কুলদা রায়

ও টগর, ও কুক্কুট : দ্বিতীয় পর্ব

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

প্রথম পর্বের লিংক :

দ্বিতীয় পর্ব

মেজ ঠাম্মার দীর্ঘ চাচর কেশ। গন্ধরাজ তেল মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠেই আবার গন্ধরাজ তেল মাখতে শুরু করে। ততক্ষণে সূর্যটা পশ্চিমপূর্ব দিক থেকে কিছুটা মাথাও উপরে উঠে যায়। সারি সারি নারিকেল গাছের পাতায় ছায়া দোলে। দেখতে দেখতে মেজ ঠাম্মা উচ্চস্বরে বলে, অ বিনা, টাকি মাছ দিয়া নটেশাক রানছ নাকি? সাথে দুইটা রসুন ভিজে দিও। টাকি মাছ দিয়ে নটে শাক, রুই মাছের মুড়ি ঘণ্ট, পিপ্পল শাক দিয়ে হালকা ব্যঞ্জন—কখনো কখনো চুকাই শাকের খাট্টামিঠা খেতে খেতে মেজ ঠাম্মা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে এক বাটি মুড়ি। দুটো নাড়ু। মুড়ি খাওয়ার পরে এলাচদানা দাঁতে কাটতে ভাল লাগে। দুটো পাখি সুপারিগাছের উপর থেকে ডাক দেয়, হিট্টি। হিট্টি। হিট্টি।

এ সময় ঠাম্মা মুরগী দুটো নিয়ে মন্দিরের পাশে চুপচাপ বসে থাকে। দুপাশে দুটো শান্ত মুরগী। মাথায় ছোট্ট বোল উঠেছে। দানা দিলে ঠুক ঠুক করে খায়। খেতে খেতে সারা উঠোনময় হেটে বেড়ায়। আর হাফ ধরে গেলে ঠাম্মার দুপাশে বসে থাকে। ছোটট বোনটি ছুটে এসে বলে, আমিও মুরগী হমু। মুরগী হমু। ঠাম্মা পুরনো বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কুকরু। কু। কুকরু কু। ছাঁদের কার্ণিশে বটগাছ জন্মেছে। বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে সবুজ সরল বটপাতা।

অন্ধকার নামার আগে খেতে বসেছে মা। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে নিয়েছে। কাঁচা পিঁয়াজ কুঁচি কুঁচি করে কাটা। মা সামান্য লবণ দিয়ে ডলে ডলেমেখে খেতে ভালবাসে। তারপর সঙ্গে লেবু। রান্নাঘরের পিছনটিতে লেবু গাছ। গোড়ায় ছাই ছিটিয়ে দিলে ফুল আসে। সারা বছর লেবু ধরে। এলাচি লেবু। দাদু বলে, এলাচি নয়রে শালা—এইটা কাগজী লেবু।

ঠিক এ সময় একজন কালোপনা বউ রান্নাঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কপালে বড় করে সিদুঁরফোটা। চওড়া লাপেড়ে শাড়ি। কালো মুখ। কিছুটা শুকনো শুকনো। ঠোঁট দুটো লাল। নাকে নোলক। দীর্ঘ এলো চুল। বলল, চাট্টি খেতে দাও।

অন্ধকার হয়ে আসছে। ডালিমগাছের উপর টুনটুনি পাখিদুটো বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছে। দাদু উঠোনে খট খট করে খড়ম পায়ে ঘোরাঘুরি করছে। পিদিম হাতে এবার মাকে মন্দিরে যেত হবে। কালো বউটি বারান্দার এক কোণে আঁচল পেতে বসে পড়েছে। মা তার পাতের ভাতগুলো একটি থালায় বেড়ে দিল। শুকনো মরিচ দিয়ে খেতে খেতে কালো বউটি বলে উঠল, ইলিশমাছ কবে রানবা গো বউ? ইলিশ খাতি মন চায়।

মা হাত ধুয়ে পিদিম ধরাতে গেল দোতলায়। বড় বোন সাজবাতির সলিতা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ দরোজায় পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেজ বোনটি ঝটপট ধুপতিতে নারিকেলের খোসার উপর ধুপ ছড়িয়ে দিল। আগুন দেবে কি দেবে না ভেবে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে কয়েকটা মশা ভনভন করতে লেগেছে মাথার উপরে। দেওয়ালের একপাশে পলেস্তারায় ফাঁটা দাগে একটি টিকটিকি হা করে চেয়ে আছে। মশা কাছে এলেই গব করে গিলে খাবে। মৌমাছির চাক স্তব্ধ।

দোঁতলার সিঁড়ি বেয়ে মা সাজবাতি নিয়ে নেমে আসছে। পিছনে দুবোন। বড় বোনটির হাতে মঙ্গল ঘট। ছোট বোনটির হাতে ধুপতি। দাদু উঠোনময় তুলসীর জলের ছিটা দিতে দিতে সন্ধ্যা মন্ত্র বলছে। ঠাম্মা মুরগী দুটো নিয়ে বসে আছে। কালো বৌটি বারান্দায় নেই। খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। মেজঠাম্মা দালানের নিচতলা থেকে বলে উঠছে, বিনা দেখতো কে য্যান মন্দিরে ঢুকছে। দ্যাখতো, কেডা ঢুকল।

দাদু মন্দিরের সিড়ির উপরে জল ঢেলে দিল। শুকনো বারান্দায় কারো পায়ের ছাপ দেখা যায়। কেউ ভেতরে ঢুকে গেছে। সাজবাতি আসায় অন্ধকার সরে গেছে। ভেতরে কেউ নেই। ধুপের ধোয়ায় কিছু কিছু মশা জানালা দিয়ে হটে গেল। মেজ ঠাম্মা দালান থেকে চেঁচিয়ে বলল, কাউরি দ্যাখতে পাইছ বিনা? হ্যার লাল শাড়ি। আউলা চুল। দাদু গম্ভীর স্বরে গায়ত্রী মন্ত্র বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকাল। আর মুরগী দুটো ঠাম্মার হাত থেকে বাক্সের ভেতর যেতে লেগেছে। ভেতরে গিয়ে বার কয়েক কুকরু কু ডাক দিয়ে দিয়ে গেল।

কাজুলিয়ার ধীরেন পাল আশ্বিনের শুরুতে হাজির। তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে নেমে খুঁজে বের করল কালিপ্রতিমার কাঠামোটি। ছনের বিচালি বাঁধতে বাঁধতে ধীরেন পাল মাকে বলল, গেলবার উন্ডিয়ায় ঘুইরা ঘুইরা মরি। আর মনে মনে কই, দোহাই মা কালি, বিধুবাবুর বাড়ির পিত্তিমা গড়তি দ্যাও গো মা জননী।

ধীরেন পাল প্রতিমা বানাচ্ছে। দড়িদড়া নিজেই নিয়ে এসেছে। দাদু সিধে বলল, পাল মশাই, পূজাতো এবার হবে না।

–ক্যান ছোটোবাবু?

–খাতি পাই না, পূজা করি কি দিয়া!

ধীরেন পাল আস্তে করে হাসছে। সাবধানে  বিড়িটা নিভিয়ে রেখেছে। তার হাতে গড়ে উঠছে—মা কালি, শিবঠাকুর আর একটা জিব লকেলকে শিয়াল। দাদু জানতে চাইল, তোমারে খবর দিল কেডা?

–কেডায় আবার—কালি মায়।

রাতে ধীরেন পাল খেতে এলো না। মা ভাত নিয়ে বসে রইল। দাদু ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলল, বৌমা, পাল মশাই আসবে না। অন্য কোনো বাড়ি খাইয়া লইছে। তুমি খাইয়া লও।

প্রতিমার গায়ে সরমাটি পড়লে গোলগাল মুখটি দেখা গেল। গলায় ঝোলানো হয়েছে মুণ্ডমালা। কোমর বেষ্টন করে আছে ছোট ছোট হাত। আর লকলকা শিয়ালটি কেন জানি আমাদের ভুলু কুকুরটির মতো হয়ে গেছে। শুধু তার লেজটি সোজা। ভুলু কুকুরটি তার চারপাশে ঘোরে আর ঘেউ ঘেউ করে।

হারুণকাকী ঝুনা নারিকেল নিয়ে এলো। আর আখের গুড়। লিচুদের বাসা থেকে এক ঝাঁকা খৈয়া ধান এসে গেল। লিচুর বোন নীলু বায়না ধরেছে—মায়ের সঙ্গে নাড়ু বানাবে। ফাতিমাকেও সঙ্গে নেবে। নূরুকাকু দাদুর সঙ্গে লেগে গেল ঝোঁপঝাড় কাটতে। বড় চাচী কয়েকটা টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, বিনা, সাজ কিনে দিও। আর মায়েরে কইয়ো—মাহবুব য্যান ফির‍্যা আসে।

বড় চাচী নামাজ পড়তে পড়তে হররোজ কান্নাকাটি করেন। আর মাঝে মাঝে লেবুগাছটির পাশ দিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে হেঁটে আসেন। এই পথ দিয়ে মাহবুব ভাই গিয়েছিলেন। বটতলার সাবু তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। বড় চাচীর সব মনে আছে। মনে আছে তার ছেলেটির গলায় ঝোলানো আছে একটি কবজ। তামার। মালাটি রূপোর। ভেতরে ভুর্জপত্রে জাফরান কালিতে কলেমা তৈয়ব লেখা। মোম দিয়ে কবজের মুখ বন্ধ করা। কে তাকে আটকে রাখে!

চক্ষুদানের আগে পিসিমশাই এসে গেলেন। সঙ্গে ভোলাই সাধু। মাথা জটাচুল। চক্ষু দুটি লাল। আকাশের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে—কিল কিল কিলা। মধ্যরাতে কারণবারি পান করে শ্মশানে বসে থাকে। চক্ষু মুদ্রিত। গভীর যোগনিদ্রায় চলে যায়। শোনা যায় এ সময় মাটি থেকে একটু উপরে উঠে যান—হাওয়ার উপরে ভাসতে থাকেন। দূর থেকে শিবাকুল বলে ওঠে হুক্কা হুয়া হুয়া হুয়া।

মধ্যরাতে সেদিন যোগনিদ্রায় যাওয়ার আগে মন্দ্র সান্দ্র গলায় ভোলাই সাধু বলে উঠলেন, আইজ কুক্কুট ভোজন তার কাইম্য।

রাত্রিব্যেপে অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। দাদু ঘুমিয়ে পড়ার আগে প্রতিমার গলায় পরিয়ে দিয়েছে শোলার ফুলের মালা। মালায় বুক অব্দি ঢেকে গেছে। এর মধ্যে তিনি জিব বের হয়ে আছেন। ধীরেন পাল একটি বেলের কাঁটা দিয়ে চক্ষুদান করতে করতে বিড় বিড় করে বলে উঠল, হেই মা জগজ্জননী—তুমি হাইসা ওঠো, মা। সন্তানেরে রইক্ষা করো। দাদুর চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। মা উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।

চারিদিকে ঘন অন্ধকার।  রাস্তা থেকে পিসিমশাই বেরিয়ে এলেন। হাতে কাঁটা মুরগী। উষ্ণ রক্ত ঝরছে। মুরগীর ছাল ফেলে দেওয়া হয়েছে। পিসমশাই মাকে ডেকে বললেন, মাংসটা রান্না কইরা দ্যান। সাধুবাবা খাইবে। লগে পেঁয়াজরসুন দিয়েন। মাংস না খাইলে সাধুবাবার যোগনিদ্রায় অসুবিধা।

প্রতিমার চক্ষুদান হয়ে গেছে। ধীরেন পাল তৃতীয় চোখের নিচে সোনার টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। টিপটি বহু পুরনো। এই টিপটা চোখের মণির মত রক্ষা করা হয় প্রতি বছর। পূজার এ কদিন নিরামিষ। সবজি ডালখিচুড়ি। মাংস নৈব নৈব চ। ধীরেন পাল বলে, ঘরে যান বৌদি। দাদু একবার মায়ের দিকে, একবার মাটির দিকে তাকিয়ে পেয়ারা গাছে দিকে চলে গেল। উঠোন দিয়ে একটা শিয়াল  হেঁটে গেল। ঝিঝির ডাক থেমে গেছে।

মা রান্না ঘরে মাংস রাঁধতে লেগে গেল। পিঁয়াজ রসুন বাটতে হবে। কৌটার তলানিতে সামান্য কিছু জিরা আছে। বের করে জলে ভিজিয়ে দিল। বাইরে হাওয়া উঠল। ভোলাই সাধুর দাড়ি উড়ছে। চারিদকে দারুচিনি এলাচের ঘ্রাণ ভেসে যাচ্ছে। আর বেলগাছের উপরে শিরশির করে বাঁশির শব্দ হচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে একটা দাড় কাক কা কা করে উঠল। যোগনিদ্রা আজ প্রবল হবে। কারণবারি শোধন করতে করতে ভোলাই সাধু বলে উঠল, কিলি কিলি কিলা।

ভোরবেলা ধীরেন পাল চলে গেছে। কেউ দেখতে পায়নি। যাওয়ার আগে মন্দিরে প্রণাম করে বলেছে, তুমি অন্তরজামি মা। আগামীবার য্যান তোমার পিতিমা বানাতি পারি। রাস্তায় পা রাখতে রাখতে একবার পিছন ফিরে ধীরেন পাল দেখতে পেল, টগর গাছটি বেশ বড় হয়ে উঠছে। পাতায় পাতায় শিশির পড়েছে। শিরশির করছে হাওয়া। ফুল ফুটতে দেরী নেই। মায়ের পূজার জন্য ফুল বড় প্রয়োজন।

রতন ঢুলি এসে গেছে। মান্দিরের সামনে বাজনা শুরু করেছে। সঙ্গে ছোট নাতি। ঠাং ঠং করে কাসিতে বোল তুলছে। ছেলেটার চোখে ঘুম লেগে আছে। গায়ে গামছা জড়ানো। ঢলডলে প্যান্ট।

ততক্ষণে সারা উঠোন নিকোনো হয়ে গেছে। কাঁচা গোবরের ঘ্রাণ উবে যাচ্ছে। তুলসীতলায় প্রদীপটি জ্বলে উঠছে। চবুতরার পাশে যে কয়েকটি ভাদলা ঘাস অলক্ষ্যে বেড়ে উঠেছিল—তা আর নেই। কলতলাটি ঝকঝক। বেলতলাটি ঘিরে চালবাটা দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়েছে। ঢাকির নাতি এক থাল মুড়ি আর এক ঢেলা নলেন গুড় পেয়ে চিবুতে চিবুতে বলে উঠছে, দুইডা কলা—রুম্মি কলা দ্যান।

মা রান্নাঘরে যেতে যেতে শুনতে পেয়েছে, মেজ ঠাম্মা বারান্দা থেকে বলছে, মন্দিরে কে গেল দ্যাখো তো বিনা।

রান্নাঘরে ধামাভর্তি ভাজা মুড়ি। চালুনির নিচে গরম বালি আর খৈয়া ধানের খোসা। দুটো টিনভর্তি গরম গরম খই। মেজ ঠাম্মা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠছে, মন্দিরে দেখতো কেডা গেল বিনা? কেডা গেল?

চুনুপিসির ঘুম টুটে গেছে। বিরক্তি নিয়ে এসেছে মন্দিরে। সিঁড়িগুলো, বারান্দা এবং ভেতরে জল ঢেলে ধোয়া মোছা শেষ। ছোট আসনখাটের কোণে কোণে সিদুঁরের ফোঁটা। কোষাকুষি পূজার তৈজষপত্রাদি আলোর মত পয়পরিস্কার। কয়েকটি ধুপতি জ্বলছে। চন্দনগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। চুনুপিসি অবাক হয়ে বলল, কখন করলা বউদি এইসব?

মার মুখে কথা নেই। ঢাকি নাতির থালা দেখিয়ে বলল, অরে দুগ্গা মুড়ি দ্যান। ছেলেটার হাত বেয়ে নলেন গুড়ের রস পড়তে লেগেছে। কয়েকটি নীলমাছি ভনভন করছে।

(চলমান…)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to ও টগর, ও কুক্কুট : দ্বিতীয় পর্ব

You must be logged in to post a comment Login