রাবেয়া রব্বানি

গল্প-(অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)

গল্প-(অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ

(১)
ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগৎ এ তপুর ইচ্ছানুযায়ি কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারণেই সে মৌরিকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল”।

জীবনটা যদি বিজ্ঞাপনের মত হত!একটি বিশেষ টুথপেষ্ট আর নিরোগ শরীর,সবার মুখে চকচকে দাঁত শুদ্ধ হাসি, উচ্ছলতায় ভরপুর সকাল। একটি বিশেষ ইন্সট্যান্ট গুঁড়োদুধ শিশুরা সব দীর্ঘদেহী,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ….। একটি বিশেষ সীম কার্ড আর কৃষকের ফসল বিক্রির ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, তাদের গায়ের নতুন জামা,গ্রামগুলোতে শুধু মেলা আর আনন্দ,ভর-ভরান্ত গৃহস্থিতে পরবাসী স্বামীর বিরহী বধু। এক ফোটা কনডেন্সড মিল্ক হলেই সাদাকালো পৃথিবীর রঙ পালটে রঙ্গীন কিংবা একটি চায়ের ব্রান্ড মানে সতেজ দেহ,ধূমায়িত কাপ নিয়ে বৃষ্টি দেখা সুখী মনের মুখ।

কিন্তু জীবনতো আর এমন নয়!তাই তপুর হাতে ধূমায়িত এক কাপ চা থাকা স্বত্ত্বেও তার মুখ নিস্তেজ।সেও একটি বিশেষ ব্রান্ডের টূথপেষ্ট ও সীম কার্ড ব্যবহার করে কিন্তু তার চারপাশে আনন্দের কোন ঢেউ নেই। তপুর পরনে ফিকে হয়ে আসা সবুজ গেঞ্জি,একটি চেক ট্রাউজার,চোখে চশমা,মুখে দুইদিনের জমানো দাড়ি। তার চায়ের কাপেও বৃষ্টির ফোটা পড়ল আর সেও ও ঠিক বিজ্ঞাপনের মতই আকাশের দিকে তাকালো কিন্তু চোখে কোন মুগ্ধতা বা বিস্ময় নেই।

বৃষ্টির আগমনী হিসাবে আকাশ গুড় গুড় করে ডেকে ঘোষণা দিচ্ছে। এমন ডাকে মনে ভয় মিশ্রিত আনন্দ হয়,ময়ূর পাখা মেলে নাচে কিন্তু তপু তেমনি নির্বিকার। এবার বৃষ্টির একটি ফোঁটা তার চশমার কাঁচেও পড়ল আর তাতে দুনিয়ার তাবৎ চশমাওয়ালাদের মত সেও বিরক্ত হল। ঘোলা কাঁচ চোখে নিয়ে আর এখানে বসে থাকার সে কোন মানে খুঁজে না পেয়ে ছাদবারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে এল।

শ্যামলির ছয়তলার এই মেসবাড়িতে তপু ছাদ লাগোয়া ইউনিটটির এই ঘরে আরো দুই জন রুমমেটের সাথে থাকে। ছাদের নিচে হওয়ায় প্রচন্ড গরম তাই অর্ধেকটা খোলা বারান্দা হলেও বাড়তি কোন আমেজ পাওয়া যায় না। আশেপাশে তেমন কোন গাছপালা নেই।কিছু নতুন দালান তপুর ছাদ ডিঙ্গিয়ে আরো উঁচুতে যাওয়ার ইচ্ছায় প্রতিদিন একটু একটু বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে যাওয়া বৃষ্টিতে এই সিমেন্ট রঙের কঙ্কালগুলো ভিজে চুপশে আরো ধুসর হয়ে আকাশের সাথে জোট বেধে গেল। তপু যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ধুসর আকাশের পটভূমিতে দৃশ্যটা ওর মনের মতই ধুসরকালো দেখাচ্ছে।

নির্মাণ কাজ চলতে থাকা বামদিকের বহুতল বাড়িটার মিস্ত্রিগুলো ছাদ ছেড়ে নিচতলা গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টি আসায় তারা মনে হয় খুশি হয়েছে। সবার মুখই হাসিহাসি। তপু বসে বসে কিছুক্ষুণ এদের খুশি মুখে চা খাওয়া দেখল তারপর তিন মাত্রার এই জগতের মাত্রা বাড়াতেই হয়ত তার পুরোনো পিসিটা চালু করল। ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বার্ধক্য জানান দিতে দিতে সেটা চালু হলো। জন ডেনভারের “এনিস সং” গানটির অসাধারণ সুরের মূর্ছনায়, বৃদ্ধ পিসিটার সারা শরীরেও জ্বলজ্বল করছে এখন ধ্রুপদী রূপ।
পুরোনো সুরের এই ক্লাসিক গানটি তার ইদানিং খুব প্রিয় হলেও খুব কমই শুনে। কিছুদিন আগে তার করূন মুখ দেখে চারতলার মেসবাসিন্দা হিরন তাকে গানটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,

“এইটা টান ভালো লাগব”।
তপু কিছুটা বিরক্ত আর অবাক হয়ে বলেছিল,
“টানবো মানে এটা কি গাজা”!
“হা হা!তার চেয়েও মারাত্মক। কলিজায় বেশি লাগলে বন্ধ রাখবি। আবার কিছু কইরা বইস না”।
“সেড নাকি বেশি”।
“ইয়েস ম্যান”।
“নাহ! আমি নষ্টালজিক গান শুনি না”।
-“আরে ব্যাটা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়। ডায়মন্ডস কাটস ডায়মন্ডস।বুচ্ছস।ওহ।আর একটা কথা,এক্সপেরিয়েন্স থেকে কইলাম,উৎকৃষ্ট সংগীত এইসব ব্যাপারে বিরাট ঔষধ তবে ভালো লাগলেই রিপলাই দিয়া রাখবি তাইলে শেষ। কয়দিন পর দেখবি টেষ্ট পাইতাছস না। গান কিন্তু আগের মতই আছে কিন্তু তর ব্রেইন এটার প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্টের টুং টাং, প্রতিটা লাইনে তর ফিলিংস কপি করে ফেলছে বা ওভার রিভাইসড করে ফেলছে।ফিলিংস এর ক্ষেত্রে, যেটা ব্রেনে অলরেডি আছে সেটা আর ধরে না।বুচ্ছস।
“না”।
মানে হইলো সুন্দর বউ দেইক্ষা ঘরে আনলেই জীবন মধুময় হয় না আসলে রুপ বা গুন মুখস্থ হয়ে গেলে সেটাও আর ধরে না। ফ্লটিং এর মধ্যে থাকতে হবে আমাদের। অলয়েজ ভাসমান। হা হা।
হিরন গাজা খায়,এলাকার লিডারদের হয়ে চাঁদা তুলে।একসাথে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করলেও হিরনকে সবার মত সেও এড়িয়ে চলে। সবার মত সেও অস্বস্তিতে হিরনকে সেদিন তাড়াতাড়ি পাশ কাটাতে মিথ্যাসায় দিয়েছিল,যে সে বুঝতে পেরেছে। আর হিরনের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই অনেকটা তাচ্ছিল্য নিয়েই গানটা শুনেছিল। কিন্তু প্রথমবার শুনতেই এমন ধাক্কা খেয়েছিল যে আর শোনার সাহস হয়নি কিছুদিন। শুধু মাঝে মাঝে গভীর রাতে, বৃষ্টি হলে, ছুটির দিনে, অলস দুপুরে কষ্টটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়,যখন কষ্ট থেকেই তার মন তাকে আরো কষ্ট নেয়ার মত সাহসী করে তুলে তখনি শুনে।

আজ ও গানটা শুনতে শুনতে মৌরিকে মনে পড়ার মাত্রা একশোগুণ বেড়ে গেল তার। ঘন কালো মেঘের এমন দিনে মৌরি খুব কাছে আসতো। এই কাছে আসা অবশ্য পুরোটাই কাল্পনিক। অনলাইনে অনেকের মত তাদেরও একটা ছোট্রজগত ছিল। যেখানে কথা বলতে বলতে চাঁদের বুকে হাটা যেত, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্র নৌকা দাড় না টেনে দিগবিদিক ভাসিয়ে দেয়া যেত,বৃষ্টি হলে নগরের সব গাড়ি-ঘোড়া উধাও করে চকচকে মসৃন পিচঢালা রাস্তার বুকে দুজনে একছাতার নিচে দাঁড়ানো যেত। পাখি এই জগতটার একটা নামও দিয়েছিল,-“অনুভব”।

ইদানিং তপুর সেই জগতের দরজাটা বন্ধ থাকায় ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই তিন মাত্রার জগতেই তাকে থাকতে হচ্ছে সার্বক্ষকণিভাবে। ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগতে তপুর ইচ্ছানুযায়ী কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারনেই সে মৌরীকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল। পৃথিবী নামক জগতের জোগাড়যন্ত্রের গুণিতক এত বেশি আর অসম্ভব হয়ে ঊঠেছিলো যে সেখানে মৌরিকে বাস্তবে আশা করা করা তার কাছে পাপ বলেই মনে হত।

পৃথীবিতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই সে মৌরিকে বলতে চাইত না। বলতে চাইত না তার মেসবাড়ির কথা,টানা টিওশনির কথা,গড় গড় করা বুড়ো পিসিটার কথা যেটা প্রায় মরি মরি করছে। কত কৌশল করে, কত কষ্ট করে সময় বাচিয়ে ব্যস্ততার দিনগুলোতে সে মৌরির সাথে চ্যাট করত সেই সব কথা। নিজেকে বড় বা ছোট করার জন্য নয় শুধু এই আড়াল ছিল অনুভবের আবেশ যাতে নষ্ট না হয়। যাতে অনুভব নামক এই জগতেও সমস্যার কথাগুলো কি বোর্ডে আঙ্গুল চেপে চেপে লেখা না হতে থাকে। কিন্তু এটাই মৌরি মানতে পারত না। সে তপুকে দুই জগতেই চাইত,রোদশুদ্ধ বৃষ্টির মত। আর এই অপূর্ণতার অভিমানে একদিন দরজাটা বন্ধ করে দিলো মৌরি, তা আজ তিন মাস হয়। এতদিন কষ্ট হলেও বেশ শক্ত ছিল সে। টাকা নামক বস্তুটা পকেটে,আর খাদ্য নামক দ্রব্যটা মুখে পুড়ার নির্লজ্জ ইচ্ছাটায় সে ভালোবাসাকে পেছনের বেঞ্চের বেয়ারা ছাত্র হিসাবেই দেখত।

এক মাস হয় তাকে অবাক করে দিয়ে তার ফুফাতো ভাই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জুনিয়ার কেমিষ্ট হিসাবে তার চাকুরী ঠিক করে দেয়। বেতনটাও প্রথম প্রথম হিসাবে মোটা। এখন তাকে টিওশনি করতে হয় না,ক্লান্তির সাথে সময় নিয়ে দেন-দরবার করতে হয় না,লোকাল বাসের ছিট পাওয়া নিয়ে হাপিত্তেশ করতে হয় না। কিন্তু এই আর্থিক ও সময় স্বচ্ছলতার সুখ পাশাপাশি তাকে মানসিক স্বচ্ছলতার জন্য কাঙ্গাল করে তুলছে প্রতিদিন। জীবন নামক সর্বভূকের খেতে পেলে আরো ক্ষিদে বাড়ে। মানে টাকা আর সময়তো হল এবার তার ভালোবাসাটাও চাই। তবে দীর্ঘদিনের ছা পোষা জীবনে ভয়ের বীজটাইতো ডালাপালা মেলে এখন বৃক্ষ।ঘাড়ে চেপে থাকা এই ভয় নামক ভূতের পরামর্শে সে ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে চায় প্রতিদিন। কিন্তু নিজের সাথে একলা হলে বিশেষ করে ছুটির দিনে তার ভীষণ কষ্ট হয়,কষ্ট থেকে তারও ইচ্ছে হয় সাহসী হতে, ইচ্ছে হয় ভয়এর বৃক্ষটা একেবারে উপড়ে ফেলতে।
আজও তেমনি একটি ছুটির দিন,রুম ফাকা। রুমমেট নাই তাই এয়ারফোন ছাড়াই গান চলছে। ডাইনিং এর ছেলেটি চা দিয়ে চলে গেছে একটু আগে। তপু তার ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গানটি শুনছে। তার কাছে মনে হচ্ছে গায়কের গলায় গাওয়া এটা কথামালা না,এক বুক কষ্ট। কি করুন সুরেই না সে প্রেমিকাকে ফিরে আসতে বলছে…
“You fill up my senses,
Like a night in a forest.
Like the mountains in springtime,
Like a walk in the rain.
Like a storm in the desert,
Like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses,
Come fill me again”.

এতক্ষণ লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি বা তার চেয়েও বেশি পানির ফোটায় শহরটা ঝাপসা হলেও দেখা যাচ্ছিল শুধু তার চোখে এক ফোঁটা পানি আসতেই ঝাপসা শহর পুরোটাই অদৃশ্য হয়ে গেল।

(২)
“এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে! সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ি বানানো যেত,অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। ।এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও তার অনুভুতিতে পুরোটাই সত্য ছিল।তা ইতো মৌরি জগতটার নাম দিয়েছিল -অনুভব”।


কয়দিন হয় বৃষ্টি হুটহাট আসা যাওয়া করছে। এমন রোদ-বিকেলে হঠাৎ আবার আকাশ ঘন কালো হয়ে গেল। এতক্ষণ মাঝখানে যা একটু নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল তাও দ্রুতগামী কিছু মেঘের পাহাড় চট করে ঢেকে দিল।আঁধারের পিছু পিছু ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি যেন হাত ধরাধরি করেই এলো শহরে। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার শো শো শব্দ ঘরের ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রটির মৃদু গোঙানী ছাপিয়ে কানে আসছে। বন্ধ জানালাটির পর্দা পুরোটা খুলে দিল মৌরি।চার বাই পাঁচ ফিট জানালার কাঁচে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু জমা,তাদের আস্তে আস্তে ভারী হওয়া, একে অপরকে আকর্ষণ করে টপ টপ করে বেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে দেখতে কখন তার মুগ্ধতা ভোতা হয়ে গেলো,কখন তাতে তপুর ভাবনা ভর করে পাখা মেলল সে টেরই পেলো না।
পাশের বাড়ির ছাদটিতে গরমের দিনে বৃষ্টি হলেই পানি নিষ্কাশনের নলটি কিছুদিন বন্ধ করে রাখে,। দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি আসায় এখন সেখানে প্রায় সাত-আট ইঞ্চি পানি জমে গেছে। সেখানে তাকিয়ে তপুর জন্য বুকের মধ্যে কেমন ছ্যাৎ করে উঠল মৌরির। এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে!
সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ী বানানো যেত, অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও অনুভুবে পুরোটাই সত্য। তাইতো মৌরী এর নাম দিয়েছিল “অনুভব”।

মৌরীর ভাবনায় এই দুই ভুবনের একটা যোগ ছিল। তার ইচ্ছা ছিল কখনো না কখনো দুই জগতের একটা সমন্ময় ঘটবে,সমম্বয় ঘটবে এই অনুভব আর সত্যের। কিন্তু কেন জানি তপু কথাটা শুনতেই পিছিয়ে যেত। তপু কোন অপারগতার কথা,কোন অযোগ্যতার কথা বলত না শুধু বলত “কি দরকার!এভাবেই ভালো আছি”। মৌরী শুধু শুনতে পেত তপুর অনিচ্ছা। আয়নায় দেখতে পেত তার গাল গড়ানো পানি। আস্তে আস্তে একদিন দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে সে কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে নিজেই। এখন তপুর হাজার ডাকেও সেটা আর খুলে না সে।
বৃষ্টির থেমে গিয়ে রোদ ঊঁকি দেয়াতে সে ভাবনা থেকে কিছুটা ছিটকে এল। বড় বড় ফোটার ঝমেঝমে তাড়াহুড়ো বৃষ্টি ঝড়িয়ে, মেঘেরা আকাশ হতে পলাতক। নীল আকাশে কিছু দলছুট মেঘ শুধু ছেড়া তুলোর মত ভেসে আছে।

বৃষ্টিস্নাত বিকেল দেখতে মৌরি পেছন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ঝকঝক করছে প্রকৃতি এখন। আকাশটা যেন আরো নীল। সবকিছুতে সূর্য্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশের ছাদের জমে থাকা পানিতে রোদের বিকেলি প্রতিবিম্ব। বারান্দার কালো কালো গ্রীলগুলো চুইয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে,ঝুলন্ত পানির কনাগুলোও রোদের কিরণ লেগে হীরের মত জ্বলজ্বলে। মৌরি আঙ্গুল দিয়ে একটি হীরের টুকরো ছুয়ে দিল,সাথেসাথেই ভারী পানির বিন্দুটা মৌরির আঙ্গুল থেকে হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল।

পাখিরা কিচির-মিচির করতে করতে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসছে। বারান্দার এক কোনে একটি চড়ুই বসে গা ঝাড়া দিচ্ছে,মৌরিকে দেখেও তার তেমন ভাবান্তর নেই। এখনো আশেপাশে সব বাসার কার্নিশ,ছাদ আর বারান্দার নলগুলো হতে পানি পড়ছে। বৃষ্টি চলে গেলেও শব্দের আবেশ এখনো বেশ জোড়ালো। টুপটাপ শব্দ আর সাদাটে হলুদ আলোর ছটায় চারপাশ ভীষণ মায়াবী লাগছে মৌরীর কাছে।কি সুন্দর!মৌরি নিজ মনে বলল।

হঠাৎ পেছন গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। অনেক ঝকঝকে সবুজ পাতা বেরিয়েছে তবে ফুলগুলো এখন আর জমকালো না। তাদের মধ্যে সন্নিবেশিত ভাবটাও আর নেই কেমন জানি ছাড়া ছাড়া আর রঙ্গটাও ম্লান। বৃষ্টির তোড়ে ফুলগুলো আরো ঝড়ে গেছে। রাস্তায় ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। বর্ষা ঝেকে আসলেই কৃষ্ণচূড়ারা শহর থেকে বিদায় নেয়।চাঁদের আলোয় এক বছর আবার কৃষ্ণচূড়া দেখা হবে না ভেবে আফসোস হল মৌরির।
হঠাৎ পেছনে মৌরির মা এসে দাঁড়িয়ে মেয়ের গায়ে হাত রাখেন। মৌরি চমকে ঊঠে,
-মা!
-হুম।ঘুমালি না।
-নাহ!তুমি কই যাও?
-মিতুলের কোচিং এ।আজ গারডিয়ানদের যেতে বলছে। ওকে নিয়ে একবারে বাজার করে আসব। আসতে সন্ধ্যা হবে। তুই কিছু খেয়ে নিস। আর সালমার মার দিকে খেয়াল রাখিস। নতুন বুচ্ছিস না?
-ঠীক আছে।
মৌরি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

মৌরির বাবা দেশের বাইরে থাকেন। মাঝে মাঝে নামে মাত্র দেশে আসেন। আর মা ব্যাংকে চাকুরী করেন। তিনি সপ্তাহ ভর চাকুরীতে ডুবে থাকেন আর টুকটাক ঝামেলায় ছুটির দিনেও ঘর-বাহির করেন। মৌরি তার মাকে চাকুরী ছেড়ে দিতে অনেক অনুরোধ করে কিন্তু তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,রাজি হন না। তার মতে,মানুষের সম্মান তার অর্থনৈ্তিক স্বাধীনতার সাথে জড়িত আর মৌরিও মাস্টার্স শেষ হতেই চাকুরীতে ঢুকে যাক এমনটাই তিনি চান।কিন্তু মার মত ঘোর প্যাচে জীবনটাকে ভাবতে চায় না সে। তার মতে অর্থের সাথে জীবনের যোগ থাকতেই পারে তার চেয়ে বড় যোগ ভালোবাসার।মৌরির কাছে জীবনের সংজ্ঞায় বিরাট অংশ ভালোবাসা আর ভালোবেসে মানিয়ে চলা।মায়ের শেখানো কাঠিন্য সে তাই কখনো রপ্ত করতে পারেন।
অতি সচেতন ইস্পাত ব্যক্তিত্ববোধ আর বদমেজাজের কারনে আজ শুধু মৌরির বাবা না,তার মায়ের আশেপাশে পুত্র-কন্যা ছাড়া আর কেউই নেই। মায়ের দমবন্ধ আনন্দহীন জীবনই তাকে স্বপ্ন আঁকতে শিখিয়েছে। তার ধারনা স্বপ্নগুলো যদি সে আঁকতে পারত তবে সে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীদের একজন হত।
মৌরি মার চলে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে আসে। দুপুরে অন করা পিসিটা স্ট্যান্ড বাই হয়ে আছে। সে পিসিটাকে স্ট্যান্ড বাই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে অনলাইন নামক আকাশ রাজ্য ডুকে গেল। বেখায়ালি বিচরণ করে বেড়াতে থাকল এখানে-সেখানে। হঠাত অচেনা কারো মেইলের নটিফিকেশনে সে সচেতন হয়ে মেইলটা খুলে দেখে,আইডিটা অন্য কারো কিন্তু সাবজেক্টের জায়গায় লেখা,
Topu from the world onuvob
মেইলটার প্রেরকের নাম আবার যাচাই করে মৌরি। অচেনা নাম কিন্তু তপুর মেইল! তপুকে ব্লক করে রেখেছে তাই হয়তো অন্য আই ডি থেকে পাঠিয়েছে বুঝতে পেরে খুলবে না খুলেব না করেও খুলে ফেলে সে।

“come fill up my sense
Come fill m again.”
আমরা এই জগতেও আকাশে কি করে উড়ব? আমাদের পাখা নেই। তবে কি মৌরি আমাদের চার-পায়ে এক পা দু-পা করেই হাটব।
আমি তোমাকে ভয়াবহ রকম মিস করছি। তুমি ফিরে এসো,ভালোবাস আবার।–তপু”।

কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্দ বনে যায় মৌরি। নিশচল হয়ে যায় তার দেহ,সে দুহাতে তার মুখ ঢেকে ফেলে। আবেগরঙ্গা বৃষ্টির জন্য তার শরীর ও এবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে মৌরি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে। পিসিটা আবার স্ট্যান্ড বাইতে চলে গেছে,সে ঊঠে বন্ধ করে না,সন্ধ্যে নেমেছে তবু বাতি জ্বালায় না,কান্না ভেজা চোখে মুখে পানি দেয় না,মোবাইল বাজে তবু ধরে না,সালমার মা চা দিতে এসে ডেকে ডেকে ফিরে যায় মৌরি হু টাও করে না। আবেগে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে যেন তপুর সোহাগী অভিমানি বধু। বহুদিন পর তার মান ভাঙ্গার আগল অল্প অল্প করে খুলছে তাই প্রেমিকের ভালোবাসায় কিছুটা লজ্জিত,কিছুটা গর্বিত মুখ সে কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না। মৌরি মনে মনে খুব জোরে জোরে ডাকে “তপু তপু তপু”। অনুভব নামক জগতে শব্দটা আলোর গতিতে লক্ষ লক্ষ মাইল ছুটে যায়।

(৩)

“ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত”

“এক সাঈজ ছোট লাগবে মনে হয়”।
“আরে ভাই না। আপনার এক সাইজ বড়-ছোট হইলেই ফিট হবে না। ফিগার লাগে বুচ্ছেন। আপনার মত ফিগারে ভাই পাঞ্জাবি বানাইয়া পইড়েন। এইগুলা তো ফ্রি সাইজের”।
অনেকগুলো পাঞ্জাবি খুলে গায়ে দিয়ে মাপ দেয়ার পর দোকানের কম বয়সী ছেলেটি তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলল তপুকে। মালিক লোকটি হা হা করে ছুটে এলেন।
“আরে ব্যাটা ছাগল তুই কি বুঝস? ভাই আপনার পড়নের সার্টের সাইজ কত”?

কর্মচারি ছেলেটা ছাগল ডাকে খুশি হয়ে মালিককে দাঁত দেখায়। তপু বিষন্ন মুখে দেখায় সার্টের পেছনের ট্যাগ।
-“নাহ!সার্টের মাপ আর পাঞ্জাবীর মাপে তফাৎ আছে। তবে আপনিতো শুকনা মানুষ এর উপর লম্বা,ফিট ঠিকঠাক হবে না। হাতা ছোট হবে নাহয় শরীরে ফিট হবে। আবার হাতা ঠিক হলে লম্বা আর ঢিলা একটু বেশি হবে। এখন তো সব সর্ট পাঞ্জাবীর চল। অসুবিধা নাই একটু বড় ছোট পড়বেন এখন সবই স্টাইল। হা হা!”

লোকটি তার বিক্রি বাড়ানোর ধান্দায় বিভিন্ন দোকানি কথার সম্মোহন ছড়াতে থাকে আর তপু সম্মোহিত হবে না এমন ভাবতে ভাবতে দোকান থেকে বেরিয়ে বেশকিছুদুর চলে আসার পর কেবল আবিষ্কার করে, তার হাতে বড় সাইজের,মেরুন রঙের পাঞ্জাবীর একটি প্যাকেট। কিভাবে সে এটা কিনে ফেলেছে এখন কিছুই বুঝতে পারছে না। অথচ মৌরির প্রিয় রঙ কালো।
তার ইচ্ছে ছিল কালো রঙের পাঞ্জাবীই কিনবে। কিন্তু এতক্ষণ দোকনে দোকানে ঘুরে মনে হলো তার মাপের কালো পাঞ্জাবীর আকাল পড়েছে দেশে। একটা কিছু নতুন তাকে কিনতেই হত আর অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়ার সময় ও এখন নেই। ধুক পুক করা খুশি মনটা একটু দমে গেলো। এখন আর বদলাতে গিয়েও লাভ নেই। টাকা আর ফেরর দিবে না নিলে পন্য নিতে হবে।
তপুর কাছে মনে হচ্ছে এখন পর-পর বাকি ঘটনাগুলোই হতাশ করার মত ঘটবে। জুতোর দোকানে জুতো পাওয়া যাবে না,দেখা করার দিন হরতাল পড়ে যাবে,বা পাখি আসবে না বা আসলেও তাকে সামনা সামনি পছন্দ করবে না। বিদুৎ গতিতে সে বিয়োগাত্মক কিছু চিন্তা করে মনে মনে হয়রান হয়ে পড়ল। অফিস ছুটির ক্লান্ত শরীরেও যে জোড়টা ছিল এখন তা নিভু নিভু করছে।

মৌরির সাথে দেখা করার কথা একরকম হঠাৎ ই ঠিক হয়ে গেল। তাড়াহুড়াটা মৌরির দিক থেকেই ছিল তবে পাছে সে আবার ভুল বুঝে তাই আর দ্বিমত করে নি তপু। এখনো মাসের বেতন পায় নি সে। তবে ভাগ্যভালো যে, হিরন তাকে পুরো টাকাটা ধার দিয়েছিল।
হিরন ছাড়া টিওশনি করা,ছা পোষা চাকরী করা ছেলেগুলোর কারো কাছেই মাস শেষ না হলে টাকা থাকে না। তেমন কাছের বন্ধু না হওয়ায় ধারটা একটু কুন্ঠিত হয়েই চেয়েছিল সে। কিন্তু হিরন খুব স্বাভাবিক ভাব করেছিল,যেন সে জানতো। সে অভিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিল,
“এই গানেই কাজ হবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হইব ভাবি নাই। তোর সাহস বাড়ছে ঠিক ধরছি না?
-হুম।
হিরন তার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলছিল,
-যখন টাকা হয় দিস। আরে ব্যাটা সাহসটাই সব,পকেটে টাকাটাই সব না। সাহস আছে তো তুই রাজা নাই তো ফকির। মানুষ কয় আমি গাঞ্জা খাই। আরে শালারপোরা তোগো সাহস আছে নি যে খাবি। শালা ননসেন্সের দল।

হিরন সমানে আরো কিছু বলে যাচ্ছিল। তপুর কানে আর কিছুই যাচ্ছিল না। টাকাগুলো গুনেই সে হিরনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল আনন্দে। এক কান দু কান করে মেসের সবাই জেনে গিয়েছে তপুর কথা। যারা তপুকে তেমন পছন্দ করত না তাদের চোখেও স্নেহ, ঈর্ষা আর কৌতূহল দেখতে পেয়েছে এই কয়দিন। বেশির ভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা, মধ্যবিত্ত, জীবিকার সন্ধানে ছুটন্ত এই তরুনগুলোর কাছে চাকুরীর মত ভালোবসাও অধরা। ভালোবাসা কদর এই মেসবাড়িতে ছেলেগুলোর চোখে কতটুকু তা এই দুদিনেই তপু দেখতে পেয়েছে বেশ। এদের ভীরে লজ্জা আর খুশিতে একটু চনমনেই ছিল এই কয়দিন।

পাঞ্জাবীর প্যাকেটটি হাতে নিয়ে আজ হঠাৎ আবার বিষন্নতা তাকে পেয়ে বসলো। সে চিন্তিত মন নিয়ে জুতোর দোকানের দিকে ঢুকে পাঞ্জাবীর সাথে যায় এমন স্যান্ডেল খুজতে থাকল। পছন্দ অনুযায়ী গুলোর দাম অনেক বেশি।সে চলনসই একটা নিয়ে মনকে প্রবোধ দিল পাখি তো তাকে দেখবে, তার জুতো নয়। আর যাই হোক মেয়েটি কোন মতেই পন্যমুখী নয়। তবুও অনেক আকাঙ্গাখিত অপেক্ষার পর দেখা হবে,সবকিছু একটু সাজানোই ছিল কল্পনায়। তা একটু একটু যেন ভেস্তে যাচ্ছে দেখে তপুর আত্মবিশ্বাস আবার মাথা নোয়ালো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেল। তাকে কিছু প্যাক্যাট শুদ্ধ দেখে নিচ-তলা থেকেই একজন দুজন করে পিছু নিল। ঘরে ঢুকে তপু দেখে তাকে ঘিরে রুমমেট সহ প্রায় দশ-বারো জনের একটি জটলা। এদের কেউ কেউ তার ক্লাসমেট, কেউ বন্ধুশ্রেনী। সবার সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। প্যাকেটদুটো পাশে রেখে তপু ক্লান্ত ভঙ্গীতে চোখবন্ধ করে লম্বা হয়ে শুলো।
চোখ বন্ধ করেই তিনতলার সোহানের জোর কন্ঠ শুনতে পেল সে,
-আরে দোস্ত তোর তো চান্নি কপাল। আয় তোর কপালে ঘসা দেই। চিকনা শইল্লেই নাইকা জুটায় ফেলছস? আমি ফিগার বানাইয়াও পারতাসি না। সবাই ফ্লেক্সি করতে কয় ভালোবাসে না!
সবাই হোহো করে হেসে উঠল। বন্ধ চোখে তপুও হাসার চেষ্টা করে, হাসিটা আসতে আসতেও কপালের চিন্তার রেখায় মিলিয়ে গেল। তার মনে পড়ল এগারোটায় মৌরীর নেটে থাকার কথা অথচ আজ কেউ সহজে ঘর ছাড়বে বলে তপুর মনে হচ্ছে না।
প্যাকেটগুলোর খোলার শব্দ হলো, কিছুক্ষন এটা সেটা মন্তব্য করে হাসাহাসি করে তারা একে একে আরো আরো যোগারের লিষ্ট শোনাতে লাগল। সে এবার চোখ মেলে ফ্যালফ্যালে তাকায় বন্দধুদের মুখে। পাশাপাশি অবসন্ন চিন্তায় কে কি বলছে তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু শব্দগুলো কানে নিয়মমাফিক গিয়ে তার মনোযোগে নাড়া দিচ্ছে।
“হাতে টাকা রেখছিস?এই সময় টাকা রাখতে হয়”।
“সাথে কি নিয়ে যাবি মানে গিফট? ভালো কিছু নিয়ে যাস”।
“আরে না আজকাল চার-পাচ হাজার টাকা ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায়? এত টাকা এখন ব্যবস্থা কিভাবে করবে তুই বরং ফুল নিয়ে যাইছ”।
“চুলটা ঠিকমত কেটে যাইস”।
“আরে না চুল আজ কাটিস নি কেন? চুল কাটলে প্রথমদিন খুব ই খারাপ দেখা যায়। মেয়েরা পছন্দ করে না”।
“তুই জানলি কেমনে তুই তো এই পর্যন্ত একটা মেয়েই যোগাড় করতে পারলি না হে হে”।
“অই শালা ফালতু কথা কবি না। আমি তো ছাগল না যে খুটি তে থাইক্কা ভে ভে করমু। আমার আইডিয়া আছে। ভালোবাসা পাই আর না পাই ডেটতো মারছি।
আবারো সম্মিলিত হাসি।

হঠাৎ হিরনকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই একে একে তপুর কাছ ছাড়ে। তপুও উঠে দাঁড়ায়। হিরন তার জন্য এক প্যকেট কাচ্চি বিরিয়ানী নিয়ে এসেছে।এটা দেখে তপুর বেশ অসস্তি হয়। আডিক্টেড মানুষের স্নেহ যেমন বাড়তি থাকে,সময়ে তাদের ভুল বোঝার মাত্রাও বিরাট আকার ধারন করে আর এতে যে চরম ভোগান্তিই আনে এটা সে ভালো করেই জানে।প্যাকেটটা নিতে নিতে তার বলতে ইচ্ছে করে “কি দরকার ছিল। আমার খাবারতো দিয়েই গেছে ডাইনিং থেকে। সেটা শুধু শুধু নষ্ট হবে। এমন করে আর কিছু আনিস না”। কিন্তু সে এগুলোর কিছুই বলতে পারে না।
হিরন যেন বুঝতে পারে,মুখে কিছু বলে না। সে সিগারেটটা ঠোটে পিষে পিষে টান দিয়ে হাত উচু করে বিদায় জানায় আর ইশারায় বলে খেয়ে নিতে।
এই গরমে ফুলস্লিভ গেঞ্জি পড়ে আছে হিরন।পেছনে লেখা “মি মেড হিরো”।হিরনের চলে যাওয়া দেখতে কেন জানি খুব খারাপ লাগছে তপুর। আজ পেছন থেকে আসক্ত মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছে না তপু,দেখছে ভালোবাসার কাঙ্গাল এতিম একটা ছেলে। কিছুবছর আগে যে কারো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেছিল। সে কোনরকম দৌড়ে গিয়ে হিরনের কাধে হাত রাখে,বলতে চায় “এত ভালোবাসা পেতে ভয় পাই রে।এমনকি মৌরির ভালোবাসাকেও”। কিন্তু এটাও বলতে পারে না সে।
হিরন এবারো কিছু না বলে একমুখ দাড়ি নিয়ে কবিদের মত হাসি দেয়। চোখ পিট পিট করে নাক-মুখ ভর্তি করে ধোয়া ছেড়ে আরো কষে টান দেয় সিগারেট।

কাপড় ছেড়ে খেতে খেতে চিন্তা নামক দৈত্যের কাছে বস হয়ে গেলো তপু। যোগাড়যন্ত্রের তালিকা বাড়ছেই। উপহারের কথাতো ভুলেই গিয়েছিল সে। আর এত টাকাওতো আর তার কাছে নেই। অথচ অনুভব জগতটা কত সহজ!মৌরির সাথে দেখা করতে হলে সেভ করতে হয় না,জুতো পর্যন্ত পড়তে হয় না,খালি পায়ে মৌরিকে নিয়ে পৃথিবী দাবড়ে বেড়ানো যায়। এক তোড়া ফুল কেন? কৃষ্ণচূড়ার পুরো একটা শহরই দেয়া যায়। জামা কাপড়ের রঙ সাইজ নিয়ে ভাবতে হয় না। ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত!খাবারের নলা মুখে নিতে নিতে এমন অসম্ভব জগতের আকাঙ্খায় তপুর চোখদুটো জ্বলে উঠে।

(চলবে)
গল্পটি একটু বড় বিধায় দুই পর্বে ভাগ করেছি।শুক্রবার শেষ পর্বটা পোষ্ট করব।
আর এনিস সং যারা শুনেন নি তাদের জন্য লিঙ্ক। শুনে দেখুন অসাধারণ কিছু

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


44 Responses to গল্প-(অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)

You must be logged in to post a comment Login