মামুন ম. আজিজ

খুন

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


মামুন ম. আজিজ

॥এক॥
গঞ্জে গিয়েছিল শুক্কুর মিয়া।
ফিরতে ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে গেলো। যখন বাস থেকে থানার মোড়ে নামল তখন ঘড়িতে রাত ৮টার বেশি। আর দেরী করেনি। একটা বিড়ি ধরিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। ঝকঝকে পিচের রাস্তা, হাঁটতে আরাম হয় বেশ। গত কয়েক বছরে উন্নয়নের তীব্র জোয়াড়ে তাদের এই নিভৃত গ্রাম এলাকার মূল রাস্তাটা পাকা হয়েছে। কিন্তু সে পথ আর কতক্ষণ , ঐ তো সামনেই তাকে নেমে যেতে হবে  কাঁচা রাস্তায়। জোয়ারের ঢেউ ওদিকে নামেনি তেমন একটা। ওদিকে সদাই ভাটা।

পাকা রাস্তায় তাও দু’একটা সাইকেল, ভ্যান, কিংবা হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে হোন্ডাও চলছিল। কাঁচা রাস্তায় নামার পর লোকজনের কোন দেখা নেই। গ্রামের বাসিন্দা সে। মনে বেজায় সাহস আছে এ বিশ্বাস তো থাকবেই। সেই ছোট থেকে এইসব পথে চলে অভ্যস্ত। তখনতো বিদ্যুৎও ছিলনা। সন্ধ্যার  পরেই  নিকোষ কালো অন্ধকার । এখন তবু দু’একটা বাড়ীর দহলিজে আলো জ্বলছে। তবুও ভূত প্রেতের কাল্পনিক ভয় বিতত করে গ্রামের লোকজন নিজেদের অতিরিক্ত সাহসী ভাবার যে মানসিকতা চিরকাল ধারন করে চলে আসছে সেও তো তার বাইরের নয়।

পাকা রাস্তা অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। ঐ তো বিলের কোনাটা পেরিয়ে ডানে মোড় নিলেই তার বাড়ি। দীর্ঘক্ষণ একা একা হাঁটছে । রাতের ক্রমাগত ঝিঁঝিঁ ডাকা শব্দ মনটাকে আচ্ছণœ করে ফেলেছে। দ্রুত পা চালাচ্ছে সে। বিলের কোনায় পৌঁছে গেছে প্রায়। হঠাৎ কানে এল নড়াচড়ার শব্দ।

থামল সে। কানটা খাড়া করল। করা যেন কথা বলছে ঘন বাগানটার ভেতরে। রাতে অবশ্য সব গাছ গাছলা আর বাগান ঘন জঙ্গলের মত লাগে গ্রামে। তখন যেন গাছ  আর আঁধারের সঙ্গম চলে।

‘ এই ভালো করে পোঁচ দে। ’
আরেকজনের কণ্ঠ, ‘দূর ছুরিতে নাই এক বিন্দু ধার। এইভোতা দিয়া গলা কাটে নাকি। তার উপর  জীবনে প্রথমবার জবাই করছি।’
‘যা শালা দিলিতো রক্ত লাগাইয়্যা। দূর । আবার ধুতে হবে।
‘তার আগে তাড়াতাড়ি কাটাকুটা শেষ করে এইগুলো সব পুতে ফেলতে হবে। ধরা পড়া যাবে না কোন ভাবেই। চল আগে এখান থেকে সরে পড়ি। ’
‘তাই চল, চল , ভাল করে ধর, আবার পালাবে দেখিস…
‘আর পালাতে পারবে না, প্রাণবায়ু আর নাই….

আর শোনার সাহস হয় না। পায়ের শব্দ সামনের দিকে মিলিয়ে যেতে থাকে । কান কাঁপছে। হাত কাঁপছে। কাঁপছে পা দু’খানাও। সামনে এগোবে, না পেছেনে সে বুঝে উঠতে পারেনা। তারপর পেছনে ঘুড়েই এক দৌড় দেয় শুক্কুর আলী।

এক দৌড়েই পৌঁছে যায় থানার কাছে। পায়ের নিচে যন্ত্রনা হচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, এখন দেখল চটি জোড়া পা থেকে কখন উধাও হয়ে গেছে। নতুন পিচের রাস্তার ক্রমাগত আদরে পায়ের তলা এখন বিপর্যস্ত। তা নিয়ে ভাবনা নেই। দ্রুত ঢুকে গেলো থানার ভেতর। হেড কনেষ্টেবল জহির আলী তার বাড়ীর পাশেই এক বাড়িতে ভাড়া থাকে।

কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড গতিতে বুক উঠানামা করছে শুক্কুর মিয়ার। হেড কনেষ্টেবল চেয়ারে বসতে বলে। সে বসেনা। এক গ্লাস পানি মুখের ভেতর ঢেলেই বলে ওঠে, ‘জহির ভাই, খ..খ..খু.. খুন!, খুন হৈছে। আমাগোর বাড়ির কাছে।  বিলের কোনাডায়। পুরান বাড়িডার জঙ্গলে। খুন, খুন! চলেন। এহনি চলেন।

॥দুই॥
রনিল, রাতুল আর মাহি তিন বন্ধু।  এইচ এসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবে মাত্র। মনে ফুর্তি। বহুকাল পড়ে কাগজ কলম আর বইয়রে প্রেষন হতে আনন্দঘন কিছূ অবসর পরিপূর্নভাবে যেন পাওয়া গেছে। যদিও খুব সম্প্রতিই আবার কোচিং নামক ফ্যাশনে বাধ্যগতভাবে ভর্তি হতেই হবে। না হলে মনের অশান্তি, পারিপার্শ্বিকতার ঘ্যাঁনঘ্যাঁনানি আর এক জবরদস্ত কোচিং আড্ডা মিস।

স্বল্প অবসরে তিন বন্ধু মিলে তাই ঠিক করলো কোচিংয়ে ভর্তির আগেই  রাতুলের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রাতুলের মামা খালা সবাই অবশ্য ঢাকাতেই থাকেন। গ্রামে একটা  পুরাতন পাকা বাড়ি আছে। সেখানে রাতুলের মেজ মামার এক শ্যালক শ্রেণীর কেউ কেয়ারটেকার হিসাবে বসবাস করে। যার ফলে কেবল বসবাসটাই হয়েছে , যতœ আত্তি হয় না। চারদিকে ঘন গাছগাছালি ছেঁয়ে গেছে। বাড়িটার সামনে যে পথটুকু পেড়িয়ে কাঁচা রাস্তায় উঠতে হয় সেটা আর পথ নেই। সেখানেও গাছ গাছালি আর ঘাসের উঁচু ডগা। রাস্তার ওপাশে বিশাল একট বিল। বিলের একটা কোনায় পড়েছে বাড়িটা । উল্টোদিকে একটা বেশ বড় প্রশস্ত খাল খুব কাছ দিয়েই ছুটে চলে গেছে দূরে নদীর পানে। একটু যতেœর ছোয়া পেলে জায়গাটা অসাধারণ হয়েই থাকত। মামারা তো যেতেই দেবেন না। রাতুল যাবেই এবং সে কারও কথা মানল না।

রাতুলরা যেদিন গেলো সেইদিন রাতেবই মেজ মামার সেই শ্যালক তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে নিজ গ্রামে চলে গেলো। মেজ মামা এটা জানতেন না। জানল কখনই কি একা একা এই জ্ঙ্গলবাড়িতে থাকতে দেন। কেয়ারটাকার আত্মীয় তার ছেলেটাকে অবশ্য রেখে গেলো। ছেলেটার নাম সুমন।  রাতুলদের কাছাকাছি বয়সী। লেখাপড়া নেই। তাই বয়সের সঠিক মাত্রা ঠিক করা কঠিন । সুমন বেশ মিশুক। ভালোই মিশে গেলো তিনজনের সাতে। ঘোরাফেরার পর গৃহ অবসরে তিনজনের তাস পেটাতে সমস্যা হলোনা। বাড়তি সদস্যটিও খেলাটা ভালোই পারে।

ওরা যাবার তৃতীয় দিনের দুপুরের ঘটনা। পুকুরে দাপাদাপি করে ভেজা কাপড় চোপড় উঠোনের ঘাসে শুকাতে দিয়েছে , বেশ কয়েকটা মুরগী এসে কাপড় চোপড়ের উপর উঠে পায়খানা টায়খানা করে একাকার।

সবার তো মেজাজ চরমে। সুমনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, মুরগীগুলো এই বাড়ি সংলগ্ন বাড়িটার। বেশ অনেকগুলো মুরগী আর হাস লালন পালন করে তারা। সবাই বেশ বিরক্ত। মুরগীর শাস্তি মুরগীকে পেতেই হবে। পরিকল্পনা হলো। সন্ধ্যার পর মুরগীরা নিজ খোঁয়াড়ে ফিরল। দরজা বন্ধ হলো। আঁধার ঘনিয়ে আসতেই সুমন আর মাহি গুটিগুটি পায়ে বাঁশ বনটা পেরিয়ে আমগাছের সারি ধরে পৌঁছে গেলো পাশের বাড়ীর কানায়। এই দিক থেকে একটা ঢোকার পথ আছে। পুকুর ঘাটে যাবার রাস্তা ওটা। দুজন ঢুকে গেলো। সুমন গিয়ে কথা বলতে লাগল ও বাড়ির এক পরিচিত বড় আপার সাথে। তেমন কোন কথা নয়। ঢাকার গেষ্টরা বাড়িতে। রান্না করতে গিয়ে মরিচ নেই।  কয়েকটা মরিচ ধার চাইলো সে।  আশে পাশে সে সময় আর কেউ নেই। মাহি কখনও মুরগী ধরেছে বলে মনে  পড়ে না। অথচ তাকেই চুরিটা করতে হবে।

মেয়েটা ভেতরে চলে যেতেই সুমন দ্রুত এসে মুরগীর খোঁয়াড় এর দরজা খুলে একটা মুরগী বেড় করে পুকুর ঘাটের দিকে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মাহির হাতে মুরগীটা ধরিয়ে দিয়ে বলল দৌড়াতে। মাহিকে মৌখিক ট্রেনিংটা সুমন ভালোই দিয়েছিল। মুরগী তেমন একটা চিৎকার করার সুযোগই পেলো না।

সুুমন আরেকটু অপেক্ষা করে ধারের মরিচ নিয়ে এল।

তারপর চারজনের সে কি আনন্দ। সুমন একটা ছুরি  যোগার করল। উঠোনের এক কোনে জবাই করতে গেলো। সুমন ছাড়া কেউ কোনদিন ও কাজ করেনি আগে। অথচ শখ হচ্ছে সবার। তারাই করবে। বিশেষ করে রনিলের শখটাই বেশি।

অবশেষে রাতুল ধরল আর রনিল জবাইয়ের জন্য যেই ছুরি বসাতে গেলো মুরগী গলায়।  একটু গলা কাটতেই মুরগীর পা আর পাখনা ছেড়ে দিল রাতুল। মুরগীতো তো এক লাফে ঢুকে গেলো বাড়ির সামনের দিকের জঙ্গলে। তাড়াতাড়ি ছুটল সবাই। গলা খানিকটা কাটায় ঘাসের উপর পড়ে ছটফট করছিল। বেশিদূর এগোতে পারছিল না। সুমন ধরে ফেলল। ছুটে গেলো রনিল ছূড়ি নিয়ে। মাহি রাতুলকে সরিয়ে নিজে ভালো করে ধরল। জবাই শেষে করে তাড়াতাড়ি ভেতের এসে বাকী কাজ শেষ করতে লাগল। পাখনা আর নাড়ীভূঁড়ি ছাড়ানোর পর সেগুলো নিয়ে গিয়ে মাহি পুকুর পাড়েই একটা গর্ত পেয়ে তাতে ঢেলে দিল।

সুমন ভালোই রান্না করতে জানে। তারপরও একটা মহিলাকে তার মা গেষ্টদের রান্না করার জন্য ব্যবস্থা করে গেছে।  কিন্তু এই চুরির মুরগীতো তার কাছে রান্নার জন্য দেয়া যাবে না। সুমনের তত্বাবধানে  মজা করে চারজন মিলেই রান্না করতে শুরু করল। এটাই আনন্দ।

॥তিন॥
কনেষ্টেবল আর একজন সিপাহী নিয়ে এসেছে শুক্কুর আলী। এবার তার বেজায় সাহস। আরও বেশ কয়েকজন মুরুব্বী গোছের লোকজনকে বাড়ী হতে ডেকে আনল। বড় বড় টর্চ লাইট নিয়ে যেখানে শব্দ হয়েছিল সেদিকে আলো মারতে লাগল। হৈচৈ আর আলো দেখে সহজাত বাংগালী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে আশেপাশের অনেকেই ছুটে এল।

শুক্কুর মিয়ার চোখেই রক্তের দাগ ধরা পড়ল প্রথমে । বেশ অনেকটা জায়গা গোল হয়ে রক্তের দাগ। এখনও টাটকা। সবাইকে ডেকে দেখাল। সবাই উত্তেজিত। কেউ ভীতও । নানান উক্তি নানা জনের মুখে। কেউ বলছে জোড়া খুন। কেউ বলছে না আরও বেশি। কেউ বলছে , ঢাকার ছেলেগুলোকে কেউ মারল নাতো। কিন্তু সামনে কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

মূল ঘর থেকে একটু ওপাশে রান্নাঘর। সেখানে থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে আলো বা হৈচৈ কানে গেলো না চার যুবকের। কিন্তু একটু পড়েই পুলিশ হুইসেল বাজাতেই তাদের কান সতর্ক হলো। ভয় পেয়ে গেলো। তবে কি মুরগী চুরি ধরা পড়ে গেলো?। শেষমেষ গ্রামে এসে মুরগী চোর হতে হবে ভাবতেই রনিল আর রাতুল কেঁদে উঠল। মাহি অবশ্য বলল, ‘চুপ, কি করা যায় সেটা ভাব।  কোন প্রমান নেই কেবল এই চুলোর উপর মাংসর হাড়িটা  ছাড়া। এটাকেও সরিয়ে ফেলতে হবে। চল এটা বাথরুমে ফেলে দেই। ’

সবাই ্এক বাক্যে রাজী হলো। যা ভাবা তাই। পায়ের শব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে। পুলিশের বাশি বাঁজছে। দ্রুত হাঁড়িটিও তারা ধুয়ে ফেলল।
সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে শব্দের দিকে এগিয়ে যাবার একটা ভান করবে তখনই মাহি বলে উঠল, ‘এই যা, পুকুর পাড়ে গর্তটার উপর মাটি দেয়া হয়নি।’

সে আর সুমন দ্রুত ছুটে যায় । পায়ের শব্দ এখন উঠোনে পৌঁছে গেছে তারা বুঝতে পারল। তাদেরও মাটি দেয়ার কাজ শেষ। তারা দু’জন এখন ঘরের দিকে এগোচ্ছে। উল্টোদিক থেকে তিনচারজন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একজন তার মধ্যে পুলিশ। কাছ এসেই বলল, ‘ ওই ব্যাটা, এত বড় সাহস। খোড় এখুনি গর্ত খোড়, বার কর। বার কর…’

মাহি ভয়ে এবার সত্যি কেঁদে ফেলে। রাতুল আর রনিলরাও কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সাথে বেশ অনেক মানুষ।

শুক্কুর মিয়া সুমনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘তুইও এগো লগে মিইল্লা গ্যাছোস? গর্ত থেকে আগে বাইর কর, বাইর কর। দেখি কার লাশ!’

চার যুবক এক সাথ চিৎকার করে ওঠে- ‘লাশ!’

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to খুন

You must be logged in to post a comment Login