জুলিয়ান সিদ্দিকী

উপন্যাস: মায়াজাল

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আজকাল কাজ করতে তেমন একটা ভালো লাগে না আব্বাসের। অফিসে ঢুকলেই মনটা কেমন বিগড়ে যায়। চারদিকের মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয় চেহারা মানুষের হলেও ভেতরে যেন লুকিয়ে রেখেছে অন্য একটি প্রাণী। যার ধারালো দাঁত-নখ, শিং সবই আছে। বাইরের আবরণটাই কেবল মানুষের।

তবু তাকে অফিসে আসতে হয়। চাকরি করে বলেই আসতে হয়। চাকরিটা যদি কেবলই নিজের জন্যে হতো তাহলে কবেই হয়তো ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তো। তেল মেরে, হাত কচলে, জি হুজুর জি হুজুর করে চাকরিতে বহাল থাকার কোনো ইচ্ছে তার নেই। এমনিতেই স্বাভাবিক ভাবে যতক্ষণ চাকরি থাকলো তো করবে, না হলে যা হবার হবে। তবে বউ বাচ্চার কথা মনে হলেই মনটা কেমন যেন ইঁদুর হয়ে যায়। ভাবতে সে বাধ্য হয় যে, চাকরি ছাড়লে সে যত না কষ্ট পাবে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবে তার বউ-ছেলেরা। তাই হয়তো নিজেরই অজান্তে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে এতদিন। কিন্তু আর হয়তো সম্ভব হবে না। দিন দিন পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। কফিল সাহেব কিছুদিন হলো কাজে অকাজে রুমে ঢুকে পড়ছেন, আর সঙ্গত কারণেই সহকর্মীদের সঙ্গে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপে মগ্ন আব্বাসকে দেখে তিনি বলতে পারেন, আপনি তো কাজ করেন না আব্বাস সাহেব! দেখেন, আমাকে ফাঁকি দিলে কিন্তু বিপদে পড়বেন!

কিন্তু আব্বাস বলেছিলো, কাজটা কতটুকু হয়েছে নিজেই দেখেন না!

কফিল সাহেব দেখেন, ম্যাক্রোমিডিয়া ফ্লাশে তৈরি সুইচ ক্যাটালগের প্রাথমিক নির্মাণ। কিন্তু তিনি চান আরো দ্রুত কাজ। আব্বাস তখনই জানিয়ে দেয় যে, এ সব কাজ করতে গেলে চোখের উপর খুবই চাপ পড়ে। ঘণ্টা-পৌনে এক ঘণ্টা কাজ করলেই মাথা আর চোখ ব্যথা আরম্ভ হয়ে যায়।

সুযোগটাও যেন ছাড়তে চান না কফিল সাহেব, সারাক্ষণই তো দেখি কথা বলেন। কাজ করেন কখন?

আব্বাসের খারাপ লাগে। ইচ্ছে হয় এখনই কথার তুবড়ি ছোটায়। পেশার বাইরের একটি ফালতু কাজের জন্য কথা শুনতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু তর্ক করতে ইচ্ছে হয় না তার। কিছু কিছু লোক চাচ্ছে তর্কটা ঘটে যাক। এতে তাদের কোনো লাভ না হোক, ছা পোষা জীবনে কিছু একটা বিষয় নিয়ে তুমুল আড্ডা মারা যাবে। আব্বাস ভাবে, লেডি কিলার কফিল সাহেব মেয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কেন এত কথা বলে? এর পেছনে আর কিছু নেই তো? তিনি নিজে যেমন অন্যকে তেমন ভাবাটা খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না। তবু এর পেছনে নেহায়েতই ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায় না আব্বাস। অফিসের স্টাফরা এখানে ওখানে আলাপ করে, কফিল সাহেব তার রুমে নতুন একজন ডিজাইনার নিয়েছেন। যাতে তার অভিসারটা ভালোমতো জমে ওঠে। দেখতে গুগলি শামুকের মতো বেঁটে খাট তানজিলার চেহারা আহামরি কিছু না হলেও প্রাকৃতিক সম্পদের জোরেই এতটুকু উঠে এসেছে। অবিবাহিতা হলেও মাস খানেকের মধ্যে শারীরিক আকৃতি পরিবর্তনের পেছনে কফিল সাহেবের হাত যে সক্রিয় নয়, কথাটি কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবু মোস্তফাকে আব্বাস বলেছিলো, হয়তো না। ওর নিশ্চয়ই কোনো গোপন প্রেমিক আছে।

আরে নাহ! কী যে বলেন না মিয়া! গোপন প্রেমিক এতদিন করলো কি? নাকি চাকরি পাওনের লগে লগেই পার্কে হোটেলে দৌড়াদৌড়ি শুরু করছে?

আব্বাস কিছু বলতে পারে না। অতটা তলিয়ে সে কখনোই ভাবতে চায় না। আর চাইলেও হয়তো কখনো পারতো না। যেমন গতকালই লাঞ্চ টাইমে দু’জনে মিলে ঘুরতে বাইরে গিয়েছিলো। সেকশনে তখন ছিলো হাফিজ আর নাইমা। নিজেদের চেয়ারে বসার পরই মোস্তফা কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলো, দেখেন না মিয়া নাইমারে, হাফিজ্যা কচলাইয়া করছে কি!

ফিরে নাইমার পিঠ দেখতে পেয়েছিলো আব্বাস। জামার নিচ থেকে ডান কাঁধের উপর অনেকটাই বেরিয়ে আছে ব্রার স্ট্র্যাপ। এর বেশি কিছু দৃষ্টিগোচর হয়নি তার। বলেছিলো, কি বলছেন বুঝতে পারছি না।

মোস্তফা কণ্ঠস্বর আরো নিচু করে বলেছিলো, যাওয়ার সময় নাইমার ঘাড় আর পিঠের যদ্দুর দেখা গেছিলো, স্ট্র্যাপ দেখতে পাইছিলেন?

তা অবশ্য ঠিক। বেরোবার মুখে প্রায়ই নাইমার ঘাড় আর পিঠের খানিকটা চোখে পড়ে। কিন্তু স্ট্র্যাপ কি সে এখানে দেখতে পেয়েছিলো? কাপড়ের নিচেই হালকা ভাবে ফুটে থাকে ওগুলো। তাহলে স্থানান্তর হলো কেন? মোস্তফার যুক্তি অনুযায়ী মেয়েরা যতটাই নড়াচড়া করুক ওদিকের ফিতে সরে আসলেও এতটা আসার কথা না। এমনকি পিঠের উপর লাগানো হুকও শিরদাঁড়ার বরাবর না থেকে অনেকটা বাঁদিকে সরে এসেছে। হতে পারে। যেহেতু দু’জনের চেয়ার পাশাপাশি। পাশাপাশি টেবিলে রাখা ওদের কম্পিউটার। অন্যান্য সহকর্মীদের অনুপস্থিতিতে সুযোগটা তারা নিতেই পারে। যদিও শোনা যায় অনেক আগে থেকেই হাফিজ আর নাইমার মাঝে প্রেম চলছে। আর প্রেমিক-প্রেমিকারা এক আধটু না হয় পুরোপুরিই কিছু করলো, তাহলে মোস্তফা বা আব্বাসদের তো কিছু আসে যায় না। তাদের মাথা ব্যথা হবে কেন?

এই যে, লিলি বা পাপিয়া ওদের পিঠের দিকে তাকালেও এমনি ব্রার হুক ফুলে আছে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও তাদের বিয়ে হয়েছে। একটা কি দু’টো বাচ্চাও আছে। তাদের নিয়ে তো এমন গল্প করে না মোস্তফা। ঘটনা কিছু একটা আছে। ঢাকা শহরে রাস্তায় বের হলে এমন অনেক দৃশ্যই চোখে পড়ে। যা আজকাল আব্বাসের তেমন চোখে পড়ে না। হয়তো পড়ে। তেমন মনোযোগ দিয়ে হয়তো তাকায় না বলেই এমনটা মনে হয় তার।

এমন সময় দরজা ঠেলে লিলি আর পাপিয়া ঢুকলে মোস্তফা ইশারায় নাইমার  পিঠের দিকে দেখায়। দু’জনেই মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে হাসে। কিন্তু কিছু বলে না। চুপচাপ নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে।

আব্বাস নিজের কম্পিউটারের মনিটরে চোখ রাখতেই দরজা ঠেলে প্রায় ঝড়ের বেগে প্রবেশ করেন তানজিলা। বললেন, আব্বাস ভাই, সকালের দিকে ফারুক সাহেবের যে কাজটা দিয়েছিলাম ওটার কতটুকু হলো?

আব্বাস বললো, ওটা ধরতেই পারিনি ম্যাডাম! কফিল সাহেব যেভাবে আমাকে ধমকে গেলেন, তারপর আর ওটার কথা মনে হয়নি!

তানজিলা দু’হাত কোমরে রেখে দু’গাল ফুলিয়ে উফ করে বাতাস ছাড়তে ছাড়তে যেন হাঁপাতে লাগলো। যেন নিচ থেকে সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে এখান পর্যন্ত উঠে এসেছে। ভেতরে ভেতরে যে তিনি রাগ করছেন বোঝাই যায়। বললেন, যে কাগজটা দিয়েছিলাম, ওটা কোথায়?

আপনিই তো আমাকে দেখিয়ে আবার নিয়ে গেলেন।

তানজিলা তড়িঘড়ি বেরিয়ে যেতেই মোস্তফা বললো, ভাবখানা যেন ডিরেক্টর!

লিলি বললো, ডিরেক্টরের পাশের চেয়ারে বসে, হাওয়া-বাতাস কি আর না লাগে!

কথাটা শুনে পাপিয়া হাসে কেবল।

এতক্ষণ ধরে এত ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, তার দিকে যেন হাফিজ আর নাইমার কোনো খেয়াল নেই। তাদের কাছে রুমে উপস্থিত বাকিরা যেন অস্তিত্বহীন এমন ভাবেই ওরা দু’জন নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে কাজ করছে।

হাফিজের সঙ্গে আর নাইমার সঙ্গেও মাঝে মধ্যে মজা করে আব্বাস। বলতে গেলে সেকশনের সবার সঙ্গেই। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সবার সঙ্গেই তার একটি মধুর সম্পর্ক রয়েছে।

আব্বাস চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে হাফিজকে বললো, এই, তোরা কী এমন কাজ নিয়ে ব্যস্ত যে, কোনো দিকে তাকাবার অবসর পাচ্ছিস না? ওদিকে যে শিঁকের দড়ি-দড়া সব খসে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে?

তারপর নিঃশব্দে এক হাতে নাইমার পিঠের দিকে ইঙ্গিত করতেই মনিটরে চোখ রেখে দেখতে পেলো নাইমা।

তাই হয়তো হাফিজ কিছু বলার আগেই সে উঠে বেরিয়ে যায়। হয়তো বাথরুমে। কিছুক্ষণ পরই শরীরের বাঁধন ঠিকঠাক করে আবার ফিরেও আসে।

অফিসের ভেতর এসব নানা কীর্তি দেখে আব্বাস ভীষণ ভয় পায় রুনিকে চাকরিতে পাঠাতে। ঘরে যতক্ষণ সামনা সামনি আছে, ততক্ষণ না হয় সবই ঠিক থাকলো। কিন্তু যখনই অফিসে ঢুকে পড়বে তখন তো চোখের আড়ালে কি হচ্ছে বোঝা যাবে না। এ নিয়ে শঙ্কিত আব্বাস রুনিকে বলেছিলো, মেয়েরা যারা চাকরি করে, তাদের ক’জনকে দেখি হাজবেন্ডের সঙ্গে থাকলে এক রকম আর অফিসে এসে ঢুকলে অন্য রকম।

এ কথা শুনেই রুনি কেমন যেন হয়ে উঠেছিলো। বলে উঠেছিলো, তোমরা ছেলেরা যে কি ভাবো না! চাকরি করতে গেলে মেয়েরা অফিসে ঢুকে বেশ্যাগিরি করে, না?

ছি রুনি! কথাটাকে তুমি ওভাবে নিচ্ছো কেন?

তুমি যা বললে, তার ছাড়া আর কোনো অর্থ হতে পারে না!

কেন পারে না?

না। পারে না! মেয়েরা চাকরি করে বলেই তাদের নিয়ে এতটা বিশ্রী ধারণা পোষণ করতে পারো না!

তুমি যা বলছো, আমি তা মিন করিনি!

কদিন আগেই একটি এনজিওতে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে রুনি। পাবলিক রিলেশন অফিসার। ঘরে ফিরে ঝলমলে মুখে জানিয়েছিলো, জানো, চাকরিটা আমার হবেই!

আব্বাস ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছিলো। তার বলতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছিলো, রুনি, যে বেতন পাই, তাতে তো আমাদের সংসার ভালোমতোই চলে! তোমার চাকরি করার কী প্রয়োজন? কিন্তু বলতে পারেনি। এর আগে একবার কথায় কথায় সে জানিয়েছিলো, তার চাকরি করার খুব ইচ্ছে। তখন বেখেয়ালে বলেছিলো, বেতনের টাকায় কি সংসার চলে না? তখনই রুনি বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই জানিয়েছিলো, ভালো রেজাল্ট নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, তোমার বাচ্চা পালতে আর সংসারের হাঁড়ি-বাসন মাজার জন্যে?

কি কথার কি জবাব! তাই আর কোনো কথা জোগায়নি আব্বাসের মুখে। বাকি সময়টা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিলো। এরপর থেকে চাকরির ব্যাপারে আর কিছু বলে না আব্বাস। সকালে বাপ-বেটাকে খাইয়ে দিয়ে রুনি পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলোর উপর হামলে পড়ে। যেটা পছন্দ হয়, একটি অ্যাপ্লিকেশন লিখে ফোল্ডারে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন সার্টিফিকেটের ফটোকপি আর ছবি সেঁটে দিয়ে খাম-বন্ধ করে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে তার দু’তিনটে আবেদনের খাম রেজিস্ট্রি করে পোস্ট করতে হয় আব্বাসকে।

ছেলে রতনকে স্কুলের গেটে ছেড়ে দিয়ে সে ফেরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আজ আগে আগেই রুনি চলে গেছে গুলশানের কোনো একটি এনজিওর হেড অফিসে। সে নিশ্চিত যে চাকরিটা তার হবেই। গতকাল বিকেলের দিকেই নাকি তাকে ফোনে জানিয়েছে আজ ন’টায় অফিসে উপস্থিত থাকতে। কিন্তু কেন তা বলা হয়নি। সকালের দিকে তাই আগে আগেই বেরিয়েছে সে।

বাসস্টপে এসে আব্বাসের মন খারাপ হয় সব সময়ই। এত যে ভিড় হয়, লোকজনের চাপাচাপির কারণে দাঁড়ানোর সুযোগটাও পায় না ভালো মতো। যদিও বাসগুলো দেখতে অভিজাত মনে হয়। চালক আর মালিক হয়তো ততটা অভিজাত নয় বলেই একই বাসে যত বেশি যাত্রী তুলতে পারা যায় সেদিকে খেয়াল থাকে। তাই কখনো দেখা যায় পরের বাসটি আসতে অনেক সময় পনের মিনিটের জায়গায় আধঘণ্টাও হয়ে যায়।

একটি বাস আসতেই লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। সামনের দিকে এগিয়ে আসার কারণে পিঠের উপর চাপ পড়ে। শক্ত কিছু একটা থেকে থেকেই পিঠের উপর বিঁধছিলো বলে সে পেছন দিকে তাকায়। খয়েরী কাচের রোদ চশমা পরা মহিলা উঁকি মেরে বাসের ভেতরকার অবস্থা দেখতে চেষ্টা করছিলো। আর তখনই পিঠের উপর বিঁধছিলো তার বুকের উপর চেপে ধরা ব্যাগের কোণা। এক্সকিউজ মি! বলে, আব্বাস দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহিলার।

তারপর বললো, আপনার ব্যাগের শক্ত কিছু আমার পিঠে লাগছে। ব্যথা পাচ্ছি!

সরি! সরি! বলে, মহিলা কিছুটা পেছনেই সরে হয়তো।

লাইনটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আব্বাস যখন উঠতে পারে, তখন মোটামুটি ঠাসাঠাসি অবস্থা। তেমন অবস্থাতেই মহিলা ঠিক তার পাশেই দাঁড়ালো। একটু সরে জায়গা দিতে চেষ্টা করলে আব্বাস তার পাশের জনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিব্রত হতে বাধ্য হয়। লোকটি সঙ্গে সঙ্গেই খ্যাক খ্যাক করে ওঠে, দেখতে পান না নাকি?

অগত্যা একবার হলেও সরি বলতে বাধ্য হয় সে।

মহিলাটি আরো কয়েকজন মহিলা যাত্রীর সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মাঝে মাঝেই সেদিকে দৃষ্টি ঘুরে আসছিলো আব্বাসের। মেয়েদের দিকে তাকালেই প্রথম তার দৃষ্টি পড়ে ঠোঁটের উপর। ঠোঁট সুন্দর মনে না হলে আর ফিরে তাকায় না সে। এরও ঠোঁটও সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক ঘষা ঠোঁটের উপর দিকটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ব্যাগটা ঠিক আগের মতোই বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রেখে এক হাতে একটি আসনের পাশে ধরে নিজকে সামলাচ্ছে। চলতে চলতে বাসটি আগে পিছে কিছুটা ঝাঁকি খাচ্ছিলো বলে, নিজকে অন্যের গায়ে ঢলে পড়া থেকে বাঁচাতে মোটামুটি কসরত করতে হচ্ছে তাকে।

তিন-চার স্টেশন পরই আব্বাসের সামনের যাত্রীটি উঠে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই আব্বাস বসে যেতে পারতো। কিন্তু সে মহিলাকে বললো, বসে পড়েন!

মহিলা মিষ্টি করে হেসে বললো, আপনি বসুন। আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না!

সে জন্যে না। দূরে গেলে বসতে পারেন। সামনের স্টেশনে নেমে পড়বো।

হঠাৎ সামনের স্টেশনে কেন? বলতে বলতে মহিলা এগিয়ে এসে সিটে বসে বললো, প্রায় তো দেখি মহাখালী নামেন।

আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না!

কেউ আসার কথা?

না না! এমনিই!

মহিলা কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকায়। তখনই সুপারভাইজার এয়ারপোর্ট বলতেই আব্বাস বললো, চলি!

মহিলা হেসে মাথা কাত করে।

আব্বাস বেঁকে চুরে দরজার দিকে এগোয়। বাস থেকে নেমে উল্টো দিকে এয়ারপোর্টের দিকে হেঁটে যায়।

অনেক বছর আগে এখানে একবার এসেছিলো সে। তখনও মন এতটা জটিল হয়ে ওঠেনি। সহপাঠিনীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে শেখেনি। প্রতিদিন একই সঙ্গে ক্যান্টিনে, ক্লাসে, লাইব্রেরিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেও পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার হেতু নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করেনি। তখনই একদিন হঠাৎ করেই লাইব্রেরিতে বসে নোট নেবার সময় নাজিয়া কোত্থেকে এসে খাতার উপর হাত রেখে বলে উঠেছিলো, কাল একবার এয়ারপোর্টে আসতে পারবে?

ভীষণভাবে চমকে উঠে তাকিয়েছিলো আব্বাস নাজিয়ার মুখের দিকে। কেন?

এমনিই! দশটার দিকে চলে এসো।

তুমিও যাবে নাকি?

হ্যাঁ। রেলিং ঘেরা উঁচু জায়গাটায় থাকবো।

ব্যাপারটা কি বলো তো?

নাজিয়া হেসে উঠে বলেছিলো, কিছুই না। আমি চাই দশটার মধ্যেই তুমি আসবে।

আচ্ছা আসবো।

তারপরই আব্বাস ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো সেদিনকার নোট নিতে। নাজিয়া কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়ে বলেছিলো, এখন উঠলাম। কাল অবশ্যই আসবে!

নাজিয়া চলে গেলে ব্যাপারটা সে প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলো। কিন্তু ব্যাগের ভেতর নাজিয়ার ক্যালকুলেটরটা রাতের বেলা পেয়েই তার মনে পড়ে পরদিন দশটায় এয়ারপোর্টে যাবার কথা বলেছে নাজিয়া। তখন ক্যালকুলেটরটা দিয়ে দিতে পারবে বলে, রুমমেট মাসুমকে বলে রেখেছিলো, সকালে যেন সে তাকে মনে করিয়ে দেয় দশটায় এয়ারপোর্ট থাকতে হবে। পরদিন সকালে টেবিলের উপর লাল কালিতে একটি কাগজে ”দশটায় এয়ার পোর্টে থাকবি” কথাটা লিখে রেখে ক্লাসে চলে গিয়েছিলো মাসুম।

তারপর ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠে বাসী মুখেই ছুটেছিলো সে এয়ারপোর্টে। কিন্তু নাজিয়াকে রেলিঙের পাশে পাওয়া যায়নি। তখন ব্যাগ হাতে নাজিয়া ঢুকছিলো এয়ারপোর্টের ভেতর। আব্বাস ছুটতে ছুটতে পেছন থেকে ডেকেছিলো, নাজিয়া!

ডাক শুনে নাজিয়া পেছন ফিরেই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ব্যাগ ফেলে ছুটে এসেছিলো। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে জড়িয়ে ধরেছিলো আব্বাসকে। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলো, সুইডেন যাচ্ছি!

আব্বাস থ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। আর হঠাৎ করেই বা সে কেন সুইডেন যাচ্ছে আর কেনই বা অমন পাগলের মতো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো, তা আজও বিস্ময় আব্বাসের কাছে। যদিও নাজিয়া বলেছিলো যে, সেখানে পৌঁছেই তাকে চিঠি লিখবে। কিন্তু নাজিয়ার চিঠি সে পায়নি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, হয়তো নাজিয়া তাকে মনে মনে খুব গভীরভাবেই ভালোবাসতো। কিন্তু মুখ ফুটে বা কোনোভাবে আগে প্রকাশ করতে পারেনি বলে শেষ মুহূর্তে তা বিস্ফোরিত হয়েছিলো। পরে ছেলেমানুষি বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে গিয়েছে। আর আব্বাস আজও বুঝতে পারে না যে, নাজিয়াকে সে নিজে ভালোবাসতো কি না। তবে, মাঝে মধ্যে রুনির দিকটা ভেবে তার মনে হয় যে, নাজিয়ার সঙ্গে সংসার পাতলেও কি নাজিয়া রুনির মতোই বলতো? অন্যান্য নারীরা কি মন থেকে তাদের বাচ্চা লালন-পালন করে না? সংসারের হাঁড়ি-বাসন মাজে না? নাকি রুনিই খুব বেশি রকম আলাদা?

হাঁটতে হাঁটতে আব্বাস সেদিকে গেলেও রেলিং ঘেরা জায়গাটা দেখতে পায় না। যেখানে দাঁড়ালে বিমানের উঠা নামা দেখা যেতো। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে, ভেতরে ঢুকতে হলে আলাদা টিকেট করতে হয়। বাইরে থেকে বিমান বলতে গেলে দেখাই যায় না। এতটা পরিবর্তন কবে হলো? কতদিন আগে হলো? অথচ এ পথেই সে সপ্তাহে ছ’দিন কখনো কখনো পুরোটা সপ্তাহই আসা-যাওয়া করে। কিন্তু এয়ারপোর্টের এত বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল তা একবারও তার চোখে পড়লো না?

একজন লোক নিচু স্বরে তার কাছে এসে বললো, ডলার লাগবো? রিয়েল, পাউন্ড, ইউরো?

আব্বাস বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলে না। লোকটি অন্য একজনের পাশে গিয়ে একই ভঙ্গীতে হয়তো এ কথাই বলে। সে পাশের ফুটপাতের মতো জায়গাটায় বসলে, একটি ছেলে বিভিন্ন রঙের গুঁড়োয় সাজানো পান নিয়ে আসে। বলে, মিষ্টি পান দিমু সার?

এখন পান-তামাক-চা কোনোটারই অভ্যাস নেই আব্বাসের। এ নিয়ে রুনি প্রথম দিকে বলতো, কেমন পুরুষ তুমি? পান-সিগারেটের অভ্যাস নেই ভালো কথা। কিন্তু চায়েরও অভ্যাস নেই এটা কেমন? ছাত্র জীবনটা কেমন ছিলো তোমার?

আব্বাস এ নিয়ে বেশি কিছু বলে না। চা-পান-সিগারেট-মদ-গাঁজা বলতে গেলে বাদ দেয়নি। কিন্তু অতীতকে হাতড়ালে নিজকেই বিক্ষত করা হয় বলে, চুপচাপ থাকলেও রুনির তা সহ্য হয়নি। বলে উঠেছিলো, তোমার কি বন্ধু-বান্ধব কেউ ছিলো না?

সে বলেছিলো, ছিলো তো অনেকই! কিন্তু আজ তারা কে কোথায় জানি না। কালে-ভদ্রে কারো সঙ্গে দেখাও হয় না।

ছেলেটি আবার বলতেই আব্বাস বললো, পান খেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো না তো?

ছেলেটি হাসে। না সার! এমন হইলে কি এই ব্যবসা করতে পারতাম?

কত?

দুই ট্যাকা।

আব্বাস দু’টাকা বের করে দিয়ে একটি পান নিয়ে মুখে দিয়ে চিবোয়। খারাপ নয়। আর একা একা বসে থাকাতে পান চিবোতে ভালোই লাগছিলো। বসে বসে আব্বাস মানুষ দেখে। হয়তো তাও দেখে না। তাকিয়েই আছে শুধু। সামনে দিয়ে কোন মানুষটা গেল? সে পুরুষ না নারী? ছেলে না বুড়ো? কোনোটাই  বলতে পারবে না।

রুনির চাকরিটা হয়ে গেলে, রতনকে না হয় প্রতিদিনকার মতো সেই স্কুলে দিয়ে অফিসে আসবে। কিন্তু ফেরার সময়? সে কি একা একা বাসায় ফিরতে পারবে? আর একা বাসায় ফিরে সে করবে কি? খাওয়ার সময় হলে কি সে নিজে নিজেই খাবার নিয়ে খাবে? কি খেলো, না কি নাই খেলো দেখবে কে? আর সার্বক্ষণিক একজন কেউ ঘরে না থাকলে ছেলেটার সব কিছুই তো এলোমেলো হয়ে যাবে! না হবে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, না হবে ঠিকমতো ঘুম আর লেখাপড়া। রুনির কি চাকরিটা না করলেই নয়?

নাহ! আর ভাবতে পারছে না আব্বাস। এভাবে কি জীবন চলে? নাকি ঠেলে ঠেলে চালানো যায়? সে কি রুনিকে বিয়ে করে ভুল করলো? আর এতগুলো বছর পার করে দিয়ে আসার পর যদি ভুল ধরা পড়ে তাহলে কি তা শোধরানোর কোনো পথ আছে? আব্বাস মনে মনে বলে, পথ না থাকলেও নতুন করে পথ খুঁজে না পেলে বানিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া তো কোনো পথ নেই।

শেষের কথাটা হয়তো সে জোরেই বলে ফেলেছিলো। একটি পথ চলতি তরুণী অবাক হয়ে পেছন ফিরে বললো, কিছু বললেন?

আব্বাস আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, আমাকে কিছু বলছেন?

তরুণী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপন মনে মাথা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে যায় তার পথে।

আব্বাস হঠাৎ করেই উঠে পড়ে। উল্টো দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে আবার রাস্তাটা পার হয়। ফুটপাতের রেলিং ঘেরা জায়গাটার ভেতর কয়েকটা চায়ের দোকান আছে। একটি দোকানের এক ফালি তক্তার বেঞ্চে বসতেই লোকটি জিজ্ঞেস করলো, কি দিমু?

চা।

লগে আর কিছু খাইবেন? কেক, বিস্কুট, বন, পাউরুটি?

আব্বাস বললো, কোনটা খেলে ভালো হবে?

কেক খান। আট ট্যাকা দাম। চা চাইর ট্যাকা।

আব্বাস একটি কেক নিলেও খেতে পারে না। কেমন সাবান সাবান গন্ধ আসছে। পাশেই ঘুরঘুর করতে থাকা একটি বালককে ডেকে কেকটি তার হাতে ধরিয়ে দিলে সেও কেমন অবাক হয়ে তাকায়। তারপরই একছুটে কোন দিকে চলে যায় আব্বাস খেয়াল করতে পারে না।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, এত চিনি?

না সাব! কৌটার দুধ মিঠা তো, লগে এক চামুচ চিনি দিলেই অনেক মিঠা অয়।

চা’টাও ঠিকমতো খেতে পারে না আব্বাস। দাম দিয়ে উঠে পড়ে আবার বাস স্টপের দিকে যেতে থাকে।

শরীরটা হঠাৎ করেই কেমন কেমন মনে হচ্ছে বলে, সে আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের বাস স্টপে গিয়ে আবার টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়ায়। যাত্রী তেমন নেই বলতে গেলে। সামনে থেকে গুণতে গুণতে নিজকে পেলো আট নম্বরে। একটি বাস তাও প্রায় ফাঁকা, আসতেই উঠে সিটে বসে পড়লো আব্বাস। বাসটা চলতে আরম্ভ করলে তার ভীষণ ঘুম ঘুম ভাব হতে লাগলো। মনে মনে কিছুটা ভয় পেলেও ততটা ঘাবড়ালো না। মাথাটাও কেমন যেন ব্যথা ব্যথা করছে। তার সন্দেহ হয় যে, পানের মধ্যে বা চায়ের ভেতর কিছু ছিলো। হয়তো চায়ের ভেতরই কিছু ছিলো। হয়তো তাও নয়। রুনির চাকরিটা হয়ে যেতে পারে। অফিসে দেখা করতে বলেছে। আর এ খবরটা শোনার পরপরই যেন সে কেমন হয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুমুতে না পারলেও রুনি কিছু টের পায়নি। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ছিলো বলে সেও শারীরিক ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি। এ সময়গুলোতে অবশ্য তারা দুজনেই বেশ সংযমী অনেকদিন থেকেই। যেহেতু রুনি কোনো ধরনের পিল ব্যবহার করতে পারে না, সে জন্যেই তারা  প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে।

সিটের উপর হেলান দিয়ে আব্বাস আপন মনেই হাসে। গতরাতের অনিদ্রাটাই এখন নিদ্রার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই এখন ঘুমুতে পারবে না। সামনের কয়েকটা স্টেশন পরেই তাকে নামতে হবে। জানালার কাছে বসেছিলো বলে গায়ে বাতাস লাগাতে এতক্ষণ আরামই বোধ হচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই পুরো শরীর কেমন কাটাকাটা দিয়ে উঠে শীত শীত বোধ হতে লাগলো। ক্রমেই বাড়তে লাগলো শীত বোধটা। মাথাটাও যেন আরো বেশি ভারী মনে হচ্ছিলো। জানালাটার কাচের পাল্লা টেনে বন্ধ করে দিতেই শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে।

একটি স্টেশনে থামতেই অনেক যাত্রী উঠলো। একজন তার পাশে বসেই কিছুক্ষণ পর পর মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিলো। আব্বাস চেষ্টা করছিলো না ঘুমাতে। চেষ্টা করছিলো সিটের উপর স্থির হয়ে বসে থাকতে। পাশের ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে বলে উঠলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার শরীরে তাপ প্রচণ্ড! জ্বর নাকি?

আব্বাস লাল চোখে তাকালো। বললো, তেমনই মনে হচ্ছে।

পরের স্টপে বাস থামতেই আব্বাস নেমে পড়ে। এখানে কয়েকটা ফার্মেসি আছে। একটিতে ঢুকে বললো, গায়ে ভীষণ জ্বর মনে হচ্ছে। কি খেলে এখনই জ্বর নামবে?

লোকটি আব্বাসের হাতটি ধরে জ্বরের উত্তাপ দেখলো মনে হয়। তারপর দু’রকমের দু’টো ট্যাবলেট দিয়ে বললো, এখনি খেয়ে ফেলেন।

দাম কত দেবো?

চার টাকা।

ওষুধের দাম পরিশোধ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটি দোকান থেকে পানির বোতল কিনলো আব্বাস। ট্যাবলেট দু’টো খেয়ে সে একটি রিকশা নেয়। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে। রুনি যদি ঘরে ফিরে না থাকে তাহলে রতন স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে।

স্কুলের সামনে আব্বাসকে দেখতে পেয়ে  ছুটে আসে রতন। তারপর রিকশায় উঠে পাশে বসে কোমর জড়িয়ে ধরে বললো, তোমার কি জ্বর? বাবা?

আব্বাসের কথা বলতে ভালো লাগছিলো না। তবু বলে, মনে হয় এখনি ছেড়ে যাবে! ওষুধ খেয়েছি!

ঘরের সামনে এসে রতন পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খোলে। তার মানে রুনি আসেনি। ঘরে ঢুকে আব্বাস রতনের কাপড়-জুতো-মোজা ছাড়তে দেখে। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ছেলেটা কিছু খায় কি না বলতে পারবে না আব্বাস। মিয়ানো কণ্ঠে বলে, কিছু খাবি বাবা?

রতন ফ্রিজ থেকে একটি বাটি বের করে চামচ দিয়ে চাওমিন খায়।

আব্বাস বললো, গরম করে দেই, ভালো লাগবে।

না বাবা। আমি তো প্রতিদিন ঠাণ্ডাটাই খাই!

তোর ভালো লাগে?

হুম!

আব্বাস বললো, আমি শুয়ে পড়ছি। আর তখনই তার চোখ পড়ে খাটের পাশে ফোনটা পড়ে আছে। সকালে বেরোবার সময় নিতে ভুলে গিয়েছিলো। ফোনটার পাওয়ার অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়ে সে।

বেলা দু’টোর দিকে পুরো শরীর আর মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো আব্বাসের। মনে হচ্ছে শরীরের সবগুলো হাড়ের জোড়া আলগা হয়ে রয়েছে। একটু নড়াচড়া করলেই ব্যথা লাগছে।  রতন পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তখনই সে শুনতে পায় বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ ক্রমাগত বেল বাজিয়েই চলেছে। কাতরাতে কাতরাতে সে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যায়।

দরজা খুলে দাঁড়াতেই রুনির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতে পায় আব্বাস। সে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েই ‘হয়ে গেছে! বলে, আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে কেমন শক্ত হয়ে গেল।

বললো, তোমার জ্বর উঠলো কেমন করে? অফিসে যাওনি?

ফিরে এসেছি।

ওষুধ খেয়েছিলে?

খেয়েছিলাম। কাজ হয়নি।

আচ্ছা, রুনু আপাকে আসতে বলছি!

তারপরই সে হায় হায় করে বলে উঠলো, রতনের কথা তো ভুলেই গেছি!

তারপর দরজার দিকে ঘুরলে আব্বাস বললো, আমি নিয়ে এসেছি। ঘুমুচ্ছে।

এখন ঘুমুচ্ছে কেন? বলে, রুনি ভেতরের দিকে যায়।

আব্বাস ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফাতে বসে। কিন্তু কোমরের কাছটাতেও ভীষণ ব্যথা বলে, সেখানেই শুয়ে পড়ে। ছোটবেলা জ্বর হলে মাঝে মাঝেই বাবা কিংবা মা এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখতেন। সে সময়টা খুবই ভালো লাগতো আব্বাসের। এখন মা কিংবা বাবা অনেক দূরের স্মৃতি। কোনো অবস্থাতেই ললাটে তাঁদের কর-স্পর্শ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। রুনি এসে যদি কপালটায় একবার হাত রাখতো। কিন্তু ও তেমন করে জ্বর দেখে না। হাতে থার্মোমিটার নিয়ে এসে আব্বাসের পাশে বসে বলে, এখানে শুয়ে পড়লে কেন? হা কর দেখি!

আব্বাস হা করলে মুখের ভেতর থার্মোমিটারটা রাখলে আব্বাস মুখ বন্ধ করে রাখে। সে মনে মনে চাচ্ছিলো যে রুনি কিছুক্ষণ হলেও তার কাছে থাক। কিংবা তাকে ধরে কিছুক্ষণ এভাবেই শুয়ে থাকে। কিন্তু এ মাত্র বাইরে থেকে এসেছে। সে কি এখানে বেশিক্ষণ বসবে?

রুনি থার্মোমিটার বের করে জ্বর দেখে নিয়ে বলে, মাথাটা একটু ধুয়ে নেবে? তাহলে কিছুটা আরাম হতে পারে। রুনু আপা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণে আমি গোসলটা সেরে নেই। বলে, থার্মোমিটার নিয়ে চলে যায় রুনি।

আব্বাস আবার শুয়ে চোখ বোঁজে। একবার জ্বর গায়ে দোকানে গিয়েছিলো আব্বাস। জ্বর মুখে পান খেতে ভালো লাগছিলো। দুর্বল লাগার কারণে সে দোকানটার সামনে টুলের উপর বসেছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলো, সে মাটিতে পড়ে আছে। দোকানের ছেলেটা মাথায় পান ধোয়ার পানি দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতে দেখে বলেছিলো, আপনের তো অনেক জ্বর। এই শইল নিয়া দোকানে আইছেন ক্যান?

আব্বাস টুলে বসে সময় নেয়। কিছুক্ষণ পর আয়নায় চোখ পড়তেই দেখে বাম গালের উপর লালচে দাগ। চোখের পাশে অনেকটা জায়গা ছড়ে গেছে। পানি লাগার কারণে বেশ জ্বলছিলোও। ঘরে ফিরে এলে ব্যাপারটা রুনির চোখে পড়লে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, কি করে এমন হলো?

পড়ে গেছিলাম।

ঘরে যে নিওবেক্রিন মলমটা আছে লাগাও।

আব্বাসের মলম খুঁজতে বা লাগাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কদিন পর ক্ষতটা সেরে গেলেও দাগটা এখনও কালচে হয়ে ফুটে আছে।

দরজার বেল বাজতেই বাথরুম থেকে রুনি বললো, দেখ তো, আপা এলো মনে হয়।

আব্বাস উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই রুনু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, এখন কেমন আছেন?

আসুন। জ্বরটা কমছে না! বলতে বলতে দরজা লাগিয়ে ফিরে আসে আব্বাস।

রুনু সোফায় বসে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে যন্ত্রপাতি বের করে বললো, শরীরে কি ব্যথা আছে? তারপর খানিকটা পাশে সরে এসে আব্বাসের কপালে হাত রাখলো।

আব্বাসের মনে হলো, এমন শীতল এক কর-স্পর্শের অপেক্ষায় সে প্রহর গুনছিলো। কিন্তু রুনি একবারও ছুঁয়ে দেখেনি।

তারপর থার্মোমিটার বের করে জ্বর মেপে বললো, জ্বর তো অনেক! রুনিটা করছে কি? গা-টা মুছিয়ে দিতে পারলো না?

আব্বাস বললো, ঘরে ছিলো না। এখনই মাত্র এসেছে।

রক্তচাপ মাপতে মাপতে রুনু আবার বলে, ঘরে তো ঠিক মতো চিকিৎসা পাবেন না! হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।

আব্বাসের মনে আবারও সে ভয়টা এসে জেঁকে বসে। সে হাসপাতালে থাকবে। রুনি কি তাকে হাসপাতালে দেখতে যাবে? নাকি কাল থেকে নিয়মিত অফিস শুরু করবে? যদিও রুনি অফিস যাওয়া শুরু করার দিনক্ষণ বলেনি। তবু আব্বাসের মনে হচ্ছিলো যে, কাল থেকেই সে অফিস শুরু করবে হয়তো। রতনের স্কুল থেকে ফেরা। খাওয়া গোসল। ঘুম। পড়া। সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যাবে।

রুনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে রুনুকে বললো, কেমন আছিস আপা? জ্বর দেখেছিস?

রুনুর মুখটা কেমন হয়ে গেল যেন। বললো, বলছিলাম, ঘরে তো তেমন সুবিধা হবে না। কোনো হাসপাতালে ভর্তি করে দিলে সুবিধা হতো।

হাসপাতালে কেন?

ওষুধ লিখে দাও। নিয়ে আসবো।

ওষুধ দিলেই তো হবে না। কিছু চেক আপও লাগবে। তোর জয়েনের তারিখটা পিছিয়ে দিতে পারিস না?

সব তো ফাইনাল হয়ে গেছে!

তাহলে চাকরিটা বাদ দে। আব্বাসের যখন এমন দেখার জন্য তো কাউকে লাগবে!

চাকরি বাদ দিতে পারবো না! এ সময় চাকরি মোটেই পাচ্ছে না মানুষ। আর আমি এত ভালো চাকরিটা ছেড়ে দেবো?

তারপর সে আবার বললো, তুই এতসব ভাবিস না। রেহানা খালার ব্যাপারে কথা হয়েছে। খালা এসে পড়লেই আর তেমন সমস্যা থাকবে না।

দু’বোনের কথাবার্তাই শুনছিলো আব্বাস। ভেতরে ভেতরে খুব খারাপ লাগছিলো। রুনির চাকরিটা বড় হয়ে গেল? একবার ইচ্ছে হলো বলে যে, আমার থেকে কি তোমার চাকরিটা বড় হয়ে গেল? কিন্তু তখনই আবার ভাবে, হয়তো রুনি বলে বসবে, আমার তেমন কিছু হলে কি তুমি তোমার চাকরিটা ছেড়ে আমার পাশে থাকতে? যদিও একজনের আয়েই সংসার চলছে। তবু রুনি এমন কথাই বলে বসতে পারে। অতটা তলিয়ে দেখবে না।

আব্বাস বললো, তেমন খারাপ হলে, হাসপাতালেই ব্যবস্থা করে দেন। এ বয়সে অতটা ঝুঁকি নেয়া চলে না।

আচ্ছা। আমি যেখানেই পারি একটা ব্যবস্থা করে জানাবো।

তারপর রুনু ব্যাগ যন্ত্রপাতি গুছিয়ে বললো, এখন আসি!

রুনি বললো, একবারে খেয়ে যা না!

অতটা দেরি করতে পারবো না। বিকেলে আবার আসবো। আর এই ওষুধগুলো রাখ। হালকা কিছু খাইয়ে দু’টো পাতা থেকেই একটা করে খাইয়ে দিস। বলে, ছোট টেবিলটার উপর ট্যাবলেটগুলো রেখে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

রুনু বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুনি এসে বললো, আচ্ছা তোমার কি এমন হলো যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে? রুনু আপা ডাক্তার বলেই তোমাকে ও কথা বলছে। তার হাসপাতালে ভর্তি হলে তো তারই লাভ! কত টাকার বিল আসবে ভাবতে পারো?

কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না আব্বাসের। সে আবার সোফায় শুয়ে পড়ে।

রুনি বললো, শুয়ে পড়লে যে!

ভালো লাগছে না!

তখনই রতন ঘুম থেকে উঠে এসে বললো, আম্মু ভাত দাও!

গোসল করে আয়। আমি ভাত বসাচ্ছি।

তারপরই গজরাতে গজরাতে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে রুনি বলতে লাগলো, একটা দিন একটু বের হয়েছি আর অমনিই সব তালগোল পাকিয়ে বসে আছে! আমি কি বাপ-বেটা দু’জনের বাঁদি? আমাকে ছাড়া কারো একদণ্ড চলে না!

আব্বাস ফের উঠে বিছানায় গিয়ে শোয়।

রতন ফিরে এসে কপালে হাত দিয়ে বললো, বাবা, তোমার অনেক জ্বর দেখছি! ওষুধ খাবে?

ও ঘরে ছোট টেবিলটার উপর ওষুধ আছে। নিয়ে আয়।

রতন গিয়ে ওষুধ আনার সময় গ্লাসে করে পানিও নিয়ে আসে।

তখনই রুনি এসে বলে, কিছু একটা খেয়ে নাও।

কি খাবো?

দিচ্ছি। বলে, রুনি গিয়ে একটি বাটিতে করে দু’টো বিস্কিট নিয়ে আসে।

তারপর বাড়িয়ে ধরে বললো, এগুলো খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়।

আব্বাস বিস্কুট খেতে পছন্দ করে না। তবু এক কামড় খেয়ে ট্যাবলেট দু’টো পানি দিয়ে গিলে শুয়ে পড়ে।

রতন তার গায়ের উপর কাঁথা টেনে দিয়ে বলে, মাথা টিপে দেই বাবা?

এত কষ্টের ভেতরও আব্বাসের হাসি পায়। মন ভালো হয়ে যায়।

তারপর ছেলেকে আদর করে বলে, না বাবা! তুই গোসল করে খেয়ে স্কুলের লেখাগুলো সেরে ফেল। যা!

রতন চলে গেলে আব্বাস চোখ বোঁজে। এমন অবস্থায় কি ঘুম আসে। ছোটবেলা বা ছাত্রজীবনে এমন জ্বর হলে তার গান গাইতে ইচ্ছে হতো। কখনো নিজের অজান্তেই গান গাইতে আরম্ভ করলে মা মাথায় পানি ঢালতে আরম্ভ করতেন। এখন অবশ্য মাথাটা ধু’তে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু উঠে যে যাবে সে ইচ্ছেটাই হচ্ছে না। আস্তে আস্তে শীত বোধ বাড়ে। শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। সে ঠির-ঠির করে কাঁপতে থাকে। দাঁতে দাঁত বাড়ি লেগে ঠকঠক করে শব্দ হয়।

হাসপাতালের বেডে নিজকে শুয়ে থাকতে দেখে তেমন একটা বিচলিত হয় না আব্বাস। তবে একটু আশ্চর্য হচ্ছে এই ভেবে যে, ওকে কে হাসপাতালে নিয়ে এলো? রুনি, রতন এরা কি সঙ্গে এসেছিলো? অবশ্য রুনি আর রতন তো থাকতেই পারে। আপন জন বলতে তো তার এ দু’জনই। সে চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। বউ ছেলে কাউকে যদি দেখা যায়। না। বাড়তি কেউ চোখে পড়ে না। আশপাশে আরো কয়েকটা বেডে বিভিন্ন রোগী শুয়ে আছে। কেউবা ঘুমুচ্ছে। কেউবা বই পড়ছে। যে বই পড়ছে তার দিকেই মনোযোগটা বেশি পড়ে আব্বাসের। রোগশয্যায়ও যে বই যোগাতে ভোলে না, তাহলে বুঝতে হবে তার মনের ভেতর হাজারো কষ্ট বাসা বেঁধে আছে।

তখনই বারান্দা থেকে ভেতরের দিকে আসতে দেখা যায় রুনিকে। রতন আগে আগে দৌঁড়ে কাছে চলে এসেই একটি হাত ধরে বলে, বাবা, বাসায় যাবে কখন?

কেন রে? তোর কি বেশি খারাপ লাগছে?

হুম!

রুনি এগিয়ে এলেও তার মুখটা কেমন ভারী মনে হয়। কিন্তু কপালের দু’পাশে চুলগুলো কেমন মনে হয়। কেটেছে হয়তো। পিঠের কাছে ঘাড়ের দিকেও দেখা গেল কোমরের উপর থেকে কেটে ছেঁটে কাঁধের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তাহলে কি নিজকে আস্তে ধীরে তৈরি করছে রুনি? গৃহবধূর খোলস থেকে বের হয়ে আসছে? এক সময় কি কাঁধের নিচ থেকে চুলগুলো কানের নিচ পর্যন্ত উঠে আসবে?

রুনি এসে একটি টুল টেনে বসতেই আব্বাস বললো, কেমন আছ?

রুনি অভিমানাহত কণ্ঠে বলে, কেমন থাকবো?

কেন? ভালো নেই?

আব্বাসের মুখে ম্লান হাসি ফুটে ওঠে।

ভালো থাকতে দিলে আর কই?

কি করেছি আমি?

মরতে মরতে তো বেঁচে গেছ। একটা সপ্তাহ কী যে ধকল গেল!

এক সপ্তাহ? বলে, রুনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আব্বাস।

তারপর বলে, কিছুই তো বলতে পারছি না! মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই ঘুমটা ভাঙলো।

যার অসুখ সে যদি বুঝতেই পারতো, তাহলে তো কথাই ছিলো না।

কি বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না।

থাক অত বুঝে কাজ নেই।

রুনি এমনই। সব কিছুতেই যেন তার আপত্তি। তাহলে সপ্তাহটা তোমার কেমন কাটলো? অফিস করতে পারছিলে? কথাগুলো  জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায় আব্বাস। বলে, আপা কোথায়? কথা হয়েছে?

হয়েছে।

কি বললো? কবে ছাড়া পাবো?

তোমার তো বেরুতে বেরুতে আরো দিন দশেক লাগবে।

কেন। মনে তো হচ্ছে জ্বর-টর নেই। মোটামুটি ফ্রেশ লাগছে।

ঘা শুকাতে আরো সময় লাগবে।

কিসের ঘা? অবাক হয়ে যায় আব্বাস।

তুমি কি টের পাও না? বলেই কেমন করে হেসে উঠলো রুনি। তারপর আব্বাসের একটি হাত নিয়ে পেটের উপর ব্যান্ডেজে রাখতেই আব্বাস চমকে ওঠে। মাথা উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করতেই পেটের ভেতর টান পড়ে। কিছুটা ব্যথাও যেন পায়।

রতন বললো, বাবা, তোমার পেটের ভেতর থেকে না মার্বেলের সমান একটি পাথর বেরিয়েছে।

পেটের ভেতর? বলেই সে রুনির দিকে দৃষ্টি ফেরায়।

পেটে না। গল-ব্লাডারে।

আব্বাস আর কিছু ভাবতে পারে না। এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেল সে কিছুই জানতে পারলো না?

রুনি বললো, তোমার চেক-বইটা নিয়ে এসেছি। ঘরে যে টাকাগুলো ছিলো এ ক’দিনে সবই শেষ হয়ে গেছে। আর তোমার বাবদ কিছু টাকা এখানে দিতে হবে।

অ্যাকাউন্টে খুব বেশি টাকা আছে বলে মনে হয় না। তবু টেনেটুনে লাখ দেড়েকের মতো হয়ে যাবে। শেষ কবে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছিলো? হ্যাঁ, দেবযানীকে যখন ভারতে নিয়ে যায়, তখন ধার হিসেবে বুদ্ধদেবকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিলো। কিন্তু মাস সাতেক পেরিয়ে গেলেও বুদ্ধদেবের কোনো খবর পায়নি আব্বাস। যে কারণে দেবযানী বেঁচে আছে না মরে গেছে, নাকি এখনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছে জানা হয়নি।

রুনি বললো, অত ভাবছো কি? টাকা না থাকলে রুনুর কাছ থেকে নিয়ে চালিয়ে নেবো!

না। কিছু টাকা আছে। কত তুলতে হবে?

হাজার চল্লিশেক পারবে না? এ থেকে আলাদা পাঁচ হাজার টাকা আমার লাগবে! কেন, জিজ্ঞেস করতে পারবে না কিন্তু!

হাত বাড়ালে রুনি চেক বইটা আর একটি খোলা কলম এগিয়ে দিলে আব্বাস পাতা উল্টে দেখতে পায় রুনি টাকার অংক চল্লিশ হাজার অংকে আর কথায় লিখে নিয়ে এসেছে। এখন আব্বাসের কাজ শুধু সই করা। উপর নিচ দু’দিকেই সই করে দেয় সে।

তারপর কলম আর চেক বই ফিরিয়ে দিয়ে বলে, সমস্যা হলে ম্যানেজারকে বলবে আমার সঙ্গে কথা বলতে।

চেক-বই, কলম ব্যাগে ঢুকিয়ে রুনি উঠে রতনকে বললো, চলো বাবা!

আব্বাস বললো, আর কিছুক্ষণ বসে যাও না!

দেরি করা যাবে না! কাল থেকে ওর পরীক্ষা আরম্ভ হচ্ছে!

রুনি বেরিয়ে যেতেই আব্বাসের কাছে মনে হলো, রুনি যেন কেবল টাকাটার জন্যেই এসেছে। এর বেশি আর কিছু না। এই যে এতটা দিন ধরে সে তার বউ-ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে না, ছুঁতে পারছে না, তাতে যেন রুনির কিছুই যায় আসে না। অথচ আব্বাসের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো রুনিকে ছুঁয়ে থাকতে। বিয়ের পরপরই আব্বাসের একবার মনে হয়েছিলো যে, রুনিকে বিয়ে করে কি সে ভুল করলো? তখন মনে হতো বিয়ে করতে হবে বলে সে আব্বাসকে বিয়ে করেছে। আর ঠিক যতটুকু প্রয়োজনে কাছে আসা, ততটুকুই। এর বেশি একটি মুহূর্তও নয়। এ কেমন জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছে আব্বাস? এ কেমন দাম্পত্য? এতে কি ভালোবাসা আছে? তা তো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ন্যূনতম যতটুকু ভালোবাসা না দিলে স্বামী হিসেবে আব্বাস মূল্যায়িত হবে না, ঠিক ততটুকুই যেন। দাম্পত্য কি দাঁড়ি পাল্লার ওজনে হিসেব কষে কাটাতে হবে?

সন্ধ্যার পরপরই একজন বয়স্ক পুরুষ ডাক্তারের সঙ্গে রুনুও এলো। ডাক্তার ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি। কাছে এসে রিপোর্টগুলো দেখে পেটের উপর হাত দিয়ে কিছুটা চেপেচুপে বললেন, একটু উঠে হাঁটাহাঁটি করেন না কেন? নড়াচড়ার মধ্যে থাকলে ভালো হয়ে উঠবেন তাড়াতাড়ি। একটু হাঁটাচলা করবেন! এ ক’দিন তো দেখলাম কেবলই ঘুমিয়েছেন। অত ঘুমাবেন না!

তারপরই আরেক বেডে চলে গেলে, রুনু বললো, আজ আমার ডিউটি আছে। পরে আসবো।

ডাক্তার রোগী দেখে চলে যাওয়ার পর। দু’জন নার্স এলো তার বিছানা আর কাপড় পাল্টাতে।

একজন এক সেট সবুজ পোশাক দিয়ে বললো, বাথরুম থেকে পাল্টে আসেন। ততক্ষণে বিছানাটা পাল্টে দিচ্ছি।

উঠতে নিলেই তো ব্যথা পাচ্ছি!

প্রথম একটু ব্যথা হবে। দাঁড়িয়ে পড়লে আর থাকবে না।

দেখি, উঠতে চেষ্টা করেন! বলে, দু’দিক থেকে দু’জন তাকে ধরে তুলে দিলো।

তারপর বললো, এবার নামেন!

আব্বাস ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই নার্স দু’জন একই সঙ্গে হেসে উঠলো। একজন বললো, আপনি এত ভীতু না!

বাথরুম কোন দিকে?

একজন দরজা দেখিয়ে দিলে আব্বাস ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাপড় পাল্টায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেটের উপর আড়াআড়ি ব্যান্ডেজটা দেখে। একহাতে চাপ দিয়ে দেখে ব্যথা করছে কি না। বেশি চাপ দিলে সামান্য ব্যথা করছে। তাহলে এক সপ্তাহ তার কাটলো কি করে? রুনির অনুভূতি কেমন হয়েছিলো? রতন কি ভয় পেয়েছিলো?

আব্বাস পুরোনো কাপড়গুলো কি করবে ভেবে না পেয়ে সেগুলো বাথরুমেই হ্যাঙ্গারের উপর রেখে বেরিয়ে এলো। নার্স দু’জন তাদের কাজ সেরে চলে গেছে হয়তো। পরিপাটি বিছানায় উঠে বসতেই কেমন একটা আরাম বোধ হলো তার। খাটের পাশে ছোট স্টিলের কেবিনেটের দরজা খুলে দেখলো বাড়তি কিছুই নেই। অথচ প্রতিদিন বিকেলে দেখা যায় অন্যান্য রোগীদের আত্মীয় পরিজন এসে চার দিকে গোল হয়ে বসে। এ এটা নিয়ে আসে ও ওটা নিয়ে আসে। অথচ হাসপাতাল থেকে তিন বেলা যা খেতে দিচ্ছে তার বেশি কিছুই পাচ্ছে না আব্বাস। কেন? তার বেলা কি বাড়তি কিছুর প্রয়োজন নেই? নাকি রুনির কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই?

সে বিছানা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বারান্দার দিকে যায়। পাকা মেঝের উপর বেশ কিছু নারী পুরুষ ঘুমিয়ে আছে। এমন দৃশ্য রাতের ফুটপাতে আর স্টেশনে অনেক দেখা যায়।

আরেক পাশে দু’জন হয়তো মাতা-কন্যাই হবে, বসে বসে চা খাচ্ছে আর নিচু স্বরে কথা বলছে। সামনে একটি ফ্লাক্স রয়েছে। হয়তো ফ্লাক্স ভরে ঘর থেকে নয়তো দোকান থেকে চা নিয়ে এসেছে। বিকেলের দিকে ট্রলিতে করে যখন চা নিয়ে আসে, তখন সে না করে দেয়। কিন্তু এখন খুবই ইচ্ছে হচ্ছিলো এক কাপ চা খেতে। এখন কি হাসপাতালে চা পাওয়া যাবে?

আব্বাস তাদের দিকে ফিরে তাকাতেই মেয়েটি একটি কাপে চা ঢেলে নিয়ে এলো। বললো, চা নিন।

আব্বাস কাপটি হাতে নিয়ে বললো, আমার তো চায়ের অভ্যাস নেই। কিন্তু আপনি যখন নিয়ে এসেছেন অবশ্যই খাবো। সত্যি কথা বলতে কি আপনাদের দেখে আমার কিন্তু চা খেতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছিলো।

আপনার শরীর এখন কেমন?

ভালো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো আব্বাস।

ভাবিটা খুবই ভালো। এ ক’দিন আপনার জন্য যা করলো! আমরা কেবল চেয়ে থেকেছি।

আমি তো কিছুই বলতে পারবো না।

পারবেন কিভাবে? ডাক্তার নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভাবি তো কেঁদে কেটে ডাক্তারকে শাসিয়ে বলেছে ভুল ওষুধ দিয়ে থাকলে প্রেস কনফারেন্স করে ডাক্তার আর হাসপাতালের বারোটা বাজিয়ে দেবে।

তাই?

ভেতরে ভেতরে আব্বাস চমকে ওঠে। রুনি তো এ ব্যাপারে তেমন কিছুই বলেনি। অবশ্য ও তো এমনই। কত কথাই বলতে ভুলে যায়। নয়তো বলার প্রয়োজন মনে করে না।

আপনার স্ত্রী ভাগ্য খুবই ভালো বলতে হবে। সারাদিন চাকরি করে হাসপাতালে এসে হাজবেন্ডের সেবা করা! আমি হলে মনে হয় পারতাম না! বলেই মেয়েটি হেসে উঠলো।

সঙ্গের মহিলাটি বলে উঠলো, ছি! এমন করে বলতে হয় নাকি?

মা, তুমি রাগ করছো কেন? আমি তো সত্যিটাই বললাম।

সব সত্যি সব সময় ভালো না।

তাহলে কি মিথ্যে বলতে হবে?

তা তো বলছি না!

তাহলে?

কোনো কোনো সত্যি সময়ে চেপে যেতে হয়।

আব্বাসের মনে হলো কথাটা খুব নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। প্রয়োজনে চেপে যেতে গিয়ে অসাবধানে বা অতি সাবধানতায় সত্যের অপমৃত্যুও হয়।

আপনারা কি রাতের বেলা এখানেই থেকে যান?

এতদিন থাকতে হয়নি। মা’টি বললো।

আব্বাস চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে যায়। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আজ থেকে গেলাম রক্তের জন্য। রাত একটায় রোগীর অপারেশন।

রোগী কে হয় আপনাদের?

কেউ না। তবে, পড়শি বলতে পারেন। সুমির বন্ধু। একই ক্লাসের।

মেয়েটি বলে উঠলো, জানেন, হঠাৎ করেই পেট ব্যথা বলে ক্লাসে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো পিংকি। আমরা ওকে এখানে নিয়ে আসার পরই জানতে পারলাম ওর অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে হবে। রক্ত লাগতে পারে। পিংকির রক্ত এবি পজেটিভ। আমাদের মা মেয়েরও একই গ্রুপ। তাই মাকে আজ আটকেছি!

গ্রুপ এক হলেও অনেক সময় কাজ হয় না। ম্যাচ করে না। রুনির আর আমার ব্লাড গ্রুপ এক হলেও কেউ কাউকে রক্ত দিতে পারি না।

ভাবিকে রক্ত দিতে হয়েছিলো কেন?

রতন জন্মের সময় অপারেশন করতে হয়েছিলো। তখনই কথাটা জানতে পেরেছিলাম। রক্ত ম্যাচ করেনি। বাইরে থেকে আনাতে হয়েছিলো।

চা খাওয়া হয়ে গেলে আব্বাস কাপটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, পিংকিকে কি দেখতে পারবো?

এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকা আপনার জন্য ঠিক হবে না।

আব্বাস বললো, আজই আমার ঘুম ভাঙলো। এখন দু’চারদিন ঘুম হয় কি না বলতে পারি না। জানেন, আমাকে কখন বাসা থেকে এখানে আনলো কখন অপারেশন হলো কিছুই টের পাইনি। রুনি আজ বলার পরই বুঝতে পেরেছি।

অপারেশনের পরও কয়েকদিন অনেক ঘুম পায়।

কি জানি! ছাত্র জীবনে একবার পরীক্ষা করতে পাঁচটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। একটানা দু’দিন ঘুমিয়েছি। তারপর  ঘুম ভাঙলে পরপর তিনদিন ঘুমোতে পারিনি।

আশ্চর্য তো! পরীক্ষা করতে কেউ বিষ খাবে? মা’টি যেন রেগে উঠলো।

আব্বাস বললো, হ্যাঁ তাই! একবার ইঁদুর মারার ওষুধও খেয়েছিলাম।

সর্বনাশ! আপনি দেখছি খুবই ভয়ঙ্কর মানুষ! বলে, অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সুমি।

হতে পারে। বলে হাসতে থাকে আব্বাস।

আপনাকে কেউ শাসন করার ছিলো না?

ছিলো অনেকেই। শাসনও করেছে অনেকেই। শাসনের অনেক চিহ্ন এখনও শরীরে আছে। এখনও অনেকেই সুযোগ পেলে শাসায়।

সুমি কেমন চুপ হয়ে যায়। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে হয়তো।

মা’টি উঠে বললো, কোথাও যাস না যেন। আমি আসছি!

আব্বাস বললো, আপনি হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন কেন?

সুমি সে কথার জবাব না দিয়ে বললো, আমার বয়স কত বলে আপনার মনে হয়?

আব্বাস কিছুক্ষণ সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, খুব বেশি হলে বিশ বছর কম একচল্লিশ!

তাই আপনি আপনি করে বলছেন?

একজন ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ করেই তুই বা তুমি বলা কঠিন। আর আমি তেমন একটা তুই তুমি বলতে পারি না।

এমনিতে আপনি কি করেন? ব্যবসা না চাকরি?

চাকরি করি! ছা পোষা!

ভাবি খুবই ভালো মেয়ে!

অনেক সময় একটি ডিম বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না সেটা সেদ্ধ না কাঁচা নাকি পচা!

হঠাৎ সুমি আবার গম্ভীর হয়ে গেল।

আব্বাস বললো, কাউকে বাইরে থেকে দেখে বিচার করা ঠিক নয়। এই যেমন আপনার মনে হলো আমি খুবই খারাপ মানুষ!

সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রতিবাদ করে বললো, আমি কি তাই বলেছি?

একজনকে ভালো বলার অর্থই হচ্ছে অন্যজন তুলনামূলক ভাবে খারাপ!

সুমি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, আপনি তো কথা নিয়ে খুবই প্যাঁচান!

তখনই মা’টি ফিরে এসে বললো, তোরা ঝগড়া আরম্ভ করলি নাকি?

তাহলে গিয়ে শুয়ে পড়ি। বলে, আব্বাস উঠে পড়তেই সুমি তার একটি হাত ধরে বললো, রাগ করলেন?

আব্বাস হেসে বললো, কথা যখন প্যাঁচাই তাহলে গিয়ে শুয়ে থাকাই ভালো।

প্লিজ! আর কিছুক্ষণ বসেন না! বলেই আব্বাসের হাতটি ছেড়ে দেয় সুমি।

তাহলে আরেক কাপ চা দিতে হবে।

দিচ্ছি! বলেই সে ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢেলে দেয়।

আব্বাস আবার বসে পড়ে কাপ হাতে নিয়ে বললো, আমার কিন্তু কথা বলতে ভালোই লাগছে। তাই কথা যাতে একটু দীর্ঘ হয় সে জন্যেই কিছুটা প্যাঁচাচ্ছিলাম!

আস্তে আস্তে সময় গড়ায়। সেদিন রাত একটা পর্যন্ত জেগে থেকে আব্বাস সুমি আর তার মায়ের সঙ্গে পিংকির অপারেশন দেখে। নিজের অপারেশনের সিডিও নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে সে। গল-ব্লাডার থেকে পাথরটা কিভাবে বের করলো, কাটাকুটির ব্যাপারটাও দেখা দরকার।

কিন্তু রুনির কারণে তা আর হলো না। এসব নিষ্ঠুর ব্যাপার দেখার কোনো মানে হয় না।

আব্বাস রুনির সঙ্গে তর্কে যায় না। মনে মনে সে রুনির উপর অনেকটা কৃতজ্ঞ। যেহেতু সুমি আর তার মা রুনির অনেক প্রশংসা করলো। তাদের দৃষ্টি থেকে হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু সে নিজে ব্যাপারটা নিয়ে অতটা না ভাবলেও চলতো। ভাবার প্রয়োজনও হতো না। ভাবতে বাধ্য করলো রুনিই। ক্লিনিক থেকে ফেরার পর আব্বাস রুনির গায়ে হাত রাখতে পারছে না। রুনি হাত সরিয়ে দিয়ে বলছে, বিরক্ত করো না তো! ঘুমাও। আমার অনেক খারাপ লাগছে!

আব্বাস যেন সঙ্গে সঙ্গেই পাথর হয়ে যায়। চুপচাপ শুয়ে থাকে। প্রতীক্ষায় থাকে রুনি তার দিকে পাশ ফিরে কখন শোবে। গলাটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আগের মতো বলে উঠবে, অনেকদিন তুমি আমাকে পাত্তা দাওনি কিন্তু!

না। রাতের রুনি যেন অন্য এক রুনি। সকালের রুনির সঙ্গে কিছুতেই মেলে না।

অথচ আগের মতো রুনি ঘরের কাজ করছে না। যা করার তার খালাই করছে। সকালে অফিসে যায় ফিরে আসে পাঁচটার আগেই। আব্বাসের মতো রাত ন’টা দশটা পার হয়ে যায় না। তবু যদি রুনির খারাপ লাগে তাহলে তাকে বিরক্ত করাটা নিশ্চয়ই মানবিক কোনো আচরণ হবে না। যদিও সে জোর করে তার প্রাপ্য বুঝে নিয়ে নিদ্রায় মগ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এমন একটি ব্যাপার সে ইচ্ছে করলেই ঘটাতে পারে না। এমন ইচ্ছে মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকলেই আয়নায় নিজের চেহারাটাকে কেমন জন্তুর মতো মনে হয়। নিজকে জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে, অনেকখানি মনুষ্যত্ব আর বিবেকের শ্যামল আঙিনা দলে আসতে হবে। আব্বাস তা কিছুতেই পেরে ওঠে না।

ক্লিনিক থেকে সে ফিরেছে পনের দিন পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে অফিস থেকে একদিন ফোন করলো মোস্তফা। জানালো একটি প্রোগ্রাম নিয়ে আটকে গেছে। কম্পাইল হচ্ছে না। সম্ভব হলে যেন সে অফিসে আসে।

পরদিন থেকেই সে নিয়মিত অফিস করতে থাকে। হঠাতই একদিন একটি হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবের কাছ মুখ চেনা সেই মহিলা হাতছানি দিয়ে ডাকলে সে এগিয়ে যায়।

সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কেন?। প্রায়ই তাকে দেখে। একদিন নিজে না বসে বাসের সিটে তাকে বসতে দিয়েছিলো।

মহিলা বললো, কোথায় ছিলেন এতদিন? গাড়িতে আসুন। আপনাকে নামিয়ে দেবো।

আজ কিছুটা দেরি হয়ে যাওয়াতে বাসে ভিড়ও বেড়ে গেছে। তাই আরামে যাওয়ার সুবিধা পেয়ে আব্বাস বললো, পার্টনারশিপ হলে ভালোই হবে।

সে বিপরীত প্রান্তের দরজা খুলে সামনের দিকে বসতে গেলে মহিলা হাহা করে বলে উঠলো, আরে এদিকে আসেন!

আব্বাস বিব্রত ভাবে মহিলার পাশে দরজার কাছ ঘেঁষে বসে।

গাড়ি চলতে থাকলে মহিলা বললো, এতদিন দেখলাম না যে? শরীর ভালো ছিলো তো? অনেক শুকিয়ে গেছেন দেখছি!

ক্লিনিকে ছিলাম।

দেখেই অনুমান করেছিলাম।

আব্বাস হাসিমুখে তাকায় মহিলার দিকে। বলে, কি অনুমান করেছিলেন?

আপনি ভালো নেই!

আব্বাস আবার বললো, আপনি ভালো আছেন?

ভালো থাকতে চেষ্টা করছি।

কি রকম?

এখন বলা যাবে না।

কবে বলবেন বলুন। আমার জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

তখনই ভদ্র মহিলার মুখটা কেমন ম্লান হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সে আবার বললো, জানেন, ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তাম, তখন আমার একটা খুবই ভালো বন্ধু ছিলো, সেও ছিলো ঠিক এমনিই। কিছু একটা সামান্য বললেই বলে উঠতো, বলো তো ব্যাপারটা! আমার জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

আব্বাস বললো, বন্ধু ছিলো বলছেন। এখন কি বন্ধুত্ব নেই?

ঠিক বলতে পারছি না। আমার দিক থেকে সমস্যা নেই। কিন্তু বন্ধুটাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো যোগাযোগও নেই।

কোথায় পড়ালেখা করেছেন। ঢাবিতে?

বুয়েটে।

ব্যাচ আর বন্ধুটার কথা যদি বলেন, তাহলে খুঁজতে চাইলে সাহায্য করতে পারি। আগে পরের অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। কিন্তু নিজের ব্যাচের কারো সঙ্গে দেখা হয় না।

আরে আমারও তো একই অবস্থা!

তখনই বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো আব্বাস। আমার রাস্তা চলে যাচ্ছে!

কথায় কথায় মহাখালী প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছিলো। তখনই আব্বাসের খেয়াল হয়।

ড্রাইভার একপাশে গাড়ি থামাতেই আব্বাস নেমে পড়ে বললো, আসি। ধন্যবাদ। আগামীকাল আবার দেখা হবে।

মহিলা উত্তরে হাত নাড়লো।

গাড়ি থেকে নেমেই আব্বাস প্রায় দৌঁড়ে রাস্তা পার হয়। একটি রিকশায় চড়ে বলে, রাফা টাওয়ার।

অফিসে পৌঁছুতেই কফিল সাহেবের সঙ্গে ঢুকবার মুখেই দেখা হয়ে গেল। সালাম দিতেই তিনি সালামের জবাব হিসেবে বললেন, কি চাকরি বাকরি করার ইচ্ছে নেই নাকি? এত দেরি করে অফিসে আসেন কেন?

গাড়িতে অনেক ভিড়। তাই বাসে উঠতেও দেরি হয়েছে।

আধঘণ্টা আগে বেরুলে কি হয়?

আমি এক ঘণ্টা আগে বের হই। তবু মাঝে মধ্যে এমন হয়ে যায়।

কফিল সাহেব কেমন বিশ্রী ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের জবাবগুলো সবসময় ঠোঁটের আগায় থাকে নাকি?

এ মুহূর্তে কফিল সাহেবকে কষে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে হয় আব্বাসের। ভাবে, হারামজাদা, তুই যেমন কর্মচারী আমিও তো কর্মচারী। মালিকের মতো কথাবার্তা তোর মুখ দিয়ে বের হয় কেমন করে?

কিন্তু অতিরিক্ত রাগের কারণে কোনো কথাই বলতে পারে না আব্বাস। লিফট দিয়ে উপরে এসে সেকশনে ঢুকতেই মোস্তফা সরব হয়ে উঠলো। আরে আব্বাস সাব থাকেন কই? আমরা খুবই বিপদে আছি। কফিল সা’বে তার পুরানাটারে মনে হয় বাদ দিয়া দিছে! নতুন আর ভালো মডেলের আরেকটারে নিবো শুনতাছি!

আব্বাস মোস্তফার সঙ্গে সুর মেলাতে পারে না। আবার উল্টো সুরেও কিছু বলতে পারে না। গতকাল লাঞ্চের পর বাইরে থেকে ঘুরে আসার সময় সিঁড়িতে দেখতে পেয়েছিলো তানজিলা কাঁদতে কাঁদতে নেমে যাচ্ছে। এমনটা সাধারণত অফিস-আদালতে দেখা যায় না। বিশেষ করে মহিলা কর্মচারী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাচ্ছে। আব্বাস বলেছিলো, আপা কি অসুস্থ? হেল্প লাগবে?

তানজিলা তেমনি ভাবে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে না করেছিলো।

মোস্তফা বললো, কি আব্বাস সাব, মন খারাপ নাকি? এখন কিছুটা ঘনঘনই মন খারাপ হবে। আমি তো নিজেই ভুক্তভোগী। বউ যখন চাকরি করে, তখন নিজেরেই হাজবেন্ড ভাবতে চেষ্টা করে।

আপনার এমন সমস্যা হয় নাকি?

হয় না মানে?

লিলি আর পাপিয়া তখনই বলে, খুন্তি দিয়ে না বেলুন দিয়ে মারতে আসে?

মোস্তফা হাসতে হাসতে বলে, আরে পাকঘরে ঢুকলেই না খুন্তি বেলুন পাইবো। পারলে হাতে পায়েই মারে!

আব্বাস পাপিয়া আর লিলির দিকে তাকিয়ে বললো, আপনারাও তো চাকরি করেন। মোস্তফা সায়েবের কথা কি বোঝেন?

উনি কিছুটা বাড়তিও বলেন মনে হয়। বউরা এতটা হয় বলে মনে হয় না।

আব্বাস ভাবে, তাহলে কেমন হয়? আর কিছু না হোক ইচ্ছের দিক থেকে রুনি অনেক স্বাধীন হয়ে গেছে। এখন একই বিছানায় শুয়ে ঘুমালেও আব্বাস আজকাল বউয়ের কোলবালিশের মতোও হতে পারে না।

রতন একদিন বললো, বাবা, আম্মু জানি কেমন হয়ে গেছে! কথায় কথায় কেবলই ধমকায় আর বলে, ঘর থেকে চলে যাবে।

ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে আব্বাস বলে, সব মায়েরাই এমন কথা বলে। তাই বলে কি সবাই চলে যায়?

হ্যাঁ বাবা! প্রতিমার আম্মু নাকি একদিন ভোর বেলা চলে গেছে। এখনও ফিরে আসেনি!

কথা শুনে আব্বাসের বুকটা ভেঙে যেতে চায়। সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।

রাতের খাওয়ার পরপরই রুনি বাথরুমে ঢুকে বমি করে। কিছুক্ষণ বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। খেতে বসার আগেই অবশ্য সে বলেছিলো, খাবারের গন্ধটা কেমন বিশ্রী লাগছে। তখনই আব্বাসের মনে পড়ে রতন যখন পেটে আসে তখন কিন্তু রুনি কিছুই খেতে পারতো না। খেতে বসলেই তার বমি আসতো। নাক চেপে ধরতো। রুনির দিকে তাকিয়ে আব্বাসের মনে হয় সে নিজেই যেন কোনো এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। লক্ষণটা কি ভালো? ক্লিনিক থেকে ফিরে আসার পর একমাস পেরিয়ে গেলেও আব্বাস এখনও রুনির বুকে জায়গা পায়নি। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা?

আব্বাস তবু নিজকে শাসন করে। এতটা হীন ভাবনা মনে জায়গা দেওয়া উচিত নয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এমন দূরত্ব তৈরি হতেই পারে। তাই বলে স্ত্রী বাইরে থেকে গর্ভে ভ্রুণ নিয়ে আসবে? এ কি করে সম্ভব? রুনি কি এতটা নিচে নামবে? একদিন সেই তো বলেছিলো যে, চাকরি করতে গেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যায় না। সেই রুনি এমনটা করতে পারে না। কিন্তু পরদিনও একই ঘটনা ঘটে। আব্বাস বলেছিলো, রুনু আপাকে জানাচ্ছো না কেন? আমি কথা বলবো?

তোমার কিছু করতে হবে না। আমার সমস্যা আমাকেই বুঝতে দাও।

একবার চেক আপ করিয়ে নিলে ভালো হতো না? খারাপ কিছু হলে শুরুতেই ধরা পড়লে সাবধান হতে পারতে।

পরদিন অফিস থেকে ফিরে আব্বাস দেখতে পায় রুনি ঘুমুচ্ছে। এ সময় সে কখনোই ঘুমোয় না। বিয়ের এতগুলো বছর পার হলো। রাত এগারোটার আগে কখনোই রুনি শুয়ে পড়েনি। আর আজ কি এমন হলো যে, দশটার আগেই সে ঘুমে কাদা হয়ে আছে?

খালা! খালা!

বাবা! কিছু বলবেন?

রুনির কি হয়েছে? অসময়ে ঘুমুচ্ছে যে?

আজ তো অফিসে যায়নি। শরীরটা নাকি ভালো না। বিকেলের দিকে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে বের হলো। আর ফিরলো কোঁকাতে কোঁকাতে। তারপরই ওষুধ খেয়ে শুয়েছে!

আব্বাসের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, আমি কী এমন অপরাধ করেছিলাম? কেন আমাকে এত বড় আঘাত করলো রুনি? জীবনভর শুদ্ধ থাকার পুরষ্কার কি এভাবেই পেলাম? আলেনা একবার তাদের খালি ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো আব্বাসকে। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে আরম্ভ করেছিলো। কিন্তু নিজের শুদ্ধতায় কালিমা লাগিয়ে কলঙ্কিত করতে চায়নি সে। কষ্ট হলেও নিজকে বিরত রাখতে পেরেছিলো। আর প্রত্যাখ্যাত হয়ে তখন কেমন পাগলের মতো হেসে উঠেছিলো আলেনা। বলেছিলো, আব্বাস, চরিত্র নষ্ট হবে বলে আমাকে অপমান করলে? কৌমার্যের শুদ্ধতা? কোনোই মূল্য নেই! একদিন বুঝবে, কী ভুল করলে! তারপর দীর্ঘদিন নাকি মানসিক হাসপাতালে ছিলো সে।

আব্বাস কিছু না খেয়েই রতনের ঘরে এসে ঢুকলো। ছেলেটা এক মনে বসে বসে ছবি আঁকছে। একবার মনে হলো বলে যে, বাবা ছবি আঁকিস না। যারা ছবি আঁকতে ভালোবাসে, দুঃখ আর কষ্টও তাদের ভালোবাসে।

সে বিছানায় বসে বললো, আমি আজ তোর সঙ্গে ঘুমুবো।

সত্যি বাবা?

হ্যাঁ।

ছবি আঁকা বাদ দিয়ে আব্বাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রতন। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই আব্বাসের ভীষণ কান্না পায়। খুবই জোরে শব্দ করে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তাকে কাঁদতে দেখলে রতনের মন খারাপ হয়ে যাবে। কেন কাঁদছে জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে আব্বাস? প্রাণপণে সে কান্না দমন করতে চেষ্টা করেও পারে না। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। আর ছেলের দৃষ্টি থেকে তা আড়াল করতেই বলে ওঠে, এইরে, তোর চুল চোখে ঢুকে গেছে! পানি বেরোচ্ছে!

বলতে বলতে আব্বাস উঠে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। কল ছেড়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে আলেনার উদ্দেশ্যে বলে, সত্যিই আমি ভুল করেছি। এ শুধু ভুল নয়। তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছিলাম। আর তার ফল দেরিতে হলেও হাতে হাতে পেয়ে গেছি!

কিছুক্ষণ পর রতন বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, এতক্ষণ কি করছো বাবা? বেরিয়ে এসো!

আব্বাস বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে টাওয়েলে চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলে, দরজা ধাক্কাচ্ছিলি কেন?

খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!

টাওয়েল রেখে রতনের মাথায় হাত রাখে আব্বাস। বলে, চল!

বাস স্ট্যান্ডে আসতেই মহিলা এগিয়ে এসে হাতে মোবাইল নিয়ে বললো, আপনার নাম্বারটা বলেন। কাল অমন করে নেমে যেতে হলো, কিছুই বলতে পারলেন না!

নাম্বার কি দিতেই হবে? বলে হাসে আব্বাস।

না দিতে চাইলে অসুবিধা নেই। তবে সে ক্ষেত্রে আমারটা নিতে হবে।

আব্বাস নাম্বারটা বলতে বলতে সে নিজের ফোনে তা টুকে সেভ করে ফেললো। বললো, নাম জিজ্ঞেস করলাম না। তবে লাঞ্চের সময় ফোন করবো। আসতে বললে আসবেন তো?

আব্বাস কিছুক্ষণ মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে, চেহারাটা তো পরিচিত মনে হচ্ছে না। বুয়েটে যদি আমার ব্যাচেরই হয়, তাহলে? আলেনা বা নাজিয়া ছাড়া কারো সঙ্গে আমার তেমন বন্ধুত্ব হয়নি। কিন্তু ওদের মতো তো মনে হচ্ছে না। মানুষের চাহনি বদলায় না। কণ্ঠস্বর অনেক সময় পাল্টায়। রোদ চশমায় চোখ ঢাকা বলে ঠিক বুঝতে পারে না আব্বাস।

আসবো। লাঞ্চ কে করাবে? আপনি না আমি?

যেহেতু ডেকে আনবো আমি। অধিকারটা আমারই বেশি থাকার কথা!

বাস আসতেই ওরা তাড়াহুড়ো করে টিকেট নেয়। কিন্তু লাইনের পেছনে থাকার কারণে বাসে উঠবার সুযোগ পায় না। বাসে উঠবার লাইনে দাঁড়িয়ে তেমন একটা কথা বলার সুযোগ নেই। বলতে গেলে সবার মনোযোগই থাকে যারা কথা বলছে তাদের উপর। তাই দু’জনেই চুপচাপ থাকে।

যদিও আব্বাস আজ কিছুটা আগেই বেরিয়েছিলো। কিন্তু কথা বলার ফাঁকে লাইন থেকে দু’জনই কিছুটা সরে এসেছিলো বলে, পেছনের লোকজন সামনে এগিয়ে যাওয়াতে তারা লাইনের বাইরে পড়ে যায়। মিনিট দশেক পরই আরেকটি বাস এলো। এবার বাসে ওরা উঠতে পারলেও আব্বাস লোকজনের চাপে পেছনের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ফলে, কথা বলারও কোনো সুযোগ হয় না তাদের মধ্যে।

অফিসে আজ কিছু একটা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারলো না আব্বাস। সেকশনের কেউ বলতে পারছে না কিছু। নিচের দিকে অনেককেই দেখা গেল অস্থিরভাবে কারো জন্য অপেক্ষা করতে।

মোস্তফা আজ আসেনি। সে থাকলে অবশ্য কিছুটা হলেও জানা যেতো।

আব্বাস নিজের টেবিলে বসে, নতুন একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাতে যে কাজটা ছিলো, আপাতত সেটাকে স্থগিত রাখতে হয়েছে।

লিলি বললো, আব্বাস ভাই, আপনার ফোনে কি টাকা বেশি আছে?

না। তবে যদি ঘরে কথা বলতে চান। পারবেন। মিনিট পাঁচেক বলতে পারবেন।

আমার মেয়েটা কাল থেকে অসুস্থ। রাতের দিকে জ্বর এসেছে। আসার সময় ওর বাবাকে বলেছিলাম, অফিসে না যেতে।

আব্বাস ফোনটা এগিয়ে দিতেই লিলি তার ঘরের কারো সঙ্গে কথা বলে। মিনিট খানেক পরই ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, থ্যাঙ্ক্যু!

বাচ্চার কি অবস্থা?

কিছুটা ভালো। বাচ্চার বাবাও ঘরে আছে। লিলির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

এমন সময় পিওন বশির উদ্দিন এসে বললো, আপনারা সবাই মিটিং রুমে আসেন।

কেন?

বলতে পারি না। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিতে।

আস্তে ধীরে সবাই কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়ে উঠে পড়তে থাকে। আব্বাস মোবাইলটা তুলে সময় দেখে। মোটে দশটা। মিটিং কতক্ষণ চলে কে জানে!

মিটিং না বলে, আড্ডাবাজি বলাই ভালো। তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়। তবু ফাঁকে ফাঁকে কিছু কাজের কথা বলা হলো। নতুন একটি বায়ারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। তারা নতুন ধরনের কিছু কাজ করাতে চায়। মাঝখান দিয়ে অফিসটাকে এখান থেকে সরানোর কথাবার্তা শোনা গেলেও আজ জানা গেল যে, মাস দু’য়েকের মধ্যেই অফিস উত্তরার কাছাকাছি সরিয়ে নেয়া হবে।

ঘন্টাখানেকের ভেতর মিটিং শেষ হয়ে গেলে, যার যার মতো চা সিঙ্গারা-সমুসা খেতে খেতে সময়টাকে ঠেলে লাঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যাবার চেষ্টা। সময় পার করে দিয়ে আব্বাস সাড়ে বারোটার দিকে নিচে নেমে এলো। আর তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ও প্রান্ত থেকে বললো, কিছুটা আগেই করলাম। আপনি ওখানকার মনসুন মিনি চাইনিজটাতে চলে আসেন। ততক্ষণে আমিও পৌঁছে যাবো!

কথা শেষ হলে আব্বাস নাম্বারটাকে সেভ করে নিয়ে নাম দেয় বুয়েট। তারপর বেরিয়ে একটি রিকশা নিয়ে চলে আসে মনসুনে। আগেও এখানে এসেছে মোস্তফার সঙ্গে। একবার সে নিজেই সেকশনের সবাইকে এখানে একবেলা খাইয়েছিলো।

ভেতরে ঢুকে একটি টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো আবার।

কানে লাগাতেই শুনতে পায়, জানালার পাশে চলে আসেন।

আব্বাস মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। চোখাচোখি হতেই সে মাথা দোলায়।

তারপর উঠে গিয়ে মুখোমুখি বসেই আব্বাস বলে উঠলো, তারপর আলেনা রোজারিও কেমন আছো?

কথাটা শুনেই আলেনা ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো। চিনতে পারলেন? কিন্তু আমি এখনও ঠিক ধরতে পারছি না! কয়েকজনের সঙ্গেই মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এগজাক্ট পারছি না!

আমি কি এতটাই বদলে গেছি?

আলেনা অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো, হতে পারে! মাথার সামনের দিকে অনেকখানি চুল উঠে গিয়ে কপালটাকে চওড়া দেখাচ্ছে। একটু একটু করে চুলেও পাক ধরেছে।

আলেনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বললো, আমি আব্বাস!

ওহ আব্বাস! তোমাকেই আমি এ পর্যন্ত মনে মনে খুঁজে চলেছি। তো চিনলে কিভাবে হঠাৎ? এতদিন চিনতে পারলে না? নাকি জেনেও বলোনি?

তোমার চাহনি আর মাথা দোলানোটাই চিনিয়ে দিলো।

ওফ্। আব্বাস! বলো কি খাবে?

তার আগে বলো, আমার উপর তোমার রাগটা আছে কি না?

সঙ্গে সঙ্গেই আলেনা গম্ভীর হয়ে যায়।

তারপর আব্বাসের চোখে চোখ রেখে বলে, আছে!

আব্বাসেরও খুব খারাপ লাগে। আলেনার দিকে তাকাতে পারে না। মাথাটা যেন আপনিই ঝুঁকে আসে। আর সে অবস্থাতেই সে হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো, ক্ষমা করে দিতে পারলে দিও। আজকাল আমিও টের পাই। অনুভব করি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে সুখী হতে পারিনি!

পারবে না জানতাম! কিন্তু তুমি বুঝতে চাইলে না।

আমি খুবই দুঃখিত আলেনা ! খুবই অনুতপ্ত! এমনকি লজ্জিতও।

শুনে ভালো লাগলো। তাহলে ধরে নাও তোমার উপর আমার রাগটা এখন নেই। তবে অপমানের শোধটা কিন্তু নেবো।

আব্বাস খুবই কাতর হয়ে বললো, যা শাস্তি দাও, মাথা পেতে নেবো।

এতদিন পর কেন এমনটা মনে হলো? ছেলে-মেয়ে ক’টি?

একটিই। ছেলে।

তারপর আলেনা র দিকে তাকিয়ে আব্বাস তো তো করতে করতে বললো, তোমার?

আলেনা মেনু দেখতে দেখতে বললো, তাহলে আমার সঙ্গে কাল রাতের ট্রেনে চলো! চিটাগাং থেকে বাসে কক্সবাজার।

আব্বাস মনে মনে যেন হোঁচট খায়। এতদিন পর হঠাৎ পরিচয়ের পর এ কথা কি স্বাভাবিক? নাকি হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিলো? এর হেতু বুঝতে পারে না আব্বাস। শেষে থাকতে না পেরে বলেই ফেললো, সিদ্ধান্তটা কখন নিলে?

এখনই।

কেন? আর হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত কি ঠিক হলো?

আমরা তো পূর্ব পরিচিতই। মাঝখানের সময়টা বাদ দিলে অস্বাভাবিক কিছু না!

এমন সময় ওয়েটার এলে, আলেনা খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। হয়তো ওয়েটার চলে যাবার প্রতীক্ষা করে। লোকটা হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যেতেই আলেনা আবার বললো, তোমার কারণে আমি অনেকদিন মানসিক রোগী ছিলাম। আমার সে সময়গুলোকে কি ফিরিয়ে দিতে পারো আব্বাস? তুমি তো ঠিকই সংসারী হলে। ছেলের বাবাও হলে। হয়তো একজন ভালো স্বামীও। কিন্তু আমি কি পেলাম? তুমি তো জানতে চাইলে আমার ছেলে মেয়ে ক’টি? কিন্তু আমার কাছে এর কোনো জবাব নেই।

আব্বাসের মনটা ফের খারাপ হয়ে যায়।

ওয়েটার খাবার নিয়ে এলে আলেনা তাড়া দিয়ে বলে, নাও। শুরু করো।

তারপর আবার বললো, অফিস থেকে কটায় বেরোও?

ছ’টার দিকেই বেরিয়ে পড়ি। কখনো সখনো কাজের চাপ থাকলে আটটা, ন’টা, দশটাও বেজে যায়।

আলেনা খেতে খেতে বলে, আমি একটা এনজিওতে ঢুকেছি। টাকা-পয়সা ভালোই পাই। কিন্তু এত বড় শহরে একজনের জন্য অনেক! খরচ করে কুলোতে পারি না। ফ্লাট কিনেছি। মাকে আর বাবাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।

আব্বাস মুখের খাবারটা গিলে বললো, বিয়ে করোনি? নাকি করেছিলে?

আলেনা হাসে। বলে, তোমাকে বিয়ে করবো বলে, আর কাউকে বিয়ে করতে পারিনি।

মনে মনে যেন কিছুটা খুশি হয় আব্বাস। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো, এটা না বলে আমাকে একটা থাপ্পড় মারলেও পারতে!

ভেতরে গিয়ে লাগলো নাকি? কিন্তু যা সত্যি আমি তাই বলেছি!

আব্বাস কিছু বলতে পারে না। মনে মনে কথা হাতড়ালেও তার মনে আসে না কি বলবে।

আলেনা বললো, তোমার অফিসটা কোথায়?

এই তো মিনিট বিশেক লাগে। রাফা টাওয়ার।

আব্বাসের খেতে ভালো লাগছিলো না। আলেনাকে দেখে তার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও মনের ভেতর কোথাও যেন একটি সূক্ষ্ম অপরাধের কাঁটা খচখচ করে লাগছে।

খাওয়া শেষ করে আব্বাস সোডা লেমনেডের গ্লাসে চুমুক দেয়।

আলেনা মুখ মুছতে মুছতে একবার হাসলো। বললো, অনেকদিন পর আমার খুব ভালো লাগছে! জানো?

আব্বাস বললো, তোমার থুতনিতে একটা মোটামুটি বড় আঁচিল ছিলো না?

ফেলে দিয়েছি। ওতে চারটা দাড়ি ছিলো। প্রতিদিনই কাটতে হতো বলে বিরক্ত হয়ে গেছিলাম। চাকরিটাতে জয়েন করে প্রথম মাসের বেতন পেয়েই কাটিয়ে ফেললাম।

গালের দাগটা?

প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছি।

আব্বাস আর কিছু বলে না। আলেনার দিকে একবার তাকিয়ে আবার গ্লাসে চুমুক দেয়।

আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছি না? বলে, আবার ঝলমল করে হাসে আলেনা।

তা হয়েছো।

খাওয়া শেষে বেরিয়ে আলেনা বললো, কাল চলো আমার সঙ্গে!

আব্বাস বললো, দেখি! আসলে রুনির শরীরটা ভালো নেই।

দেখি না! একদিনে রুনি মরে যাবে না! আজই টিকেট করবো।

আব্বাস হ্যাঁ কিংবা না বলে না।

আলেনা বললো, কাল তোমার অফিস কটায় ছুটি? হাফ না?

মাথা নাড়ে আব্বাস।

তাহলে আজ গিয়েই ব্যাগ গোছাগাছ করে নেবে।

রুনিকে কি বলবো? রতন যদি বলে, তাকে কি মিথ্যে বলবো?

রুনি কিছু জিজ্ঞেস করবে বলে মনে হয় না। আর রতন জিজ্ঞেস করলে সত্যি কথাটাই বলবে। বন্ধুর সঙ্গে চিটাগাং যাচ্ছো।

আলেনার আহ্বানে কোনো রাখঢাক নেই। কিন্তু সেই বা কেমন করে সাড়া দেবে? রুনি না হয় নষ্ট হয়ে গেল। সেও কি প্রকারান্তরে নষ্ট হবে না? কী মূল্য থাকবে শুদ্ধতার? তখনই তার আরেক মন বলে ওঠে, রুনি সেই শুদ্ধতার মর্যাদা রাখেনি। নিজেও তার নৈতিকতার প্রাচীর ভূলুণ্ঠিত করেছে। যার জন্য সে নিজকে এতকাল তথাকথিত পবিত্র রেখে এসেছে, আদতে নিজকে যেমন কষ্ট দিচ্ছে তার আশপাশের মানুষগুলোরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন বস্তাপচা নৈতিকতা ধরে রাখতে দৃঢ় কল্প না হলে হয়তো আলেনার জীবন থেকে অতগুলো উজ্জ্বল আর বর্ণাঢ্য দিন হারিয়ে যেতো না। তাকেও এমনভাবে অপরাধী হয়ে কাল গুজরান করতে হতো না।

রুনি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও মনের দিক থেকে যে কষ্ট পাচ্ছে দেখলেই বোঝা যায়। তবু কিছু জিজ্ঞেস করেনি আব্বাস। নিজ থেকেও রুনি কিছু বলেনি। তবে ভেতরে ভেতরে যে নিজকে অপরাধী ভাবছে তা তার চোখে মুখেই ফুটে আছে। আব্বাসের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি।

ব্রিফকেসের ভেতর একটি সার্ট-প্যান্ট, তোয়ালে-লুঙ্গি-স্লিপার আর টুথব্রাশ-পেস্ট ঢুকিয়ে বন্ধ করতেই রুনি বললো, কোথাও যাবে নাকি?

চিটাগং।

রুনি আর কোনো প্রশ্ন করে না। তবে আব্বাস রতনকে নিয়ে যে ভয়টা পেয়েছিলো, রতন কোনো প্রশ্নই করলো না দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলো। রতন কেবল বলেছিলো, আমার জন্য একটা বড় শামুক এনো বাবা।

আব্বাস হঠাৎ করেই হেসে উঠে বলেছিলো, শামুক নাকি শামুকের খোল?

জীবন্ত শামুক হলে বালতির পানিতে রেখে পুষবো!

বুকের ভেতরকার বদ্ধ হাওয়াটা যেন নিমেষেই উবে গিয়েছিলো।

ব্রিফকেস হাতে অফিসে ঢুকতে দেখেই অনেকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছিলো আব্বাসের দিকে। কেউ প্রশ্ন করেনি। কিন্তু সেকশনে ঢুকতেই সবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো। এমন কি হাফিজ আর নাইমা, যারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ, তারাও প্রশ্ন না করে থাকতে পারলো না।

সবার প্রশ্নের একটিই জবাব হতে পারে। বলে, আব্বাস প্রতিটি কৌতূহলী মুখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে আনে। তারপর আবার বলে, একটা জরুরি কাজে চিটাগং যেতে হচ্ছে বলে একবারেই তৈরি হয়ে বেরিয়েছি।

মোস্তফা কানের কাছে মুখ এনে বললো, নাকি ভাবির সঙ্গে কিছু হলো?

হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আপনি কেন কাল আসেননি? তার মানে এই না যে, বউ আপনাকে মেরে বিছানায় শুইয়ে রেখেছিলো?

সত্যিই তাই! এই দেখেন, বলেই মোস্তফা পেটের কাছে সার্টটা উঁচিয়ে ধরে আবার বললো, এখানে বটি দিয়ে কোপ মেরেই দিয়েছিলো প্রায়। ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছি!

নাইমা হঠাৎ বলে উঠলো, এমন শয়তান বউ নিয়ে সংসার করছেন কেন?

মোস্তফা হেসে উঠলো, আরে শয়তান না তো! মাথার স্ক্রুগুলো একটু ঢিলা!

বুঝি না ভাই! সংসার কেমন করে করেন!

লিলি বললো, সংসার আগে পাতেন, তারপর বুঝবেন!

কি করে পাতবো? মাঝে মাঝে আপনাদের কাছ থেকে যা শুনি, তাতেই মনে হয় মানুষ হয়ে কেন জন্ম নিলাম!

পাপিয়া বললো, লিলি, তুমিও ভেবে দেখ যে, সংসারের অশান্তির মূলে কিন্তু মেয়েদের ভূমিকাও কম না! যদিও আমি একজন মেয়ে, তবু বলতে ভয় পাই না!

আব্বাস বললো, তবু কেন বুঝে শুনে মেয়েরা এমন করে?

ওই যে মোস্তফা ভাই বললো না যে, স্ক্রুগুলো একটু ঢিলা! আসলে বউদের মাথার স্ক্রুগুলো সত্যিই হয়তো কিছুটা ঢিলা। সমস্যা তৈরি করে পরে যখন বুঝতে পারে তখন হাতে পায়ে ধরে হোক বা কেঁদেকেটে আর ভয়ডর দেখিয়ে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নেয়।

আপনিও এমন করেন নাকি?

লিলি হেসে উঠলো। বললো, আমি আগেই বলে রেখেছি, যাই করি, বুঝে শুনে বা ইচ্ছে করে তো সমস্যা করি না!

আপনার হাজবেন্ড মেনে নিয়েছে?

মানুষটা খুবই ভালো আব্বাস ভাই! এ না হলে মনে হয় আমার প্রতি মাসেই একজন করে বদলাতে হতো! বলতে বলতে সে শব্দ করে হেসে উঠলো।

কাজে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলো না আব্বাস। সময়টা যেন আজ স্থির হয়ে আছে। কিছুতেই কাটছে না। সে উঠে অ্যাডমিনে এসে বললো, আমার একটা জরুরি কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে। ঘণ্টা খানেক পর বেরুতে হবে।

আপনার সেকশন হেড জানেন?

উনি তো আজ আসবেন না।

তাহলে অন্য কাউকে জানিয়ে চলে যান।

সেকশনে বলেছি।

তাহলে ঠিক আছে।

আব্বাস বেরিয়ে এসে ফের নিজের চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। আলেনাকে আসতে বললে কি আসবে না? কোনোভাবে ম্যানেজ করে বেরিয়ে পরতে পারবে?

বাইরে এসে আব্বাস আলেনাকে ফোন করলো। বেরুতে পারবে? এখন?

একটা মিটিঙে আছি। ঘন্টাখানেক লাগবে।

মিটিং সেরেই বেরিয়ে আমাকে ফোন দিও।

আচ্ছা।

লাইন কেটে যেতেই আব্বাস রুমে ফিরে আসে। আর তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। রুমটা বলতে গেলে বদ্ধ। একটি দরজা। জানালা নেই। বিদ্যুৎ চলে গেলে এয়ারকুলারও থেমে যায়। আর মুহূর্তেই রুমটা কেমন দমবন্ধ করার মতো হয়ে যায়। আব্বাস ব্রিফকেস হাতে উঠে পড়ে বললো, আমি যাই। অ্যাডমিনে বলে এসেছি।

অফিস থেকে বেরিয়ে আব্বাসের কিছু করার থাকে না। ঘন্টাখানেক পর যদি আলেনা তাকে ফোন দেয় তাহলে কিছুটা দম ফেলতে পারবে। কিন্তু এতটা সময় সে করবে কি? কোনো রেস্তোঁরায় বসে চা খেয়ে সময় কাটানো যায়। তা অবশ্য যায়। তবে স্টল থেকে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে একটি রেস্তোঁরায় ঢোকে। একটি শূন্য টেবিলে বসে, পাশে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে ব্রিফকেসটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে পত্রিকাটা মেলে ধরে।

প্রথম পাতায় হেডিং হয়েছে মতিঝিলে বলাকা ভাঙার খবর। মাঝ রাতে মোল্লারা সেটাকে ভেঙে ফেলতে জোট বেঁধে এসেছিলো। এও হুমকি দিয়েছে বিমান বন্দরের কাছে নির্মিয়মান লালনের মূর্তিও ভাঙবে। আস্তে আস্তে ঢাকা শহরের সব মূর্তিই ভাঙবে। আব্বাস অবাক হয়ে ভাবে, পথে ঘাটে মোল্লাগুলোকে দেখলেই মনে হয় একেকটা জড় প্রকৃতির। আর এরাই কিনা আন্দোলন করে। বোমা ফাটায়। মিছিল করে বাংলাকে আফগান বানানোর স্লোগান দেয় প্রকাশ্যে। দু’পাতা আরবি পড়ে কি যে ভাবে নিজেদের। অথচ নিজের মাতৃভাষাটাও ঠিক মতো লিখতে পারে না। শোনা যায় এরাই নাকি বোমা বানাচ্ছে। পরিকল্পনা করে  একই সময়ে সারাদেশে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নিজেদের সংঘবদ্ধতার জোরালো প্রমাণ দিচ্ছে। যে কোরআনকে এরাই বলছে আসমানি কিতাব, যার ভেতরের প্রতিটি অক্ষর নাকি আকাশের কোথাও লওহে মাহফুজ নামের কোনো জায়গায় রক্ষিত আছে, সে কোরআনের পাতা খোদাই করে ভেতরে পিস্তল রিভলভার লুকিয়ে রাখে। তারাই পাশ করে বেরিয়ে একেক জন ইসলামের রক্ষাকারী হয়ে যায়। নিজকে নায়েবে রসুল বলে ঘোষণা দেয়। আরে ইসলাম ইসলাম করে চিৎকার করলেই কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে? বোমা ফাটিয়ে মানুষ মেরে কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে? এখন তো মানুষের ভেতর এ বিশ্বাসের জন্ম হবে যে, মুসলমান মানেই খারাপ! মুখে বলে এক কথা, কাজে করে আরেক!

আব্বাসের মনে হয় যে, পৃথিবীর সব দেশেই মোল্লারা সংঘবদ্ধ। আর নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে পরকালের মুলো দেখিয়ে বিপথগামী করছে।

চা’টা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। আর চায়ে চুমুক দিতে দিতেই তার মনে পড়লো সুমির কথা। পিংকির কথা। সুমি তাকে ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলো মাঝে মধ্যে ফোন করতে। কিন্তু নানা ঝামেলায় আর তা হয়ে ওঠেনি। ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিতে দিতে আব্বাস সুমির নাম্বার বের করে রিং দেয়। ওপাশ থেকে সুমি বললো, এতদিন পর মনে পড়লো?

কেমন আছেন?

ভালো। আপনি?

পিংকি কেমন আছে?

ভালো। এই তো আমার পাশেই আছে। কথা বলেন।

আরেকটি কণ্ঠ বলে উঠলো, স্লামালেকুম? কেমন আছেন?

বেশি ভালো না। আপনি কেমন?

ভালো। আপনার কথা শুনেছি সুমির মুখে। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু আপনি ফোন করেননি বলে সুমি আপনাকে ফোন করেনি।

এই তো করলাম!

তাও তো একমাসেরও বেশি হয়ে গেছে।

এ জন্য আমি দুঃখিত। কত ঝামেলা টেনশনে থাকতে হয়!

আপনি একদিন দেখা করবেন না?

কোথায় করবো?

আপনি যেখানে বলবেন আমরা আসবো। আজ আসতে পারবেন?

আজ না আপু! চিটাগং যাচ্ছি। ফিরে এসে একদিন দেখা করবো।

কবে?

সেটা তো বলতে পারছি না। তবে, আপনারা ফোন করবেন। সুমিকে বলবেন। যোগাযোগ না থাকলে তো আপনাদের কথা ভুলে যাবো।

ঠিক আছে। সুমির সঙ্গে কথা বলেন।

সুমি ফোন নিয়ে বললো, ভাবি কেমন আছে? রতন?

রতন ভালো। তবে রুনির শরীরটা ভালো নেই।

কেন নেই? আপনার জন্যই হয়নি তো?

না। এ জন্য ও নিজেই  দায়ী। আচ্ছা রাখি। কেউ মনে হয় আমাকে কল করছে।

লাইন কাটতেই আলেনার ফোন আসে। কার সঙ্গে এত কথা বলছিলে?

আমার দু’টো আপু। ক্লিনিকে পরিচয়। তুমি বের হচ্ছো?

হ্যাঁ।

তাহলে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ো।

আমার তৈরি হওয়ার কিছু নেই।

ট্রেনে উঠবার আগে কিনে নিলেই হবে।

তাহলে চলে এসো।

তুমি মগবাজারে চলে এসো।

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?

কখনো তো কারো জন্যে এভাবে দাঁড়াতে হয়নি। আমার ভালোই লাগবে। তুমি এসো।

১০

বাঁধা-ধরা জীবন-যাপনের বাইরে বের হলে কখনো কখনো জীবনটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাওয়া যায়। নিজের প্রতিও তাকানোর অবসর মেলে। এই যে আব্বাস দীর্ঘ আটটি বছর একজন দায়িত্ববান স্বামী হিসেবে সংসার করে এসেছে, প্রতিদিন সকাল বেলা ঘর থেকে বের হওয়া, শ্রান্ত আর ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। দৈনন্দিন কিছু কথাবার্তার পর একটু উষ্ণতা। ব্যাস, একই আবর্তন প্রতিদিন। কিছুটা বেশি হলে রুনিতে সমর্পিত হওয়া। ব্যতিক্রম বলতে কোনো শুক্রবার বউ-ছেলে নিয়ে কোনো পার্কে নয়তো কোনো রেস্তোঁরায়। এতেই সীমাবদ্ধ বারোমাস। কিন্তু আলেনা অপেক্ষা করছে। আব্বাস সিএনজি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে এতেই যেন তার দেহমনের যাবতীয় বোধ কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। একটু লুকোচুরি থাকলে হয়তো কিছুটা অপরাধ বোধেও দংশিত হতো সে। কিন্তু এখন মনের ভেতর সে রকম কোনো বোধ কাজ করছে না। রুনিই যেন তাকে জোর করে ঠেলে দিয়েছে বাইরের দিকে। সে যেন বাইরে ঝাঁপ দিতে মুখিয়েই ছিলো। আর আলেনার একটু আহ্বান যেন তাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেললো অবাধ আনন্দের নাগরদোলায়।

সিএনজি বিদায় না করেই আব্বাস নেমে গিয়ে আলেনাকে বললো, টিকেট ফেরত দেয়া যায় না?

যায়।

তাহলে ওগুলো ফেরত দিয়ে বাসেই চলে যাই।

আলেনা বললো, ফেরত দিতে হবে কেন? তিনমাস তো সময় আছেই।

তাহলে উঠে পড়। কেনাকাটা কি করার আছে করে নাও।

আলেনা উঠে বসতে বসতে বললো, তেমন কিছু না। একটা থ্রিপিস। টাওয়েল, সাবান। টুথব্রাশ-পেস্ট নিলেই হবে।

টুথব্রাশ, সাবান আর থ্রি পিস নাও। আমার সঙ্গে টাওয়েল আছে। ব্যবহার করতে না চাইলে আরেকটা নিতে পারো। কোত্থেকে নেবে?

এখান থেকে নিয়ে নিলেও চলে। মার্কেটের তো আর অভাব নেই!

তাহলে সিনজি বিদায় করে দেই?

দাও।

সিএনজি বিদায় করে দিয়ে ওরা মার্কেটের ভেতর ঢুকে পড়ে।

কিনবো না করতে করতে করতেই অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। আব্বাসের হাতে ব্রিফকেস থাকলেও আরেক হাতে একটি শপিং ব্যাগ উঠলো। আলেনার দু’হাতে দু’টো।

কেউ দেখলে ভাববে মাত্র শপিং সেরেই যেন তারা ঘরে ফিরে যাবে। আলেনার সঙ্গে যে এতকাল পর দেখা বা অনেকদিন দেখেও চিনতে না পারা যেন তাদের কারো মনেই প্রভাব ফেলতে পারছিলো না। নাজিয়ার সঙ্গে যেমন ক্লাসে লাইব্রেরিতে অসংকোচে ঘোরাফেরা করতে পেরেছে আলেনার সঙ্গে কিন্তু অতটা না থাকলেও সম্পর্ক ভালোই ছিলো। আলেনা নাজিয়ার কারণে পাশে ভিড়তে পারতো না বলে ইলা দত্তের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছিলো। কিন্তু আব্বাসের কারণেই এত ভাল ছাত্রী হয়েও আলেনা পরে পাসকোর্স নিয়ে পড়েছে।

বাসে উঠবে কোত্থেকে?

এখানেই কোথাও আছে। মালিবাগে বা সায়েদাবাদ একখান থেকে উঠলেই হবে।

তাহলে এখান থেকেই উঠি। বলে আলেনা বললো, একটি রিকশা নাও।

রিকশায় করে ওরা বাস কাউন্টারে এলে, আলেনা বললো, একবারে কক্সবাজার নিয়ে নাও।

আব্বাস টিকেট কেটে জানতে চাইলো কতক্ষণ পর বাস ছাড়বে?

একটা পঁচিশে।

ওয়েটিং রুমে দু’জন যাত্রী আছে কেবল। ঘড়ি দেখে আলেনা বললো, চল্লিশ মিনিট সময় আছে। কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসো।

তারপর ফিসফিস করে বললো, তুমি এলে আমি টয়লেটে যাবো। হাতমুখ ধুয়ে পেটের ভার নামিয়ে আরাম করে বসা যাবে।

আব্বাস বাইরে গিয়ে শুকনো খাবার বলতে কিছুই পায় না। কেক বিস্কুট কলা পাউরুটি ফল আর জুস দিয়ে একটি ব্যাগ ভরে ফিরে আসে। আলেনা তার পাশে হাতের ব্যাগ দু’টো রেখে টয়লেটের দিকে যায়।

মিনিট বিশেক সময় নিয়ে ফিরে আসে আলেনা। বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছে। সে কি আব্বাসের সঙ্গ উপভোগ করছে? হয়তো বা। কারো কারো অবশ্য কাউকে পাওয়ার জেদ থাকলে অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও মনের ভেতর সে ক্ষোভ পুষে রাখে। আলেনাও হয়তো প্রথম দিককার প্রত্যাখ্যানের ক্ষোভ মনের ভেতর পুষে এসেছে এতকাল। আর তাই আব্বাসের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবদমিত সেই বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সে কারণেই বোধ করি তার মনে একবারের জন্যও উদয় হয়নি যে সে কারো স্বামী কিংবা কারো পিতা।

কিছুক্ষণ পরই একটি বাস এসে দাঁড়ালে কাউন্টার থেকে লোকটি বললো, বাসে উঠে পড়েন।

আগে আগে দু’জন যাত্রী উঠে গেলে আব্বাস আর আলেনা ওঠে। টিকেটের গায়ে লেখা সিটের নাম্বার মিলিয়ে সিট পেতেই আলেনা বললো, আমি জানালার দিকে বসি?

বসো।

বাসটা ছেড়ে দিতেই আলেনা বললো, কি কি আনলে?

আব্বাস ব্যাগটা এগিয়ে দিতেই ভেতরে উঁকি দিয়ে আলেনা হেসে উঠলো। এত খাবার ক’দিনে খাবে?

ওখানে যতদিন থাকি।

আলেনা কেমন করে যেন তাকায় আব্বাসের দিকে। এমন দৃষ্টিটা সহ্য করতে পারে না আব্বাস। রুনি কোনো অন্যায় করার পর যখন এভাবে তাকায় তখন সবই গণ্ডগোল হয়ে যায়। এখনও কেমন যেন হয়ে গেল আব্বাস। আলেনার গা ঘেঁষে বসে বললো, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে?

আব্বাসের গায়ের উপর হেলে পড়ে আলেনা বললো, তুমি নির্বোধ ছিলে বলে কিছুই বুঝতে পারোনি। নাজিয়াটাকেও বুঝতে পারলে না!

নাজিয়া হুট করেই সুইডেন চলে গেল। আগের দিন বললো, আমাকে এয়ারপোর্ট যেতে। আমাকে দেখেই কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। বলেছিলো গিয়ে চিঠি লিখবে। কিন্তু কোনো চিঠি পাইনি।

আলেনা আব্বাসের একটি হাত ধরে কোলের উপর নিয়ে বললো, আমি ঠিক করেছি ওখানে তিনদিন থাকবো। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।

আব্বাস কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলেনার মুখের দিকে।

আলেনা হাতটা ঝাঁকি দিয়ে বললো, বুঝতে পারছো না?

পারছি। কিন্তু আমি তো মাত্র দশহাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছি।

তোমার টাকায় হাত না ও পড়তে পারে! আমার কাছে আরো বেশি আছে।

বিভিন্ন জায়গায় থামতে থামতে বাসটা বলতে গেলে যাত্রী পূর্ণ হয়ে গেল। বাসের এসি চালু হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আলেনা ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর কাত হতে হতে আব্বাসের কাঁধে মাথাটাকে এলিয়ে দিলে আব্বাস আলেনার ঘুমন্ত মুখের দিকে ভালো করে তাকায়। মুখটা সুন্দর হলেও কোথাও যেন একটি বিশাল রকমের অসামঞ্জস্য আছে বলে মনে হয়। তাহলে কি ভালো চাকরি করেও আলেনা সুখী নয়? আব্বাস না হয় নিজের অসুখী জীবনটাকে মেনে নিয়েছে। এখন কোনো সুযোগ নেই যে জীবনটাকে ভেঙে আবার নিজের মতো করে গড়ে নেবে। দাম্পত্যের যে ছাঁচে বর্তমান জীবনের ছকটা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এতটুকুই সম্ভব। যেমন আলেনার সঙ্গে সে যাচ্ছে নিজের গণ্ডীর বাইরে। দু’চারদিন বা দু’চার সপ্তাহ হলেও তাকে ফিরতে হবে আগের গণ্ডীতেই। নইলে প্রশ্ন উঠবে ঘরে। বাইরে। এমনকি নিজের মনেও।

আলেনার ঘুমটা বোধ হয় খুবই প্রয়োজন ছিলো। এমন করে নির্ভাবনার নিশ্চিত ঘুম সে কতদিন ঘুমাতে পারে না কে জানে! তাহলে কি তার একটি নির্ভরযোগ্য অবলম্বন প্রয়োজন ছিলো? আব্বাস কি তার সে অবলম্বন? যার উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়? মানুষ তাহলে কত ভাবে অসহায়! অবলম্বন ছাড়া কেউই চলতে পারে না? প্রতিটি মানুষেরই একটি নিশ্চিত আশ্রয় প্রয়োজন। যেখানে তার দেহ-মনের পুরো ভারটুকু ছেড়ে দিয়ে নির্ভার হবে। একটু হালকা হবে। যেমন দিনান্তে একজন পরিশ্রান্ত শ্রমিক তার অবসন্ন শরীরটাকে সঁপে দেয় ঘুমের কাছে। তারপর ঝরঝরে দেহমন নিয়ে সে জেগে ওঠে ঘুম থেকে।

বাসটা কুমিল্লা বিশ্বরোড এসে তাদের কাউন্টারে থামলো। যাত্রীরা যার যেমন নেমে পড়লো। আলেনাকে ঘুম থেকে জাগাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না আব্বাসের। কিন্তু তার নিজের প্রয়োজনেই নামতে হবে বাস থেকে। তাই আলেনাকে জাগিয়ে দিয়ে বললো, ওঠো। নিচ থেকে একটু ঘুরে আসি। কক্সবাজারের আগে চিটাগং একবার থামবে।

আলেনার ঘুম ভেঙে গেলে সে বলে উঠলো, কোথায় এলাম?

কুমিল্লা।

প্রায় সব যাত্রীই নেমে গিয়েছে। ওরাও নেমে আসে। আলেনা লাফিয়ে নেমেই বলে উঠলো, আহ, কতদিন পর ঢাকার বাইরে বেরুতে পারলাম!

তারপরই সে বলে উঠলো চলো, রসমালাই খাই!

এখনই?

হ্যাঁ।

আচ্ছা। আগে ওয়েটিং রুমে চলো। আমার একটু কাজ আছে।

আব্বাস টয়লেটে ঢুকে ভারমুক্ত হয়ে হাতমুখ ধোয়। তারপর বেরিয়ে এসে রুমালে হাতমুখ মুছতে মুছতে বলে, চলো।

তারপর আবার বললো, রসমালাই আর আগের মতো নেই। পত্রিকায় পড়েছি এখন রসমালাই আর দইয়ের ঘনত্ব বাড়াতে টিসু পেপার মেশায়।

তাই? বলে মুখটা কেমন বিকৃত করে ফেলে আলেনা। তাহলে আমার হয়েছে। ফিরে চলো।

আব্বাস হেসে বললো, কেন? একটু খেয়ে পরীক্ষা করেই দেখি না।

দোকানে ঢুকে রসমালাই খাওয়ার কথা বললে, ওদের টেবিলে দু’টো ছোট ছোট বাটি দেয়া হলো।

আলেনা চামচে করে মুখে দিয়ে বললো, অপূর্ব! মনে হয় এগুলো নির্ভেজাল!

আমারও তাই মনে হচ্ছে।

আলেনা যেমন শখ করেছিলো তেমন খেতে পারে না। অর্ধেকটা ফেলে উঠে পড়ে। এত মিষ্টি! গলার ভেতর কেমন করে!

লোকজন বাসে উঠতে থাকলে আব্বাস বললো, টয়লেট ঘুরে এসো।

আমার লাগবে না।

তবু যাও।

আমাকে কি বাচ্চা-মানুষ পেলে?

আব্বাস হাসে। বলে, বাস ছাড়লেই টের পাবে। তখন না হলেও এক ঘণ্টা।

আলেনা সঙ্কট বুঝতে পেরে বললো, ঠিকই বলেছো।

তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে বাসে উঠেই বললো, আমার না আচার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে আচার পাওয়া যাবে না?

হয়তো যাবে। বলে, আব্বাস দাঁড়াতেই বাসটা ছেড়ে দিলো। আবার বসে পড়ে সে বললো, সামনের যে স্টেশনে বাসটা থামবে, সেখান থেকেই তোমার জন্য আচার কিনবো।

বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত রুনি একবারও আচারের নাম মুখে আনেনি। কোনো ধরনের ছেলেমানুষি বায়না করেনি। কিন্তু আলেনার আচার খাওয়ার ইচ্ছের কথা শুনে আব্বাসের মনে হলো, রুনি যেন ঠিক স্বাভাবিক একজন নারী নয়। যেন খুব বেশি পরিণত। খুব বেশি হিসেবী। এই যে আলেনা কেমন সহজভাবে বলতে পারলো। মিষ্টির দোকানে গেল। এমনটা রুনির দৃষ্টিতে যেন খুবই অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে।

১১

হোটেলের রুমে ঢুকে প্রথমেই আব্বাস বাথরুমে ঢুকলো। গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই আলেনা নতুন কেনা থ্রি পিস নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। গোসল সেরে ভেজা চুলে থ্রি পিস পরে বেরিয়ে আসতেই আব্বাস মুগ্ধ হয়ে গেল যেন। কিছুক্ষণ ঠায় তাকিয়ে রইলো আলেনার মুখের দিকে।

আব্বাসের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা দেখতে পেয়েই হয়তো সে বলে উঠলো, আমাকে খুব সুন্দর লাগছে বুঝি?

অসাধারণ! বলেই এগিয়ে যায় আব্বাস। দু’হাতে আলেনার দু’গাল চেপে ধরে। তারপরই আচমকা ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। আর এ জন্যেই বুঝি আলেনা এতকাল প্রতীক্ষায় ছিলো। চৈত্রের খর তপ্ত মাটি যেমন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে, সেই বৃষ্টির পানি শুষে নেয় নিমেষেই। আলেনাও যেন নিমেষেই শুষে নিলো আব্বাসের বুভুক্ষু আবেগ। অপারেশনের পর একমাসেরও বেশি সময় ধরে কাতর আব্বাস, হয়তো আরো বেশি সময় ধরে কাতর আলেনা। পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় আলিঙ্গনে। এতটুকুতেই যেন তাদের দু’টি বুভুক্ষু দেহে ছড়িয়ে পড়ছিলো পরিতৃপ্তির ঘ্রাণ। আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলো পরস্পর একটি অচেনা উষ্ণতায়।

আট বছর দাম্পত্যের পর একজন পুরুষ বা নারীর কাছে শরীর ব্যাপারটা অচেনা থাকার কথা নয়। তবু কেন যেন আব্বাসের মনে হচ্ছিলো আলেনাতে ভিন্ন কিছু আছে। তার ছোঁয়ায় ভিন্ন এক মাদকতা। তার পরশে অদ্ভুত এক আনন্দে আবিষ্ট হয় দেহমন। রুনির কাছে যা তিলমাত্র ছিলো না। তার কাছে শরীরী ব্যাপারটা যেন ছিলো প্রাত্যহিক গার্হস্থ দায়িত্ব পালনের মতোই।

বাসে দীর্ঘ পথপরিক্রমনের ক্লান্তি আর আকস্মিক ভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠা দু’টো মানব মানবী এলোমেলো ঘুমে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। এ ঘুম যেন তাদেরকে উপহার দেয় নতুন জীবনের প্রণোদনা। বেঁচে থাকার অপরিমেয় আনন্দ। বিকেলের দিকে জেগে উঠে আলেনা আব্বাসকে জাগিয়ে তোলে। বলে, চলো সৈকতে যাই। কাছ থেকে সমুদ্র কখনো দেখিনি। এর পানিতেও নামিনি।

আব্বাস আলেনার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, এভাবেই আমার ভালো লাগছে।

আব্বাসকে ঠেলে আলেনা বললো, বাইরে চলো তো!

তারপর আবার বললো, বাইরে আরো ভালো লাগবে!

আব্বাস উঠে শাওয়ার নিতে গেলে আলেনা বললো, সাগর মন্থনের পর। এখন ওসবের দরকার নেই!

আব্বাস তৈরি হতেই আলেনা বললো, নিচে নেমে কিছু খেয়ে তারপর যাবো।

তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।

রেস্টুরেন্টে বসে খেতে খেতে ওরা সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে পরিদৃশ্যমান উত্তাল সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে আলেনা বললো, ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পাচ্ছো?

আব্বাস বললো, এ তো বলতে গেলে কিছুই না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দিকে কান পাতাই দায় হয়ে পড়বে। আমার তো মাথা ভারী হয়ে যায়।

আলেনা বললো, আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে জীবনের কাছ থেকে অনেক কিছুই পাওনা ছিলো। কিন্তু সময় আমার কাছ থেকে তার অনেক কেড়ে নিয়েছে।

তারপরই সে আব্বাসের একটি হাত ধরলো। বললো, মনে আছে, তোমার ব্যাগে একবার শিপ্রার ক্লিপ পাওয়া গিয়েছিলো?

কথাটা মনে হতেই হেসে উঠলো আব্বাস। বললো, ওটা কে রেখেছিলো তখন বুঝতে পারিনি!

ও নিজে রেখেই আমাকে বলেছিলো। ভেবেছিলো সাদমানী স্যার তোমাকে প্যাঁদাবে!

স্যার হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। না হলে তিনি বলতেন না যে, কোনো মেয়েকে দিয়ে দাও!

তিনি তো শিপ্রার কথাই বলেছিলেন?

আব্বাস জবাব না দিয়ে আলেনার মুখের দিকে তাকায়।

খেয়ে বের হয়ে ওরা হাঁটতে হাঁটতে সৈকতের দিকে যায়। কিছুটা দূর এগিয়ে যেতেই আলেনা স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে বালির উপর হাঁটতে হাঁটতে বললো, পায়ের তলা কেমন শির শির করছে!

তারপরই সে দৌঁড়–তে থাকে। অনেকটা দৌঁড়ে সে পোঁছে যায় সৈকতের কাছে। তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকে আব্বাসকে। কিন্তু আব্বাসের দৌঁড়–তে ইচ্ছে হয় না। সে আস্তে আস্তেই হেঁটে চলে। ওদিকে আলেনা ভেজা বালির উপর দাঁড়িয়ে থাকলে সাগরের ঢেউ এসে ওর পা ধুয়ে দিয়ে যায়। আর এতে যেন সে আরো মজা পায়। নেমে পড়তে থাকে পানির ভেতর। আব্বাস চিৎকার করে বলে, সাঁতার না জানলে নেমো না!

কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে কেউ কেউ বললো, ছবি তোলাবেন? দশ মিনিটে প্রিন্ট! আরেকজন জানালো সঙ্গে সঙ্গেই প্রিন্ট।

আব্বাস বিরক্ত হয়। কোথায় এসেছি কিছুটা সময় নিজেদের মতো করে কাটাবো বলে, আর এখানেও নানা পেশার মানুষ এসে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। বিরক্ত হলেও হাসিমুখে সে জানায়, ছবি লাগবে না। ক্যামেরা নিয়ে এসেছি।

আসলে এখানকার কোনো দৃশ্যই সে ক্যামেরার ফ্রেমে বাঁধতে চায় না। যতটুকু থাকার মনের ফ্রেমেই বন্দি থাকুক। এতকাল আলেনা যেভাবে তার মনের ভেতর ঘুমিয়েছিলো। আজকের বা আগামী দিনে আলেনার সঙ্গের স্মৃতিগুলোকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখবে হৃদয়ের উষ্ণ শয্যায়।

আলেনা হয়তো বাতাস আর ঢেউয়ের গর্জনে আব্বাসের কথা শুনতে পায় না। সে আরো পানির দিকে নামতে থাকলে হঠাৎ ঢেউয়ের তোড়ে কাত হয়ে পড়ে যায়। ভয় পেয়ে সে উঠেই উপরে চলে আসে। তারপর আব্বাসের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।

আব্বাস এগিয়ে গিয়ে আলেনার কাছাকাছি দাঁড়ালে সে আবার পানি নিয়ে মেতে ওঠে নতুন করে। শিশুসুলভ চাপল্যে সে দু’হাতে পানি ছিটায়। ভেজা বালির উপর গড়াগড়ি খায়। এতে করে তার ভেজা শরীরে বালি চিকচিক করে। সন্ধ্যা হয়ে আসতে থাকলে আব্বাস বললো, চলো ফিরে যাই। অন্ধকার নামলে একধরনের প্রাণী লুটপাট করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আলেনা ভয় পায় যেন। গোল গোল দৃষ্টি মেলে বলে, এখানেও কি এসব হয়?

আব্বাস আলেনার একটি হাত ধরে টানতে টানতে বলে, অনেক ধরনের বিপদ! বলে ঠিক বোঝাতে পারবো না।

ও, আমার স্যান্ডেল? বলেই আলেনা আব্বাসের হাত ছাড়িয়ে ফিরে যায়। কিন্তু স্যান্ডেল খুঁজে পায় না। কোথায় রেখে কোথায় সে খেলতে খেলতে চলে এসেছে এখন হয়তো মনে করতে পারছে না।

আব্বাস বললো, যেখানটায় প্রথম নেমেছিলে সেদিকে হাঁটি। সূর্যাস্তটাও দেখা যাবে।

এখনো তো অনেক সময় আছে। হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখবো।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরও ওরা স্যান্ডেল খুঁজে পায় না। আব্বাস বললো, হয়তো পানিতে ভেসে গেছে।

আলেনা আব্বাসের হাত ধরে বললো, চলো ফিরি। এমন সময় দু’টি কিশোর কিশোরী এসে বললো, ঝিনুক, শঙ্খ, ঝিনুকের মালা নেবেন? অনেক সস্তায় দেবো।

আলেনা বললো, এসব এখন নেবো না। যেদিন যাবো সেদিন।

আলেনা খালি পায়েই ফিরে আসে। বলে, আমি এখন কি পরবো?

কাছেই মার্কেট আছে। সন্ধ্যার পর নিয়ে আসবো।

আমি কি একা একা রুমে থাকবো নাকি?

তুমি খালি পায়ে যেতে পারলে আমার আপত্তি নেই।

আমার অসুবিধা হবে না।

রুমে ফিরে এসে ওরা দু’জনেই শাওয়ার নেয়। সারা শরীরে বালি কিচকিচ করছে। বিশেষ করে মাথায়। অনেক ধুয়েও পুরো বালি দূর হলো না।

আলেনা বললো, আমার আরেক সেট থ্রি পিস লাগবে।

চলো, তাহলে। স্যান্ডেল-থ্রি পিস, চাইলে আরো কিছু নিয়ে আসতে পারবে।

ওরা দু’জনেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সূর্যটা বিশাল আকার নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পানির ওপাশে। আর সে আলোয় বুকে রক্ত নিয়ে যেন এদিকেই ছুটে আসছে ঢেউগুলো।

১২

দেখতে দেখতে যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল তিনটে দিন। তৃতীয় রাতে দু’জনের কেউই ঘুমতে পারলো না। একজন আরেকজনের বুকে মুখ গুঁজে থেকে আদরে সোহাগে আর ভালোবাসায় পার করে দিলো রাতটুকু। দিনটাকে শুরু করলো সূর্যোদয় দেখে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের সোনালী আলোয় ভিজতে ভিজতে আলেনা বললো, আমরা আবার কবে আসবো?

আব্বাস হেসে বললো, বলবো কি করে? ছুটি তো বেশি পাই না!

টিকেট দু’টো কাজে লাগাতে হবে না?

মাস খানেক পর না হয় আবার আসা যাবে।

আলেনা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, এত দিন?

মাসে তিনদিনের বেশি তো ছুটি পাবো না!

কেন? ক্যাজুয়েল না থাকলে মেডিক্যাল তো আছেই!

আব্বাস হাসে। মাস খানেক আগেই তো সব খুইয়ে ফেলেছি!

ঠিক আছে, ব্যবস্থা করে নেবো। আমার ফ্লাটে চলে আসবে।

আন্টি আর আংকেল কি মনে করবে?

কি আবার মনে করবে? তোমাকে তো আগে থেকেই জানে। খুশি হবে হয়তো।

এতদিন পর তুমি আমাকে দেখে চিনতে পারোনি। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। তারা কি করে পারবেন?

না পারলে কি? আমার কোনো গেস্ট আসতে পারে না?

তা পারে। তাই বলে তাদের সামনেই দরজা লাগাবে?

আমাকে এমন বোকা ভাবছো কেন? আর যখন সমস্যা হবে তখন বুঝবো। তুমি আর কোনো দিকে চোখ দেবে না বলে দিচ্ছি!

তুমি চোখে চোখে রেখো। ঘরের জন তো আমাকে চোখে চোখে রাখতে পারলো না। এতদিন নিজেই নিজকে সামলে চলেছি। আর একবার যখন বাইরে পা পড়েছে, তখন তো পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয়ও আছে!

আচ্ছা রাখবো।

বাকি জীবন?

তুমি যতদিন সাড়া দেবে।

বেলা আটটার দিকে ওরা গোছগাছ করে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলো। তখনই আব্বাসের মনে হলো রতন শামুকের কথা বলেছিলো। একটি মোটামুটি বড় আকৃতির শঙ্খ কিনে ব্রিফকেসে ঢোকায় আব্বাস।

আলেনা অবাক হয়ে বললো, এটা কোন কাজে লাগবে?

আব্বাস হেসে বললো, এটার দিকে যখন চোখ পড়বে, তখন তোমার আমার এখানকার সময়গুলো মনে পড়বে।

আলেনা হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না।

তিনটা দিন। তিনটা দিন পার করে দিয়ে যখন বেলা সাড়ে তিনটা চারটার সময় ঘরে ফিরলো, তখনই যেন বাস্তবের কঠিন ভূমিতে আছড়ে পড়লো আব্বাস। রুনি বললো, এই না বলেছিলে একদিন! তিনদিন কি করলে?

সময় কি ধরে রাখা যায়? কত ব্যাপারই তো থাকে!

রতন শঙ্খটা পেয়ে খুশি হলেও বললো, জীবন্ত হলে আরো মজা হতো! তাই না বাবা?

রুনিকে এ সময় ঘরে দেখতে পাবে আশা করেনি আব্বাস। হয়তো ছুটি নিয়েছে অসুস্থতার কারণে। বললো, আজ অফিসে যাওনি?

না।

তারপরই বললো, তোমাকে ভাত দেবো? নাকি হালকা কিছু খাবে?

আব্বাস কাপড় পালটিয়ে ফ্রেশ হয়ে বললো, এক কাপ চা দিতে পারো।

রুনি কেমন অবাক হয়ে তাকায় আব্বাসের দিকে। তারপর হেসে বললো, এ ঘরে কি কেউ চা খেতো?

তাহলে দাও কিছু একটা।

আব্বাস ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভিটা অন করে। সিএনএন, বিবিসি থেকে আরম্ভ করে চ্যানেল বদলে বদলে শেষে ইএসপিএনে ক্রিকেট দেখতে থাকে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেলে আব্বাস চায়ের কথা বা হালকা কিছু খাওয়ার কথা ভুলে যায়। তখনই রুনি দু’কাপ চা আর  একটি প্লেটে করে চানাচুর নিয়ে আসে।

আব্বাসের পাশে বসে, সামনের ছোট টেবিলে ওগুলো নামিয়ে রেখে বললো, খেলা দেখছো? জিটিভিতে দাও।

আব্বাস চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়ে চানাচুর নিয়ে মুখে দিয়ে বলে, কেমন ছিলে? শরীর ভালো?

রুনি কিছু না বলে টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকলো।

চানাচুর খেতে খেতে আব্বাস আবার বললো, অফিসে গেলে না যে?

যাচ্ছি না।

আব্বাস অবাক হয়ে বললো, যাচ্ছো না মানে?

ছেড়ে দিয়েছি!

কত শখ করে না চাকরি নিলে?

শখ মিটে গেছে।

আব্বাস চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো, কি হয়েছিলো তোমার? বললে না তো!

কিছু না! আর মেয়েলী ব্যাপার জেনে তুমি কি করবে?

আব্বাস আর কিছু বলে না। নীরবে চাটা শেষ করে উঠে বললো, একটু শুই গিয়ে। বড্ড কাহিল লাগছে!

আব্বাস বিছানায় শরীরটা টানটান করে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো, আলেনা ঘরে পৌঁছুলো কি না। সে ফোনটা তুলে রিঙ দিতেই আলেনা বললো, পৌঁছেছো?

হ্যাঁ।

আমিও এই মাত্র খেয়ে উঠলাম। আচ্ছা রাখি!

আচ্ছা।

আব্বাস ফোনটা রাখতেই রুনি এলো। পাশে শুয়ে পড়ে বললো, কার সঙ্গে কথা বললে?

আলেনা।

ওটা আবার কে?

এক সঙ্গে পড়তাম। ক’দিন আগেই যোগাযোগ হলো।

কি করে?

একটা এনজিওতে চাকরি করে।

বিয়ে-টিয়ে হয়েছিলো?

নাহ। একসময় আমাকে না পেয়ে অনেকদিন মানসিক রোগী হয়ে ছিলো।

এটা তো কখনো বলোনি! তোমাকে কি এখনও ভালোবাসে?

হয়তো।

তারপরই রুনি হঠাৎ পাশ ফিরে আব্বাসের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি কিন্তু আমাকে একটুও পাত্তা দিচ্ছো না!

তুমিই কি দিয়েছিলে? এতদিনকার ক্ষোভ যেন বেরোবার শত পথ পেয়ে ফুঁসে ওঠে। কতদিন তোমাকে ছুঁতেও পারিনি। হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছো! কি হয়েছিলো তোমার? বমি করছিলে কেন? তারপর ক্লিয়ার করে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে! আমি তো তোমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি?

আসলে আমি নষ্ট হয়ে গেছি! বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রুনি। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললো, ওরা কোকের সঙ্গে মদ মিশিয়ে দিয়েছিলো। ব্যাপারটা কখন ঘটেছে টের পাইনি।

আমাকে জানাতে পারতে!

নিজকে এতটাই অশুচি মনে হচ্ছিলো যে, বেঁচে থাকার প্রশ্নে দ্বিধায় ভুগছিলাম!

এখন কি করবে ঠিক করলে?

কিছুই ঠিক করিনি। আমি তো সে অধিকার নষ্ট করে ফেলেছি!

আব্বাসের মনটা হঠাৎ করেই নরম হয়ে আসে রুনির ওপর। আব্বাস ছিলো বলেই সে জেদ করে চাকরিটা নিতে পেরেছিলো। আর আব্বাস আছে বলেই অশোভন বাস্তবতার ধাক্কা খেয়ে ঘরের মানুষ ঘরেই ফিরে এসেছে। হয়তো সে-ই তাকে নিরাপত্তা আর নির্ভরতা দিতে পারবে! থাক! অনুশোচনা মানুষকে শুদ্ধ করে। রুনিও অনুতপ্ত। অনুশোচনার আগুনে পুড়ছে দিনরাত। তাকে আপন বলে ভাবতে পারছে বলেই না অকপটে সব স্বীকার করতে পেরেছে! তাই মুহূর্তেই যেন এতদিনকার রাগ-বিদ্বেষ-অভিমান সবই ভুলে যায় আব্বাস। বলে, ওটা একটা দূর্ঘটনা।!

রুনি আব্বাসের বুকের কাছে আরো কিছুটা সরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি! অন্যায় করেছি! যে শাস্তি দেবে মেনে নেবো!

আব্বাস কিছু না বলে, রুনির মাথাটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে নির্ভার মনে চোখ বোঁজে।

(সমাপ্ত)

(অনেক আগে বাংলা লাইভ আই পত্রিকায় প্রকাশিত।)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to উপন্যাস: মায়াজাল

You must be logged in to post a comment Login