মুহম্মদ জাফর ইকবাল

গভীর রাতে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আয়েশা ফায়েজের৷ শঙ্কিত মন নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন তিনি৷ এসে দেখেন তাঁর মেজো ছেলে ইকবাল কাঁদছে৷ সেই কান্নার শব্দে আস্তে আস্তে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং সবাই উঠে এলেন ইকবালের কাছে৷ ইকবাল কাঁদছে কারণ- আশি বছর পর তাকে মরে যেতে হবে৷ ঘুমাতে যাবার আগে তার বাবা তার হাত দেখে বলেছেন- “তুমি তো দীর্ঘজীবী৷ প্রায় আশি বছর আয়ু তোমার৷” আশি বছর পর সে মরে যাবে, এ কথা ভাবতেই ইকবালের কান্না পাচ্ছে৷ ইকবালের কান্না দেখে তার বাবা আবার তার হাতটা টেনে নিয়ে ভাল করে দেখলেন এবং তাকে সাত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তুমি একশ বছর বাঁচবে৷’ একশ সংখ্যাটি বালক ইকবালের কাছে অনেক বেশি মনে হওয়ায় মুহুর্তেই খুশি হয়ে উঠল সে৷

সেদিনের ইকবাল নামের সেই ছোট্ট ছেলেটিই আজ বাংলাদেশের অন্যতম লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল৷ যাঁর লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না৷ কিন্তু সেই মানুষটিই লেখালেখি দিয়ে তৈরি করেছেন দেশজোড়া খ্যাতি৷ জাফর ইকবালের প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘ছেলেমানুষ’ নামে একটি গল্প৷ সায়েন্স ফিকশন তিনি লিখবেন এমন কোন ইচ্ছা তখনও মনের গোপনে স্থায়ী বাসা বাঁধেনি৷ ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ গল্পটি অল্প একটু লেখা হয়েছে এমন সময়ে বড়ো ভাই হুমায়ূন আহমেদ এলেন, দেখলেন, পড়লেন৷ মুখে বললেন, “তুই নিজে লিখেছিস না ট্রানস্লেট করেছিস?” গল্পটির লেখক উত্তরে জানালেন যে, তিনি নিজেই লিখেছেন৷ বড়ভাই হুমায়ূন আহমেদ ছোটভাই-এর চমত্‍কার লেখায় মনে মনে সেদিনই মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “বেশ ভালো হচ্ছে” ওই শুরু৷ কিন্তু ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ গল্পটি তখনকার একমাত্র ম্যাগাজিন ‘বিচিত্রা’-তে প্রকাশিত হলে এক পাঠক প্রতিবাদ জানায় যে, লেখাটি নকল করে লেখা৷ বিষয়টি জাফর ইকবালের আত্মসম্মানে লাগে৷ আসলে এটি একটি রোবটের গল্প৷ তিনি এর প্রতিবাদ করার জন্য অভিনব পদ্ধতি বের করলেন৷ আরো কয়েকটি সায়েন্স ফিকশন লিখে কপোট্রনিক সিরিজ করলেন৷ নকল করে তো একটা লেখা যায় কিন্তু অনেকগুলো লেখা যায় না৷ বের হলো তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘কপোট্রনিকের সুখ দুঃখ’৷ এর পরপরই ‘হাত কাটা রবিন’-এর কাজ শেষ করেন৷ তারপর দীপু নাম্বার টু, তিন্নী ও বন্যা, নয় নয় শূন্য তিন, জলমানব, অবনীলসহ আরও অনেক মজার মজার বই শিশু-কিশোররা জাফর ইকবালের কাছ থেকে পেতে থাকে৷ এভাবে শিশু-কিশারদের জন্য একের পর এক বই সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ভূবনে জাফর ইকবাল হয়ে ওঠেন এক অবশ্যম্ভাবী নাম৷

২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাফর ইকবালের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০৪টি৷ জাফর ইকবালের ‘দীপু নাম্বার টু’-উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম-এর তৈরি চলচ্চিত্র খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ দস্যি দু’জনসহ বেশকিছু জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা জাফর ইকবাল৷ বিটিভির সিসিমপুরের নিয়মিত লেখক তিনি৷

কেবল শিশুসাহিত্য নয় জাফর ইকবাল কলম ধরেছেন বড়দের জন্যও৷ ফলে একজন কলামিস্ট জাফর ইকবালের কলম অথবা কলাম আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সমাজকে দেখিয়েছে পথ৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় তাঁর লেখনি সোচ্চার হয়ে ওঠে৷ জাফর ইকবাল কখোনোই সমাজের অসংগতিগুলোকেও নীরবে মেনে নেননা৷ কানসার্টে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর আনোয়ারের রক্ত মাখা শার্ট নিয়ে তাঁর অনবদ্য কলাম কারো চোখ এড়িয়ে যায়নি৷ শিক্ষকদের অনশন বিষয়ে কারো যখন মাথাব্যথা ছিল না তখন তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে জাফর ইকবালের কলাম৷ এসএসসিতে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি খারাপ ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে আবার শংকিত হয়ে কলামও তিনি লিখেছেন৷ তিনি যেন সমাজের মানুষকে সচেতনতার দিকে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷

ছেলেবেলায় প্রচুর বই পড়ার নেশা ছিল জাফর ইকবালের৷ স্বপন কুমার, দস্যু বাহারাম, মাসুদ রানাসহ দেশি-বিদেশী অনেক লেখকের বই পড়তে পড়তে বড় হয়েছেন তিনি৷ আর এসব বই পড়তে পড়তে একসময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন৷ তিনি পড়ার এই অভ্যাসটা পেয়েছেন বাবা ও তাঁর বড় ভাই জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকেই৷ কারণ তাঁদের নেশার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল বই পড়া৷ ছেলেবেলা থেকে একটা সম্পদের ছড়াছড়ি দেখে বড় হয়েছেন জাফর ইকবাল, আর তা হলো বই৷

জাফর ইকবালের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুরে৷ কিন্তু সেখানে স্থির থাকেননি তিনি৷ বাবা পুলিশ অফিসার হওয়ায় ছেলেবেলা কেটেছে বিভিন্ন জায়গা ঘুরেঘুরে৷ বাবার চাকরির সুবাদে বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সাথে দেশের বিভিন্নঅঞ্চল দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি৷ সিলেটের কিশোর মোহন পাঠশালায় পড়াশুনার শুরু হলেও সেখানে বেশি দিন স্থির হননি৷ বাবার বদলির কারণে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে৷ চলতি পথে অনেক সহপাঠীদের সাথে হয়েছে বন্ধুত্ব৷ সিলেটের বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে চলে যান জগদ্দল, দিনাজপুর৷ সেখান থেকে চলে যান পঞ্চগড়৷ তারপর প্রথমে রাঙামাটি, পরে বান্দরবান৷ বান্দরবান থেকে চট্টগ্রাম৷ এরপর যান বগুড়া, সেখান থেকে কুমিল্লা ৷ কুমিল্লা থেকে সোজা পিরোজপুর৷ সেখানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ৷ সব শেষে চলে আসেন ঢাকায়৷ জাফর ইকবালের নিজের ভাষায় – “দীপু নাম্বার টু- বই-এ দীপু যেসব জায়গায় গিয়েছিল আমার স্কুলগুলোর নাম ওইখানে দেওয়া আছে৷”

বিভিন্ন স্কুল ঘুরে মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চমাধ্যমিকে এসে স্থির হন ঢাকা কলেজে৷ উচ্চমাধ্যমিক সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন প্রাচ্যের অঙ্র্ফোড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ৷ ১৯৭৩ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৭৪ সালে লাভ করেন মাস্টার্স ডিগ্রি৷

আমেরিকার মতো স্বর্গরাজ্যে Ph.D. করার সুযোগটাও মেধা দিয়ে জয় করেছিলেন জাফর ইকবাল৷ সে সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকেরা ফেলোশিপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আসতেন সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে৷ আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা ভাইভা নিতে এলে অনেকের সাথে জাফর ইকবালও সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন৷ কয়েকমাস পরের ঘটনা৷ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে Ph.D. করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠায়৷ ঠিক করেন আমেরিকা যাবেন৷ কিন্তু যাবেন যে, সমস্যা হলো প্লেন ভাড়া৷ এতগুলো টাকা কোথায় পাবেন! জাপান প্রবাসী এক বন্ধু এগিয়ে এলেন৷ সেই বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে জাফর ইকবাল পৌঁছলেন আমেরিকার ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে৷ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে মেধাবী ছাত্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতির সাথে সাথে ১৯৮২ সালে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে অর্জন করলেন Ph.D. ডিগ্রি৷ তাঁর বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom.

Ph.D. ডিগ্রি অর্জনের পর একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে আমেরিকায় পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল৷ তরুণ সফল গবেষকের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ছিল আমেরিকায়৷ পনেরো বছরের নিশ্চিন্ত জীবন ছিল তাঁর৷ উপার্জনও ছিল অনেক ভালো৷ কিন্তু অন্যদেশে রাজার মতো জীবন কাটাতে তাঁর মন টানেনি৷ মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য ছটফট করেছেন প্রতি মুহূর্তে৷ স্বজনেরা দেশে ফিরে আসতে না করেছেন বারবার৷ সেই সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘসময়ের বন্ধু, স্ত্রী ইয়াসমিন হক৷ বিদেশের মাটিতে নানা সময়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- University of Washington- এ Research Assistant হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এরপর আমেরিকার Caltech- এ Research Faculty তে ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত৷ ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বে সঙ্গে ‘Member of Technical staff ‘- এর দায়িত্ব পালন করেছেন Bell Communications Research এ৷ এরপর পরই মাতৃভূমির টানে স্তী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে চলে আসেন৷ বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করছেন৷ এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের Research Journal ‘SUST Studies’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন৷ Research Initiatives Bangladesh এবংFreedom Foundation এর বোর্ড মেম্বার হিসেবে আছেন৷ ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ‘Bangladesh Informatics Olympiad Committee-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন৷ এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন৷

বাঙালি জাতিকে গল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে জাফর ইকবালের অবদান অনস্বীকার্য৷ এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি দেশপ্রেমিক, ইতিহাস সচেতন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বল মানুষ তৈরি করার ক্ষেত্রেও এই ব্যক্তিত্বের অবদান আজ সর্বজনবিদিত৷ যারা মুক্তযুদ্ধ দেখেনি তাদের জন্য জাফর ইকবাল ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ নামে এক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন৷ তাঁর মতে- নিজের দেশকে চিনতে হবে, জানতে হবে এই দেশটির বাংলাদেশ হয়ে ওঠার সঠিক ইতিহাস৷ আর ইতিহাস জানা মানেই শুধু কিছু দিন, তারিখ এবং কিছু মানুষের নাম মুখস্থ করা নয়৷ শুধুমাত্র এ জন্যই এতগুলো জীবন থেকে রক্ত ঝরেনি৷ নতুন প্রজন্মের কাছে তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত তথ্য নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করাতে, তাদের উপলদ্ধিতে সেদিনের ত্যাগ, বীরত্ব, নির্যাতনের নির্মমতা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে শুরু করেছিলেন এই অভিনব কার্যক্রম৷ আর এই অনুষ্ঠানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে৷ সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা এই অনুষ্ঠানে এসে শিশু-কিশোরদের সামনে স্বীয় অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে৷ শিশু-কিশোররা বিভিন্ন প্রশ্ন করে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে৷ নতুন প্রজন্ম সেইসব দিন মনের জগতে কল্পনায় সাজিয়ে নেয়, উপলদ্ধি করে৷

একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণসচেতনা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি৷ সচেতন সমাজের সমর্থন আদায় করে এটি প্রতিরোধ করেন জাফর ইকবাল৷ দেশের সাধারণ মানুষ, শিক্ষক সবাই তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিল৷ সাংবাদিক সম্মেলন করে, কলাম লিখে দেশের মানুষকে একমুখী শিক্ষা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে শিক্ষার সর্বনাশ রোধ করতে সমর্থ হয়েছেন৷ আবার জাফর ইকবাল গণিতের মতো কঠিন বিষয়ের ওপর সাধারণ জনগণের আগ্রহ তৈরি করেছেন৷ গণিতের সাথে যেন বাঙালিদের আড়ি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের গণিতের সাথে দুরত্ব নিজেই উপলদ্ধি করেছেন৷ কিন্তু ভালো সায়েন্টিস্ট বা ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ভালোভাবে অংকের ওপর দক্ষতার প্রয়োজন৷ তাই অংক ভীতি দূর করতে বন্ধু কায়কোবাদকে সাথে নিয়ে প্রথমদিকে শিশু-কিশোরদের জন্য ‘দৈনিক প্রথম আলো’ তে গণিত বিষয়ে পাঁচটি করে প্রশ্ন দিতেন৷ ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে ‘এই নিউরনে অনুরণন’ নামের এই অংশটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ পরে এ দলে মুনির হাসান যোগ দেন৷

ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের গণিতে আগ্রহী করার জন্য পরবর্তীতে শুরু করেন ‘গণিত অলিম্পিয়ার্ড’ কার্যক্রম৷ ধীরে ধীরে এই গণিত অলিম্পিয়ার্ড কার্যক্রমটি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মহা উত্‍সাহ নিয়ে জটিল জটিল অংকের সমাধান করছে৷ মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে তাই দেখতে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেছেন জাফর ইকবাল৷ তিনি শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন৷ কখনো প্রশ্ন জটিল হলে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে, কঠিন দেখে ছেলে-মেয়েরা যদি উত্‍সাহ হারিয়ে ফেলে৷ আবার ছেলে-মেয়েদের ‘অংক’ বিষয়ে উত্‍সাহ দিতে ‘আমি তপু’র মতো গল্পও লিখেছেন৷ বর্তমানে বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড’ এ অংশগ্রহণ করছে৷ গণিত অলিম্পিয়াড এর মাধ্যমে তিনি এদেশের শিশু কিশোরদের মনে তৈরি করেছেন গণিতের প্রতি ভালোবাসা৷ দূর করেছেন গণিতের প্রতি মানুষের আজীবনের ভয়৷ আজ তারা গণিতের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বপ্নকে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে৷

লেখক জাফর ইকবালের সাহিত্যিক জীবনে ছড়িয়ে আছে প্রেরণার এবং মজাদার অনেক কাহিনী৷ প্রেরণার একটি হলো- ১৯৭৫ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক পত্রিকায় শহীদ বাবাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন তিনি৷ লেখাটি প্রকাশের কিছুদিন পরেই বাংলা সাহিত্যের আরেক স্তম্ভ আহমেদ ছফার সাথে রাস্তায় দেখা৷ তিনি জাফর ইকবালের রিকশা থামিয়ে বললেন, “তোমার লেখাটা আমার ভালো লেগেছে৷ নাও, এক টাকা নাও৷” লেখা থেকে সেই প্রথম উপার্জন৷ জাফর ইকবাল সেদিন অসম্ভব প্রাণিত হয়েছিলেন অগ্রজের এই স্বীকৃতিতে৷ অপরদিকে মজার কাহিনী হলো তাঁর জন্মদিন এবং পিতৃদত্ত নামটি নিয়ে৷ প্রত্যেক মানুষের তো জন্মদিন একটা৷ তাঁর কিন্তু দু’টো৷ স্কুলের শিক্ষকেরা জাফর ইকবাল নামের ছাত্রটির জন্ম তারিখের স্থানে ১৯৫৩ সালের ৩ অক্টোবর দিয়ে দেন৷ তবে তিনি নিজের সাহিত্যকর্মে বা সাক্ষাত্‍কারে আসল জন্মদিনটা উল্লেখ করেন৷ আর সেটা ভাষা আন্দোলনের বছর, ১৯৫২-র ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের মীরা বাজারে৷ দু’জন্মদিনের বিষয়টা বেশ উপভোগ করেন জাফর ইকবাল৷ নামের ক্ষেত্রে হয়েছে আরেক ঘটনা৷ আগে নামের বানানে তিনি ‘মোহাম্মদ’ লিখতেন৷ আহমেদ ছফা তাঁকে বললেন, “এভাবে লিখলে চলবে না৷ ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ যেভাবে লেখে সেভাবে লেখো৷” তারপর থেকে নিজের নামের বানানে ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ লিখতে শুরু করেন৷

শুধুমাত্র দেশেই নয় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের বাইরেও একটি পরিচিত নাম৷ আর তাঁর সে পরিচয়টা বিজ্ঞানী হিসেবে৷ এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ও মেধার স্ফূরণ দেখে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড্যামলেট তাঁকে নিজের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ ক্যালটেকের বেল ল্যাবরেটরিতে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বারোজন নোবেল লরেট৷ তিনি নিযুক্ত ছিলেন ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে তৈরির কাজে৷ তাঁর উদ্ভাবিত টাইম প্রজেকশন সুইজারল্যান্ডের এক পাহাড়ের নিচে বহুদিন যাবত্‍ ডাটা সংগ্রহের কাজ করছে৷ গবেষণার কাজকে প্রচণ্ড আনন্দদায়ক বলে মনে হয় এই গবেষকের কাছে৷ বিজ্ঞানী জাফর ইকবাল Electronics, Computer Science and Engineering, Bangla Computerization, Networking, Non-Linear Optics এবং পদার্থ বিজ্ঞানের ওপর বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ করেছেন৷

এই সফল মানুষটির জীবনেও রয়েছে বেদনার গভীর ক্ষত৷ যে বেদনাকে তিনি ধারণ করেন গর্বের সাথে৷ ঘটনাটি ১৯৭১ সালের৷ বাঙালিজাতির স্বাধীনতার বছর৷ জাফর ইকবাল তখন প্রায় আঠারো বছরের তরুণ৷ ১৯৭১ সালে তাঁর বাবার পোস্টিং ছিল পিরোজপুরে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে তাঁর পুলিশ অফিসার বাবাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার পর লাশ ফেলে দেয় ধলেশ্বরীর পানিতে৷ পিরোজপুর ভাটি অঞ্চল৷ নদীর জোয়ার ভাটায় সেই মৃত শরীর একবার এদিক আরেকবার ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল৷ কখনও ঠেকে যাচ্ছিল পাড়ে৷ নদী থেকে সেই মৃত শরীরটি তুলে আশপাশের মানুষজন নদীর পাড়েই দাফন করে৷ আর জুতো জোড়া রেখে দেয় পরিবারের লোকজনকে দেখানোর জন্য৷ যুদ্ধ শেষে জাফর ইকবাল বাবার মৃতদেহ শনাক্ত করে মায়ের কাছে নিয়ে আসে৷ তাই মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাবাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, আর কোনদিন বাবাকে দেখতে না পাওয়ার গভীর যন্ত্রণা৷

নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার বিখ্যাত পীর জাঙ্গির মুনশি’র ছেলে মৌলানা আজিমুদ্দিন মুহম্মদ জাফর ইকবালের দাদা৷ তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের আলেম এবং মৌলানা৷ জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা গৃহিনী৷ তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়৷ তাঁর বড়ভাই বাংলাদেশের লেখালেখির ভূবনে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ৷ গত ত্রিশ বছর ধরেই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ৷ সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট এবং রম্য লেখক৷ দেশের একমাত্র রম্য পত্রিকা উন্মাদ’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক৷ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমীন হক৷ ব্যাক্তিগত জীবনে ড. ইয়াসমীন হক জাফর ইকবালের সহপাঠী৷ তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এ শেষে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে চ.যফ করেছেন৷ এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন৷ এই দম্পতির দু’সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে নাবিল ইকবাল এবং একমাত্র মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল৷

জাফর ইকবাল ২০০২ সালে কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক পান ৷ ১৪১০-এ খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক লাভ করেন৷ ২০০৩ সালে লাভ করেন শেলটেক সাহিত্য পদক৷ এরপরের বছর অর্থাত্‍ ২০০৪ সালে শিশু সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাফর ইকবালকে ইউরো শিশুসাহিত্য পদক দেওয়া হয়৷ জনগণের ভোটের মাধ্যমে ২০০৫ সালে জীবিত ১০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে জাফর ইকবালের নাম উঠে এসেছে৷ ২০০৫ সালে তাঁর সাহিত্য জিতে নেয় মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক৷ এই বছরই মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাঁকে সম্মাননা পদক প্রদান করে৷ একই বছরে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বড় স্বীকৃতি জাফর ইকবালের ভাণ্ডারে জমা হয়৷ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০০৫ লাভ করেন তিনি৷ ২০০৫ সালে আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যসোসিয়েসন পদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েসন পদক ‘০৫ লাভ করেন৷

তিনি কখনই অন্যায় এর সাথে আপোষ করেননা৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার হয়ে ওঠেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ৷ সমাজে কোনো অন্যায় দেখার সাথে সাথে তাঁর কলম সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ওঠে৷ আর এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁর বাড়িতে বোমা মারা হয়েছে৷ পাঠানো হয়েছে কাফনের কাপড়৷ ছেলেবেলায় একদিন যে বালকটি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে কেঁদে সারা হয়েছিল বড় হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে পথ চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু তিনি একমুহুর্তের জন্যও থেমে যাননি৷ হাজারও হুমকি-ধামকি আর কাফনের কাপড়ের মধ্যে বাস করেও ছেলেবেলার সেই ছোট্ট ইকবাল মৃত্যু ভয়ে ভীত না হয়ে পথ চলছেন নির্ভয়ে৷ আর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বলিষ্ঠকন্ঠে৷

সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: জাফর ইকবালের প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর৷ এ দিনটিতেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সেটা করেছেন ১৯৫৩ সালের ৬ অক্টোবর৷ আর শিক্ষকদের দেওয়া এই তারিখটিই তাঁকে বহন করতে হয়েছে সব সার্টিফিকেটে, পাসপোর্টে এবং সবধরনের দাপ্তরিক কাজে৷

বাবা-মা: জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা আয়েশা ফায়েজ গৃহিনী৷ তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়৷

পড়াশুনা: সিলেটের কিশোর মোহন পাঠশালায় পড়াশুনার শুরু হলেও সেখানে বেশি দিন স্থির হননি৷ বাবার বদলির কারণে ঘুরতে হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে৷ বিভিন্ন স্কুল ঘুরে মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চমাধ্যমিকে এসে স্থির হন ঢাকা কলেজে৷ উচ্চমাধ্যমিক সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ৷ ১৯৭৩ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৭৪ সালে লাভ করেন মাস্টার্স ডিগ্রি৷ এরপর ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮২ সালে এঙ্পেরিমেন্টাল ফিজিক্স অর্জন করলেন Ph.D. ডিগ্রি৷ তাঁর বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom.

কর্মজীবন: Ph.D. ডিগ্রি অর্জনের পর একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে আমেরিকায় পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল৷ বিদেশের মাটিতে নানা সময়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- University of Washington- এ Research Assistant হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এরপর আমেরিকার Caltech- এ Research Faculty তে ছিলেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত৷ ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বে সঙ্গে ‘Member of Technical staff ‘- এর দায়িত্ব পালন করেছেন Bell Communications Research এ৷ এরপর পরই মাতৃভূমির টানে স্তী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে চলে আসেন৷ বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করছেন৷ এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের Research Journal ‘SUST Studies’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন৷ Research Initiatives Bangladesh এবংFreedom Foundation এর বোর্ড মেম্বার হিসেবে আছেন৷ ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ‘Bangladesh Informatics Olympiad Committee-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন৷ এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন৷

স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে: জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমীন হক৷ ব্যাক্তিগত জীবনে ড. ইয়াসমীন হক জাফর ইকবালের সহপাঠী৷ তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম.এ শেষে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে চ.যফ করেছেন৷ এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন৷ এই দম্পতির দু’সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে নাবিল ইকবাল এবং একমাত্র মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল৷

লেখক : আয়েশা সিদ্দিকা রাত্রি

শিষ্টাচার: লেখাটি গুণীজন পোর্টাল থেকে সংগ্রহকৃত।