তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৯)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

নয়

দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটির সাইজ কত হবে? ছয় ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি? এটুকু দিয়ে মুখ দেখতে গেলে হয় শুধু চোখ-নাক নাহয় নাক-মুখ দেখতে হবে, আর চুল আচড়ানোর সময় শুধু চুল দেখতে হবে। এটুকু দিয়ে রফিকের ছেলে হিসেবে যে সাজগোজ লাগে তা ভালই চলে যায়। দীনানাথবাবু দেয়ালে ঝোলানো সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টয়লেট টিস্যু পেপার দিয়ে মুখের তেল পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। রফিক যেটা বাথরুমের কাজ সারার জন্যে ব্যবহার করে, দীনানাথবাবু সেটাই প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ করছেন মুখের তেল পরিষ্কার করার কাজে। উনার ধারনা, মুখের তেলগুলো টিস্যু পেপার শুষে নিবে, মুখ আর তখন তেলতেলে লাগবে না। এখন বামগালের মাঝখানে সদ্য উঠা একটা ব্রণ গেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথমে সাদা ভাতের মত কিন্তু ছোট কি যেন বের হল, তারপর রক্ত। সে রক্তও মুছে নিলেন টিস্যু পেপার দিয়ে। ব্যবহৃত টিস্যুগুলোর জায়গা হবে এখন ঘরের এখানে সেখানে। বুয়া না আসা পর্যন্ত ওগুলো ওখানেই পড়ে থাকবে। রফিক শুয়ে শুয়ে এসব দেখছিল। হঠাৎ দীনানাথবাবুকে তার খোঁচাতে ইচ্ছা করে।

-কি দাদা? এতদিনে পাত্রী মনে হয় পেয়েছেন নাহলে মুখের এত পরিচর্যা?

-ধুরু দাদা, আপনি খালি ভুল অর্থ খুঁজে বেড়ান।

-তাই? তাহলে আসল অর্থ কি?

-নাইবা শুনলেন দাদা।

-কেন? বলেন?

-না দাদা।

রফিক গোপন কথার অস্তিত্ব টের পায়। তারপর তা জানার অভিপ্রায়ে দীনানাথবাবুকে চাপাচাপি করতে থাকে। দীনানাথবাবু কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন। তারপর বিছানায় বসে বলেন,

-দেখেন দাদা, আমি এইসব কিছু কাউকে বলি না। কিন্তু আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে। জানিনা কেন জানি মনে হচ্ছে আপনাকে বলা যায়।

-বলেন। সমস্যা কি?

-দাদা আমি বিবাহিত ছিলাম। আমার ডিভোর্স হয়েছে। ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বাবা মা মেনে নিল না, সংসারটাও টিকল না শেষপর্যন্ত। তারপর মনে করেছিলাম আর কোনদিন কোন নারীর ছায়া মাড়াবো না। কিন্তু দাদা বুঝেন তো মানুষের শরীর, কিছু পেতে চাই। এসময় আমার খারাপ পাড়ায় আনাগোনা শুরু হয়। সেখানকার একজনকে ভাল লেগে যায়, আমি তার নিয়মিত কাষ্টমার। হ্যাঁ, সে এখনো সেখানে আছে। অন্য কাষ্টমাররাও তার কাছে এখনো যায়। আপনি বলবেন, সবকিছু জেনে আমি কি করে তাকে ভালবাসলাম? আমি যে ভালবাসাটা কখনো পায় নি, আমি বুভুক্ষের মত সারাজীবন যেটা চেয়েছি সেটা ও দিয়েছে দাদা।

দীনানাথবাবু এক নিঃশ্বাসে বলে যান। রফিক প্রথমে স্তম্ভিত তারপর অবাক হয়। বলে,

-নাম কি উনার?

-পোশাকী নাম হিজলপাতা। আসল নাম মিনা।

-মুসলমান?

-হুম। আমি জানি আপনি কি ভাবছেন দাদা। যেখানে জীবনের সবকিছু খুঁইয়েছি সেখানে আর ধর্মকে ডেকে এনে কেন কষ্ট দেওয়া?

রফিক এবং দীনানাথবাবু দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। দীনানাথবাবু এবার উঠতে চাইলেন।

-আচ্ছা দাদা, বাইরে যেতে হবে; বাথরুমের কাজ সেরে ফেলি।

রফিকও পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।

-কেন দাদা? আজকেও কি ডাইরেক্ট এ্যাকশন নাকি?

-অ্যা্রে না দাদা। কি যে বলেন?

দীনানাথবাবু হেসে বাথরুমে চলে যান। রফিক ভাবনার দেয়ালটা মেলে ধরে। বাইরে থেকে একজন মানুষকে দেখে যা বুঝা যায় আসলেই কি তা সম্পূর্ণ? কিছু মানুষ বুকের মধ্যে হাজারটা দুঃখ-কষ্ট পুষে রাখে, কিছু মানুষ পৃথিবীর সব মানুষকে জানিয়ে বেড়ায় আর কিছু মানুষ তা সহ্য করতে না পেরে একসময় দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। দীনানাথদা এদের মধ্যে কোন বিভাগে পড়ে, ভাবে রফিক।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই রফিক বাইরে বেড়িয়ে পড়ে। গত পরশু ওলির বান্ধবী লিপির সাথে দেখা হয়েছিল। আজ ওলি আর লিপির পিংক সিটি শপিং কমপ্লেক্সে যাওয়ার কথা। রফিকের গন্তব্যস্থল সেখানেই। শপিং কমপ্লেক্সের পাশেই যে ছোট ছোট খাওয়ার দোকানগুলো আছে ও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে রফিক ভেবেছিল ওরা এখনো আসেনি তারপর ওলিদের গাড়ি দেখে নিশ্চিত হয় যে ওরা এসেছে। শপিং কমপ্লেক্সের মধ্যে যেতে রফিকের মন চাই না, কোন ফ্লোরে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে তারও কোন ঠিক নেই, রফিক গিয়ে কোথায় খুঁজবে ওদের? তার চেয়ে এই ভাল, ওরা নেমে গাড়ির কাছে আসলেই তো সে দেখতে পাবে। রফিক একটা সিগারেট ধরায়, অপেক্ষার সঙ্গী হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রংয়ের গাড়ি দেখতে থাকে রফিক। এমন সুদৃশ্য গাড়ি সে কি কোনদিন কিনতে পারবে? গাড়িগুলোর ড্রাইভাররা যত বেতন পায়, রফিকের আয় আর তাদের আয় মনেহয় বেশি হেরফের হবে না, ভাবে রফিক। মনে মনে বলে, “শালার লাইফটা একদম বাজে”।

রফিকের সিগারেট যখন প্রায় শেষের পথে তখন সে লিপিকে গেট দিয়ে বের হতে দেখে। সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে সামনে এগুনো চেষ্টা করে। তারপর দু’কদম যাওয়ার পরই থমকে দাঁড়ায় পিছনের মহিলাকে দেখে। ওলির মাকে এর আগেও দূর থেকে দেখেছে রফিক। চিনতে তেমন সমস্যা হয় না, সে দিক চেঞ্জ করে সামনের দিকে এগুতে থাকে। সামনের দিকে মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়।

গাড়ির কাছে গিয়ে ওলি তার মাকে বলে,

-মা, আমি ঠিক সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছিয়ে যাব।

লিপিও ওলির কথার সাথে যোগ করে,

-হ্যাঁ, আন্টি আমরা শুধু আরেকটু ঘোরাঘুরি করে চলে যাব।

জাহানারা তবু মাথা নাড়ান। সাখাওয়াত সাহেব জাহানারাকে অনেকবার বলে দিয়েছে, ওলিকে একা না ছাড়তে। সকালে আজকাল সাখাওয়াত সাহেব নিজে গিয়ে ভার্সিটি রেখে আসেন। হঠাৎ বাইরে যাওয়া নিয়ে সাখাওয়াত সাহেব আপত্তি তোলার কারনও আছে। ওলি তার বাবাকে বলেছিল, কয়েকদিন যাবৎ কে জানি তাকে ফলো করছে। তারপর থেকেই ওলিকে আর একা প্রয়োজন ছাড়া বের হতে দিচ্ছেন না। জাহানারা বলেন,

-তোকে এখানে রেখে গিয়ে আমি তোর বাবার সাথে ঝগড়া করতে পারব না।

-মা, প্লিজ।

-না, গাড়িতে উঠ।

অগত্যা ওলি গাড়িতে উঠে বসে, মুখটা ভার করে কালো অন্ধকার করে রাখে। ওলির পিছনটা শুধু দেখতে পেল রফিক। ওলি কি দেখা না করেই চলে যাচ্ছে? আজ কি যেন বলবে বলেছিল? লিপির মাধ্যমেই রফিক এসব জানে, আজও লিপিকেই ধরতে হবে, ভাবে রফিক। ওদের গাড়ি চলে যেতেই রফিক সামনে এগুতে থাকে। লিপি কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়, ও আর ওলি রফিককে দেখতে পেয়েছিল। প্রথমে লিপি কথা বলে উঠে,

-কি? এরকম সাপের মত কিলবিল করে সামনে এগিয়ে গেলেন কেন? ভয় পেয়েছিলেন নাকি?

রফিক হাসে। বলে,

-ওলি চলে গেল?

-হ্যাঁ। দেখতেই তো পাচ্ছেন।

-ও।

-আপনার জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে রফিক ভাই।

-হুম। তোমার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

-ছাই বুঝেছেন। কিছুই বুঝেন নাই। ওলিকে নাকি কেউ কিছুদিন ধরে নাকি ফলো করছে। তাই আংকেল আর ওলিকে একা বের হতে দিচ্ছেন না।

-বলো কি?

-হুম। আরেকটা সংবাদ হচ্ছে, আংকেল ওলির বিয়ের কথা চিন্তা করছেন। সম্ভবত আংকেল-অ্যান্টি আপনাকে মেনে নিবে না।

রফিক চুপ করে শুনে। তারপর বলে,

-এটা তো জানায় ছিল লিপি। এক এতিম ছেলেকে মেয়ে কে দিতে চাইবে?

-কি বলেন রফিক ভাই? কত মেয়ে আছে আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে।

-তুমিও হবে নাকি?

লিপি খিল খিল করে হেসে উঠে। বলে,

-ওলি শুনলে আমাকে মার দিবে।

রফিক প্রসঙ্গ পাল্টায়। বলে,

-এখন যাবে কোথায়?

-আর যাব কোথায়? হোস্টলে চলে যাব।

-চল আমিও যাব তোমার সাথে।

লিপি চোখ কপালে উঠে বলে,

-আপনার মেস তো অন্যদিকে। এতদূর ঘুরবেন কেন?

-নাহ, একটা কাজ আছে। বাসে যেতে তোমার সাথে কিছুক্ষন কথাও বলা যাবে।

-ওমা তাই?

লিপি “ওমা তাই” খুব টেনে টেনে বলে, “তাই” এর “ই” দু সেকেন্ড বেশি ধরে রাখে। কথা শেষ করে এমন মুখের ভঙ্গি করল যে রফিক না হেসে পারল না।

বাসে বেশ ভীড়, তবে ঢাকা শহরে আজকাল কখন ভীড় থাকে না সেটা যে কোন টক শোর ভালো আলোচ্য বিষয় বটে। এমনকি শুক্রবারেও মানুষের উপচে পড়া ভীড় থাকে। লিপি বাসে উঠে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করা সিটে একটা সিট পেয়ে যায়। বাসটা ধীর গতিতে এগুতে থাকে, সিগনাল আর জ্যাম পেড়িয়ে যেতে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে। রফিক লিপির পাশেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। বাস যখন খুব শব্দ করে সামনে এগুচ্ছে তখন রফিক হয় জোরে কথা বলছে নয়ত মুখটাকে লিপি কানের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

-আমি দুইদিন আগে যখন ওর সাথে দেখা করি তখন আমারও এরকম মনে হয়েছিল, কে যেন আমাদের দিকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে।

-খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন না কেন?

-ওলিকে তো কেউ জ্বালায় না তেমন। ওকে ডিস্টার্ব করলে আমাকে বলত না?

-তাতো ঠিক। আমিও তো জানতে পারতাম।

-আমার মনে হয় কি জানো?

-কি?

-ওলির বাবাই লোকটাকে লাগিয়েছিল ওলিকে ফলো করার জন্যে।

-ওমা আংকেল কেন লাগাতে যাবে? আর আপনিই কিভাবে্ তা বুঝলেন?

-এমনি, মনে হল তাই বললাম। সিক্সথ সেন্স না কি জান আছে না? ওইটা।

লিপি আবারো সেই সময়কার মত বলে উঠে,

-ওমা তাই।

রফিক হাসে। আজ ওলির সাথে দেখা হল না। মনটা তেতো হয়ে আছে। ফাঁকা বাঁশ ফেটে গেলে যেরকম শব্দ শোনা যায় সেরকম লাগছে তার হাসি। বাস শাহবাগের মোড়ে আসতেই দুজনে নেমে যায়।

-এবার কোনদিকে যাবেন রফিক ভাই?

-তুমি কোনদিকে যাবে?

-বারে, একবার বললাম না; হোস্টেলে চলে যাব।

-চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

লিপি আবারো তার ভুবন ভোলানা “ওমা তাই” বলে উঠে। তারপর বলে,

-চলেন।

-চল।

কিছুদূর যাওয়ার পর রফিক লিপিকে বলে,

-পালিয়ে বিয়ে করলে কেমন হয়?

-আমি বুঝতে পারছিলাম আপনার মাথায় এটাই ঘুরতেছে। একদম বাজে হবে ভাইয়া। ওলি আন্টি আংকেলের একমাত্র সন্তান। এতবড় আঘাত কি উনারা সইতে পারবেন?

-তাতো ঠিকই।

ওদের আর কথা এগোয় না। হোস্টেলের কাছে এসে লিপিকে বিদায় দিয়ে মেসের উদ্দেশ্যেই রওনা দেয়। মেসে ঢুকতেই ওর পাশের রুম থেকে অশ্লীল শব্দ শুনতে পায় সে। কৌতুহলে  হঠাৎ কি মনে করে পাশের রুমে ঢুকেই পড়ে। ওদের মেসে যে ছেলেগুলো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সবগুলো একসাথে বসে কিছুদিন আগে আনা কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফি ছবি দেখছে। রফিককে দেখে ছেলেগুলো তেমন লজ্জাবোধ করল না বা বিব্রতও হল না। বরং একজন বলেই বসল,

-অ্যা্রে দাদা যে। আসুন, আসুন। দারুন মাল এনেছি আজকে।

রফিকের ইচ্ছা করল ছেলেটাকে গিয়ে কানে ধরে ওর বাবা মার কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে আসে। ঘর অন্ধকার, দীনানাথবাবু এখনো আসেনি। ওর মাথায় শুধু একটি বাক্য ঘুরছে, “তাহলে ওলি কে আমার হবে না”? রফিক ঘরের লাইট জ্বালাতে যায় কিন্তু জ্বালায় না। রফিক ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার ভরে বিছানাটা গুঙ্গিয়ে উঠে। আর রফিক মনে মনে বলতে থাকে, “ওলি তাহলে আমার নয়, ওলি আমার নয়”।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


5 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৯)

You must be logged in to post a comment Login