শামান সাত্ত্বিক

জোৎস্না জড়ানো শিহরণ – ১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বিছানায় শুয়ে আছে অনুসূয়া। ফুলেল বিছানা। তা বিছানার চাদরে বড় বড় গোলাপের ছাপ। বালিশেও তা। পরিপুষ্ট শরীর। একটা সুখের সৌরভে জেগে উঠেছে। রাত্রিবাসে সে ঘরের আলোতে ছায়াচ্ছন্ন ভাব ধরে আছে। ঘর জুড়ে উত্তরের পর্দা। তা সরালেই সকালের বাহিরের আলো। আজ ছুটির দিন। বাইরের আলোটা কেন জানি মরা।

আজ সুরেশকে মনে পড়ে তার। সুরেশের সাথে লং ড্রাইভে শুধু গিয়েছিল একবার। ড্রাইভটা লং হওয়ার কথা ছিল না। এক বাসায় দাওয়াত থেকে ফিরছিল। তার হৃদয়ের বান্ধবীর বাসায়। না করতে পারে নি। প্রদীপের অফিসের কাজে শহরের বাইরে থাকাতে যেতে না পারাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কুমুর বাসার দাওয়াতকে না বলাটা ঠিক ছিল না। এদিকে অনুসূয়ার গাড়ীতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্রেকটাই একটু গন্ডগোল করছিল। ভাল গাড়িটা প্রদীপ নিয়ে গেছে। কুমু তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেলেও, শেষমেশ ফিরতে সুরেশের গাড়িতে উঠতে হয়েছে। কুমুই সুরেশকে অনুরোধ করেছিল, অনুসূয়াকে তার বাসার পথে নামিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু দু’জনে কথাতে এত মশগুল ছিল যে, সুরেশের অনুসূয়াকে নামিয়ে দেয়াটা মাথা থেকে সরে গিয়েছিল।। সে তার নিজের ঘরমুখী চলছিল। তার স্ত্রী দেশে গেছে বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে। দু’মাস থাকার পরিকল্পনার, শেষ দু’সপ্তাহে সুরেশ গিয়ে দেশে পৌঁছবে। তারপর একসাথে সবাই ফিরে আসবে।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে সুরেশ যখন তার বাসার কাছে পৌঁছালো, তখনই মনে হলো, অনুসূয়াকে নামানো হয়নি। গাড়ি তখন রেড লাইটে এসে থেমেছে। আর তখনই দু’জন দু’জনার মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠলো।

শনিবারের রাত। আকাশটাকে বেশ অন্যরকম লাগছিলো। রাতের শহরের যে একটা পরিচ্ছন্ন, গুছানো রুপ আছে, তা শহর থেকে একটু বাইরে গেলে ধরা পড়ে। অগাষ্টের প্রথম দিকের আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার। একটা ফুরফুরে ভাব আছে। উপভোগ্যই মনে হচ্ছিল রাতের এই উদাসীন সৌন্দর্যকে। অফিস-আদালতের ব্যস্ততার বিপরীতে এক মনোরম আনন্দবর্ধক অনুভূতি। এমন অনুভূতি মানুষের জীবনে হঠাৎ-ই আসে। আসে এমন হারানোর অভিলাষ। ছুটি পেলে প্রদীপের ঘুমিয়ে বা ইন্টারনেটে কাটাতেই পছন্দ। ঠেলে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না সহজে। নিজের মর্জিকে বেশি দাম দিচ্ছে। বলে কি না, মুড না এলে কোন কিছু সে করতে পারে না। কোথাও যাওয়াও না। তাছাড়া যুক্তিও দেয়। “সবসময় তো বাইরেই থাকি। ছুটিতে আর বাসায় থাকতে দেবে না?”

এখনকার এ মূহুর্তটাকে আর অবহেলায় হারানো যায়? এরকম মূহুর্তগুলোয় শুধু নিজেকেই উপভোগ উপলব্ধির মধ্যে নিতে হয়। অন্যের সাথে শেয়ার করা যায় না। প্রদীপের সাথে তো নয়। ভিডিও গেমে যে আনন্দ উপভোগ করে, সে জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া বালুকাময় চরে জিপে চড়ে বেড়াতেই ভালবাসবে। তাতে জোৎস্নাকে উপভোগ করা নয়, তাকে মাড়িয়ে যাওয়াই হয়।

অনুসূয়া তখনো হাসছে। হঠাৎ মনে হলো, কী আছে একটু হারিয়ে গেলে! কেমন হয়? সুযোগটা নেয়া যাক! স্বাচ্ছন্দ্যে সুরেশকে বলে বসে, “চলুন না, শহরের বাইরে কোথাও এক ছুট দিয়ে ঘুরে আসি।”

সুরেশও রাজী হয়ে যায়। তাই তো! কী বা করবে ঘরে গিয়ে এখনই। একটু কাটানো যাক না এভাবে।

পাক্কা ঘন্টা দেড়েকের উপর হাইওয়েতে ড্রাইভ শেষে তারা এমন একটা স্থানে আসে যা পুরোপরি শহর ছাড়িয়ে। সেখান হতে দূরে শহরটাকে পুরো দেখা যায়। শহরের স্তর থেকে এটা উঁচুতে। তাই পুরো শহরটার আকাশসীমারেখার পরিষ্কার দর্শন মেলে। রাতের কৃত্রিম আলোয় শহরটাকে অদ্ভূত সাররিয়েল মনে হয়। অথচ এই আলোয় রাতের জোৎস্নাকে একদম টের পাওয়া যাচ্ছে না। শহর ছেড়ে এদিকে আসায় পূর্ণিমাকে ভালই টের পাওয়া যায়। গাড়ি থেকে নেমে এসে এই উঁচুতে দাঁড়িয়ে তারা আলোর বিচিত্রতায় দূর শহরের দৃশ্যটাকে উপভোগ করে নীরবে।

দু’একটা গাড়ি কিছু পর পর শাঁ শাঁ করে পেছনের রাস্তা ধরে চলে যায়। এভাবে শব্দহীন রাতের সাথে সখ্যতা গড়ে দু’জনে ঘন্টা আধেক অথবা কিছুক্ষণ আরো। অনুসূয়া একসময় বলে উঠে, “সুরেশ বাবু, ফেরার ইচ্ছে করছে না?” একটু দ্বিধান্বিত হয়ে সুরেশ বলে, “আমার তো ভালই লাগছে।” অনুসূয়া উৎফুল্ল হয়ে বলে, “আমার তো থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ।” দুজনে কিছুক্ষণ হাসলো। কোন অর্থ আছে কি না এই হাসাতে তা বোঝা যায় না। দু’জনে হাঁটতে থাকে এলোমেলো দু’দিকে। কিছুটা উদভ্রান্ত মনে হতে পারে। এই হাঁটার যেমন অর্থ নেই, দু’জনের মাঝে এই নিয়ে কোন ঝগড়া-ঝাটিও নেই।

এইভাবে কতক্ষণ হাঁটে একা একা অনুসূয়া মনে নেই। তবে হেঁটে সে অনেকদূর চলে আসে। তারপর এক জায়গায় অনাদরে পড়ে থাকা এক ছোট বর্গাকৃতির পিলারের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। পূর্ণিমা রাতের সুনসান সৌন্দর্য এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বিশালতায় জেগে আছে। প্রাণভরে অনুসূয়ার আত্মার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে তা। অন্যদিকে সুরেশের আর বেশি দূরে যাওয়া হয় না। সে উল্টো ঘুরে তার গাড়ির কাছে চলে আসে, যে স্থান থেকে তারা দু’দিকে হাঁটা দিয়েছিলো। পূর্ণিমার আলো তার প্রাণেও বাঁশির সুর তোলে। অনেকক্ষণ আনমনা হয়ে থাকে সে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে সাত-পাঁচ ভাবে। দূর হতে অনুসূয়া হেঁটে আসে। সুরেশকে দেখে তার হাঁটার গতি বেড়ে যায়। সুরেশের কাছে এসে পাশে একটু দাঁড়ায়। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে, “চলুন, ফেরা যাক।” “ও হ্যাঁ” বলে সুরেশ গাড়ির দরজা খুলে অনুসূয়াকে ঢুকতে দেয়। ভোরের আলো ফুটে উঠার দেরি বেশি নেই।

“আপনি ঘরে ফিরে আমাকে জাস্ট একটা ফোন দেবেন। তাহলে বুঝতে পারবো, আপনি ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছে গেছেন।” – অনুসূয়াকে বাসায় নামিয়ে দিলে সুরেশকে সে এই কথাগুলো বলে। সুরেশ ফোন করে নিরাপদে বাসায় ফেরার কথা ঠিকই জানিয়ে দেয়।

এর দু’দিন পর প্রদীপ ফিরে এলো। সেই সাথে মেয়ে স্বাতীও ফিরলো, পাশের শহরে খালার বাসা থেকে। কী আশ্চর্য! টেলিফোনে আগত কললিস্ট থেকে বৌদি শিবানীর ফোনের উত্তর দিতে গিয়ে ভুলক্রমে সুরেশের ফোন নাম্বারে ফোন করে বসলো অনুসূয়া। সঙ্গত কারণেই ফোন সুরেশের ভয়েস মেইলে চলে গেছে। সুরেশ এখন দেশে। বৌ-বাচ্চাকে নিয়ে ফিরবে।

অগাস্টের শেষ। এই সময় আবহাওয়ার মাঝে একটা শীতল ঠান্ডা আমেজ থাকে। এটা খুব ভাল লাগে অনুসূয়ার। এই সময়টাই বেশি প্রিয়। ‘ফল’ ঋতু আসার আগে ‘সামার’ মিলিয়ে যাবার সময়টা এখানে উপভোগ্য ঠেকে। শীতে দেশে যাবার পরিকল্পনা আছে বলে, অনুসূয়া বা প্রদীপ, কারোরই এবার অফিস থেকে গ্রীষ্ম ছুটি নেয়া হয়নি।

সুরেশকে বেশ মনে পড়ছে। আবারও অফিসের কাজে প্রদীপ দূরের শহরে গেলে পথে স্বাতীকে তার চাচার বাসায় নামিয়ে দিয়েছে।

অনুসূয়া পর্দা সরিয়ে বাইরের প্রকৃতিটাকে আরেকবার দেখে। সূর্যের দেখা এখনো মেলেনি। শান্ত প্রকৃতির কেমন থমথমে ভাব। কী হয় ঘুমিয়ে নিলে আরেকবার!

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to জোৎস্না জড়ানো শিহরণ – ১

You must be logged in to post a comment Login