রিপন কুমার দে

কবিতা: বাবা

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[আমার বাবা এখন আমার থেকে হাজার মাইল দুরে। এটা লিখার সময় বাবাকে খুব অনুভব করেছি, মনে হয়েছিল বাবা আমার সামনে বসা। অনেকদিন পর বাবার সাথে সামনাসামনি কথা বললাম। সেই ভাল লাগার অনুভুতিই এখানে মূখ্য। কবিতা হল কি হল না সেটা মুখ্য না।]

 

মনে পড়ে বাবা?

বাবা,

সেই প্রথম তুমি যেদিন,

শিশির জমা ঘাসের মধ্য দিয়ে

হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলে আমায়

আমার প্রথম স্কুলে,

শিমুলচাপা বাগানের ধার দিয়ে।

আর আমি, স্কুলের ব্যাগ কাধেঁ নিয়ে

মৃদু পায়ে চলেছিলাম তোমার পিছু পিছু,

নিরিবিলি শান্ত ছেলের মত।

পথে আমি বায়না ধরেছিলাম,

হাওয়াই মিঠাই খাব বলে,

তুমি মিতালীপাড়ার নুড়িকাকুর দোকান থেকে

কিনে দিয়েছিলে, পরম আদরে।

মনে পড়ে বাবা?

 

বাবা,

অঝোড় ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন,

স্কুলে আটকা পড়ে আছি, অনেকক্ষন।

তুমি সেদিন আমার ছোট্ট সবুজ ছাতা নিয়ে

মেঠো পথের কাদাঁ ডিঙ্গিয়ে

আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলে,

অনেক দুর থেকে, খালি পায়ে।

কপালে বিন্দু বিন্দু, ক্লান্ত তুমি,

তবু আগলে ধরলে আমায়।

মাথা সামান্য ভিজে গিয়েছিলে বলে

তুমি সেদিন তোমার শার্টের কোনা দিয়ে,

মুছে দিয়েছিলে আমার ভেজা চুল।

আর তোমার মায়ামাখানো চোখ রাঙ্গিয়ে

শাসন করেছিলে,

“আর কক্ষনও ভিজবি না বৃষ্টিতে, বুঝলি?”

মনে পড়ে বাবা?

 

বাবা,

গ্রীষ্মের আমকাঠাঁলের ছুটির সময়,

উত্তরপাড়ার ছেলেদের সাথে

কাবাডি খেলে ঘরে ফিরে আসার সময়

বেয়াড়া গাছের কাটার উপর পড়ে গিয়ে

পা খানিকটা কেটে গিয়েছিল,

তুমি অস্থির হয়ে

সাদা কাপড়ের পট্টি বেধেঁ দিয়েছিলে

পায়ের জখমের উপর, সযতনে।

ঐদিন রাত্রিতে ঘামজ্বরে

গা পুড়ে যাচ্ছিল বলে,

তোমার তীব্র আকুলতা

সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল সেদিন।

তোমার চোখের কোনে

টলমল করছিল স্নেহঝড়ানো উদ্বিগ্নতার জল।

সারা রাত জেগে আমার পাশে নির্ঘুম তুমি,

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে,

পরম মমতায়।

মনে পড়ে বাবা?

 

বাবা,

সেদিন প্রথম বৃত্তি পরীক্ষার দিন,

ঘর থেকে বের হওয়ার আগে,

আমার প্রবেশপত্র আর কলম

হাতে ধরে দিয়ে বলেছিলে,

“ভাল করে পড়ে উত্তর করিস, বাবা”

তোমার চোখে ছিল তখন,

আমার জন্য আকাশছোয়াঁ স্বপ্ন,

পরীক্ষা শেষে তুমি আমায় নিয়ে গিয়েছিলে,

রথযাত্রার মেলায়, পড়ন্ত গোধুঁলিবেলায়।

প্রথম নাগোরদোলা চড়িয়েছিলে সেদিন তুমি আমায়।

তুমি তোমার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে

কিনে দিয়েছিলে একটা সাদা কবুতর, মেলা থেকে।

সেই কবুতর হাতছাড়া করতাম না আমি কখনও,

জড়িঁয়ে রাখতাম সবসময়, তোমার উপহার বলে।

মনে পড়ে বাবা?

 

বাবা,

আমার টিউশনির টাকা

একটু একটু করে জমিয়ে,

আমি তোমাকে দিয়ে বলেছিলাম একদিন,

“বাবা, একটা নীল ডোরাকাটা শার্ট,

আর একটা ফিতাওয়ালা কালো জুতা কিনে আনবে তোমার জন্য।”

তুমি দুটি শার্ট কিনে এনেছিলে সেদিন,

অসীমবাবুর দোকান থেকে, কিন্তু একইরকম।

একটা আমায় দিয়ে বলেছিলে,

“নে, এটা তোর জন্য, জুতো তো আমার আছে,

কি হবে শুধু শুধু কিনে”

তোমার সেই নীল শার্ট এখনও আলমারিতে যত্নে রাখা,

ব্যবহার করনা তুমি, নষ্ট হয়ে যাবে বলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে আমি,

স্কলারশীপ নিয়ে দেশের বাইরে আসার সময়,

আবেগি তুমি, কান্না থামিয়ে রাখতে পারছিলে না।

ভোঁ ভোঁ করে কেদেঁ উঠেছিলে সবার সামনে।

আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলে,

“ভাল থাকিস, বাবা”

সেই তুমি আজ বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত।

ডায়াবেটিস, রক্তচাপ,

কোমড়ের ব্যথা, কি নেই তোমার?

প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার একটি ফোনের জন্য

অপেক্ষা করে বসে থাকো জীর্ন তুমি,

চাতকপাকির মত।

একদিন কথা না বললে

অস্থির হয়ে আমার সাথে রাগ করে বসে থাকো,

অবোধ শিশুদের মত।

মনে পড়ে বাবা?

 

বাবা,

আচ্ছা আমি কি পারব, তোমার মত হতে?

ভয় হয়,

আমার।

একটু মাথায় তোমার আশীষের হাতটি বুলিয়ে দিবে, বাবা, ঠিক আগের মত।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


9 Responses to কবিতা: বাবা

You must be logged in to post a comment Login