জুলিয়ান সিদ্দিকী

ছোটগল্প: বিশ্বাসঘাতক

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

Cover Biswasghatok

 

গোলাম আযম মারা গেছে হাসপাতালে। টেলিভিশনে সংবাদটি শুনে জাহানারা কেমন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন প্রথম। খানিকটা ধাতস্থ হতেই ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন, এটা কেমন হলো? ভালো ভালো একুশ পদের খাবার খেয়ে, আরামে থেকেও বেজন্মাটা মারা গেল? দেশের কত কত মানুষের শ্রমের টাকা মিশে আছে সরকারী এই খরচের সঙ্গে। আছে তেমন মানুষদের টাকা যারা বংশ পরম্পরায় এই নরপশু আর তার বাহিনীর নাম শুনলেও সে নামের ওপর ছুঁড়ে দেবে দলা দলা ঘৃণা মিশ্রিত থুতু। অথচ সরকার কী এমন ভাল কাজটা করল এই নষ্টবীজটাকে জামাই আদরে রেখে? 

জাহানারা যেন মেনে নিতে পারছিলেন না গোলামের স্বাভাবিক মৃত্যুটাকে। যেমন করে মেনে নিতে পারেননি ফাঁসীর বদলে আমৃত্যু কারাবাসের রায়। আরে বুড়ো বলে নরখাদককেও মানবতা দেখাতে হবে? কারা এমন মানবতা দেখাল? বিচারকদের কেউ কি পাকি হানাদারদের অত্যাচার চাক্ষুষ করেনি? তারা শোনেনি রাজাকার আলবদর আলশামস নামের এ দেশী মীরজাফরদের বর্বরতার ইতিহাস? তাদের মা-খালা, চাচি-জেঠি, দাদি অথবা নানী, ভাই, আত্মীয়-স্বজন কেউ একাত্তরের পৈশাচিকতার মুখোমুখি হয়নি? গোলামের বাহিনী কি মানবতার কথা ভেবে শিশু হত্যা বন্ধ রেখেছিল? নাকি হাতে পড়া কোনো গর্ভবতীকে মাতৃজ্ঞানে সসম্মানে পালঙ্কে বসিয়ে সেবাযত্ন করেছিল? বিচারক বা ট্রাইব্যুনালের বিবেকে ভাবনাগুলো কি একবারও অনুরণিত হয়নি? নাকি একাত্তরের ভয়াবহতার সঙ্গে পরিচয় না থাকার সঙ্গে সঙ্গে কোনো রকম ইতিহাসও পড়ে দেখেনি?

হায় আমাদের মনুষ্যত্ব, হায় আমাদের শিক্ষা। চিরকালীন লোভী মীরজাফরদের বিবেক বোধ কি ভ্রূণেই বিলুপ্ত হয়ে যায়? আর সে কারণেই বোধ করি তারা স্বার্থের প্রয়োজনে নিজেদের রক্তকেও বিকিয়ে দিতে পারে। পণ্য করে তুলতে পারে মায়ের সম্ভ্রম। বোনের কুমারীত্ব ঠেলে দিতে পারে প্রভুদের শয্যা বিলাসে। আমাদের জাতির চোখ হয়তো এভাবেই অন্ধ হয়ে থাকবে বাকি জীবন। হয়তো আর কখনওই আমরা মানুষের কাতারে দাঁড় করাতে পারবো না নিজেদের। জাহানারার বুকের ভেতরটা বিশুষ্ক মরুভূমির মতই যেন রূঢ় হয়ে ওঠে হঠাৎ।

শৈশবে মায়ের মুখ থেকে শোনা খালা আর চাচির সম্ভ্রম হারিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তাকে যতটা ব্যথিত করেছিল যৌবনে উপনীত হয়ে সে সম্ভ্রম লুটেরা নিজামুদ্দিনকে চেয়ারম্যান হতে দেখে আরও বেশি কষ্ট পেয়েছিল। বেশ কিছুদিন কিছুই মুখে দিতে পারেননি। ঘুমাতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে লজ্জা বোধ করছিলেন এই ভেবে যে, এমন একটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতির রক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মেছেন, যাদের বড় একটা অংশের বিবেক চেতনা আর শিক্ষা বেচাকেনা চলে প্রকাশ্যে। জীবনভর লাম্পট্যের পর দেহের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে গেলেই কেবল পরকালের কথা মনে পড়ে কিছু মানুষের। আর তখনই নিজেকে ঘোষণা করে ধর্মের সেবাদাস হিসেবে। জাহানারার বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য বোধ হয় হঠাৎ। ইচ্ছে হয় লাথি মেরে টেলিভিশনটাকে বাইরে ফেলে দিতে।

বিয়ের প্রথম বৎসর তার প্রথম সন্তান সময় মতো ভূমিষ্ঠ হবার আগেই এক দুর্যোগের রাতে চলে এসেছিল পৃথিবীতে। খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি অপুষ্ট শিশুটি। তার শবদেহ বুকে চেপে ধরে একই রকম অনুভূতি হয়েছিল জাহানারার। সময় মতো হাসপাতাল বা ডাক্তারের সাহায্য পেলে হয়তো বাঁচতে পারতো শিশুটি। কিন্তু সে রাতে কোনো রিকশা বা ভ্যান পাওয়া যায়নি। ঘর থেকে বের হতেই কেউ সম্মত হয়নি। ব্যর্থতার আক্রোশে কেবল ফুঁসেছিলেন তিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল পুরোটা গ্রাম তছনছ করে দিতে, নিষ্ঠুর পুরুষগুলোকে ধরে ধরে জ্যান্ত কবর দিতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমরে মরা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না তার সামনে।

যারা সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে অতগুলো নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারল। যারা নিষ্পাপ কত শত নারীকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের মুখে। কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা তো চাইলোই না, তার ওপর নির্লজ্জের মতো এদেশের মানুষের সুযোগ সুবিধায় ভাগ বসিয়ে যমের ভোগে গেল। থু অমন মানবতায়। থু অমন লোক দেখানো শিক্ষা আর পোশাকি দেশপ্রেমে। প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও কিছুটা এগোতেই উঠোনে বসে হড়বড় করে বমি করতে আরম্ভ করেন।

বেশ কিছুটা দুর্বল মনে হওয়াতে ঘরের বাতি নিভিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়ে ছিলেন জাহানারা। এরই মাঝে একবার বড় ছেলে আফতাবের বউ রুকিয়া এসে জিজ্ঞেস করে গেছে খাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি। মনে মনে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছিলেন এমন একটি মেরুদণ্ডহীন জাতির পরিচয়ে জন্ম নিয়েছেন বলে। একাত্তরের রণাঙ্গনে যে জাতির শৌর্য আর বীর্যে পাকি হানাদাররা প্রত্যক্ষ করেছিল বীর বাঙালীর নতুন পরিচয় আর সিংহের মতো প্রবল পরাক্রমশালী সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের যে কাহিনী শুনে আর পড়ে পড়ে বড় হয়েছেন, তা যেন লহমায় ছাড়িয়ে গেল হাজার বছরের পুরোনো রূপকথার গল্পকেও। গাজী-কালু-চম্পাবতী কেচ্ছার কুমির বাহিনীর মতোই যেন মন ভোলানো কিছু। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মারা না গেলেও অনেকেই বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ। কিন্তু তাদের ঔরসে যারা জন্মেছে তারা কি তাদের জন্মদাতার অসীম  সাহসের ছিটেফোঁটাও পায়নি? তারাই বা কী করে এত কিছু সহ্য করে মুখ বুজে?

অবশেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই যেন জাহানারা ফের ভাবেন যে, হয়তো ট্রাইব্যুনাল বা সরকারের ভেতর প্রভাবশালী কোনো আলবদর ছিল। যে ব্যক্তি আড়ালে নেড়েছে কলকাঠি। যার ফলে গোলামের ফাঁসি না হওয়াতে তার বাস্তবায়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি স্বাধীনতার পক্ষের লোকগুলো। অথচ জাহানারা ইমাম আয়োজিত গণ আদালতে গোলামের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। সরকার নিজেই যদি যুদ্ধাপরাধীদের ভরসা স্থল হয়ে ওঠে, সচেতন মানুষকে দমাতে তো সরকারী বাহিনীকে মাঠে নামাতেই হয়। রাজাকারদের ফাঁসির দাবীতে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হলেও তার ভূমিকা আশাহত করেছে মানুষকে। আর কিছু না পারুক, দেশদ্রোহী এসব কুচক্রী পাকিপ্রেমী কীটগুলোর যাতে এদেশের মাটিতে কবর না হয় তেমন একটা দাবি তোলা যেতো। আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবরে পাকি সরকার বিশ্বাসঘাতক শব্দটা লিখে দিয়েছে সে কথা কি টুপি দাড়িওলাদের অন্ধ ভক্ত বাঙালি মুসলমানরা জানে?

স্বামী বদরুল ব্যাপারী এখনো হজ থেকে ফিরে আসেননি। আফতাবও কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত বলে বাইরে বাইরে বাইরেই সময় কাটাচ্ছে। তাদের কাউকে কাছে পেলেও হয়তো কথা বলে বুকের ভার লাঘব করতে পারতেন। রুকিয়া একে তো অশিক্ষিত, তার ওপর বাড়ির বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো রকম কৌতূহল আছে বলে তার কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়নি এ পর্যন্ত। কাজেই তার সঙ্গে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা না বলা সমান।

অন্তর্গত অস্থিরতার কারণেই হয়তো ঘুমাতে না পেরে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর পাশে একটি ছোট্ট দেহের নড়াচড়া টের পেতেই মুখ থেকে আঁচলের আবরণ সরিয়ে দেখতে পান আফতাবের মেয়ে লতা শুয়ে আছে। অন্য দিন হলে এ সময় তিনি খুশি হয়ে উঠতেন। নাতনির সঙ্গে মেতে উঠতেন নানা রকম কথা আর মজার খেলায়। কিন্তু আজ কিছুতেই তার উৎসাহ নেই। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে একবার যেন আফতাবের মুখে শুনতে পেয়েছিলেন ঢাকায় লোকজন পাঠানোর জন্য গাড়ি ভাড়া করতে যাবে। কিন্তু তার জানা নেই কোন কাজের জন্য লোকজন পাঠাবে আফতাব? অবশ্য কয়েক মাস আগে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে থানা পর্যায়ে ভালো একটা পদ অর্জন করেছে। যদিও জাহানারা ছেলেকে অনেকবার বলেছেন, আমাগো রাজনীতির কাজ নাই। এখনকার রাজনীতির কোনো নীতি নাই। নেতারাও ভালো হয় না। কথায় কাজে মিল নাই। কোন সময় কোন বিপদে পড়বি কেউ ফিরা তাকাইবো না।

জবাবে আফতাব বলেছিল, আমরা আল্লার রাস্তায় থাকি তুমি কি চাও না?

ছেলের কথা শুনে এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। যে আল্লার ইশারায় এ জগতের সৃষ্টি। যার অসীম দয়ার বরকতে এখনো বেঁচে-বর্তে আছেন তার আনুগত্য অবশ্যই কর্তব্য। কিন্তু আল্লার দল নামে তো বেশ কয়েকটা দল আছে। যাদের কর্মকাণ্ড খোদ শয়তানকেও লজ্জায় ফেলবে। তেমন কোনো দলে ভিড়ল না তো ছেলেটা? এ ব্যাপারে তখনই কিছু জানতে চাননি বলে, এখন বেশ আক্ষেপ হচ্ছিল তার।

পাশ থেকে লতা মৃদু স্বরে ডাকছিল, দাদি, দাদি!

জাহানারা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কী কইবি ক! হুদাহুদি যন্ত্রণা করিস না!

-খিদা লাগছে!

-খিদা লাগলে এখানে কী, মায়েরে যাইয়া ক!

-তুমি খাওয়াইবা!

জাহানারা বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে বললেন, বউ, তর মাইয়ারে খাইতে দিলি না?

-কয় দাদির লগে খাইবো।

-আমার ভালা লাগতাছে না।

-আপনের নাতিন তো তাও কয় দাদির লগে খাইবো।

জাহানারা বিছানা থেকে নেমেই বুঝতে পেরেছেন তারও বেশ খিদা লেগেছে। খাওয়ার টেবিলে বসে তিনি বললেন, ভাত বাইড়া দাও।

রুকিয়া একটি থালায় ভাত বেড়ে এগিয়ে দেয় শাশুড়ির সামনে। তারপর ডাল আর তরকারির বাটি দুটোও এগিয়ে দেয়।

লতাকে খাওয়াতে খাওয়াতে রাগ অভিমান সহ কখন যে নিজেও খেতে আরম্ভ করেন বুঝতে পারেন না জাহানারা। রুকিয়ার অপেক্ষায় না থেকে নিজের হাতেই আরও ভাত তরকারি নিয়ে পাতে মাখাতে মাখাতে নাতনিকে দেবার পর নিজেও খেতে থাকেন। রুকিয়া টেবিলের বিপরীত দিকে একটি চেয়ার টেনে বসে।

প্রায় আধা আধি খাওয়া হতেই ফোনটা বেজে ওঠে। রুকিয়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, আম্মা, আপনের ফোন বাজে।

-নিয়া আয় তো মা!

রুকিয়া ফোন এনে জাহানারার হাতে দিতেই রিসিভ করে কানে লাগিয়ে বললেন, হ্যালো। কেমন আছেন? ফ্লাইট কবে?

ওপাশে বদরুল ব্যাপারীকে বলতে শোনেন, উরুজাহাজ আইজ রাইত দুইটায় ঢাকা গিয়া পৌঁছাইবো। তর পোলারে সময় মতন থাকতে কইস। কই কী করতাছে আল্লায় জানে। ফোন বন্ধ পাইলাম।

-আইচ্ছা, আপনে চিন্তা কইরেন না, আমি কইয়া রাখমু।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন নামিয়ে রেখে জাহানারা বললেন, তর শ্বশুর আইতাছে। রাইত দুইটার সময় ঢাকা নামবো। আফতাবরে খবরটা কেমনে দেই? ফোন নাকি বন্ধ কইরা থুইছে।

-ব্যবস্থা করতাছি। এইডা লইয়া চিন্তা কইরেন না।

জাহানারা পাতের বাকি খাবারগুলো এঁটো ফেলবার বাটিতে রেখে থালায় হাত ধুয়ে লতার মুখ মুছিয়ে দিলেন ভেজা হাতে।

এজলাসে জাহানারার ডাক পড়তেই তিনি এগিয়ে যান। তার উকিলের বক্তব্য শেষ হতেই ম্যাজিস্ট্রেট অবাক হয়ে বললেন, বদরুল ব্যাপারী একজন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানী মানুষ। তা ছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে এরই মধ্যে আপনি অবসরও নিয়েছেন। কোনো একজন নারী পঞ্চাশের পর সংসার বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে সেটাকে স্বাভাবিক বলা যাবে না। রাগের মাথায় এমন কাজ করা ঠিক হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

-ঠিক মনে করছি বলেই আমি আবেদন জানাইছি। লোকটা এইবার হজ করে দেশে আসার পরই গোলাম আযমের মরার সংবাদ পাইয়া কান্নাকাটি আরম্ভ করছে। এমন কি আমার বড় ছেলেও বাপের সঙ্গে গলা মিলাইছে। অথচ যারা আমাদের দেশটারে ধ্বংস কইরা ফেলল, তার পরও নানাভাবে দেশটার ক্ষতি করতে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে, তেমন পশুর সঙ্গে খাতির ভালোবাসা কে রাখতে যাবে তাদের সমগোত্রের না হইলে? আমার বাপ, খালা, চাচি এই ব্যাপারীর লোকজনের হাতেই নিঃস্ব হইছিলেন সব দিক দিয়া। তাদের অত্যাচারের চিহ্ন মুছতেই আমার সেই চাচি আর খালা আত্মহত্যা করছিলেন। ব্যাপারী পশুটা নিজের মুখে তার কীর্তি জানাইছে। বলছে, আমার বাপ মুক্তিবাহিনীর লোক ছিলেন। খালা আর  চাচি মুক্তি বাহিনীর লোকজনদের  সহযোগিতার জন্য নাকি শাস্তি পাইছেন। এমন পশুর সঙ্গ ছাইড়া দেওয়াটাই বরং আমার জন্য সম্মানের হবে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক জাহানারা খাতুন।

-আপনি আমার খাস কামরায় বসেন। ব্যাপারটা কী করা যায় দেখি।

ম্যাজিস্ট্রেট আনিসা বেগমের কথা উপেক্ষা করেননি জাহানারা। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসেননি। স্বামী এবং ছেলের মতে একাত্তরে হাজার হাজার কাফের, ফাসেক আর মুশরিক হত্যা করা হয়েছে। তারা যেমন ইসলামের জন্য বিপদজনক ছিল, তেমনই ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশে বদ্ধপরিকর। কাজেই তেমন বিপথগামী মানুষদের হত্যা করাটা অন্যায় হয়নি।

জাহানারা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, শিশু বাচ্চারা কী দোষ করছিল? আমার খালা আর চাচি কী দোষ করছিল?

হাজি বদরুল ব্যাপারী স্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাব দেবার বদলে রেগে উঠে বলেছিল, তুই তর বাপের মতন হইবি জানলে তর বাপের লগে লগে তরেও পুড়াইয়া মারতাম।

স্বামীর কথা শুনে মুহূর্তেই যেন মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গিয়েছিল জাহানারার। এ লোকটাও ছিল সেদিনকার নরপশুগুলোর সঙ্গে? চাচি-খালার সম্ভ্রম লুটেরাদের সঙ্গে? ছিহ!

তার পুরো শরীর কেমন রিরি করে উঠেছিল। এরই মধ্যে অমানুষটার সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছর সংসার করে ফেলেছেন। তার কাছে নিজেকে পুরোপুরি  সঁপে দিয়েছিলেন। অথচ একই মানুষ যে আরও বেয়াল্লিশ বছর আগে তার খালা এবং চাচিকে স্পর্শ করেনি তার তো কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। এতকাল পর ভণ্ড লোকটির কার্যকলাপ প্রমাণের কোনো পথও খোলা নেই। তারচেয়ে আরও বেশি লজ্জা আর অপমানের বিষয় যে, অমন নিকৃষ্ট লোকটির সন্তানও গর্ভে ধরেছেন। কী করবেন এ অশুচি জীবন নিয়ে? তার চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই কি উত্তম নয়?

আনিসা বেগম কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করে না জাহানারাকে। পরিণতি যেন এমনই হবার কথা  ছিল। তবে নব্বই দিনের ভেতর যদি বদরুল ব্যাপারী জাহানারার আবেদনে সাড়া না দেয় তাহলে তিনি মুক্ত হয়ে যাবেন। সাড়া দিলেও তার মুক্ত হতে তেমন বাধা থাকবে না।

স্বামী পুত্রের সঙ্গে অর্থহীন বিতর্ক দীর্ঘ না করে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘর থেকে। আদালতের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে ভাবছিলেন, কুলাঙ্গার আফতাবের এমন পরিণতি হবে জানলে তাকে আলোর মুখ দেখতে দিতেন না কিছুতেই। তবু তাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও নব্বই দিন। ব্যাপারী আদালতে হাজির হলে, আরও দৃঢ়তার সঙ্গে মুখের ওপর জানাতে পারতেন, যে দেশে এমন কুলাঙ্গাররা সম্ভ্রান্ত পরিচয় নিয়ে বাঁচে, সে দেশ আর যাই হোক মানুষের বাসযোগ্য নয়। কিন্তু এ মুহূর্তে দেশ ছেড়ে তিনি যেতে পারবেন না। পারবেন না প্রিয় জন্মভূমি থেকে বেশি দিন দূরে থাকতেও।

জেলা সদর আদালতের প্রধান ফটক দিয়ে বের হতে হতে বুক ভরে শ্বাস নেন জাহানারা খাতুন বি.এ.বিটি। মনের ভার যেন নিমেষেই দূর হয়ে যায়। স্বজনদের জন্য আর কিছু না পারলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পেরেছেন। বদরুল ব্যাপারীকে ফাঁসিতে ঝোলানো না গেলেও তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দিতে পেরেছেন। এটাই তার সান্ত্বনা।

(সমাপ্ত)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to ছোটগল্প: বিশ্বাসঘাতক

You must be logged in to post a comment Login