গল্পঃ-একটি ওয়েটিং রুম ও কিছু জলছাপ
একটি ওয়েটিং রুম ও কিছু জলছাপ
-রাবেয়া রব্বানি
(১)
সাড়ে এগারোটার ফ্লাইট। এখন বাজে সাড়ে দশটা। এমনিতেই এয়ারপোর্টের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা আর জেল খাটা আমার কাছে একি রকম লাগে তার উপর সিগারেট খেতে উঠে বাইরে যাওয়া যাবে না ভেবে আরো বিরক্ত লাগছে।
-ভাইয়া এই এক ঘণ্টা কি করা যায়?
উত্তর অপেক্ষা না করে প্রশ্নটা সিগারেটের ধোঁয়ার মত ভুস করে ছেড়ে দিল রাহুল, আমিও উত্তর দিলাম না। সে কানে ইয়ার ফোন গুজে নিলো, ছেলেটার মাঝে তথাকথিত ডুড ভাব প্রবল।
দেশে আসলেই প্রায়ই আত্মীয় পরিজন সব ঠেলেঠুলে কক্সবাজার চলে যাই। এবার ছোট ফুফুর এই ছেলেটি আগে থেকেই কাঁধে চড়ে ছিল, আমার বাবা তাতে আহ্লাদিত হয়ে একেবারে মাথায় তুলে দিলেন। রাহুল আমার বয়সে বেশ কিছু ছোট, কিছুদিন আগেও কিশোর হিসাবেই দেখেছি তাই সখ্যতা একেবারেই কম ।কিন্তু তাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই খুব বেশি সহজ স্বচ্ছন্দ। এবার বোধ হয় আমার প্রবাসী ক্লান্ত মনটাকে প্রিয় সমুদ্রটির কাছে জমা রাখতে পারব না। রাহুলের ব্যাগ আর সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে কক্সবাজার গিয়ে সে আমার মাথায় কত্থক নৃত্য নাচবে।
হাতের পত্রিকাটি ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হল। সময় কাটানোর জন্য কোন কিছুতেই মনযোগী হতে পারছি না। এলোমেলো চোখ বুলাতে থাকলাম ওয়েটিং রুমে ঢুকতে থাকা মানুষগুলোর উপর। মনে হয় ডোমেস্টিক ফ্লাইটে বেশির ভাগ পারিবারিক ট্যুরে যাচ্ছে মানুষ। চোখে মুখের ছুটি ছুটি আমেজ আর উৎসাহে এদের সহজেই আলাদা করে ফেলা যাবে। হঠাৎ চোখে প্রশান্তি এনে দেয় এমন নীল কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি মেয়ে নীল আর আবছা রূপোলী সালোয়ার কামিজে সিকিউরিটি পার করল। বয়স হয়ত বাইশ থেকে পঁচিশের মাঝামাঝি হবে। মেয়েটির সাথে একটি কিশোর আর একটি মাঝ বয়সী পুরুষ। তারা আস্তে আস্তে এদিকেই এসে আমাদের বাম পাশ বরাবর সারিতে বসল। এখন আমার আর নীল রঙ্গা মেয়েটির মাঝখানে শুধু মানুষ চলাচলের ছোট ফাকা জায়গা।
সেল ফোনটা বেজে উঠায় আমি কিছুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে যাই। কথা বলতে বলতে বে-খেয়ালী চোখ সারা ঘরটা চষে বেড়ায়। একটা ছুটতে থাকা দুরন্ত শিশু, তার পেছনে ব্যস্ত মা, পেট কাঁপিয়ে হাসা মধ্যবয়স্ক লোক, চুইংগাম চিবাতে থাকা তরুণী, এয়ার লাইন্স গুলোর সার্ভিসিং এর মানুষ, সোনালী চুলো এক বিদেশিনী ঘুম ঘুম চোখ, কবুতরের জোড়ার মত এক দম্পতি, গুটিসুটি মেরে বসে থাকা খুব উদ্বিগ্ন চেহারার এক তরুণ, তারপর নীল রংটার ভেতর এক উজ্জ্বল মানবী। আমার দৃষ্টি এখানে এসে থেমে গেলো। এবং থেমে থাকতে চাইল।
হঠাৎ এই ওয়েটিং রুমটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, যেন একে নতুন করে দেখার কিছু নেই এটার নারী-নক্ষত্র আমার চেনা। মেয়েটির দিকে চোখ বার বার চলে যাওয়ার কারণ এখন বেশ খানিকটা স্পষ্ট হতে থাকল আমার কাছে। আমার চোখ আবার নীল রঙ অনুসরণ করে। মেয়েটি হয়ত অন্য কিছু ভাবছে। আসলে যে তা নয় তাকে তা বোঝানেরও কোন উপায় নেই। এই পরিস্থিতি আমার জন্য নতুন নয়। এ ক্ষেত্রে বিস্ময়ের সাথে অস্বস্তি হয় প্রচণ্ড।
অস্বস্তি এড়াতে নিজের নোটবুকটা বের করি। আমার কাছে এই পরিস্থিতিতে ব্যস্ত থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হল নিজেকে নিজে লেখা। এরমধ্যে আমার বেয়ারা চোখ আর একবার মেয়েটির মুখ ঘুরে এলো। সে এবার ওয়াশ রুমে গিয়ে তার মুখ ধুয়ে এসেছে, তার চোখের কাজল বেশ খানিক ছড়িয়ে গেছে, সারা মুখে যুবতী বিড়ালীর মতো খুব মোলায়েম মায়া, গোলাপি ঠোট প্রসাধন হীন। হঠাৎ মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। এতক্ষণ অন্যমনস্ক ঝোঁকে তাকালেও এই প্রথম মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ বোধ করলাম। আমি হ্যাঙলার মত মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকি না কারণ আমাকে দিনে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন মোটামুটি সুন্দরী মেয়ের মুখোমুখি হতে হয় এবং এই কারণে মেয়েরা আমার কিছুটা চোখ সওয়া। তবু চোখ নামাতে খানিক সময় নিলাম, অবশ্য মেয়েটাও সময় নিলো। কেন জানি আমার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই লিখতে শুরু করি, আমাকে আমার চিঠি ,
-মেয়েটির ভেজা মুখের নরম মায়া, ওয়েটিং রুমটির মানুষগুলোর ব্যস্ততার প্রলেপ খুলে রাখা মুখ, খুব সুন্দর শীতের সকাল! আপনার সিগারেট এবং স্কেচ দুটোতেই মন টানছে তাই না মিঃ শান্তনু? কিন্তু আপনি ভয়াবহ অস্বস্তি আর টেনশনে ডুবে যাচ্ছেন। আপনার কাছে মনে হচ্ছে এই সকালটা পাশের সব দৃশ্য, সমুদ্রের মত নীল রঙ্গা মেয়েটি সহ ঘটনাটি আগেই ঘটেছে। দৃশ্যগুলো পুরোনো একটি ছবির মত। আসলে তা ঠিক নয়। আচ্ছা ধরুন ঘটনাটি যদি আগেই ঘটে থাকে তাহলে বলুন তো এর পরের মুহূর্তে কি হবে? চুপ করে আছেন যে ?পারছেন না তাই তো?এর মানে হলো ডিজ্যাঁভু ডিসঅর্ডারটা আবার ভর করল। এর পরেই ভয়াবহ ডিপ্রেশনে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা। মিঃ শান্তনু আপনি মেয়েটার দিকে তাকাবেন না। আপনি বরং আপনার মৃত মাকে চিঠি লিখুন। মৃত মানুষকে মন খুলে সব বলতে পারার কথা।
………………।।
আমি আমাকে লেখা চিঠিটা বেশিদূর নিতে পারলাম না। অবচেতন ভাবে মাকে চিঠি লেখার নামে বের হয়ে এলাম। আবার প্রচণ্ড কৌতূহলে তাকাতে চাইলাম চারপাশটায়, মেয়েটার দিকে। ডিজ্যাঁভুর সময় পরিচিত লাগতে থাকা দৃশ্যগুলো যেমন অস্বস্তি তৈরি করে তেমন দেখার একটা নেশাও থাকে যা খুব টানে। রাহুলের মধ্যে হয়ত কিছু ভদ্রতা আছে সে আমার লেখায় উকি দিলো না তবে দু’ বার কি যেন বলল। আমি ইচ্ছে করেই শুনেও শুনলাম না। তাড়াতাড়ি মায়ের সাথে কথোপকথনে ডুবে যেতে চাইলাম।
মা,
তুমি জানো? এখন আর স্কেচ করতে পারি না। মানুষের মুখ স্কেচ করতে গেলে তার ঠোঁটে এমন হাসি দিয়ে দেই মনে হয় সে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন করছে। আর প্রকৃতি আঁকতে গেলে সভ্যতার অসুখগুলো বিকৃত ভাবে ফুটে উঠে। চোখ বুজে কিছু কল্পনা করতে গেলেই ভাসে ডিএনএ’র মত জড়াজড়ি করে থাকা সংখ্যা।
সিঙ্গাপুরে দু দুটো ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক হয়ে বসে আছি কিভাবে, এখন ভাবলে দুঃস্বপ্নের মত লাগে, মা। মনে হয় আমি একটা যন্ত্রের ভেতর হাত পা ঢুকিয়ে বসেছিলাম,হঠাৎ আটকা পড়ে গেছি আর বেরোতে পারছি না। শুধু মাথার মধ্যে সংখ্যাগুলোই ঘুরপাক খায়, ডিগবাজি দেয়, সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছে হয় লাথি মেরে চলে আসি কিন্তু সব গেড়ে বসে গেছে একেবারে। আসতে গেলে নিজেকে অর্ধেক ছিঁড়েই আসতে হবে।
জুরং এ আমার অফিসে বসে বসে সি সি ক্যামেরা দিয়ে ওত পেতে তাকিয়ে থাকা, সেলস ম্যানের ভুল ধরা, কাগজে, পিসিতে ফুটে থাকা সংখ্যা আমার মাথায় পোকার মত অদ্ভুত সম্মিলিত গুঞ্জন শুরু করে। আমার প্রায়ই প্রচণ্ড ইচ্ছে হয় মগজটাকে মাথা থেকে খুলে রেখে দেই। স্লিপিং পিল খেয়ে কত রাত পার করি মা। অথচ তুমি বলতে আমি নাকি কুম্ভকর্ণ।
মা, সবচেয়ে মজার কথা কি জানো? তোমার বোনের যেই মেয়েটিকে হারিয়ে, টাকা কে জীবন মনে হলো, এবার তোমার মৃত্যু বার্ষিকীতে তাকে দেখে, কথা বলে হতাশ হয়ে গেলাম। সে এখন বিশাল দেহের , গয়নার আবরণে মোড়া এক স্থূল মনের মহিলা। আমি খুঁজেও তার মাঝে আগের শ্যামাকে পেলাম না। আর এই মেয়েটির বিরহেই আমি কিনা পয়সার পেছনে ছুটে ব্যবসায়ী আর দোকানি হয়ে গেলাম। হা! হা!
ভালো কথা না লিখে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয় এমন কথাই লিখে ফেলছি। মাকে আর লিখতে ইচ্ছে হলো না। নোটবুক নামক বস্তুটাকে অহেতুক ভারী লাগতে লাগল। সিগারেটের তৃষ্ণাটাও মাথা চাড়া দিল। হঠাৎ রাহুল তাড়া দেয়,
-ভাইয়া আমাদের ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জাররা এখনই যাবে।
আমি নোটপ্যাড থেকে আবার ডিজ্যাঁভু নিয়ে বের হয়ে এলাম আবার পরিচিত লাগতে থাকা ওয়েটিং রুম, আর মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে ফুটে থাকা মেয়েটির জগতে। আমরা প্লেনের উদ্দেশ্যে ওয়েটিং রুম থেকে বেরুচ্ছি, সাথে নীল রংটাও। সরাসরি না তাকালেও চোখের সীমানায় রংটি ঠিকঠাক জানান দিচ্ছে।
(২)
ওয়েটিং রুমে ঢুকেই ধুসর কোর্ট পড়া লোকটাকে চোখে পড়ে। ভিড়ের মধ্যেও কিছু মানুষ কেমন করে যেন আলাদা হয়ে থাকে।এই লোকটাও তেমন, পুরো ওয়েটিং রুমে এতগুলো মানুষের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই রহস্য বুঝতেই হয়ত আমার অবচেতন মন আমার দৃষ্টিকে বার বার সেখানে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। তা না হলে পুরুষ মানুষে আমার আলগা ঝোঁক নেই। মামাও কি মনে করে তাদের বরাবর সারিতেই আমাদের বসার জায়গা করে নেন। বসার পর লোকটা অন্য দিকে তাকালে আমি তাকে ভালো করে দেখে নেই। বয়স ত্রিশোর্ধ হবে হয়তো, দীর্ঘ দেহ, রিম-লেস চশমায় বেশ স্বচ্ছতা, গায়ের রঙ শ্যামলা, তীক্ষ্ণ নাক, চোখ তেমন বড় না আবার ছোট না, চেহারায় নিখুঁত ভাব প্রবল কিন্তু তাতে মেয়েলী কোন অবয়ব নেই। একটু বড় চুল পেছনে ঝুটি করা অথচ ব্যক্তিত্ব আর ভদ্রতা তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। পোষাকে পরিপাটি ভাবটা একটু বেশি। আমার মনে হচ্ছে লোকটা প্রবাসীই, সাধারণত দেশের বাইরে থাকা লোকদের মধ্যে এমন একটা আলগা চটক থাকে। অবচেতন কৌতূহল মেটে কিছুটা। লোকটার চোখে চোখ পড়ার আগেই আমি পিয়ালের দিকে মুখ ফেরাই।
আমরা যাচ্ছি কক্সবাজার, মামার বাড়ি। আমি, মামা আর আমার ছোট ভাই পিয়াল। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর মামা নিজে এসে আমাদের নিয়ে যান। এমনিতে আমরা প্রতিবার বাসে যাই কিন্তু এবার পিয়ালের আবদারে প্লেন চড়া। আর এবার মামার উৎসাহ-উদ্দীপনাও একটু বেশি। ওনার মতে ওখানকার সবচেয়ে যোগ্য পাত্রের সাথে তিনি আমার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন কারণ আমাকে যে তাদের পছন্দ হবে এই ব্যাপারে মামার কোন সন্দেহ নাই। ছেলে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি থেকে মাস্টার্স, বয়স কম হলেও মামার সহকর্মী, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিটিতে বেশ ভালো পোষ্টে আছে ,পাশাপাশি কিছু হোটেল আর গো-কার্ডের বিজনেস আছে ,পারিবারিক সম্পত্তির লিস্টও বিশাল। মাও এবার আমার ব্যাগ বিশেষ ভারী করে দিলেন, বললেন ‘ঘুরতে টুরতে যাবি জামা কাপড় তো লাগবেই’। আমি কিছু বলিনি। বিয়েতে আমার তেমন মত না থাকলেও আমি আমার সংসার-পোড়া বিধবা মাকে হতাশ করি না। আসার সময় মা এমন মুখ করে ছিলেন মনে হচ্ছিল আমার বিয়ে হয়ে গেছে আর আমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি, আমার যথেষ্ট বিরক্ত লাগলেও বুঝাইনি। সিএনজিতে বসে ভারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে বসে আমিও ইতিবাচক বিদায় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি তোমরা রাজী হলে আমিও রাজি।
মনে হচ্ছিল এবার মামার বাড়ি নয় এক অজানা গন্তব্যে যাচ্ছি তবে এয়ারপোর্টে আসতে আসতে জানুয়ারি মাসের ধুলোময় ঢাকার কিছু ধুলো সারা শরীরে, চুলে মেখে এসেছি। আমার ধুলোতে খুব অস্বস্তি তাই ওয়াশ রুমে গিয়ে মুখ ধুতে গেলাম। ফিরে আসতে আসতে আঁচ করি লোকটি আমাকে দেখছে। এমনিতে পুরুষরা তো তাকায়ই কিন্তু আমি যার প্রতি কৌতূহল বোধ করছি সেও আমাকে কেমন কৌতূহলী চোখে দেখছে তা বুঝতে গিয়ে একটা ভীষণ একটা চোখাচোখি হয়ে গেলো। একটা সুন্দর দৃশ্য দেখার মত লোকটার চাউনিতে আমি মুগ্ধ হলাম, চোখ নামাতে সময় নিলাম হয়ত তাই। ছিঃ লোকটা হয়ত ভাবছে আমি কেমন না কেমন মেয়ে!নিজের কাছে নিজে লজ্জা পেয়ে ব্যাগ হাতড়ে ম্যাগাজিন খুঁজতে থাকি। হঠাৎ আমার ছোট ভাই পিয়াল আমার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে প্রশ্ন করে,
-আপু প্লেনে উঠলে বমি আসে?
-নাহ!কে বলল?
-শান্ত। ও যখন বাবা-মার সাথে টার্কি গিয়েছিল তখন নাকি ওর বমি এসেছিল।
মামা আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
-দুর!ওটা বড় জার্নি তে হতে পারে এখানে খুব কম সময় মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। কিচ্ছু হবে না। জুই, আমার ব্যাগ থেকে ঔষধের বাক্সটা দে তো!
আমি মামাকে ঔষধের বাক্স দেই। পিয়াল তবু শান্ত হয় না। মামাকে নানান প্রশ্ন করতে থাকে।
বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কাজ নেই। মামা আর পিয়াল খেলা নিয়ে কথা বলছে এখন, যার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। আমার ডানদিকের বরাবর সারিতে বে-খেয়ালী চোখ বুলাতেই দেখলাম লোকটা খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছে। তার ওপাশে জানালার পাশে বসা একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে নিজের চূলে এমন ভাবে হাত বুলালো, যেন সে আমাকেই ছুলো। ছেলেটা হেসে মিষ্টি ইশারা করতে চাইলো। নিজের অবাধ্য চোখের উচিত শিক্ষা হয়েছে, ভাবলাম। আমি তাড়াতাড়ি ঘুরে পিয়াল আর মামার গল্প মনোযোগী হতে চাইলাম। তাদের কথার ভিতর নিজেকে জোড় পূর্বক ঢুকিয়ে দিয়ে প্লেনে উঠার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
আমরা এখন একি ফ্লাইটের লোকেরা এয়ারপোর্টের গাড়ী করে প্লেনের কাছে যাচ্ছি। গাড়ীতে লোকটাও যাচ্ছে। লোকটাও যে একি এয়ারলাইন্সের একি ফ্লাইটেই যাচ্ছে এটা দেখে কেন জানি ভালো লাগল। তবে এবার আর তাকালাম না।
প্লেনের কাছাকাছি আসতেই পিয়াল অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ল, সে কল্পনার সাথে বাস্তব মিলাতে চাচ্ছে। আমার কাছে একদম ভালো লাগছে না। ডোমেস্টিকের বেলায় প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের প্লেনগুলো তুলনামূলক ভাবে ছোট হয় শুনেছিলাম, আসলেও তাই। এয়ার-হোস্টেজের সাথে মেকি হাসি বিনিময় করে ভেতরে ঢুকতেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।এই জানুয়ারি মাসেও প্লেনটি প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে। ভেতরটা অনেক চাপা বসার আর জায়গা এত ছোট যে তেমন নড়াচড়াও করা যাবে না ।আমার মনে হলো এর চেয়ে লোকাল বাসও বুঝি ভালো। অনেকেই একটু জোড়ে বিরক্তিতে একি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে ‘এসি কাজ করে না নাকি?’হঠাৎ পিয়াল বলল,
-আপু আমার বমি আসছে। অনেক গরম!
-কিচ্ছু হবে না। তুমি এই পাশে আসো।
আমি উঠে আমার জায়গা ছেড়ে ওকে জানালার পাশে বসতে দেই যাতে ও বাইরের দৃশ্য দেখতে পায় আর বমি ভাবটা কমে। মনে হলো ভেতরে ঢুকে পিয়াল বেচারাও কিছুটা হতাশ। মামা পাশের সিট থেকে আমাদের ইশারায় বেল্ট বাধতে বললেন। আমরা বেল্ট বেধে টেক অফের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি আর মনে মনে বলতে লাগলাম ‘আল্লাহ!স্বপ্নের মত দ্রুত কক্সবাজারে পৌঁছে গেলেই বাঁচি!’
রানওয়ে পার করতে করতে প্রচণ্ড স্বরে প্লেনের ইঞ্জিন আওয়াজ করে টেক অফের জন্য রেডি হচ্ছে। পিয়ালের মুখে হাসি আর ভয় মিশ্রিত অনুভূতি। সে শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে। আমিও কিছুটা উত্তেজনা বোধ করছি। মাধ্যাকর্ষণ অস্বীকার করে এই প্রথম আকাশে উড়ব। হঠাৎই আওয়াজ অনেকটা কমে গেলো। অভিজ্ঞতা না থাকলেও চট করেই আমার মনে হল কিছু সমস্যা আছে। এবং হলোও তাই, প্লেন থেমে গেলো। এয়ার-হোস্টেজ মেয়েটি হাসিমুখে চমৎকার বাংলায় এসে জানালো, “ সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ যান্ত্রিক ট্রুটির কারণে আমরা কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি ঘোষণা করছি। অপেক্ষা করে আমাদের সহায়তা করার জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনাদের দুপুরটা সুন্দর হোক”।
বাংলাদেশের ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্সের ওয়েটিং রুমটিতে স্মোকিং জোন নেই। সিগারেটের জন্য যাকে বলে পেট পুড়ছে। এমনিতেও কিছুদিন হয় সিগারেটের তৃপ্তি নিয়ে একটা আক্ষেপ চলে এসেছে। কারণ সিঙ্গাপুর থেকে আনা ব্র্যান্ড ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছি ইদানীং বাংলাদেশি একটা ব্রান্ড নিয়েছি যেটা দেশে থাকতে মন ভরে ফুঁকতাম, এখন কিনা সেটা পানসে লাগছে। অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারছি না আগে পাওয়া ব্রান্ডটার আমেজ। এর মধ্যে ওয়েটিং রুমটি এখন আর আগের মত নাই। মানুষের মাঝে উত্তেজনা ,উৎকণ্ঠা দুই কাজ করছে। মুখগুলোর নির্মল ভাব টা যেন হাওয়া হয়ে গেছে। ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথায় বোঝা যাচ্ছে প্লেনের সমস্যা গুরুতর। হয়ত ফ্লাইট বাতিল হবে। এক লম্বা চওড়া প্রৌঢ় বলছেন “ঠিক হলেও তো উঠা উচিত না কারণ কি ধরনের যান্ত্রিক ট্রুটি তা তো প্লেন কর্তৃপক্ষ বলেনি। যদি মাঝ পথে আবার এমন হয়”! তার স্বর উঁচু এবং নেতৃত্ব স্থানীয়। মনে হচ্ছে এক সময় বড় সরকারী আমলা ছিলেন। কারণ একমাত্র রিটায়ার্ড সরকারি আমলাদের বয়স বাড়লেও ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাস না কমে বরং দ্বিগুণ হয়। লোকটার কথায় মানুষের অস্পষ্ট গুঞ্জন বাড়ে। তবে জটলাটা বেশিক্ষণ থাকে না। লোকজন আস্তে আস্তে যে যার মত আলাপ করতে করতে কম বেশি বসে পড়ে।
রাহুল হঠাৎ এসে ধপ করে বসল,
-ভাইয়া ওরা বলছে লেট হবে,এবং দুপুর হয়ে গেলে লাঞ্চ ওরাই করাবে। কিন্তু ফ্লাইট ক্যান্সেল না। ঠিকঠাক করে একবার ট্রায়াল দিয়ে তারপর ফ্লাই করবে। আশেপাশের মানুষেরা যা বলছে সব রিউমার।
-চশমা পড়িয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে।
-মনে হয় না। তাহলে বেরোতে হবে। একজন দুজনকে ঘুস দেয়া যায় কিন্তু এখানে তো অনেকগুলো চোখ। একজন বেরোলে কালার হয়ে যাবে না?
-হুম।
-আমি নিরীহ আবদার করে দেখি।
রাহুল উঠে যায় সার্ভিসিং এ কথা বলতে । সিগারেটের জন্য চট করে রাহুল কে ঘুসের কথাটা বলে ফেললাম। বেশ কিছুদিন হয় দুর্নীতির সাথে অভ্যাসে জড়িয়ে গেছি। আমার দুটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালাতে বেশ কিছু বিক্রয় কর্মী লাগে। থাই বা চীনাদের সাথে কাজ করতে, আধো থাই আধো ইংরেজিতে কথা বলতে ভালো লাগে না আর আমি এদের সহ্য ও করতে পারি কম তাই বাংলাদেশ থেকে লোক নেই। ভিসার শর্ত অনুযায়ী এদের মাস্টার্স কোয়ালিফাইড হতে হয়। কিন্তু অনেকেই মাস্টার্স থাকে না। বাংলাদেশে আমার কিছু লোক আছে যারা ভুয়া সার্টিফিকেট করে দেয় আর আমি অনায়াসে তাদের সিঙ্গাপুর নিয়ে আসি। পণ্যের মধ্যে ভেজাল না মিশালেও, ভালো চালিয়ে দেই। কর্মচারীদের মাঝে মাঝে অহেতুক মালিকানা ভাব দেখাই। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় ঘুস দেই। আসলে ঠিক দোকানী হওয়ার পর থেকেই দুর্নীতি আমার মজ্জাগত হয়ে গেছে।
রাহুল ফিরে এসে তার অপারগতাই জানায়। ওকে এখন আর বিরক্তির লাগছে না। আমাদের এয়ারলাইন্স থেকে যাত্রীদের টুকটাক খাবার দেয়া হচ্ছে কেক,জুস,বিস্কিট ইত্যাদি। সবাই কম বেশি ক্ষুধার্ত তাই আগ্রহ নিয়েই সবাই সেগুলো নিচ্ছে , আমিও নিলাম। রাহুল টুকটাক কথা বলছে আর আমি খাচ্ছি। ওর কিছু কথায় স্পষ্ট হিন্দু ধর্মের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা শুধু নয়, সে ধর্ম বিরোধী এবং কমিউনিজম এর প্রকট গন্ধ। আমি বিশেষ আস্তিক নই। ধর্মের প্রলেপ মেখে বসে থাকি না কিংবা ধর্ম চিন্তা আমাকে বুদ করে না কিন্তু নাস্তিক ব্যাপারটা তেমন নিতে পারি না। হিন্দু ধর্মের গঠনগত দিক আমাকেও ভাবায় তবে ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার স্বভাবগত। একা একা ঈশ্বরের সাথে কথা বলি অনেক। ডিজ্যাঁভুর সময় ঈশ্বরকে ছেলেমানুষি চিঠিও লিখি। আমি রাহুলের কথায় তাল, বেতাল কিছুই দেই না। ওর কথায় তারপরের আদলে ছোট্ট ছোট্ট হুম ছুড়ে দিয়ে খাওয়া শেষ করি।
প্লেনে উঠে ভেবেছিলাম এই তো আর কিছুক্ষণ আমি চোখ বন্ধ করে এই ডিজ্যাভুর পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে যাব। কিন্তু প্রকৃতির এমন পরিকল্পনায় আমি আরো হতাশ বোধ করছি ।মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেড়িয়ে এলো,
-শালা জেলে এসেছি।
আমার কথায় রাহুল খুব হাসল।
-ভাইয়ার কি খুব খারাপ লাগছে সিগারেটের জন্য?থ্যাঙ্ক গড আমি সিগারেট খাই না।
প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে রাহুল বলল,
কবিতা শুনবে? জেল নিয়ে নাজিম হিকমতের রিলেটিভিটি ঘেঁষা একটা কবিতা আছে। এই সেদিনই মাত্র গলায় তুললাম। বলে, সে জড়তে হীন আবৃতি শুরু করে দিল-
জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুনে গুনে দশবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে
পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো,বলবে-
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল
আমি বলব-
‘না, আমার জীবনের দশটা বছর’।
আরো বড় পুরোটা শুনবে?
-হুম।
২
যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে খইয়ে ফেলতে এ হপ্তাও লাগে নি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে;
‘একটা গোটা জীবন’
আমি বলব:
‘এমন আর কী, মোটে তো একটা সপ্তাহ।“
খুব জোরে না আবার আস্তেও না, এমনই একটু চাপা, তবু চমৎকার স্বরে আবৃতি করে যাচ্ছে রাহুল। এই কবিতাটি আগেও কবি বন্ধুদের কাছে শুনেছি আজ অনেকদিন পর কবিতাটির ভাব খুব করে মনে ধরল। রাহুলের আবৃত্তিতে সতর্কতার চেয়ে আবেগই বেশি । এই ছেলেটাকে কিনা আমি এতদিন ডুড খেতাব দিয়েছিলাম মনে মনে। আমার দোকানী চোখ এখন দ্রব্যই চিনে, মানুষ চিনতে পারে না। আমি কবিতার ভেতরে একেবারে ডুবে গেলাম, আনমনে সরে গেলাম ওয়েটিং রুম থেকে।কবিতাটি শেষ হলো,আর আমার এই ডুবে যাওয়া মন আবার ভেসে উঠল সেই কাজল মায়া মাখানো মুখে। মেয়েটি সাথের ছেলেটির সাথে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে, একটু হাসছে। এই চাউনি আর হাসি খুব দেখেছি এ জনমে নয় যেন হয়ত পাঁচশ বছর আগে। আমার অনুভূতিটা জীবনানন্দের সেই কবিতাটির মতো
“কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি
কবে যেন রাখিয়াছি হাত
তার হাতে কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড়
ঝড়ে গেছে কবে যেন, এ জনমে নয় যেন এই পাড়া গাঁর
পথে তবু তিনশো বছর আগে হয়তো বা আমি তার সাথে
কাটিয়েছি পাঁচশো বছর আগে হয়তোবা সাতশো বছর…………
কি অদ্ভুত রকম মিলে গেলো কবিতাটি। মনে হচ্ছে জীবন বাবু ডিজ্যাঁভু নিয়েই কবিতাটি লিখেছে কিংবা তিনি কি নিজেকে জাতিস্মর ভাবতেন?
(৪)
যে গাড়ি করে প্লেন পর্যন্ত এসেছিলাম, সে গাড়ী করেই আবার ফিরে যাচ্ছি ওয়েটিং রুমে। পিয়াল একেবারে চুপ হয়ে গেছে। চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি ওর মন খারাপ। সব মানুষই হয়ত এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছে। মামা পাশের লোকটির সাথে কথা বলছেন। সময়মত যেতে না পারায় লোকটির নাকি বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো। লোকটা হঠাৎ একটু জোড়ে বলে উঠল, “ফালতু এয়ারলাইন্স যত্তোসব”। মামা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকালো। ড্রাইভার শুনতে পেলো কিনা বুঝা গেলো না তবে সামনের দিক থেকে সেই ধুসর কোর্ট পড়া ভদ্রলোক ফিরে তাকালো । ভ্রু-জোড়া ভীষণ রকম কুচকে আছে। আমার এখন মনে হচ্ছে লোকটার সুন্দর চেহারাই আমাকে টানছে আর কিছু নয়। কিংবা এমন লোককেই আমি সুন্দর ভাবি বা আমার ভালোলাগার প্রতিরূপ লোকটি। তা না হলে আমি কি লোকটাকে চিনি? কি জানি কেমন লোক। আমি অবাধ্য চোখ ফেরাই।
আবার সেই ওয়েটিং রুম। এখন মনে হচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকতে হবে। বসে বসে মানুষের মুখ দেখা ছাড়া কাজ নাই। সামনে একটা টিভি আছে ঠিকই তবে এখান থেকে কথা বুঝা যাচ্ছে না। বোবা বাক্স দেখতে ভালো লাগল না।
এখন অনেকের মুখই মুখস্থ হয়ে যাবে রাস্তা ঘাটে দেখলে মনে হবে আরে!আমরা তো একি ওয়েটিং রুমে ছিলাম। আবার ফিরে এসে আমাদের ফ্লাইটের লোকজন যেন মানসিক প্রস্তুতির সাথে সাথে শরীরও ছেড়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে তারা ধরেই নিয়েছে অনেক দেরী হবে। মানুষগুলোর ভদ্রতার মোড়ক কিছুটা খুলে গেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষা মানুষকে ঠিক অভদ্র করে না তবে ভদ্রতা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ম্লান করে দেয়। তাই প্রমাণ করল অনেকের চাপা গালি আর বিড়বিড় করে বলে উঠা অস্পষ্ট শব্দ। আশেপাশের অনেকের মুখেই হতাশা আর ক্ষোভ। আমার নিজের চেহারাও দেখতে ইচ্ছে হলো।
-জুই! খিদে পেয়েছে না? এই দেখ খাবার এসে গেছে। পিয়াল বাবা দেখো তোমার প্রিয় জুস।
মামার কথায় ফিরে তাকিয়ে দেখি এয়ারলাইন্সের লোকগুলো খাবার নিয়ে এসেছে কিছু। আমাদের ক্ষুধার্ত রাখতে হবে না দেখে মামার খুশি চোখে পড়ার মত। আমাদের প্রতি মামার টান সব সময়ই বাড়তি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তা চৌগুণ। এগুলো আমার পছন্দ নয় তবে আমি মামাকে খুশি করতে অতি উৎসাহে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু পিয়াল এখনো চুপচাপ। ওকে আমার একটু অস্বাভাবিক লাগছে। মামা পিয়ালের হাতে জুস আর কেক ধরিয়ে দিল,
-খাও বাবা।
-বমি আসছে।
-ঠিক আছে খেয়ে বমি কর। মামা পিয়ালের মাথায় হাত রাখেন। আমাকে বলেন,
-জুই। তুই লোকগুলোর কাছ থেকে পানিগুলো নে তো।
-ঠিক আছে ।মামা পিয়াল তো মনে হয় অসুস্থ হয়ে যাবে তেমন কিছু খেয়ে আসে নি কিন্তু এখনো খাচ্ছে না।
-আরে না না খাবে না কেন?মামা প্রায় চিৎকার করে উঠেন, পিয়ালকে নিজে খাইয়ে দিতে থাকেন।
এর মধ্যে আশেপাশের মানুষের মাঝে জোড় গুঞ্জন উঠল, প্লেনে বিরাট সমস্যা। তারা বলছে আসলে এই প্লেনগুলো সেকেন্ডহ্যান্ড, প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো আসলেই খারাপ। এক লোক বিমান বাংলাদেশ কে উদ্দেশ্য করেও বেশ কিছু কথা বলছে যার সারমর্মে তার উক্তি “আর ডোমেস্টিক বিমান বাংলাদেশ তো বিরাট খেয়ালি কবি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এদের টিকিট যেমন সস্তা, তেমন ঈদের চাঁদ। সার্ভিসিং এ কাঁচকলা”। পিয়াল কান খাড়া করে প্লেন সংক্রান্ত সব কিছু শুনছে। ওর চুপচাপ থাকার কারণ আমি এখন বুঝতে পারছি। ও আসলে ভয় পেয়েছে। আমার ধারনা সত্য করে ও খেতে খেতে মামাকে প্রশ্ন করে,
-আচ্ছা প্লেন কি নষ্ট হলে ক্রাশ করে। টিভিতে যেমন দেখি। তাহলে তো সবাই মারা যাবে।
-আরে না না।প্লেন নষ্ট হয় নি তো। না রে জুই?প্লেনে তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল।
-হ্যাঁ তাই তো।
আমি আর মামা পিয়ালকে বুঝাতে থাকি। কিন্তু বুঝানো বেশিদূর এগোয় না। কারণ পিয়ালের অমনোযোগিতা আমাদের সাত পাঁচ বুঝকে অস্বীকারই করে। পিয়ালের বয়স এখন এগারো, বুঝ নেয়ার বয়স এখন আর তার নেই। তার নিজস্ব চিন্তা আছে। তবু আমি হাল ছাড়ি না নানা কথা বলে ওর মনোযোগ ঘুরাতে চেষ্টা করি। আমার ওর জন্য খারাপ লাগতে থাকে। এত উৎসাহ ছিল বেচারার এখন চেহারার দিকে তাকালে মায়া লাগছে।
পিয়াল আমার সাথে কথা বলায় আগ্রহ দেখাল না। হঠাৎ বলে উঠল,
-মাকে ফোন করব।
মামা ওকে মার সাথে কথা বলায়। পিয়াল ফোনটা নিয়ে হেটে হেটে কথা বলতে থাকল। মামা ওর পাশে থাকেন। পিয়ালের দিকে তাকাতে তাকাতে লোকটার দিকে চোখ গেল। এখন তারা আর আমাদের পাশের ছিটে না, একটু পেছনে কিন্তু দূরত্ব তেমন না। বরাবর না হওয়ায় আমি যে তাকে দেখছি এটা তার চট করে চোখে পড়বে না। পাশের লোকটি কথা বলছে, লোকটি শুনছে আর খাচ্ছে। সে তার কোর্ট খুলে ফেলেছে। ঝকঝকে সাদা সার্টে আরো সুদর্শন লাগছে তাকে। ভদ্রলোক মুচকি হাসলে থুতনির টোলের কারণে পুরো চেহারায় এক অদ্ভুত মিষ্টতা ছড়িয়ে গেলো। হাসিটা সে বেশিক্ষণ গালে ধরে রাখল না, কেমন করে যেন আস্তে করে মিলিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ই তাকিয়ে রইলাম হয়ত। হুশ হতেই চোখ ফেরালাম। এখন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে আর আমি কিনা এতদিনে অপরিচিত এক যুবককে দেখে মুগ্ধ বোধ করছি!আমি বোবা টিভিতে তাকিয়ে তাকিয়ে অন্য কিছু ভাবতে চাই, ভাবতে থাকি।
বেশ কিছুক্ষণ পর পিয়াল ফিরে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল।আমিও ওর হাত দুটো ধরে বলি,
-ভাইয়া টয়লেটে যাবে?
-হুম। আপু আমার বমি আসছে।
-কি বল? এখনো বমি আসছে?
-হুম।
পিয়াল মুখে হাত দিয়ে উগরে আসা বমি ঠেকাতে চাইলো। মামা একটু সামনে লোকদের সাথে কথা বলছে। আমি ওকে টয়লেটে নিয়ে যেতে যেতে আর মামাকে ডাকতে ডাকতে পিয়াল ওয়েটিং রুমের মেঝেতেই বমি করে দিল। অনেক মানুষ ছুটে আসছে, আমি আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না।
(৫)
জানিসই তো আমাদের ধর্মে আগের জন্মের কথা যাদের মনে থাকে কিংবা যারা আমার মত এমন ধাঁধায় পড়ে, তাদের জাতিস্মর বলে। আমি জাতিস্মর কিনা জানিনা তবে অনুভূতিটা এমনি।
-মানে তুমি কি বলছ তুমি জাতিস্মর?রাহুলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে।
-নাহ!জাতিস্মর ভেবে নিজেকে আলাদা ভাবা বা ফাঁপা আত্মবিশ্বাসে ডুবতে পারলে ভালই হত হয়ত, পারিনা। ডাক্তারি বিদ্যায় এটা ডিজ্যাঁভু যার আভিধানিক অর্থ “অলরেডি সিন”। বাঙ্গালা করলে আরো অদ্ভুত মানে, ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি।হা হা!
আমি হাসছি। গল্পের বৃদ্ধ নাবিকের মত রাহুলকে নিজের ব্যক্তিগত কথা বলছি। রাহুলকে বেশ ভালো লেগেছে তাই নিজের কথায় নিজের কানে কোন জড়তা খুঁজে পেলাম না। কেমন করে কোন কথার ফাকে যেন নিজের ভেতর বৃদ্ধ নাবিক উকি দিল। রাহুল আমার আরো কাছ ঘেঁষে বলে,
-তুমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওনি? রাহুলের মুখ আগের মতই,
-হুম। আমার প্রথম ডিজ্যাঁভু হয় দু বছর আগে। বসন্তের এক বিকেলে। আমি জুরং বার্ড-পার্কে ফ্লেমিঙ্গো কর্নারে ছিলাম। এক বৃদ্ধা তার নাতনীকে চকোলেট দিচ্ছে। ব্যাস আমার মনে হলো এটা একটা পুরোনো দৃশ্য আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নিজের অনুভূতিকে। আর প্রথমবার তাই বিস্ময় এর ধাক্কাটাও খুব বড় ছিল। বেশ অনেকদিন আমি সেই আবেশ থেকে বের হতে পারিনি। তারপর একদিন আমার ডিপার্টমেন্টে। দ্বিতীয় বারের ঘটনাটা অনেকক্ষণের জন্য ছিল, কিছুদিন আর ঠিকমত অফিস করতে পারলাম না। কোন কাজ ভালো লাগত না। সি সি ক্যামেরার সামনে বসে দোকান চালানো আর টাকা গোনার জীবন যে কি নিরর্থক তা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। তারপর প্রায়ই ঘটে এমন ঘটনা। কিছুদিন যেতে আমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। উনি আমার জীবনবৃত্তান্ত শুনেন। তারপর মিঃ থাপা চমৎকার ইংরেজিতে আমাকে যে ব্যাখ্যা দেন তা হলো। আমি ডিজ্যাঁভু ডিসঅর্ডারে ভুগছি। বিভিন্ন ব্যাখ্যা আর হাল্কা ঔষধে তিনি রোগটাকে প্রায় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সেটা উড়লো না, আরো বসে গেলো। এর পর বেশ কিছুদিন পর পর আমি উনার কাছে যাই। আস্তে আস্তে আরো আলোচনায় উনি বলেন, রোগটা নিয়ে অনেক হাইপোথেসিস আছে।
-যেমন?
-দুটো মনে আছে শুধু। যেমন ফ্রয়েড, উনি তো স্বপ্ন বিশারদ। উনার মতে, কোন একটা স্বপ্ন বার বার আর গভীর অনুভবের কারণে বাস্তবের সাথে ঘুলিয়ে যায় তখন এমন মনে হয়। আর হ্যাঁ সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট হাইপোথেসিস হলো মেমরি সেন্টারের কর্মকাণ্ডের গণ্ডগোল।
-মানে? খুব ইন্টারেস্টিং তো!গণ্ডগোলটা বুঝিয়ে বলো।
-আমি তেমন ভালো বলতে পারব না।উনি আমাকে একটা ছক এঁকে বুঝালেন কীভাবে মেমোরি স্টোর হয়। প্রথম কাউকে দেখলে তা শর্ট টার্ম মেমোরিতে যায়।আর লংটার্ম মেমোরি চারটা স্টেপে সেটল হয়। রিকগনিশন মানে কাউকে দেখা বা চিনা, রেজিস্টার মানে তাকে মনে রাখা, রিহার্সাল মানে প্রায় দেখা বা ভাবা আর রি-কল মানে তাকে চাইলেই মনে করতে পারা। এই ভাবে শর্ট টার্ম মেমোরি থেকে লং টার্ম ডেভেলপ করে । এখন কাউকে প্রথম দেখলে তা শর্ট টার্ম মেমোরিতেই যাবে। কিন্তু কাউকে প্রথম দেখি আর ব্রেন যদি তাকে লং টার্মে নিয়ে যায় তবে এই সিস্টেমটাকে বলে ওভারল্যাপ। আর এই ওভারল্যাপ হলেই ডিজ্যাঁভু।
রাহুল কিছু বুঝলো কি না বুঝতে পারলাম না। তবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে আবার প্রশ্ন করল,
-তোমার কি এখন মনে হচ্ছে যে… রাহুল কথাটা শেষ করেনা। তবে তার বোকা বোকা কথার আড়ালের বুদ্ধিমত্তায় কিছুটা চমকে যাই।
-হুম। মিঃ থাপার বিশ্লেষণ শুনে ভেবেছিলাম ধুর এটা একটা বিষয় হলো। আমি তো বুঝতেই পারলাম ব্যাপারটা, মেমোরি সিস্টেমের কাঁথা পুড়ি। কিন্তু কিছুদিন যেতেই যেই সেই। এতকিছু জেনেও একি রকম বোধ করি।
-হুম। এটার সাইড এফেক্ট কি?
-ডিপ্রেশন। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ডিপ্রেশন।
-তুমি কি এখন ডিপ্রেসড ফিল করছ? ভাইয়া, আমি আছি না এখন, আমি তোমাকে ডিপ্রেসড থাকতে দেবো না।
রাহুল আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ ছেলে ওর চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। নিজের আবেগ কমার পাশাপাশি অন্যের আবেগেও অস্বস্তি হয়। আমি হালকা ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। হঠাৎ একটু শোরগোল ওঠে। নীল জামা পড়া মেয়েটির সঙ্গের ছোট ছেলেটি বমি করেছে। সাথের ভদ্রলোকের মুখে আতংক। কিছু মানুষ ধরাধরি করে ছেলেটিকে নিয়ে যাচ্ছে ওয়াশ রুমে। রাহুল ও এগিয়ে গেলো। আমি উঠলাম না। ছেলেটির জন্য খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু এগিয়ে না যেতে না পারাটাই আমার স্বভাব। খারাপ লাগাগুলোও কাছ থেকে এক রকম সহ্য হয় না।
ওরা ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে বসল। মেয়েটি কাঁদছে ছোট ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে মাঝ বয়সী ভদ্রলোকের কোলে মাথা রেখে কি যেন বলছে। তাদের ঘিরে এখনো কিছু মানুষের অর্ধবৃত্ত। রাহুল এসে জানালো ছেলেটা নাকি যেতে চাচ্ছে না। সে ভয় পেয়েছে। আমি আমাকে লেখা চিঠির উপদেশ অমান্য করে মেয়েটির কান্না ভেজা মুখ দেখতে থাকি, যতক্ষণ দেখা যায়। রাহুল আমাকে নানান কথায় ব্যস্ত রাখতে চাইছে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু হঠাৎ ই আমি নিরুত্তর হয়ে ওর চেষ্টায় পা পিছাই। আস্তে আস্তে ওর কথা কমে যায়।
ইতিমধ্যে আমাদের এয়ারলাইন্স তৈরি হয়ে আমাদের জানায়। আমরা তৈরি হচ্ছি। মেয়েটি আর সাথের লোকটি এখনো ছেলেটিকে বুঝাচ্ছে হয়তো। তারা বসেই আছে। আমি ওয়েটিংরুম ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছি মেয়েটিকে দেখতে দেখতে কী মায়াময় মুখ! চলতে চলতে মুখটি আড়াল হয়ে গেল। বুকটা হাল্কা মোচড় দিল। খুব পুরোনো অনুভূতি। মনে হচ্ছে মেয়েটির এই মুখ পেছনে ফেলে আমি অনেক আগেই এসেছি, “এ জনমে নয় যেন হয়ত পাঁচশো বছর আগে”।
……………………………………………………………………।।
23 Responses to গল্পঃ-একটি ওয়েটিং রুম ও কিছু জলছাপ
You must be logged in to post a comment Login