শামান সাত্ত্বিক

এ লে ফ্লে দ্যু মাল – শেষ পর্ব

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এ লে ফ্লে দ্যু মাল ১
এ লে ফ্লে দ্যু মাল ২
এ লে ফ্লে দ্যু মাল ৩
এ লে ফ্লে দ্যু মাল ৪
এ লে ফ্লে দ্যু মাল ৫

১৮

ফয়েজুর রশীদ বোনো আগে থেকেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন, ব্যাপারটা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাপ মারতে তিনি ওস্তাদ, কিন্তু এবারে সাপটাকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণে আনা চাই। তার মান-সন্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তিকে পর্যুদস্ত করে ফেলতে যাচ্ছে এই অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ ছোকরা। অথচ এর সামান্যতম ইঙ্গিত বা লক্ষণ তাদের হাতে ছিল না। মানুষ কখন যে কার দ্বারা জব্দ হয়, তা কি কেউ জানে! এত জালে, চক্রাকারে সারা জীবন খেলেও এখনো তাল পান না, কখন কোথায় কী ঘটে যাবে! তার জন্য প্রস্তুতিই বা কি? একেই বলে, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। মানুষের ধরা-ছোঁয়া-বোঝার বাইরে।

শায়ান সাজঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হয়। ঘরের মাঝামাঝি আলিশা। আতঙ্কে সেও উঠে দাঁড়িয়েছে। বিউটিশিয়ানরা এখনো কনের পাশে রয়ে গেছে। তারাও ভীত-সন্ত্রস্থ। দু’চারজন আলিশার বান্ধবীও সে রকম আতঙ্ক নিয়ে শায়ানকে দেখছে। চোখে চোখে কথা হয়, আলিশা ও শায়ানের। কিন্তু শায়ান আলিশার চোখের ভাষা বুঝে উঠে না, বুঝে উঠতে কষ্ট হয় তার মুখের অভিব্যক্তি, যা আগে কখনো হয়ে উঠেনি। ওখানে না আছে আবেগ, প্রেমময় অনুভূতি, ভালবাসা বোধ। আলিশার শুষ্ক চোখে কেমন এক রোষ, তার আজ এই উৎসবের দায়িত্ব পালনই সব। সেখানে শায়ান কই? একি সেই আলিশা, যাকে শায়ান তার স্বপ্নের উর্বশী বলে জেনেছে! আলিশা নির্বাক, যদিও আলিশার কন্ঠে কথা শায়ান কখনো শোনেনি। নির্বাক আলিশার চোখ এবং মুখাবয়বে আজ এ কিসের ইঙ্গিত?

শায়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠে। কী করতে হবে ভেবে পায় না। কি হলো আলিশার? তাকে এই নরকপুরীতে উদ্ধারের কাজেই তো সে নিল আজ এই সাজ। ছোট বেলায় শুনে শুনে বড় হয়েছে, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’। আজ সেও তাতে সজ্জিত হলো। তাহলে কেন এমন আলিশার ভাব! প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু রাগ করবে কার উপর? এতো সে নয়, যে এক নিমিষে তার সাথে উড়ে গিয়েছিল সে বন বনানীতে। তাহলে কি সে এক মিথ্যা স্বপ্নে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল? ধূর্ত ফয়েজুর রশীদ বোনো এই সময়টার জন্যই বোধ হয় অপেক্ষা করে আছে। তিনি শায়ানকে পাশ কাটিয়ে সাজঘরে ঢুকে আলিশার দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘মা, তোমাকে উনি নিতে এসেছেন। তুমি তার সাথে যাও।’ আলিশা পাথর হয়ে আছে। বারগেন্ডি গাউনে বিয়ের সাজ। ভাস্করের হাতে গড়া এক মোহনীয় মূর্তি। তার চোখের পাতার পলক পড়ছে না। উদ্ভ্রান্ত তার দৃষ্টি। শূণ্যতার সাথে মিশে আছে কেমন এক ঘৃণা, ভয়। বড় উদ্ভ্রান্ত সে। কোন উত্তর আছে বলে তার মনে হয় না। কালো মেয়ের কালো পুরু ঠোঁট। তাতে কাঁপুনির দেখা মেলা যায় কি?

বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে শায়ান। যার জন্য সে নিয়েছে এমন বেশ, সে এখন পাথর সদৃশ স্তব্ধ। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছে এখানে, তা এখন বিনষ্ট হতে বসছে। এক ঝটকায় সে নিজের ডান হাত দিয়ে আলিশার ডান হাত ধরে টানতে থাকে। উচ্চস্বরে বলে উঠে আলিশা, ‘না!’ থতমত খেয়ে শায়ান তার হাত ছেড়ে দেয়। এই প্রথম দেবীর কথা তার কানে এলো। তা এক গভীর তীক্ষ্ণতায় তার হৃদয়ের তন্ত্রী ছিঁড়ে দিলো। দেরী না করে ফয়েজুর রশীদ বোনো-ও সাথে সাথে বলে উঠে, ‘যাও মা, উনি অনেক কষ্ট করে তোমাকে এখানে নিতে এসেছেন।’ ‘না, আমি যাবো না। আমি ওর সাথে যাবো না।’ আলিশার জেদী ও দৃঢ় উত্তর। আলিশার কন্ঠগত প্রকৃতির মাদকতাও ঝরে পড়ে। প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়ে শায়ান। এ যে তার সন্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। ক্ষুব্ধ হয়ে তীব্র বেগে সে আবারো নিজের ডান হাতে আলিশার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরে, ঝটকা টানে দৃঢ়তায় বলে, ‘আসো, আসো আমার সাথে।’ আলিশাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। সে এবার সর্বশক্তি দিয়ে নিজের হাত টেনে রেখে, আগের চাইতে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘ছাড়ো ছাড়ো আমাকে। আমি যাবো না, কখ্‌খনো ওর সাথে যাবো না। তারপর হবু শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে বলুন।’ মূহুর্তেই শায়ানের হিতাহিত জ্ঞান বিলুপ্ত হয়। কোন কিছু না ভেবে কাঁধের অস্ত্র উঠে আসে তার দু’হাতে। একেবারে আলিশামুখো তাক করে বসে। হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত চিৎকার দিয়ে উঠে আলিশা, ‘মারবে? মারো। এ ছাড়া তোমার আর কি বা করার আছে? হোক এটাই তোমার আমার সাথে সর্বশেষ কীর্তি।’ সশব্দে কাঁদতে শুরু করে আলিশা। কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ে। তার সাজসজ্জাকালে বসা নীচু কাঠের বেদীতে মাথা নামিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

কনফিউজড শায়ান। কী করতে এসে কী করে ফেললো সে! নিজেকেই বা দোষ দেয় কিভাবে? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। একি! তার ভেতরের থাকা আলিশার বাকি দু’চারটা প্রজাপতি ছটফট করছে কেন? তার এমন লাগছে কেন? এ কিসের লক্ষণ? আহ্‌ প্রজাপতিগুলো এভাবে বেরিয়ে আসতে চাইছে কেন? এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন তার? হা করে থাকে শায়ান কিছুক্ষণ। প্রজাপতিগুলো তার নিশ্বাস নিঃসৃত হয়ে দুর্বল গতিতে আলিশার চোখের জলে মিলিয়ে যায়। শায়ানের সেখানে টিকে থাকা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। প্রজাপতি শূন্য হৃদয় অসহ্য বেদনায় ঝড়ের গতিতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে তার জিপ গাড়িতে উঠে বসে।

পুরো বিয়ে বাড়ি এতক্ষণ পিন পতন নীরবতায় এক দুর্দান্ত নাটকের মহড়া সচক্ষে অবলোকন করে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। শায়ানের প্রস্থানে তাদের সম্বিত ফিরলে বিয়ে বাড়ির সবাই আলিশার ভূমিকাকে দারুন দারুন বলে সমর্থন দিয়ে উপভোগ করতে থাকে।

১৯

বনানীর এক প্রান্তে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে শরীর থেকে যুদ্ধ বেশ খুলে ফেলে দেয় জীপ গাড়ির মাঝে। আজ প্রকৃতিকে ভীষণ উষর নিঃসঙ্গ নিস্তেজ মনে হয় তার। এত বিষাদাত্মক রূপ প্রকৃতির সে কখনো দেখেনি। শায়ানের পথ চলে না। জলাধারে পানি বয়ে যায়। কিন্তু তার হৃদয়ের শুষ্কতা কমে না। শায়ান জানে না, কী তার করা উচিত! কিন্তু তার ভেতরের বিক্ষোভ যে কাটে না। একসময় হৃদয়ের আগুন ঠিকই বেরিয়ে আসে। মনোরম সুদৃশ্য পিকচার পারফেক্ট বাড়িটা এখন সে আগুণে জ্বলে পুরে ছাই হচ্ছে। এক স্তব্ধতা জড়িয়ে ধরে শায়ানকে। জলাধারের মাঝখানের উষ্ণ পানিতে দপ করে সে বসে পড়ে বাম পা সামনে ভাঁজ করে, ডান পা হতাশ ভঙ্গিতে সামনে এলিয়ে দেয়। চতুর্দিকে ধোঁয়ার উদগীরণ চলছে অনবরত।

দূরে খোলা আকাশ মেঘ কালো। পাহাড়ের উপরও কালো মেঘ। কালো মেঘ আকাশের একাংশে। অল্প অল্প করে বৃষ্টি নামছে। এই বৃষ্টি শায়ানের খুব প্রিয়। এমনকি শ্বেত উর্বশীদের দেশেও ছিল তা তার প্রিয়। ভঙ্গুর এক মানুষ জলাধারের খোলা প্রান্তরে নিশ্চুপ হেলে বসে আছে। বৃষ্টি নামছে তার উপর। তার প্রিয় বৃষ্টি। ধোঁয়া নেতিয়ে গেছে বা মিলিয়ে গেছে। পোড়া বাড়ির অবশেষও এই বৃষ্টিতে সটান ভিজে আছে বিষন্নভাবের জলছবিতে। কাঠ কয়লাগুলোতে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। ছাইগুলোও হচ্ছে পানিতে জবুথুবু। পানির সাথে গড়িয়ে যাচ্ছে ছাই। বৃষ্টি বিধৌত প্রকৃতির এই পরিবেশ কোনভাবেই শায়ানের ভেতরের সেই দীপ্ত সুরকে স্তব্ধ করে দেয়নি:

All my life I’ve been waiting for
In the perfume of pain
To forget when I needed more
Of love’s endless refrain

We live and we pray
pour les fluers du mal
I’ve lost my way
What is done will return again
Will I ever be free?

শুনুন সেরাহ ব্রাইটম্যান – এ লে ফ্লে দ্যু মাল

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to এ লে ফ্লে দ্যু মাল – শেষ পর্ব

You must be logged in to post a comment Login