মামুন ম. আজিজ

ঠিকানার চিরকূট [একটি শিশুতোষ ছোট গল্প]

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

নিলয়ের গা বেয়ে অবিরাম ঘাম ঝরছে ।
দু রকম ঘাম- একরকম ঘাম ক্লান্তির আর অন্যরকম টি প্রচন্ড টেনশনের। অবশ্য দুটোকে আলাদা করে চেনার কোন উপায় থাকেনা।

গত একটি ঘন্টায় সে কম করে হলেও ৬/৭ কিমি রাস্তা হেঁটে — না হেঁটে না, চষে ফেলেছে। তন্নতন্ন করে খুঁজেছে আশেপাশের সব অলি গলি। কোথাও চোখে পড়ল না ছোট ভাইটির চেহারা। এত এত মানুষের ভীড়ে কোথায় খুঁজবে আর।

এতক্ষণ আশা ছিল, হাঁটার কষ্টটুকু সেই আশার কাছে পরাজিত হয়ে নিশ্চুপ ছিল। এখন আশা থেমে গেছে, কষ্টগুলো তাদের স্বকীয় উৎপাত জুড়ে দিতে লাগল। ছুটে ছুটে আসতে লাগলো প্রচন্ড একটা ভয় , উৎকণ্ঠা।

চোখদুটো একটু অজান্তেই উপর দিকে দৃষ্টিপাত করে,এমন ভাব যেন মহান সৃষ্টি কর্তা কেবল উপরেই থাকে। তারপর মনে মনে সর্বান্তকরনে সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করে সে, ‘আল্লাহ, আর কোনদিন আব্বু আম্মুকে না বলে কিছু করব না কখনও, কোনদিন না, বাসা থেকে একটু দূরে গেলেও আব্বু আম্মুকে বলেই যাব, প্লিজ আল্লাহ নিবিররে মিলিয়ে দাও, প্লিজ। ’

চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি নেমে এসে শুকিয়ে ওঠা ঘামের সাথে মিশে যায় ।
নিবির বিচ্ছিন্ন হবার সময় থেকে পুরো ঘটনাটা আরেকবার মনে করার চেষ্টা করে।
গরুর হাঁটে এসেছিল বাসায় না জানিয়ে ছোট ভাই নিবিরকে নিয়ে, আর সাথে ছিল দুই বন্ধু আপন আর তারেক। প্লানটা ছিল তিন বন্ধুরই কেবল। নিবির শুনে ফেলেছিল বের হবার সময়।

নিবির ওমনই, একবার যখন শুনেই ফেলল, ওকে না নিয়ে নিবিরের সেই গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কখনই সম্ভব ছিলনা। আপন অবশ্য না করেছিল। করবেই বা না কেনো তারা তিনজনেই কত ছোট, সবে মাত্র ক্লাশ সেভেনে উঠেছে আর সাথে নিতে হচ্ছে নিবির যে কিনা সবে ক্লাশ টুতে উঠেছে।

কিন্তু আপনও রাজী হয়েছিল যখন নিবির বলেছিল, ‘আপন ভাইয়া আমি কিন্তু আন্টিকেও বলে দেবো।’

তারপর হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে এসেছিল পাড়ার গলি ছাড়িয়ে আরও দুটো গলি পেড়িয়ে বড় রাস্তায় । সেখান থেকে মিনিট পনের হেঁটেই তারা পৌঁছে ছিল গরুর হাঁটে। পরশু কোরবানীর ঈদ। আজ তাই স্কুল ছুটি  ওদের। গরুর হাঁটে কখনও যায়নি তারা কেউ। ছুটির এই অবসরে তাই গোপনে দুঃসাহস  দেখানোর সুযোগ তারা ছাড়লোনা।

হাঁটে তারা পৌঁছেওছিল ভাল ভাবেই। কিন্তু হঠাৎ খুব হট্টগোল শুরু হলো। কে যেন বলল, ‘গরু ছুটে গেছে ,গরু।’ তারেক এর কানে সেটা সবচেয়ে আগে পৌঁছালো বোধহয়। সে বলে উঠল- ‘দৌড় দে।’

তারপর কোন এক অজানা শঙ্কায় দৌড়ই দিয়েছিল তারা সকলেই। নিলয়ের হাত থেকে নিবিরের হাত ছুটে যেতে খুব একটা দেরী হইনি। প্রচন্ড ভীড়ের দাবি তেমনই ছিল।
দৌড়াদৌড়ি থেমে ছিল খুব তাড়াতাড়িই। সম্ভবত ছোটা গরু কে আটকানো হয়েছে। নিলয় আবিষ্কার করল সে দাঁড়িয়ে আছে হাঁটের বাইরে একা। আপন, তারিক , কেউ নেই , নেই নিবিরও।

প্রথমে ভেবেছিল হয়তো ওদের সাথে নিবির আছে। একটা প্রশান্তি জাগছিল প্রাণে প্রচন্ড দুশ্চিন্তার মাঝেও। কিন্তু একটু পরেই দূরে একটা রিকশায় আপনের মত কাউকে মনে হলো সে দেখলো। হ্যাঁ, মোড় ঘুরতেই স্পষ্ট চোখে পড়ল, ওটা আপনই, সাথে তারেক। দুবার চিৎকার করে ডাকল। না দূরত্ব কমনা। এত হট্টগোলের মধ্যে সে শব্দ কানে যাবার নয় মোটেও তাদের।

কিছুটা ভয় তখনই পেয়েছিল নিলয়। তারপর তার ব্রিলিয়ান্ট মস্তিষ্কটা বেশ ভাবতে চাইল। হাঁটের আশাপাশ, ঢোকার পথগুলো এবং ভেতরেও যতটুকু সম্ভব খুঁজে দেখলো সে। পেলো না । অস্থিরতা তখন ব্যাপকতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল , হাঁট থেকে বের হয়ে আশে পাশের সবকটা অলি গলি খুঁজল, বড় রাস্তা ধরে হাঁটল অনেকক্ষণ।
না মাথা আর কাজ করছে না। আর কোথায় খুঁজবে সে?

ভীষণ ক্লান্ত হয়ে তখন একটু জিরিয়ে নেয়র জন্য একটা টং দোকানের বেঞ্চে বসে বুঝল কি ভীষন তেষ্টা তার ভেতর তখন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একটা বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি খেলো। কিন্তু প্যান্ট এর পকেটে হাত দিয়েই বুঝল মানি ব্যাগটা নাই। নিশ্চয় কোথাও পড়ে গেছে। অথবা উঠিয়েই নিয়েছে কেউ। শখ করে কেনা। এই তো মাত্র কদিন আগেই ঈদের শপিং এ আব্বুর সাথে মার্কেটে গিয়ে বায়না ধরেছিল। বলেছিল সে এখন বড় হয়েছে, মানিব্যাগ থাকা দরকার প্যান্ট এর পেছনের পকেটটাতে। আবদার ফেলেনি বাবা। সাথে অবশ্য নিবিরও পেয়েছিল একটা।

‘নিবিরটার ও কপাল ! সবকিছু আগে আগেই পায়। আমি পেলাম এই ক্লাশ সেভেনে উঠে আর ও এই বাচ্চা বেলাতেই।’

‘কপালটাই আজ খারাপ। কেনো যে বাসায় না বলে আসলাম। আল্লাহ প্লিজ নিবির কে ফিরিয়ে দাও, মানিব্যাগ লাগবেনা, পঞ্চাশ টাকা ছিল , যাক ওটাও , কিন্তু নিবির কে দাও আল্লাহ, আমি আর আব্বু আম্মুর কথার অবাধ্য হবনা, দেখো , সত্যি।’

ভাগ্য একটু প্রসন্ন মনে হলো তার যখন দেখল বুক পকেটে ১৫ টাকা পাওয়া গেলো। বিস্কুট আর পানির দাম দিতে পারল তা দিয়ে।এবার সে কি করবে। হঠাৎ মনে একটা আশার আলো ধপ করে জ্বলে উঠল। এইতো কাল রাতেই বড় আপু দুটো কাগজে বাসার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর সুন্দর করে লিখে নিবির আর নিলয়ে নতুন মানিব্যাগ দুটোতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল, ‘সবার কাছেই সব সময় বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর রেখে দেয়া উচিৎ। কখন কোন বিপদ হয় সে কি আর বলা যায়। ছোটদের কাছে তো অব্যশই ঠিকানা দিয়ে রাখতে হয়। কোথায় কখন হারিয়ে যাবে, ঠিকানা থাকলে তবু কাউকে বললে পৌঁছিয়ে দেবে।’

‘নিবির কি পকেটে মানিব্যাগ এনেছিল? ওর মাথায় যে বুদ্ধি , ঠিকই এনেছিল। আল্লাহ সত্যি যেন ওর পকেটে মানিব্যাগটা থাকে। না হলে ওতো ঠিকানাটাও ভাল করে জানে বলে মনে হয়না। রাস্তা চেনা তো দূরের কথা।’

এবার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। বুঝে উঠতে পারছিলনা কি করা উচিৎ। তবে মনে হলো বাসায় ফিরে না গেলে আরও দেরী হয়ে যাবে, আব্বু আম্মুকে জানানোই শ্রেয়। যদি খারাপ ঘটনাটি ঘটেই যায় খোঁজার ব্যবস্থাটা অন্তত করা যাবে।
কিন্তু মাত্র দশটাকা পকেটে রিকশা ভাড়াও তো হবেনা। পা ও চলছে না আর। তবুও হাঁটা শুরু করল।
বড় রাস্তা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর রিকশা ঠিক করল। এখান থেকে দশটাকা ভাড়া সে খুব ভালই জানে। আব্বুর সাথে প্রায়ই এখানে আসে বাজার করতে।

বাসার সামনে যত এগোচ্ছে হার্টবিট তত বাড়ছে নিলয়ের। তাদের তিনতলা বাড়ীর ছাদ চোখে পড়তেই ভয় আর উৎকণ্ঠা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে চাইল। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা যেন শুরু হলো হঠাৎ, যেন হার্ট বুকের মোটা চামাড়া ভেদ করে বের হয়ে আসতে চাইছে।

রিকশাওয়ালে যখন বাসার গেটের সামনে থামতে বলল ব্যাটা থামল না। বুঝতে পারল ওটা রিকশাওয়ালার দোষ না। তার গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে খুব ক্ষীণ স্বরে। গায়ে হাত দিয়ে থামতে বলল। এক লাফে নেমে ভাড়া দিয়েই কলিং বেল চাপতে যাবে তার আগেই বড় আপু আর নিবির বের হয়ে এল।

বড় আপু হাসতে হাসতে কান ধরে টান দিল এবং বলল, ‘ কিরে নিলিয় তুই নাকি হারিয়ে গেছিস। তা তোর পকেটে ঠিকানা টা ছিলনা কাল যেখানা লিখে দিয়েছিলাম।’
ভয় টা এখনও কাটেনি। একটু হাপাচ্ছেও সে। বলল,‘ আপু আমি হারাব কেনো , হারিয়েছিল তো ঐ গাধা।’

‘ তা ঐ গাধা তো তোর ঘন্টাখানেক আগেই বাসায় এসেছে এবং তোর ভাগ্য ভাল এখনও আব্বু আম্মুকে কিছু বলেনি। আম্মু তোর খোঁজ করেছিল, বলেছি আপন আর তারেকের সাথে আছিস। ওহ! ঐ গাধাদুটোও এসেছিল তোর খোঁজে। ওরা আসার পর তো আরও নিশ্চিত হলাম তুই হারিয়েই গেছিছ। নিবিরের সাথে প্লান করছিলাম , তুই সত্যি সত্যি যদি তুই হারিয়েই থাকিস তাইলে কিভাবে খুঁজবো তোকে সেই প্লান।’
‘আপু , আমি রাস্তাঘাট সব চিনিতো। ঐ গাধাটার জন্য কত কষ্ট করলাম, খুঁজলাম, মানিব্যাগটাও হারালাম ’ বলেই নিলয় হাতটা বাড়িয়ে নিবিরের কান ধরে টানতে গেলো।
নিবির সরে গিয়ে বলে উঠল,‘ভাইয়া , ঠিকানা হারিয়ে খুব কষ্ট হলো আসতে না, ইস পকেটটার দিকেও খেয়াল রাখতে পারনি। না তোমার সাথ আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। আমি দেখ দিব্যি ঠিকানাটা বার করে ট্রাফিক পুলিশ আঙ্কেলকে দেখালাম, উনি একটা রিকশা ঠিক করে দিল, ব্যস, আমাদের পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের সামনে রিকশা আসতেই সব চিনে ফেললাম। ’

ওদের দুজনের আপু পাশে দাঁড়িয়ে  এই মজার ঝগড়া থামিয়ে বললেন, ‘চুপ কর , ভেতরে চল। আর কান ধর দুজনেই এবং বল আর কোনদিন এরকম ভুল করবি না।’
সাথে সাথে নিবির বলল,‘আপু কোন ভুল, ঠিকানা পকেটে না রাখা না বাসায় না বলে দূরে যাওয়া, কোনটা?’

আপু বললেন, ‘ দুটোই , আর যদি এরপর ভুল হয় তাইলে কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলে দেবো। কোথাও গেলে অন্তত আমাকে বলে যাবি, বুঝলি। আর ঠিকানার চিরকূট ..’
আপুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুজনেই বলে উঠল একসাথে,‘ …কখনই সাথে রাখতে ভুলবনা।’

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


14 Responses to ঠিকানার চিরকূট [একটি শিশুতোষ ছোট গল্প]

You must be logged in to post a comment Login