তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক

মেস থেকে বের হয়েই রফিক বুঝতে পারল এসময়ে বের হওয়া একদম ঠিক হয়নি। পশ্চিম আকাশ দেখতে দেখতেই ঘন কাল মেঘে ছেয়ে গেছে। রিক্সায় বসেই ভাবতে থাকে সে ফিরে যাবে কিনা? তারপর ফিরে না যাওয়ার সিন্ধান্ত নেয় সে এবং তার সাথে সাথে রিক্সাও সমান গতিতে এগুতে থাকে। মধ্যবয়সী রিক্সাওয়ালাটা বাতাসের ঝাপটায় রিক্সা নিয়ে বেশি জোরে এগুতে পারছে না। কিছুটা ক্লান্তও মনে হচ্ছে তার সাথে কিছুক্ষন পর পর খুক খুক কাশি। আবহাওয়া খারাপ, ভাইরাস জ্বর চলছে চারদিকে, রফিক তাই বিরক্তবোধ করছে। রিক্সাওয়ালাটার কাছ থেকে জ্বরের ভাইরাস চলে না আসে আবার! ঠিক এসময় বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বাতাস মনে হচ্ছে রিক্সাকেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পাশে বালির স্তুপ থেকে বালি উড়ে এসে পড়ল রফিকের শরীরে বলে খিস্তি ঝাড়ল সে। কার উপর করল তা বুঝার উপায় নেই তবে রিক্সাওয়ালাকেই বকা দিয়ে জোরে রিক্সা চালাতে নির্দেশ দেয়। রফিকের কথা শুনে রিক্সাওয়ালাও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে। এক মিনিট পার হতেই ওর প্যান্টে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে থাকে। শালার বৃষ্টি তো আজকে ভিজিয়েই দিবে মনে হচ্ছে, মনে মনে ভাবে সে। তারপর রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে পলিথিন আছে নাকি? রিক্সাওয়ালা পলিথিন আছে জানায় কিন্তু এও বলে তাতে কোন কাজ হবে না, খুব জোরে বৃষ্টি আসবে বরং আশেপাশে কোন জায়গায় কিছুক্ষন দাঁড়ানো্র কথা বলে সে। রফিক সাঁই দেয় তার কথায় কিন্তু আশেপাশে দোকানপাট নেই বললেই চলে। শহরের এ পাশ এখনো কিছুটা গ্রামের মত। রিক্সাওয়ালা সামনেই একটা চায়ের দোকান আছে বলে জানায়। রফিক দ্রুত চালাতে বলে রিক্সাওয়ালাকে। এরইমধ্যে সে কিছুটা ভিজে গেছে। রিক্সার হুড তুলে দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে থাকে সে।

রিক্সা দোকানটার কাছে আসতেই সোজা নেমে দোকানের দিকে দৌঁড় দেয় রফিক। “ধুর শালা, ভিজেই গেলাম“, আবারো খিস্তি ঝাড়ে সে। দোকানটিতে বেশ লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, বলার অপেক্ষা রাখে না বৃষ্টিই এর জন্যে দায়ী, প্রায় জনাবিশেক যার বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। মানুষগুলোর মধ্যে কিছু ছোট বাচ্চাও আছে মূলত তারাই বাবুই পাখির মত কথা বলে চলেছে। বৃষ্টির ব্যাপারে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই মনে হয় উপরন্তু কি একটা ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করছে। রফিক দোকানের বেঞ্চিতে বসে বাইরের দিকে মনযোগ দেয়। বাইরে এর মাঝেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এসময় রফিকের সিগারেটের তৃষ্ণা পায় বলে দোকানদারের দিকে এগিয়ে যায়। দোকানদার একজন মহিলা, সাহায্যকারী হিসেবেও রয়েছে একটা মেয়ে সম্ভবত সেই মহিলাটিরই কন্যা। রফিক একটা গোল্ড লিফ সিগারেট আরাম করে ধরায়। ইদানিং সে নিয়মিতই সিগারেট খাচ্ছে ফলে পকেটের মোটা অংশ এর পিছনেই যাচ্ছে আজকাল।

রফিক টিউশনির জন্যে বের হয়ছিল এই সকালবেলায় কিন্তু বৃষ্টি এসে সবকিছু ভন্ডুল করে দিল বলে আজকের মত টিউশনিতে যাওয়া বাদ দেয় সে। বৃষ্টি এখনো থামেনি তবু রিক্সা নিয়ে কোথায় যাবে ভাবতে থাকে। এসময় একটা ছোট বাচ্চা এসে তার শরীরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আবারও বিরক্তবোধ করে সে কিন্তু কিছু বলে না বাচ্চাগুলোকে। এবার বাচ্চাগুলোর চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারে, বাচ্চাগুলো ওদের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করছে। কত টাকার খেলা হবে, এই নিয়েই তাদের মূল আলোচনা। কিন্তু হতচ্ছাড়া বৃষ্টির জন্য ওদের খেলা হচ্ছে না। একসময় সেও ঠিক ওদের মত কত ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছে। রফিকের বাবা ছিল সরকারী চাকুরে সেই সূত্রে সে চিটাগাং, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, কত জায়গায় না ঘুরে বেড়িয়েছি আর কতই না স্মৃতি তার। সে খুব ভাল খেলত বলে অনেক জায়গায়ই তাকে হায়ার করে খেলতে নিয়ে যেত। কোথায় যে হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো!

এবার খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে নজরে আসে রফিকের, প্রায় প্রত্যেকের হাতেই বিড়ি। পাশে কোথাও নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ হচ্ছে, ওরা সেখানেই কাজ করে মনে হয়। সবগুলো লোকের হাতে পায়ে কাদামাটি লেগে আছে। তাদের কথার বিষয়বস্তু অবশ্য তাদের গাঁয়ের কথা। এভাবে বৃষ্টি হলে এবার আমের মুকুল সব ঝড়ে পড়ে যাবে, ধানের ফলনও খারাপ হবে ইত্যাদি। ওদের কথার ভাষা শুনে চাঁপাই নবাবগঞ্জের লোক বলে ধারনা করে রফিক। ঢাকায় নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ হলে সেইদিকের লোকই কেন যেন বেশি দেখা যায়। ঐদিকের লোকগুলো কি বেশি গরীব? নাকি শুধু ঐদিকের লোকগুলোই ভাল বাড়ি বানাতে জানে? কে জানে?

রফিকের সিগারেট শেষ হয়ে আসে সাথে বৃষ্টিটাও কমে এসেছে। সে আরো দুইটা গোল্ড লিফ সিগারেট কিনে রিক্সাআলাকে যাওয়ার জন্যে তাগাদা দেয়। এই ফিট ফিট বৃষ্টিতেই রওনা দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অবশেষে রফিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাসাবোতে খালার বাসায় যাওয়ার। অনেকদিন যাওয়া হয় নাই একটা বাহানা দেওয়া যাবে সাথে দুপুরের খাওয়াটাও পাওয়া যাবে যদি ভাগ্য ভাল থাকে। পয়সার যা টানাটানি তাতে একবেলা ফ্রি খাবার পাওয়া ভাগ্যের কথা। রফিক রিক্সায়ালাকে তাড়াতাড়ি টানতে বলে। এরমধ্যে আবার বৃষ্টির মধ্যে পড়তে চায় না ও কারণ ওর আবার বৃষ্টির পানি মাথায় পড়লেই জ্বর আসে। তখন আবার অযথা খরচ, গত মাসেই অসুস্থ হয়েছিল সেইজন্যে মাসের সব টাকাই বেড়িয়ে গিয়েছিল।

খিলগাঁ ফ্লাইওভারের কাছে জটলা দেখতে পাই সে। দূর থেকে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে সম্ভবত কোন এ্যাক্সিডেন্ট। এই ঘটছে আজকাল সবসময়, আর হবেই বা না কেন, সবাই আছে তাড়াহুড়োয়। এর সাথে ও লাগাচ্ছে তো সে আরেকটার সাথে আরেকজন তারপর আহত হলে তো কথায় নেই, চলে একঘন্টা ধরে চলে ঝগড়া। সেই জটলা সাইড কাটিয়ে রিক্সা এগুতে থাকে। খালার বাসায় যাওয়ার আগে মুখে চুইংগাম মত কিছু দেওয়া দরকার। তার মুখ থেকে কেউ সিগারেটের গন্ধ পেলে তা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। রিক্সা থামিয়ে সে দুইটা সেন্টার ফ্রেশ কিনে নেয় তারমধ্যে একটা মুখে পুড়ে দেয়।

রফিক যখন খালার বাসায় পৌঁছায় তখন বারটা বেজে দশ। ওর ভাগ্যটা খারাপ কারণ বাসায় তালা ঝুলছে। রফিক কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সেদিকে এবং দরজায় লাথি মারার সুপ্ত একটা ইচ্ছা দমন করে বৌ্দ্ধ মন্দিরের দিকে হাঁটা দেয়। হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল দিলকুশার মধ্যে এসে পড়ে ততক্ষনে বৃষ্টির তেজও নাই বললেই চলে। শহরের এদিকটা বাণিজ্যিক এলাকা বলে ছোট ছোট খাওয়ার হোটেলে ফুটপাত পুরোটাই সয়লাব কিংবা দুইটা বিশ তলার বিল্ডিংয়ের মাঝে ঘুপচির মধ্যেই ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। রফিক দুপুরের খাবার সারার জন্যে তারই একটা খাওয়ার ভাসবান হোটেল বেছে নেয়। সত্যি কথা বলতে কি আসলে একটা ভ্যানের উপর খাবারের হাঁড়ি পাতিল সাজিয়ে মানুষকে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। অন্যান্য ভ্যানগুলোর চেয়ে এর বিশেষত্ব হচ্ছে এইটার শরীরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “খিচুরি পাওয়া যায়”। যে খাবার বিভিন্ন হাঁড়ি পাতিল থেকে তুলে তুলে দিচ্ছে সে বেশ স্বাস্থ্যবান। বৃষ্টিতে বেশ ঠান্ডা আবহাওয়াই বলতে হবে তবুও লোকটার শরীর দিয়ে দর দর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে যেটা রফিক দেখেও না দেখার ভান করল। ওর বেশ খিদা লেগেছে তাই এসব দেখার সময় নেই ওর। সে সেই লোকটাকেই জিজ্ঞাসা করল, “কি আছে”। লোকটা উত্তর দেওয়ার আগেই একটা ছোট্ট ছেলে যে কিনা সবাইকে গ্লাসে পানি তুলে দিচ্ছে সে বলতে লাগল,
-খিচুরি, ডিম, গরু, মুরগি, আলু ভর্তা, কাঁচা মরিচ। ডিম নিলে ২৫ টাকা, গরু ৪৫ আর মুরগি ৪০। কি খাবেন কন?
-খিচুরি সহ দাম?
-জ্বি। কি খাবেন কন?
-খিচুরি আর ডিম দাও।

রফিক উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে টুং টাং শব্দ হতে হতে প্লেটে খিচুরি আর একটা রান্না ডিম তার সামনে এসে পড়ে। আন্যান্য মানুষগুলোর মত সেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে শুরু করে। খাবার খেয়ে কোথায় যাবে আবারো ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে একটা বাসে উঠে পড়ে, রমনা নয়ত শাহবাগ, শাহবাগই ভাল। সিগনালের সামনে নেমে পাবলিক লাইব্রেরীতেই ঢুকে পড়ল ও। অনেক বেছে একটা গল্পের বই নিয়ে বসে পড়ল। কিছুক্ষন পরেই হাঁপিয়ে উঠল সে, প্রত্যেকটা গল্প যেন রগরগে সেক্সের বর্ণনা। ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোর টেবিলের দিকে চলে যায়, আশেপাশে একটিও সিট নেই। রফিক আবার চুপচাপ আগের চেয়ারেই এসে বসে পড়ে। রফিকের ঘুম ভাংগল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে, এক্সাক্টলি বলতে হলে বলতে হয় চারটা পঁয়ত্রিশ। ঘুম ভেংগে লজ্জিত বোধ করে, কখন চেয়ারে বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল! বাইরে বের হয়ে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করে। বাথরুমে মুখ ধুয়ে লাইব্রেরীর গেট দিয়ে বের হয়ে এসে সিঁড়ির কাছে আসতেই এক পা হঠাৎ দুমড়ে যায় তার। লম্বা সিঁড়িতে গড়া গড়ি খেতে খেতে পিচঢালা রাস্তায় নেমে আসে। নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু করে, হাঁটু গেড়ে বমিও করল একটুখানি, খিচুরীর কিছু অংশ বের হয়ে এল মুখ দিয়ে। এ অবস্থায়ও আশে পাশের লোকজন এগিয়ে এল না। রফিক ধাতস্থ হতেই পানির জন্যে পাবলিক লাইব্রেরীর ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যায়।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১)

You must be logged in to post a comment Login