তৌহিদ উল্লাহ শাকিল

চলে যাবার পূর্বে

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

 

 //তৌহিদ উল্লাহ শাকিল//

মায়ের চোখে অনেক জল । চোখ মুখ ফুলে গেছে । বোরকার পর্দা মানে নেকাবটা জলে ভিজে একাকার। আমি সব সময়ের মত নির্বাক, নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চুপ হয়ে। এত কোলাহল তাতে আমার কিছুই যেন হয়নি ।

ছোট বোন মনি সেও বারকয়েক ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছে , একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছেছে। এরপর আর আমার দিকে তাকায় না কিছুটা ভয়ে। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পিচ্চিটার হাত ধরে। পিচ্চি মানে মনি’র ছেলে নাম রাতুল । একটু নাদুস নাদুস ছেলে । সবাই তাই বেশী করে আদর করে । বিশেষ করে আমার বাবা মানে রাতুলের নানা।

মনি’র ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল উকিল হবে । কিন্তু সে তা হতে পারেনি । এস এস সি পরীক্ষার দিন কয়েক পূর্বে তার বিয়ে হয়ে যায়। দেশের মানে গ্রামের পরিস্থিতি তখন ভালো ছিল না । দুই কি মি দূরে পায়ে হেটে স্কুলে যাবার পথটা ততটা নিরাপদ ছিল না । মানে আজ যাকে কি বলে ? ও হ্যাঁ ইভ টিজিং। হ্যাঁ অনেক ছেলের দল ( মাস্তান) রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্কুলের মেয়ে গুলোকে কত্ত কি বলত । মাঝে মাঝে আমরা কয়েকজন রুখে দাড়াতাম । তবে আমাদের পক্ষে তাদের সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না । আর তাই অসহায়ত্ব নিয়ে চুপ থাকা ছাড়া আমাদের করার কিছু ছিল না। ইদানিং তো আইন হয়েছে , তবে প্রশ্ন থেকেই যায় ।ইভ টিজিং কি বন্ধ হয়েছে? মনি’র মত কত মেয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তাদের পরিবার মান ইজ্জতের ভয়ে। সমাজ ? এর কথা কি বলব । সমাজ তো সাধারন মানুষের জন্য না । সমাজ হল গুটিকয়েক ক্ষমতাশালী আর পয়সা ওয়ালা লোকদের জন্য ।

তাই বলে ভাবা যাবে না মনি দুঃখে আছে । হ্যাঁ এক স্বপ্ন পুরন না হওয়ার দুঃখ ত থাকবেই । এখন স্বামী সংসার আর সবে ধন ছেলে রাতুল কে নিয়ে বেশ খুশীতেই আছে। সকল ভাই চাইবে তার বোন সুখী হোক । এই যে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনি’র কথা ভাবছি ও ঠিকই টের পেয়ে যাবে। এটা এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক । আমি আর মনি পিঠাপিঠি ভাইবোন । আমি দুই বছরের বড় আর ও দুই বছরের ছোট । ওর বিয়ে হয়েছে , সংসার হয়েছে , দেখে ভালই লাগে।

বাবা আজ কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে ঠিক আমার মত । আমি বারকয়েক তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি । কিন্তু তিনি অন্যদিকে ফিরে আছেন । মনে হয় আমাকে লক্ষ্য করছেন না। বাবা তোমায় অনেক ভালোবাসি , এই কথাটি কেন যেন আজ পর্যন্ত মুখ ফূটে বলতে পারিনি আজো । বাবার বেশ মেজাজ গরম। তাই পরিবারের সকলেই বাবাকেভয় পায় । যেমন আমি ও পাই । স্কুল ফাঁকি দিয়ে একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম বলে বাবা আমাকে সেদিন অনেক মেরেছিল । কিন্তু কেন জানি বাবার প্রতি আমার সেদিন একটু ও রাগ হয়নি । বরঞ্চ রাগ হয়েছিল নিজের প্রতি । সেই থেকে ক্রিকেট ছেঁড়ে দিয়েছি । বাবা’র এমন নীরবতা কি ভালো লাগে ? বিশেষ করে আজকের দিনে!

ফুপাত ভাই পিপলু সব সময় আমার পাশেই থাকে । সুখে কিংবা দুঃখে । ছেলেটা বেশ ভালো । আজ ও আছে । কিছুক্ষণ পূর্বে এখানেই দাড়িয়েছিল । মনে হয় সিগারেট ফুঁকতে বাইরে গেছে । আমাদের মাঝে সেই একমাত্র সিগারেট পান করে। ছাত্র জীবনের কিছু দিন পিপলু আমাদের বাড়িতে ছিল । সে সময় থেকে কিংবা এর অনেক আগে থেকেই পিপলুর সাথে আমার দারুন সম্পর্ক । এইতো আসছে গালকাটা পিপলু। গালকাটা মানে একবার আমাদের বাড়ীতে তার আম্মু সহ এসেছিল । তার আম্মু তখন হাঁস কাটছিল পিপলু তার মায়ের কোলে বসে ছিল হুট করে তার আম্মুর কোল থেকে হাঁস কাটার বটিতে পড়ে গাল কেটে গিয়েছিল । সেদিন সবাই মিলে হাসপাতলে সেলাই করে আনা হয় । কিন্তু গালের ঠিক মাঝ বরাবর দাগটা সৃতি হিসাবেই থেকে যায়।

মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম মা জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন । আমি বরাবরের মতই চুপ । এরপর মনি , রাতুল , মনির স্বামী মোহন ভাই সকলের সাথে কথা বললাম । বাবা’র কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। বাবা এবার আর দেরী করলেন না বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। বাবার বুকের চাতির মাঝে আমার মুখ লুকানো ছিল , সেই সুযোগে আমি ও কেঁদে উঠলাম । যদি ও আমার কান্না কেউ দেখেনি। পিপলু বলে উঠল সময় নাই । দুইজন প্রহরী তখন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । বুকের মাঝে এবার ধক করে উঠল । হ্যাঁ কিছুক্ষণ পর থেকে এদের সবাইকে আমি আর দেখতে পাব না । পিপলু এগিয়ে এসে ঝরিয়ে ধরল । অকে খুব শক্ত করে আকড়ে ধরলাম । সকল ভালোবাসা তার সাথে এসে গেল বুক ভরে । পিপলু ও আমাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল ডুকরে । আমি ও কাঁদলাম ভেতরে ভেতরে । মুখে হাসি বজায় রাখলাম যাতে বাবা মা কেউ মনে কষ্ট না পায় ।  এরপর ভেতরে ঢুকে গেলাম এদের সকলের কান্নামাখা মুখ পেছনে ফেলে ।

পরিশিষ্ট ঃ সৌদি এয়ার লাইন্সের বিমান সাতশ সাত তখন অপেক্ষায়রত ঢাকা বিমানবন্দরে । বোর্ডিং পাশ নিয়ে আমি পা রাখলাম বিমানের ভেতর । বুকের মাঝে আবার মোচড় মেড়ে উঠল বেশ জোরে । বুঝতে পারলাম এখন আর চাইলে ও মা বাবা ভাই বোন কিংবা বন্ধু কাউকে দেখতে পারবো না। অন্য রকম ঘোরের মাঝে জানলার পাশের সিটে বসলাম। কিছুক্ষণ পর বিমান আমাকে নিয়ে চলল দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অজানা অচেনা দেশের মাঝে। পেছনে পড়ে রইল একদল ক্রন্দনরত মুখের সৃতি।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to চলে যাবার পূর্বে

You must be logged in to post a comment Login