শৈলী বাহক

এত কাছে সব

এত কাছে সব
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

রবীন দত্ত

“ক্রমশঃ সন্ধ্যা নেমে আসছে ঠাকুরমা । ফিরতে যে অনেক দেরী হয়ে যাবে । এখান থেকে বাস ধরে করিমগঞ্জ তাও ঘণ্টা চারেকের রাস্তা । তারপর আবার অটো তবেই তো সদয়পুর শহর । ফিরে চল ঠাকুরমা । মাকে তো বলে আসা হয়নি।”                                                                                      

            “কিন্তু
বুড়ি আমাকে যে খুঁজে পেতেই হবে সন্দীপের ঘাটের কাছে সেই মাঠটা । যেখানে আমরা লুকোচুরি  – ধাসা কত কি যে খেলতাম ।“

            “ওই
ভদ্রলোক তো বললেন ,সন্দীপের ঘাট বলে এখানে একটা জায়গা ছিল । কিন্তু সে তো বহু বছর
আগে । এখন সেখানে তো কোনও ঘাটই নেই ।আছে 
কিছু হাউসিং কমপ্লেক্স ।“

            “চল
বুড়ি , তাহলে ফিরেই যাই । জানিস বুড়ি , ওই মাঠটা আমি খুঁজে পাবোই । তার মাটি মাথায়
ঠেকিয়ে ক্ষমা চেয়ে তবে আমি ফিরে যেতে পারব এ জীবনটা থেকে । “

            “ঠাকুরমা
আমায় বলবে কেন তুমি এই জায়গাটার গল্প করো প্রতিদিন আমার কাছে । যখনই সন্দীপের ঘাট
উঠে এসেছে আলোচনায় , আমি দেখেছি তোমার চোখ দুটো তখন খুঁজে নিয়েছে অতীতকে – দু
চোখের জল আমি দেখেছি । বলো না ঠাকুরমা । কী ছিল সন্দীপের ঘাটে । তোমার দু চোখ কি
খোঁজে ওখানে । কী হারিয়ে এসেছ সেখানে যে এমন আকুল ভাবে খোঁজো । তুমি আমাকে তো সব
বল, তাহলে এটা বলতে তোমার অসুবিধা কোথায় । আমি তো আর বাবা মাকে কিছু বলতে  যাচ্ছি না ।“

            “বলব
, তোকে একদিন সব বলব । যাবার আগে তোকে সব বলে যাব । তাহলেই তুই বুঝবি সন্দীপের ঘাট
কেন এতখানি ছিল আমার । আমি চলে যাবার পর সন্দীপের ঘাটের কাছে মাঠটা যদি খুঁজে পাস
কখনও তাহলে তার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিস । বলিস , ঠাকুরমা
ক্ষমা চাইতেই এসেছিলো কিন্তু মাঠটাই তো খুঁজে পায়নি ।“

            “তা
ঘটনাটা কি বলবে তো ।“

            “বলব
– তার আগে তুই বল তুই কেন মায়ের করা রান্না খাস না ।“

            “কেন
খাই না জানো , হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর কলেজে যাতায়াতের  সময়েই বুঝতে পেরেছিলাম বাবা এত টাকা কোথা থেকে
পায় । বাবা সেলস ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে একটা হেড ক্লার্ক । বাবাদের স্কেলে মাইনে
ত্রিশ হাজার টাকা । কিন্তু আমাদের সংসার খরচ – লোক লৌকিকতা –আমার  এডুকেশন – কার মেন্টেনেন্স – রেগুলার
গোল্ড  অর্নামেন্ট –  হট ড্রিংস কেনা এই টাকাগুলো আসে কোথা থেকে,  কম করে হলে মাসে সত্তর  পঁচাত্তর হাজার টাকা খরচ । জানতে পারলাম এগুলো
সব ঘুষের টাকা । আমি ডিপার্টমেন্টে  বাবার 
অগোচরে খোঁজ নিয়েছিলাম । যেদিন কনফার্ম হলাম , সেদিন থেকে চিলে কোঠায় তোমার
ঘরে স্টোভ জ্বেলে রান্না করতে শুরু করলাম । অনেকগুলো টিউশানি ধরলাম । পড়ার খরচ
তুলতে লাগলাম । বাবা-মা প্রচন্ড রাগারাগি করতে লাগলো । আমাকে বোঝাতে শুরু করলো ।
মাকে একটা কথাই বলেছি , এতদিন ঘুষের পয়সায় খেয়ে বড় হয়েছি এটা মনে পরলেই আমার ঘৃণায়
শরীর শিউরে ওঠে । বমি করে যদি অন্নপ্রাসন থেকে শুরু করে সব খাবার উগরে দিতে পারতাম
তাহলে সব চেয়ে খুশি হতাম । সেইটাই তো আর হয়না ঠাকুরমা । এই ভাবেই নিজের পরিশ্রমের
টাকায় কলেজ – ইউনিভার্সিটির গণ্ডী পেরিয়ে আজ পি এইচ ডি করছি । আশীর্বাদ কর ঠাকুরমা
এই ভাবেই যেন মাথা উঁচু করেই যেন আমি বেঁচে থাকতে পারি।“

            “ঠিকই সিধান্ত নিয়েছিস মা । খোকা যে
ঘুষ খায় তা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরে ছিলাম । ওকে বুঝিয়ে ছিলাম । ও শোনেনি । তাইতো
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চিলে কোঠার ঘরে বন্দী করে দিয়েছি ।“

         “আর একবার
বলো তো সন্দীপের ঘাটের  ঘটনাটা কি । এখনই
তোমায় বলতে হবে , বলতেই হবে ।“

         “শোন তবে ,
আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে আমার সঙ্গে অরুণের শেষ দেখা হয়ে ছিল সন্দীপের ঘাটের পাশের
মাঠটায় । ওকে ভালবাসতাম , কিন্তু ওইদিন ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে
দিয়েছিলাম। শুনেছিলাম ওর সঙ্গে নাকে 
চূর্ণী বলে একটা মেয়ের সম্পর্ক 
তৈরী হয়েছে এই রাগে । বাস্তবে কিন্তু এটা একটা রটনাই ছিল । ও কিন্তু
বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল । এই ঘটনার কিছু দিনের
মধ্যেই বাবা-মার দেখে দেওয়া ছেলেকে বিয়ে করে গ্রাম ছেড়ে দিয়ে তোদের বাড়িতে চলে আসি
। তারপর থেকে তার আর কোনও খোঁজ পাইনি । প্রতিদিন ভাবতাম আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা
চাইবো , সেটা আর এ জীবনে হয়ে উঠল না । ক্ষমা চাইতে গিয়ে জায়গাটাই আর খুঁজে পেলাম
না । “

         “ঠাকুরমা
ভুলে যাও সব।এরকম ঘটনা মানুষের জীবনে অনেক ঘটে ।ভুলে যাও সব কেমন।“

         “হ্যাঁরে ,
তুই যে  ছেলেটার গল্প মাঝে মাঝে করিস , সে
কেমন আছে রে । একদিন ওকে নিয়ে আসিস না আমার কাছে । একটু দেখব । খুব ভালো  স্টুডেন্ট 
তাই না রে ।“

         “হ্যাঁ
ঠাকুরমা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট । কিন্তু পড়ে খুবই কম । সেদিন ক্লাসে  আমরা কজন মিলে 
ডিবেট করছিলাম । সঙ্গে আমাদের ফিলসফির স্যার ডক্টর এস. কে. ঘোষও ছিলেন । তোমার
ওই মুখচোরা ছেলেটা জাকে কোনোদিন চোখের ওপর চোখ রেখে কথা বলতে দেখিনি, যে সারাদিন
আপন মনে ঘুরে বেড়ায় আর বিড় বিড় করে কি সব বলে । সেদিন সে ক্লাসের এক কোনে চুপচাপ
বসে ছিল , দেখে মনে হচ্ছিল ডিবেট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওর কানে বোধহয় কিছুই যাচ্ছিল
না । হঠাৎ দেখলাম সেগমন্ড ফ্রয়েডের একটা থিয়োরি যেটা ডক্টর এস. কে. ঘোষ সাপোর্ট  করেছিলেন সেটার এগেনস্টে বলতে উঠল । বিশ্বাস করো ঠাকুরমা ও যখন উদাত্ত
স্বরে , তীক্ষ্ণ ইংরাজীতে একটার পর একটা যুক্তি খাড়া করছিলো , ফ্রয়েডের থিয়োরিকে দেবীপ্রসাদ –মোতিলাল
–অনির্বান্ ইত্যাদি প্রেজেন্ট ফিলোসফারদের রেফারেন্স দিয়ে খন্ডন করছিলো  ।  বিশ্বাস
করো ঠাকুরমা সারা ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলো । এমন কি লজিকগুলোর  এগেনস্টে ডক্টর ঘোষও কিছু বলতে পারেনি , কোনও যুক্তি খাড়া
করতে পারেনি । প্রায় এক ঘণ্টা যুক্তির জাল বিছিয়ে ও স্তব্ধ হোলো তারপর ডক্টর ঘোষের
দিকে একবার তাকিয়ে ক্লাস ছেড়ে কোথায় চলে গেল । ডক্টর ঘোষ শুধু বলেছিলেন বিক্রমকে
নতুন করে চিনলাম । বিকালে ছুটির পর ওকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি ও কলেজের দক্ষিন
কোণে এক পলাশ গাছের দিকে একমনে তাকিয়ে কি যেন দেখছে । বলতে গেলাম আমি তোমায় খুঁজছি
। ও গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কুঁড়ি এসে গেছে পলাশ আসবে।‘ আমার না বলা
প্রশ্নের উত্তর পেয়ে বিষাদময় মন নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম।

             “তুই ওকে ভালবাসিস না রে ।“

              “ঠাকুরমা
ও সব ভালোবাসার উর্ধে । ওকে ভালোবাসা দিয়ে ছোঁয়া যাবে না ।“

              “তাহলে
কি দিয়ে ।“

              “সেটাই
তো জানি না ।“       

              “একদিন
ওকে আমার কাছে আনিস কেমন ।“

              এর
সপ্তাহ দুয়েক পরের ঘটনা । একদিন দুপুর বেলা , বাবা অফিসে – মা মাসির বাড়ি, বুড়ি বিক্রমকে
নিয়ে ঠাকুরমার ঘরে ।

              “ঠাকুরমা
বিক্রমকে নিয়ে এসেছি । এই হল সেই বিক্রম ।“

ঠাকুরমাকে প্রনাম করে বিক্রম ঘরের কোনে সোফাটায় বসল ।

              “ওকে
একটু জল মিষ্টি দে রে বুড়ি ।“

              “
না-না , আপনার ব্যাস্ত হবার কিছু নেই । “

              “
তোমার নাম কি বাবা ।“

              “
বিক্রম ঘোষ ।“

              “
কোথায় বাড়ি । “

              “
শ্যামবাজার । “

              “
বাড়িতে কে কে আছে ।“

              “
আমি আর মা । “

              বুড়ি
দেখল ঠাকুরমা জানলার দিকে তাকিয়ে কি যেন সব ভাবছে । এই ভাবে কিছুক্ষণ কথাবার্তার
পর বিক্রম চলে যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাকুরমাকে প্রনাম করতে গেলে , ঠাকুরমা
জিজ্ঞাসা করলো , “ তোমার বাবার নাম কি ? “

              “
লেট অরুণ ঘোষ – উনি মারা গেছেন বছর তিনেক হল । “

              বুড়ি
দেখল ঠাকুরমা ক্রমশ হেলে পরছে , দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরমাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় নিয়ে
গিয়ে শুইয়ে দিল ।

              “
কি হল তোমার হঠাৎ , কেমন ফিল  হচ্ছে এখন ।

              “
আসলে কি জানিস , আমি না সকালে প্রেসারের ওষুধটা খাইনি । তাই বোধহয় মাথাটা ঘুরে গেল
। “

              বুড়ি
বুঝল ঠাকুরমা মিথ্যে কথা বলছে । ও নিজের হাতে ঠাকুরমাকে প্রত্যেক দিনের মত
প্রেসারের ওষুধ  খাইয়ে ছিল । তখন ও কিছু
বলল না । বিক্রম চলে যেতে ও ঠাকুরমার পাশে শুয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা
করল –

              “ঠাকুরমা
দেখলাম বিক্রম ওর বাবার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মুখের রঙ বদলে গেল , মৃত্যুর
খবরটায় তোমার মাথা ঘুরে গেল । কেন ঠাকুরমা এরকম হল , আমায় বল , বলতেই হবে তোমাকে ।

              “
বুড়ি বিক্রমকে দেখেই আমার অরুণের কথা মনে পরে গেল । সেই সন্দীপের ঘাটে যাকে তাড়িয়ে
দিয়ে ছিলাম – যাকে বাতিল করেছিলাম । সেই হুবহু একই মুখ , একই রকম উজ্জ্বল  উদাস চোখ। একই রকম লম্বা , একই গায়ের রঙ । যখন ও
ওর বাবার নাম বলল, তখনই বুঝলাম সেই অরুণের ছেলে । তাই অরুণের মৃত্যুটা মেনে নিতে
পারলাম না রে , মাথাটা ঘুরে গেল ।  আমার তো
ক্ষমা চাওয়া হল না মা । ক্ষমা চাইব এই আশাতেই তো এত বছর বেঁচে ছিলাম । আর বাঁচার
তো কোন অর্থই রইল না মা । “

              “
তোমায় যে আমার জন্য বাঁচতেই হবে ঠাকুরমা । “

              পরম
স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঠাকুরমা বলল, “ সে দেখা যাবে। তবে তোর কাছে
আমার একটা অনুরোধ আছে যে মা । আমি বুঝেছি তুই বিক্রমকে ভালোবাসিস । ওকে আঁকড়ে ধরে
রাখিস মা । কোন কিছুর লোভে ওকে তাড়িয়ে দিস না কেমন । আর ওকে বলিস- ঠাকুরমা চলে
গেলেও তার আত্মা প্রতিনিয়ত তোমার মৃত বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে যাবে।

              এই  প্রথম বুড়ি ঠাকুরমাকে কাঁদতে দেখল । বুঝল
পাথরের ভেতরে অনেক ভেতরে জলও থাকে । 

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login