেন স্বর্গের বাগান।দুজন দুজনের হাত ছুতেই পেল প্রথম মানব-মানবী হওয়ার স্বাদ। এক মহান সঙ্গীতের কম্পন শুরু হলো সব বস্তুতে। সমস্ত প্রকৃতি সাথে কোরাস করতে লাগল,
Let me give my life to you.
Let me drown in your laughter,
Let me die in your arms.
Let me lay down beside you,
Let me always be with you.
Come let me love you,
Come love me again.

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………।।
আসলে অনুভবের জগতটা বা কল্পনার এক আলাদা ইন্দ্রিয়ও ঈশ্বর প্রদত্ত। মানুষের জীবনের কিছু কিছু দূর্লভ মূহুর্তে এই দুই জগতের মিলন হয়।আর সেটাই হয়ত মেজিক মোমেন্ট।সমস্যার বেড়াজালে আবার ভুবন পৃথক হয়ে যায়।তবুও সেই সুন্দর মূহুর্তের স্মৃতিই মানুষ সারা জীবন যত্নে লালন করে,কল্পনায় তার সাথে বার বার দৌড়ে বেড়ায়।
তপু এবং মৌরির জীবনে সামনে অনেক সমস্যা আসবে। হয়ত তাদের আর পাশাপাশি আর হাঁটা হবেনা,হয়ত আবেগ চাপা পড়ে যাবে,কিংবা হয়ত ভালোবাসা নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে ফিকে হয়ে যাবে। সেটা আর লিখতে আর ইচ্ছে হলো না।জানি পৃথিবীতে স্থির সময় বলে কিছু নেই তবু ইচ্ছে হলো গল্পে এই বিকেলটা স্থির করে দিতে।ওরা হাঁটতে থাকুক হাত ধরা ধরি করে অনুভবে পা ফেলে পৃথিবীর পথে।


শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


26 Responses to গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব

You must be logged in to post a comment Login