এ.বি.ছিদ্দিক

ফানুস-5

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

মোবারক হোসেন সাহেব মুখ চুন করে বসে আছেন। বাবা হিসেবে এ বাড়িতে তাকে আলাদা সম্মান দেখান হয়, চাকরি জীবনেও তিনি স্টুডেন্টদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু আজকে কিনা তার নিজের ছেলে তাকে বাবা ভাই ডাকল? এত বড় অসম্মান কিছুতেই সহ্য হচ্ছেনা মোবারক হোসেন সাহেবের। তিনি কখনও তার সন্তানদের সাথে চড়া গলায় কথা বলেননি। আজ দিনকে কিছু বলবেন কিনা তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিনি। তিনি শুধু ঘরের মধ্যে হাটাহাটি করছেন। এমন সময় রূপকথা ঘরের মধ্যে চা হাতে প্রবেশ করল। মোবারক হোসেন সাহেব বলবেননা বলবেননা করেও রূপকথাকে সব বলে ফেললেন। রূপকথা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বলল-

–           কাকাবাবু, আপনি কি আর এককাপ চা খাবেন?

–           চা? ঠিক আছে আন আর এক কাপ।

রূপকথা মোবারক হোসেন সাহেবের জন্য আরও এককাপ চা আনল।

–           আমি কি বসব কাকাবাবু।

–           হ্যাঁ মা বস বস।

–           আমার মনে হচ্ছে আপনি খুব বেশি চিন্তিত, কষ্ট ও পাচ্ছেন।

–           হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ।

–           আমি কি আপনার মাথার চুল টেনে দেব?

– না না, তার দরকার হবে না।

–  আপনি না হয় শুয়ে পড়ুন আমি আপনার মাথা ম্যাসেজ করে দেই।

–           আসলে আমি একটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না, ভাবতে পার আমার নিজের ছেলে আজ আমাকে ভাই ডাকল, অথচ আমার এই ছেলেটি আমাকে সব থেকে বেশি শ্রদ্ধা করে।

–           কাকাবাবু, আমার মনে হয় উনি আপনাকে অসম্মান করে কিছুই বলেননি।

–           এ তুমি কি বলছ মা? নিজের বাবাকে ভাই বলল আর বলছ অসম্মান করে কিছু বলেনি?

–           উনি হয়ত এসব বলতে চাননি তবু হয়ে গেছে।

–           কিন্তু হঠাৎ এমন কেন করল? তুমি কি ওকে একটু ডেকে পাঠাবে?

–           কাকাবাবু আসলে উনি খুব শৌখিন একটা মানুষ, আজ উনার বরশী কে যেন অর্ধেক করে ভেঙেছে, তাই হয়ত উনি ওসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেছেন।

– তাই?

– হ্যাঁ।

–           এটাই তাহলে সত্য।

–           আমারও তাই মনে হয়।

–           রূপকথা মা?

–           জি কাকাবাবু?

–           তুমি আমাকে অনেক বড় একটা টেনশন থেকে বাচালে মা। তোমাকে ধন্যবাদ।

রূপকথা সেকথার উত্তরে কিছু বলে না।

–           রূপকথা, অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমাতে যাও। খেয়েছ মা?

–           জি কাকাবাবু খেয়েছি।

–           এখানে থাকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?

–           না কাকাবাবু।

–           যে কোন সমস্যা হলে আমায় জানাবে, একটুও লজ্জা পাবে না।

–           জি কাকাবাবু জানাবো।

–           আচ্ছা মা তুমি এখন যাও।

–           নমস্কার।

–           ওয়ালিকুম সালাম।

রূপকথা নমষ্কারের বিনিময়ে ওয়ালিকুম সালাম শুনে মূদু হাসল তারপর চলে গেল। মায়া ওর নিজের ঘরে পড়ছে। রূপকথা মোবারক হোসেন সাহেবের ঘর থেকে যাবার সময় মায়ার ঘরে ঢুকল।

– আসতে পারি?

– সিওর। দিদি কেমন আছ তুমি?

রূপকথা বসতে বসতে বলল

– ভাল আছি, তুমি যে খুব ভাল আছ সেটা কিন্তু তোমায় না জিজ্ঞেস করেও আমি বুঝতে পারছি।

মায়া লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে বলল

– কি করে বুঝলে?

– যে ভাবেই বুঝি কথাটা কিন্তু সত্যি। তাই না?

– হ্যাঁ সত্যি।

– বাবা ভাই ডাকটা কিন্তু বেশ সুন্দর তাইনা?

রূপকথার মুখ থেকে হঠাৎ এ কথা শুনে মায়া অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমতা আমতা করতে করতে ও বলল

– ও ভোলাদা, সরি দিন ভাইয়ার কথা বলছ? ও আসলে একটু উল্টাপাল্টা হলেও বেশ ভাল।

– আমি ভাইয়ার কথা বলছি না, আমি তোমার কথা বলছি।

– আমার কথা?

– হ্যাঁ তোমার কথা। কেও না জানলেও আমি ঠিক ই বুঝতে পেরেছি কাজটা তুমি ই করেছ। কি, ঠিক না?

মায়া হো হো করে হেসে উঠল।

– দিদি তুমি ঠিকই ধরেছ।

– দিন দাদার বরশীটা কে ভেঙেছে তাও কিন্তু আমি জানি।

– কে?

– পাপন, তাই না?

মায়া হাসূচক মাথা নাড়ায়।

– ও কেন ভেঙেছে সেটার পেছনে আমি যুক্তি দাড় করিয়েছি।

– কি যুক্তি?

– তোমার দেওয়া বিখ্যাত চুরিবিদ্যা রপ্ত করতে গিয়ে। অর্ধেক চুরি, অর্ধেক রেখে দেওয়া, তাই তো?

– কিন্তু আমি তো ওকে বরশী ভাঙতে বা চুরি করতে বলিনি।

– তাহলে শোন ব্যাপারটা, দিন দাদা পুকুরে মাছ ধরছিল, আমি আর তরী দিদি গিয়েছিলাম পুকুর পাড়ে। পাপন গিয়ে দাদাকে বলল- “মামা আমায় মাছ ধরতে দেবে?” দাদা তখন বলল- “এখন না পরে।” তখন পাপন বলল- “মামা আমিও তোমার মত একটা বরশী কিনব, মামা তোমার বড়শির দাম কত?” তখন দাদা বললেন-“শখের জিনিসের কি দাম হয় রে ব্যাটা? এই বড়শির দাম লাখ টাকারও উপরে।” আমার যেটা মনে হয় এই লাখ টাকার কথা শুনে ই পাপন এই কাজটা করেছে। আর তুমি এ কাজটা কেন করেছ তা আমার কাছে পরিষ্কার না হলেও আমি একটা জিনিস আইডিয়া করেছি।

– কি?

– কাকাবাবু হাসপাতালে সবার সামনে তোমায় ধমক দিয়েছিল সেটা ই কি কারণ?

– দিদি তুমি মিসির আলির নাম শুনেছ?

– সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের লেখা জনপ্রিয় চরিত্র।

– হ্যাঁ ঠিক ধরেছ, তুমি উনার কোন বই পড়েছ?

– একটা পড়েছি, বৃহন্নলা।

– আমি সব পড়েছি, আমার দারুণ লাগে। দিদি, তুমি তো মিসির আলি পর্যায়ের বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা কর, এমন একজন বাড়িতে থাকলে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, কিন্তু দিদি তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

– মায়া তোমাকেও আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এসব ছেলেমানুষি করলে কি হবে মায়া?

– কি করব বল, আমি তো চাই গিট্টু না লাগাতে, কিন্তু  গিট্টু না লাগালে যে কিছুতেই থাকতে পারিনা।

– এই গিট্টু আর কতদিন চলবে?

– জানিনা যে। দিদি আমি আজ রাতটা তোমার সঙ্গে ঘুমব। তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগছে।

– কিন্তু তোমার পড়ার ক্ষতি হবে যে।

– কোন ক্ষতি হবেনা, আমি আজ তোমার সঙ্গে ঘুমচ্ছি এটাই ফাইনাল।

– ঠিক আছে।

– দিদি তুমি আর কতদিন থাকবে আমাদের বাড়ি?

– আর ১৯ দিন।

– ইষ্ যদি সারাজীবন থাকতে!

– চলে তো যেতে হবেই।

– দিদি আমি যদি কোনদিন তোমাকে নিয়ে গিট্টু লাগিয়ে ফেলি তুমি কি আমার উপর খুব রাগ হবে?

রূপকথা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ওর মুখটি হঠাৎ  ভারী হয়ে গেল, চোখটাও ছলছল করে উঠল।

–           দিদি কিছু বললে না তো? গিট্টু লাগিয়ে ফেললে রাগ হবে?

–           তুমি যেটা ভাবছ সেটা হয়না মায়া।

–           কেন হয়না দিদি?

–           তুমি কল্পনার জগৎ এ আছো, বাস্তব তো সেখান থেকে বহুদূর। আমি এসেছি, চলেও যাব সেটাই তো নিয়ম, তাইনা? অযথা এসব ভেবে লাভ কি বল?

রূপকথা আর কোন কথা না বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল। সেই রাতে আর রূপকথার সঙ্গে ঘুমানো হয়নি মায়ার।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to ফানুস-5

You must be logged in to post a comment Login