শাহেন শাহ

ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র: নৌকাডুবি

ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র: নৌকাডুবি
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[‘একালে গল্পের কৌতূহলটা হয়ে উঠেছে মনোবিকলনমূলক। ঘটনা-গ্রন্থন হয়ে পড়েছে গৌণ। তাই অস্বাভাবিক অবস্থায় মনের রহস্য সন্ধান করে নায়ক-নায়িকার জীবনে প্রকাণ্ড একটা ভুলের দম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল —অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু ঔৎসুক্যজনক। এর চরম সাইকলজির প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, স্বামীর সম্বন্ধের নিত্যতা নিয়ে যে সংস্কার আমাদের দেশের সাধারণ মেয়েদের মনে আছে তার মূল এত গভীর কি না যাতে অজ্ঞানজনিত প্রথম ভালোবাসার জালকে ধিক্কারের সঙ্গে সে ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু এ-সব প্রশ্নের সর্বজনীন উত্তর সম্ভব নয়। কোনো একজন বিশেষ মেয়ের মনে সমাজের চিরকালীন সংস্কার দুর্নিবাররূপে এমন প্রবল হওয়া অসম্ভব নয় যাতে অপরিচিত স্বামীর সংবাদমাত্রেই সকল বন্ধন ছিঁড়ে তার দিকে ছুটে যেতে পারে। বন্ধনটা এবং সংস্কারটা দুই সমান দৃঢ় হয়ে যদি নারীর মনে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের অস্ত্র-চালাচালি চলত তা হলে গল্পের নাটকীয়তা হতে পারত সুতীব্র, মনে চিরকালের মতো দেগে দিত তার ট্র্যাজিক শোচনীয়তার ক্ষতচিহ্ন।’
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভূমিকা, ‘নৌকাডুবি’)]

উপন্যাসে ঘটনা পরম্পরার বদলে চরিত্রের ‘আঁতের কথা’ বের করবার রীতি রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ তে প্রথম অবলম্বন করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার ঠিক পরের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’-তেও তার রেশ বজায় ছিল। ঘটনা প্রবাহ সেখানে খুব সামান্যই আছে। মুল একটিই ঘটনা–বিয়ে করে ফেরার পথে নৌকা ডুবে যাওয়া। তাকে আশ্রয় করে রবীন্দ্রনাথ মূলত চারটি চরিত্রের (রমেশ, কমলা, হেমনলিনী, নলিণাক্ষ) মানসিক নানান টানাপোড়েনকে চিত্রিত করেছেন। তাঁদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জটিলতাকে পাঠকের সামনে হাজির করেছিলেন। সেই উপন্যাসটি অবলম্বনে এবারে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ-এর নতুন চলচ্চিত্র–‘নৌকাডুবি ( Boat wreck)’। ‘নৌকাডুবি’ নিয়ে এর আগেও হিন্দিতে কিংবা বাংলাতে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ‘অবলম্বন’ করে তৈরি এই ছবি একদম নতুন স্বাদের। এই ছবির দর্শকেরা কিন্তু একেবারেই এক নতুন পরিচালক ঋতুপর্ণকে পাবেন। তাঁর আগের ছবিগুলোতে তিনি যে ঘরানা তৈরি করেছেন তার থেকে এ ছবির ট্রিটমেন্ট একেবারেই ‘হ্যট্‌কে’। ঋতুপর্ণর নিজের কথাতেই বলা যায় সিনেমা হিসেবে এই ছবিতে তেমন কোনো প্যাঁচ-পয়জার নেই। ‘নৌকাডুবি’ নিতান্তই একটি ‘সহজ, সুস্থ বাণিজ্যিক ছবি’। ‘মূলধারা’-র বাণিজ্যিক ছবির বাইরে এ ধরনের চেষ্টা খুবই প্রশংসনীয়। সুভাষ ঘাই-এর ‘মুক্তা আর্ট্‌স লিমিটেড’-কে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এই রকম একটি ছবি বানানোর সাহস জোগানোর জন্য আমাদের অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো উচিত।

গল্প ও চরিত্র বিষয়ে পরিচালক কিছু বিষয়ে নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়েছেন। তবে মূল প্লটটি এক। এ ক্ষেত্রে ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথ থেকে বেশিরভাগটাই নিয়েছেন। তবে চরিত্রগুলির মানসিক দ্বন্দ্বের দিক গুলিকে তৈরি করার ক্ষেত্রে পরিচালক আলাদা রাস্তা বেছে নিয়েছেন। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রগুলির সংকটের যে সাবলীল এবং হৃদয়স্পর্শক মূহুর্ত তৈরি করেছেন চলচ্চিত্রে সেটিকে পুনর্নিমানে কিছুটা খামতি আছে। চরিত্রগুলির মনের ভেতরে আরো বেশি করে ঢুকে পড়ার অবকাশ তেমনভাবে তৈরি করেননি ঋতুপর্ণ তাঁর ‘নৌকাডুবি’-তে। বিশেষ করে নলিনাক্ষ চরিত্রটি নিয়ে বলা যায়, এক্ষেত্রে প্রসেনজিতের মত একজন অভিনেতাকে পেয়েও তাকে বেশি ব্যবহার করা গেল না। চিত্রনাট্যে ঋতুপর্ণ যদি চরিত্রটির জন্য আরো কিছু উপকরণ রাখতেন তাহলে এর ফল হয়তো আরও উপযুক্ত হতে পারতো। তাছাড়া ছবির শেষের দিকে, এতদিন ধরে পর পুরুষের সঙ্গে সংসার করা কমলার মধ্যে রমেশকে আবার দেখে যে সংকট তৈরি হওয়ার কথা সে সংকটের তেমন আভাষও তেমন তৈরি করতে পারেননি পরিচালক। ‘রবীন্দ্রনাথ’–প্রতিষ্ঠানটিকে খানিকটা দূরে সরিয়ে রেখে যদি ছবিটিকে যদি শুধুমাত্র একটি বাংলা সিনেমা হিসেবে ভাবা হয়, যার কোনো পূর্বসূত্র নেই; তাহলে এটি একটি ঝাঁ চকচকে সুন্দর বাংলা সিনেমা হিসেবে প্রশংসা পাবেই। তবে রবীন্দ্র অনুরাগীরাদের দাবি হয়তো একটু বেশিই। তাই তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা হতাশ হতে পারেন।

ছবিটির কয়েকটি দৃশ্য অনবদ্য। পরিচালক আর চিত্রগ্রাহক (সৌমিক হালদার) এখানে মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন বলা যায়। দুটি দৃশ্যের কথা এখানে উল্লেখ করবো। প্রথমটি নৌকাডুবির পর রমেশের (যিশু সেনগুপ্ত) ‘সুশীলা’(আদতে ‘কমলা’ চরিত্রে রিয়া সেন)-কে খুঁজে পাওয়ার দৃশ্যটি। এখানে আবহে ‘যে রাতে মোর দুয়ার গুলি’-র ব্যবহারও মুহূর্তটিকে আলাদা চমৎকারিত্ব দিয়েছে। আর একটি দৃশ্য, ছবির শেষের দিকে কমলা যখন আবিষ্কার করলো সে যার সঙ্গে সংসার গড়েছে সে আসলে তার স্বামী নলিনাক্ষ নয়, সেই মুহূর্তে তার মনের ভাঙ্গা-গড়াটাকে ঋতুপর্ণ অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে পোর্ট্রেট করেছেন। এই ছবির সব থেকে বড় পাওনা রিয়া সেন। নির্দ্বিধায় বলা যায় এ ছবি রিয়ার অভিনয়ের কেরিয়ারে একটা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। দর্শক সম্পূর্ণ নতুন এক রিয়া সেনকে আবিষ্কার করবেন এ ছবিতে। আর যিশু সেনগুপ্তর কেরিয়ারে এ ছবির অভিনয় এখনো পর্যন্ত তাঁর সেরা অভিনয়গুলির মধ্যে শীর্ষে থাকবে এ কথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। ঋতুপর্ণর নিজের মনে হয়েছে এ ছবিতে যিশুকে দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে যিশু যেন যুবক বয়সের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রাইমা আগাগোড়া সাবলীল অভিনয় করে গেছেন। সাবর্ণী দাসের পোশাকে রাইমা কিছু কিছু জায়গায় সুচিত্রাকে মনে পড়িয়ে দেন। প্রসেনজিৎ তাঁর ছোট্ট উপস্থিতিতেই নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। ‘চোখেরবালি’-র পরে আরো একটি রবীন্দ্র উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নে নলিনাক্ষ চরিত্রে প্রসেনজিৎ দর্শকের মনে দাগ কাটতে সক্ষম। হেমনলিনীর বাবার চরিত্রে ধৃতিমানও তাঁর ছাঁপ রেখেছেন।

ঋতুপর্ণর ছবিতে বরাবর গানের একটা আলাদা মাহাত্ম্য থাকে। রবীন্দ্রনাথের গানকে ঋতুপর্ণ যেভাবে ব্যবহার করেন এখানেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। রাজা নারায়ণ দেব আর সঞ্জয় দাস ঋতুপর্ণর চাহিদা গুলিকে খুব যত্ন সহকারে মিটিয়েছেন। ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’ কিংবা ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি’-র মত গানকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘পারমিতার একদিন’-এ প্রথম গানটির ব্যবহার অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ‘নৌকাডুবি’-তে পুরুষ আর মহিলা দুই কন্ঠে আলাদা আলাদা সময়ে গানটির ব্যবহার ভাল লাগে। সুপ্রতীক দাস, শ্রীকান্ত আচার্য্য, অভিরূপ গুহঠাকুরতা, সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, পরমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গান গুলি গেয়েছেন। পুরো সিনেমা জুড়ে এর আবহে বিভিন্ন সময়ে গানগুলি ছবিটিকে টানটান করে ধরে রেখেছে।
এ ছবিতে শিল্প নির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ আর সম্পাদক অর্ঘ্যকমল মিত্রের কাজ দর্শক অনেক দিন মনে রাখবেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সময়টিকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ইন্দ্রনীল। আর অর্ঘ্যকমলের সম্পাদনা ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘নৌকাডুবি’-কে ‘সহজ, সুস্থ বাণিজ্যিক ছবি’ হিসেবে ঝাঁ চকচকে একটি শিল্প আকারে উপযুক্ত রূপদান করেছে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র: নৌকাডুবি

You must be logged in to post a comment Login