নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি, পর্ব-৪০ (চতুর্থ অধ্যায়)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

(পূর্ব প্রকাশের পর) আজ শুক্রবার। বিকেলে রেস্টুরেন্ট খোলার পর থেকেই শুরু হল সেফ এর চিৎকার চেঁচামেচি। রাশেদ সাহেব রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন, এ কয়দিন তবুও কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু আজ সবই কেন যেন ভুল হচ্ছে। এখানে ভুল ওখানে ভুল, আর সেই সুযোগে সেফ এর অশ্লীল গালাগালি। রাশেদ সাহেব অবাক, এই কি সেই লোক যাকে এ কদিন দেখেছে? কেমন যেন গুলিয়ে গেল সব কিছু। দৌড়া দৌড়ি ছুটা ছুটিও বেশি হচ্ছে। রাত প্রায় দশটার দিকে আর পারছিলেন না। কি করবেন, কাকে বলবেন? আমি আর পারছি না। মারুফকে ডেকে বলবেন সে উপায় নেই, তার পাশেই সেফ। না আর কুলাচ্ছে না। কবিরকে বললে কবির বলল,
ভাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না মারুফকে বলেন।
মারুফের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সেফ চ্যাচিয়ে বলল,
কি, এখানে কি?
সাথে যোগ করলেন …………………বাংলা ভাষার অনুচ্চারণ যোগ্য অশ্লীল কিছু শব্দ যা শুধু এক শ্রেণীর লোকদের মুখেই শোনা যায়, কখনো কাগজে লেখা যায় না। রাশেদ সাহেব মারুফের কানে কানে বললেন ভাই আমি আর পারছি না।
মারুফ বলল
দেখেন, এখন কি ভাবে কি করা যাবে, এগুলি তো শেষ করতে হবে, এখন কাকে পাবো বলেন? আচ্ছা আমি কবিরকে বলছি সে আপনাকে সাহায্য করবে।
সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, ব্যথায় কোমর টনটন করছে, হাতের কাটা গুলিতে ভীষণ জ্বালা হচ্ছে, কিছু ধরতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। কি আর করবে, ওই ভাবেই বাকি কাজ শেষ করে রাত সাড়ে বারোটার কিছু পর উপরে গিয়ে কাপর বদলেই শুয়ে পরলেন। তার পরের দিনও একই রকম ব্যস্ততা। আজ রবিবার, কাজের চাপ কম। রাতের কাজের শেষে সেফ বলল বেয়াই কাল সোম বার আপনার অফ।
এর মধ্যে তিন দিন অফ গেছে। অপেক্ষায় থেকেছে পরবর্তী অফের দিন মেইল পাবে। তার নয়ন মনিরা সবাই চিঠি লিখবে তার মনি লিখবে। প্রতি অফের দিনে সাত দিনের প্রতীক্ষিত মেইলের আশায় লাইব্রেরিতে গেছে। বাড়ি থেকে পাঠানো মেইল মন দিয়ে পড়েছ। এক বার, দুই বার, কয়েক বার পরেছে। মনে হয়েছে কতদিন মনির চিঠি পড়া হয়নি। সেই যে বিয়ের পর মনিকে রেখে চলে বিদেশে গিয়েছিল তখন। তা প্রায় পঁচিশ বছর তো হবেই। সেই দিনগুলির কথা মনে পরে। মনির চিঠি পেলে কেমন যেন হয়ে যেত। কতবার করে যে পড়েছে প্রতিটা চিঠি। পড়তে পড়তে প্রতিটা অক্ষর তার মুখস্থ হয়ে যেত। তাকে লেখা মনির প্রথম চিঠির কথা স্পষ্ট মনে আছে। তাকে সম্বোধন করতে গিয়ে কয়েকবার কেটে শেষ পর্যন্ত লিখেছিল “প্রিয় স্বামীন” এখনো মনে পরে। মনি লিখত খুব সুন্দর করে, গুছিয়ে অনেক কিছু লিখত। অনেক বড় হত চিঠি গুলি। সে নিজেও লিখত। তার লেখা দীর্ঘ চিঠি হয়েছিল একুশ পাতা। মনির ছোঁয়া বয়ে নিয়ে এসেছে যে চিঠি তা সে ফেলতে পারত না, বালিশের পাশে রাখত। মনির হাতের গন্ধ মাখা ছোঁয়া পাবার জন্য। এখন ঘরে ঘরে ফোন, ইন্টারনেট, হাতে হাতে মোবাইল কত কি। তখন শুধু চিঠির অপেক্ষা। কি ভাবে যে দিন গুলি গেছে পরের চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত। সে যারা ভুক্ত ভুগি তারা ছাড়া কে বুঝবে?

মেয়ে আর মনির লেখা অনুরোধ উপদেশের ঝুড়ি খুলে দেখেছে। তার নিজের রোজ বিবরণী পাঠিয়েছে। কবে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে, কি দেখেছে, এদেশের মানুষেরা কি ভাবে কথা বলে, থাকার জায়গা কেমন, কোথায় কি ভাবে কি করতে হয় সব কিছু খুলে লিখেছে। তবুও মনে হয়েছে মনি আর মেয়েদের হাজার প্রশ্নের জবাব দেয়া হল না। ঘুরে ঘুরে লাইব্রেরি দেখেছে। এর মধ্যে লাইব্রেরির স্টাফদের সাথে খাতির হয়ে গেছে। এখন ফাকা থাকলে তাকে নির্দিষ্ট এক ঘণ্টা সময়ের চেয়ে বেশী সময় দেয়। একদিন কেও ছিল না বলে তাকে দুই ঘণ্টা দিয়েছিল। দুপুরে সময় মত এসে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে গেছে। একদিন ভেবেছিল অক্সফোর্ড যাবে। বিশ্বের সেরা ইউনিভার্সিটি দেখে আসবে। কিন্তু কে যেন বলল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি নিজের গাড়ি ছাড়া দেখা কঠিন ব্যাপার, কারণ এটা এক জায়গায় না। এক ফ্যাকাল্টি থেকে অনেক দূরে অন্য ফ্যাকাল্টি। সারা অক্সফোর্ড জুড়ে এই ইউনিভার্সিটি। তাই এমনি এক জায়গায় গিয়ে কি দেখবেন? আর যাওয়া হয়নি। এই শহরেই ঘুরে ফিরে দেখেছে। ছোট্ট শহর, তেমন কিছু নেই। কিছু দোকান পাট আর দুইটা ব্যাঙ্ক ছাড়া। সেদিন দুপুরে কাজ সেরে উপরে আসার সময় বাড়িতে ফোন করেছিল। অস্থির মেয়েগুলি আর তাদের অস্থির মাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য। অল্পই কথা হয়েছে। কেমন আছ, তোমাদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে, আমি ভালো আছি, চিন্তা করবে না। আব্বু তুমি সময় মত খাবে, ঠাণ্ডা লাগাবে না, ওষুধ খাবে মনে করে, আমাদের জন্যে চিন্তা করবে না। এই ধরনের।

এর মধ্যে আসাদ সাহেব চলে গেছে। তার জায়গায় প্রবীণ নামে নেপালি এক ছেলে এসেছে। প্রবীণ আসাতে নুরুল ইসলাম নিচের রুমে চলে গেছে। এখন তার রুম মেট প্রবীণ। অল্প বয়সের ছেলে। লেখাপড়ার নাম করে এদেশে এসেছে কিন্তু কলেজে নাম লিখিয়ে রেখে কাজ করে যাচ্ছে দুই বছর ধরে। মাসে একবার যেয়ে কলেজে হাজিরা দিয়ে আসে। রাশেদ সাহেবের সাথে বেশ আলাপ জমে উঠেছে। কখনো মন খারাপ দেখলেই এগিয়ে আসে, হিন্দি ভাষায় কথা বলে। বলে ভাইয়া আপনি প্রায় আমার বাবার বয়সের, আপনি এই বয়সে এখানে কেন এসেছেন তা আমি বুঝি। আমার বাবার ব্যবসা যখন খারাপ যাচ্ছিল তখন সেও এখানে এসেছিল,  কয়েক বছর থেকে গেছে। তখন নেপালিদের এখানে আসতে ভিসার প্রয়োজন হত না। যাই হোক এখন কাঠমুন্ডুতে কাঠের আড়ত করেছে, স মিল সহ ভালই চলছে। আপনি বেশি চিন্তা করবেন না, চিন্তা করলে শুধু মন খারাপ থাকবে, কাজে মন বসাতে পারবেন না। আর কোন লাভ হবে না। তার চেয়ে মন ভালো রাখেন, হাসি খুশি থাকেন, সুস্থ ভাবে কাজ করেন। আমি আপনাকে বলে দিব কিভাবে কাজ সহজে করতে হয়। আমিও কিচেনে কাজ করেছি প্রথম দিকে। কিচেনে কাজ কষ্টের কাজ, সবচেয়ে ভাল হয় আপনি যদি সামনের কাজ করেন। মাঝে মাঝে সামনে আসবেন, আমি আপনাকে সামনের কাজের কিছু ধারনা দিয়ে দিব শিখে নিবেন। জব সেন্টারে গিয়ে বলবেন আমি সামনের কাজ জানি, দুই এক মাস করেছি। ওখানে থাকার সমস্যা তাই অন্য কাজ খুঁজছি। এদেশে মিথ্যা না বললে চলে না, সবাই মিথ্যা পছন্দ করে কারণ মিথ্যা চকচকে হয়। আর সত্য মিথ্যার মত চকচকে হয়না তাই কেও পছন্দ করে না। আপনি যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারবেন তত আকর্ষণীয় হবেন। এক সপ্তাহ আমার কাছে দেখেন, তারপর নেক্সট অফ ডেতে লন্ডন গিয়ে জব সেন্টারে সামনের কাজ খুঁজেন ভাল হবে। আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি এই ধরনের কাজে অভ্যস্ত নন। আপনি কোন বড় ধরনের কাজ করতেন। আপনার চশমা দেখেই বুঝেছি সাধারণ লোকেরা এতো দামী চশমা পরে না। সেদিন সেফ আর ওসমান আপনার ব্যাপারে আলাপ করছিলো। বলছিল এই লোকের চশমার দাম বাংলাদেশে দশ হাজার টাকা হবে, এই লোক নিজের পরিচয় গোপন করছে। আমি তখন বারে কাজ করছিলাম। আসলে আমি গত দুই বছর যাবত কাজ করছি এবং সবই বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে, কিন্তু আপনার মত কাউকে পাইনি। আপনার কথাবার্তা আচার ব্যাবহার সবই অন্যদের চেয়ে আলাদা, সত্যি করে বলেন তো আপনি কি করতেন ওখানে?
তা শুনে আর কি করবে ভাই। আচ্ছা দেখি তুমি আমাকে কিছু শিখিয়ে দাও, আমি তোমার কথা মতই করব আমার বন্ধুও তাই বলেছে। আমি কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না তাই কিছু করতে পারছি না। তুমি যখন বলছ একটা পথ পাবো বলে মনে হচ্ছে। নেক্সট উইকে লন্ডন যাব। আচ্ছা মনে কর কাজ পেলাম, তারপর কি করবো? মানে এখান থেকে ছুটবো কি ভাবে?

সেজন্যে ভাববেন না, সেটা আমি বলে দিব কি করতে হবে। আপনি আগে কাজ নিয়ে আসেন তখন দেখব।
নাও একটু তামাক নাও।
বানিয়ে দেন আমি তো পারি না জানেন।
সত্যি সত্যি এর পরদিন থেকেই প্রবীণের কাছে তালিম নেয়া শুরু করলেন রাশেদ সাহেব। কয়েকদিনের মধ্যে বেশ যত্ন করেই প্রবীণ তাকে খুঁটিনাটি সহ মোটামুটি একটা তালিম দিয়ে দিল। সাথে বলে দিল যা শিখিয়ে দিলাম আপনি যদি মনে রাখতে পারেন কেউ বুঝতে পারবে না যে আপনি কখনো সামনে কাজ করেননি। শুধু মনে সাহস রাখবেন অসুবিধে নেই। আপনি ইংলিশ জানেন আপনার ইংলিশ ভালোই আমি লক্ষ করেছি, আর কি? বেতনের জন্যে ভাববেন না এখানে যা পেতেন ওখানেও তাই পাবেন।
পরের অফ ডেতে সকালে উঠে নাস্তা সেরে দেরি না করে বেরিয়ে পরলেন অক্সফোর্ডের উদ্দেশ্যে। চেনা পথ, সেদিন যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেই ভাবে এসে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনের রিটার্ন টিকেট কিনলেন। ফিরবেন আগামীকাল। গত সপ্তাহে ফিরোজের সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে সরাসরি ব্রিকলেন যেতে। ওখান থেকে কাজ সেরে তারপর বাসায় আসবে। রাতে ওখানে থাকবে পরদিন সকালে অক্সফোর্ড চলে আসবেন।
বেকার স্ট্রিটে নেমে গেলেন কোচ থেকে। টিউব স্টেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কুল কিনারা না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে দেখিয়ে দিল। ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে, ডানদিকে রাস্তার ওই পাশে। টিউব স্টেশনে পৌঁছে প্রথমে একটা ম্যাপ নিয়ে দেখে নিলেন ব্রিকলেন যেতে হলে এখান থেকে হ্যামারস্মিথ লাইন ধরে অল্ডগেট ইস্টে নামলেই হবে। হিসেব করে জোন এক এবং দুই এর একটা ডে টিকেট নিয়ে নিলেন।
ব্রিকলেন পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন চেনা সেই জব সেন্টারের কাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আরও কয়েকটা জব সেন্টার আছে। তার কাছে সবই সমান। এর আগে যেটায় গিয়েছিলেন সেখানে গেলেন না। অন্য আর একটায় ঢুকলেন। সামনে কয়েকজন দাঁড়ানো। একটু পরেই টেবিলে বসে যে এতক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলছিল, সে এবারে তাকে বলল, বলেন ভাই কি করতে পারি।
একটা কাজ দরকার।
সামনে না পিছনে?
সামনে।

আগে করেছেন কখনো?
একটু থতমত খেয়ে গেলেন হটাত করে ডাহা একটা মিথ্যা মুখ দিয়ে বের হতে চাইল না। জীবনে যা কখন করেননি যা তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করেন আজ তাই বলতে হবে। সারা জীবন ভরে তো ন্যয় নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়িয়েছেন। মিথ্যাই যদি বলতে হবে তাহলে এদেশে কেন এলাম? নিজের দেশে যেখানে ছিলাম সেখানে প্রমোশন হত, বেতনের বাইরেও বেশ কিছু পেতে পারতাম। না, যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায় না। সবাই যেভাবে চলতে চায় সেভাবে চলতে পারে না। এজন্যে চেষ্টার সাথে আরও কিছু প্রয়োজন আর সম্ভবত তা হচ্ছে সাহস, এমন সাহস রাশেদ সাহেবের নেই। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রবীণের কথা মনে পরে গেল। মিথ্যা কথা চকচকে হয় তাই সবাই পছন্দ করে। হ্যাঁ, সে তো একথা মেনে নিয়েই এসেছে। মিথ্যা কথা বলবে। এখন দ্বিধা করার কি দরকার?
হ্যাঁ করেছি দুই এক মাস।
আচ্ছা একটু বসেন।
আশে পাশে দেখলেন বসার কোন জায়গা নেই, একটু সরে দাঁড়ালেন। এবারে অন্যদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন কে কিভাবে কি বলছে। তিন চার জনের সাথে আলাপ সেরে টেবিলের ওপাশে বসা লোকটা এবারে টেলিফোন ধরে কার সাথে যেন আলাপ শুরু করল। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। এবারে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলল,
এইযে ভাই স্কটল্যান্ডে যাবেন?
রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন না। পাশে দাঁড়ানো এক জন জিজ্ঞেস করলেন আপনার ফ্যামিলি কি এখানে, মানে লন্ডনে?
না এখানে আমার কেউ নেই।
তাহলে আপনার জন্য কাছে আর দুরের মধ্যে কোন তফাত নেই রাজী হয়ে যান, ওখানে ভালো পয়সা দেয় তবে শীত বেশী।
টেবিলের ওপাশের লোক আবার বললেন কি বলেন ভাই, যাবেন?
হ্যাঁ যেতে পারি।
তাহলে এই যে নেন মালিকের সাথে কথা বলেন,
টেলিফোনের রিসিভার এগিয়ে দিলেন।
হ্যালো,
ওপাশ থেকে প্রশ্ন, আপনি কতদিন এই কাজ করেছেন?
বেশি দিন না মাত্র দুই এক মাস।
আচ্ছা, কবে আসতে পারবেন?
আমি তো অক্সফোর্ডে এক জায়গায় কাজ করছি তাদেরকে তো এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে, তা আগামী মঙ্গল বারের আগে পারা যাবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি মঙ্গলবারেই আসেন।
ঠিক আছে আসতে পারব।
এমন সময় টেবিলের ওপাশের লোকটা বলে দিল বেতনের কথা জিজ্ঞেস করেন।
আচ্ছা বেতনের ব্যাপারটা বলা যাবে?
হ্যাঁ, দেখেন আপনি তো  নতুন মানুষই বলা যায়, তা আমি একশ চল্লিশ পাউন্ডের বেশি দিতে পারব না আপাতত।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তাহলে এই কথাই রইলো আগামী মঙ্গল বারে আসবেন।
হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে কি ভাবে যাবো ওখানে?
ভিক্টোরিয়া থেকে ওবান এর টিকেট করবেন। দশ বারো ঘণ্টা লাগবে। সন্ধ্যায় যাত্রা করলে সকালে এসে পৌঁছবেন। এখানে এসে ফোন দিবেন। ঠিকানা ফোন নম্বর সামাদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন, আচ্ছা সামাদ ভাইকে দেন একটু আমি বলে দেই।
হ্যাঁ এইযে নেন
বলে রিসিভারটা লোকটার হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামাদ ভাই কথা শেষ করে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল
এইযে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে নেন।
এক টুকরো কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল। ওগুলি লেখা হলে বলল দেন বিশ পাউন্ড দেন। রাশেদ সাহেব ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রেখে
ওয়ালেট বের করে দশ পাউন্ডের দুইটা নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন। বাইরে এসে মনে হোল মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। দেলু মিয়ার গালাগালির হাত থেকে মনে হচ্ছে এবারে রেহাই পাবেন। কোন রকমে এই কয়টা দিন কাটাতে পারলেই হল। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেই দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে আরাম করে টানলেন। তারপরেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন। মুক্তির আনন্দে যেন শীত লাগছে না তবে মনে হচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে। হাত দেখে ভাবল ক্ষুধা তো লাগবেই অন্ধকার হয়ে গেছে, চারটা বাজে। এতক্ষণ নিষ্কৃতির একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কি খাবো, কি পাওয়া যায় এখানে? এইবার দেখতে পেলেন আশেপাশে অনেক রেস্তোরা ও ফাস্টফুডের দোকান। আগেও ছিল তখন চোখে পড়েনি। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেলেন । এবারে হাতের ডানে একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে একটা চিকেন এন্ড চিপস আর এক ক্যান ডায়েট কোক নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আড়াম করে নিশ্চিন্তায় আস্তে আস্তে খেলেন। কোন তারা হুড়ো নেই। খেতে খেতে মনে হল বাসায় যাবার আগে ফিরোজকে একটা ফোন করে যাই যদি আরও কিছু করতে বলে। খাওয়া শেষ হল। কোকের ক্যানে শেষ চুমুক দিয়ে বিনে ফেলে দিয়ে আবার একটা সিগারেট বানালেন। রাস্তার পাশে একটা ভাঙ্গা বেঞ্চের পাশে বসলেন। মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ভরে সিগারেট টানলেন।

এদেশের প্রথম কর্মজীবনে রেস্টুরেন্টের বিভীষিকাময় দিন গুলো থেকে মুক্তির উল্লাস। প্রাচীন যুগের ক্রীতদাসদের কথা মনে হল। অনেক দূরে চলে গেলেন, অনেক দূরে। ক্রমে মনটা আনন্দ থেকে আবার বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ওহ! ফোন করা হয়নি এখনো। উঠে ফোন বুথ খুঁজে পেল। হ্যালো,
ভাবি, আমি এখন ব্রিকলেনে একটু পরেই আসছি। ফিরোজ কোথায়?
এইতো, বাসায় আছে দিচ্ছি, আপনি চলে আসেন তাড়াতাড়ি।
হ্যাঁ ফিরোজ, তোমার কথা মত আজ সকালে এসেছি।
কাজ পেয়েছ?
হ্যাঁ।
কোথায়?
স্কটল্যান্ডে।
বেশ ভালো, তুমি কোথায় এখন?
ব্রিকলেনেই আছি।
চলে আস।
হ্যাঁ আসছিলাম, হটাত মনে হল তুমি যদি আর কিছু করতে বল তাই জানার জন্যে ফোন করে নিলাম।
না আর কিছু করতে হবে না, তুমি চলে আস আমি বাসায় আছি।
বাসায় আসতে আসতে মনে হল রাত গভীর হয়ে গেছে অথচ রাত এখন মাত্র ছয়টা। প্রচণ্ড শীত। ফিরোজ বসেই ছিল, সব কিছু শুনে বলল,
তুমি আজ এখনি ফোন করে নোটিস দিয়ে দাও।
হ্যালো, ওসমান ভাই, আমি রাশেদ বলছি।
হ্যাঁ ভাই, বলেন কি খবর?
ভাই আমি আগামী রবিবারের পর আর কাজ করব না আপনারা মানুষ দেখেন।
কেন কি ব্যাপার, কি হয়েছে?
না কিছু হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই।
আপনি কবে আসবেন?
কাল বিকেলে।
ঠিক আছে আসেন তারপর দেখা যাবে।
তাহলে তুমি সামনের সোম বারে আসছ?

হ্যাঁ, তাই আসছি তবে ঐ দিনেই আমাকে রওয়ানা হতে হবে।

হ্যাঁ তাই কর। [চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to নক্ষত্রের গোধূলি, পর্ব-৪০ (চতুর্থ অধ্যায়)

You must be logged in to post a comment Login