অন্তিম শয়ানে শিল্পী কলিম শরাফী
বরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী মঙ্গলবার দুপুরে নিজ বাড়িতে মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ৮৬ বছর। শহীদ মিনারে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল প্রয়াত শিল্পীর প্রতি রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা জানায়। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবির এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুজ্জামান প্রয়াত শিল্পীর কফিনে ফুল দেন।
শিল্পীর মরদেহ ঢাকার বারিধারার বাসা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় সন্ধ্যা ৬টার দিকে। সর্বস্তরের মানুষ সারিবদ্ধভাবে প্রয়াত শিল্পীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। কালো কাপড়ে নির্মিত বিশেষ মঞ্চে রাখা কফিন ভরে উঠে শ্রদ্ধার ফুলে। এশার নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে শিল্পীর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। এরপর তার মরদেহ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সিপিবির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, গণতন্ত্রী পার্টির মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ।
শিল্পী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীর মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক এম আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, মুস্তফা মনোয়ার, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কামাল লোহানী প্রমুখ।
বরেণ্য এ শিল্পীকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে সমবেত হন হাজার হাজার মানুষ।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তপন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, কলিম শরাফী স্ত্রী অধ্যাপক নাওশাবা খাতুন এবং দুই সন্তান আলেয়া শরাফী ও আজিজ শরাফীকে রেখে গেছেন। প্রয়াত শিল্পীর সন্তানরা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।
নাট্যশিল্পী রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কলিম শরাফী বেশ কিছু দিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। “তিনি ছিলেন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার পথিকৃৎ”, বলেন তিনি। কলিম শরাফীর মৃত্যুর খবরে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিরা বারিধারায় তার বাড়িতে ছুটে যান। প্রিয়জনকে হারিয়ে অনেকের চোখে ছিলো জল।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কামাল লোহানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কলিম শরাফী শুধু সঙ্গীত শিল্পীই ছিলেন না। তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। কলিম শরাফীর জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়ি মহকুমার খয়রাডিহি গ্রামে। সেটা তার নানা বাড়ি। শৈশব ও কৈশোরের অধিকাংশ সময়ে নানাবাড়িতেই দিন কেটেছে তার। উপনিবেশিক শাসনে থাকা ভারতবর্ষে ছাত্র জীবনেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন কলিম শরাফী। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলও খাটেন তিনি। কারাগারেই আন্দোলনকর্মী বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার।
‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানায় কাজ করার সময় তিনি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সংস্পর্শে আসেন, যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এর মধ্যেই চলতে থাকে সঙ্গীত সাধনা।
১৯৪৬ এর দাঙ্গার সময় এইচএমভি থেকে বের হয় তার গণসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড। প্রথমে গণসঙ্গীত গাইলেও পরে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা শুরু করেন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান রেডিওতে নিষিদ্ধ ছিলো কলিম শরাফীর গান। বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে শিল্পী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। শুধ সুর সাধনাই নয়, বহু সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন কলিম শরাফী। দীর্ঘদিন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনাও করেন তিনি। সঙ্গীত জীবন দীর্ঘ হলেও এই সময়ে তার প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ৫। সঙ্গীতে অবদানের জন্য একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন কলিম শরাফী। এছাড়াও অনেক পুরস্কার ও সম্মামনা পেয়েছেন তিনি। ‘৯০ এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করার কাজ করেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।
You must be logged in to post a comment Login