নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি (তৃতীয় অধ্যায়) পর্ব-২৮

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকেই মন ভরান একটা ঘ্রাণ এলো নাকে। দেখল বাম পাশের পুরোটাই কাচের দেয়াল। দেয়াল এর নিচে সুন্দর করে সাজানো সুন্দর সব ঘর সাজাবার গাছ। সামনের  দেয়ালে বিভিন্ন ছবির ফ্রেম। মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো, তার উপর দুই জন চার জন বসার মত করে আলাদা আলাদা চেয়ার টেবিল সাজানো। টেবিলের উপর সাদা টেবিল ক্লথ বিছানো তার উপর ছুরি, কাটা চামচ, টেবিল চামচ, ন্যাপকিন, ওয়াইন গ্লাস এবং তার  পাশে একটা কোয়ার্টার প্লেট। ডান পাশে একটা ছোট কাউন্টার এর মত যার ভিতরে নানান রকমের বোতল। দেখে চিনতে পারলো মদের বোতল। এটা রেস্টুরেন্টের বার। পিছনের দেয়ালে ব্র্যাকেটে করে আরো অনেক বোতল সাজানো তার নিচে ওই সব মদ পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন রকমের গ্লাশ। পুরো বারটাই সুন্দর কারুকাজ দিয়ে সাজানো। সামনে দুই টা টেলিফোন, পিছনে একটা টিল, পাশে একটা পিডি কিউ মেশিন যাতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে লেনদেন করা হয়। সামনে ব্যারেলের লাগার ঢালার কয়েকটা টেপ তাতে বিভিন্ন কোম্পানির লোগো আকা।
যে লোকটা চেয়ার টেবিল মুছছিল  সরাসরি তার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটাও তার দিকে এগিয়ে এল।
আমি রাশেদ, মারুফ সাহেবের সাথে লন্ডনে জব সেন্টারে—
কথা শেষ করতে হলো না। লোকটা সিলেটি বাংলায় বলল

হ্য জানি আপনার আসার কথা তা এতো দেরি করলেন কেন? জানেন না আজ শুক্র বার। আচ্ছা আসেন।
বলে রেস্টুরেন্টের পিছন দিকে ঘুরে বেরিয়ে গেল। রাশেদ সাহেব শুক্র বার আর মঙ্গল বার এর পার্থক্য কিছু বুঝতে পারল না তবে অনুমান করল কিছু একটা আছে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে তাকে অনুসরন করে যেখানে এসে দাঁড়াল তা দেখে বুঝল এটা রান্নাঘর। মারুফ সাহেবকে দেখল খুব ব্যস্ত। সাথে আরো দুই জন, তারাও ব্যস্ত। সবার পরনে এয়াপ্রণ মাথায় কাগজের টুপি। বড় বড় কয়েকটা চুলা জ্বলছে তাতে বিশাল ডেকচিতে কি কি যেন জাল হচ্ছে। সারা রান্নাঘরে যা কিছু জ্বাল হচ্ছে তার মিলিত গন্ধ আর ধোয়া। যারা কাজ করছে তাদের চিতকার শুনে মনে মনে ভাবছিল এরা কি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেনা? এই সব কিছু মিলিয়ে এক ভিন্ন নতুন জগত বলে মনে হল । মারুফ রাশেদ সাহেবকে দেখেই বলল
যান তারাতারি উপরে যান কাপর বদলে চলে আসেন। আজ শুক্র বার। দেরি করে ফেলেছেন।
কোথায় উপরে যাবে কোন কুল কিনারা পাবার কথা নয় তবুও আর কি করা আজ যখন শুক্র বার তখন যাই দেখি কোথায় যাওয়া যায়। শুক্র বারের মহাত্ব্য পরে জানা যাবে। উপরে উঠেই একটা রুম দেখল দরজা খোলা। আরো দু এক টার দরজা বন্ধ। যাই হোক খোলা ঘরের ভিতরেই ঢুকে পরল। মিট মিটে আলোয় দেখল চার পাচ টা বিছানা, একটা ছোট টেবিল, দুটা ফোল্ডিং চেয়ার, একটা রুম হিটার। ঘরের মধ্যে নোংরা দুর্গন্ধ। এলো মেলো কাপর চোপর জুতা মুজা ইত্যাদিতে সারা ঘর ভরে ছড়ান ছিটানো। ঘর জুরে বিছানো কার্পেটটায় যে কখনো রঙ ছিল সেটা যে কি রঙ তা বোঝার উপায় নেই। এই কি লন্ডনের পরিবেশ? এর মধ্যেই থাকতে হবে তার ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত। যাক, ভাগ্যে যা আছে তাই ই তো হবে। এখন এসব দেখার সময় নয়। এক পাশে তার স্যুটকেস ব্যাগ রেখে কাপর বদলে কাজের জন্য আগে থেকে ঠিক করে রাখা কাপর পরে ফিরোজের দেয়া জুতা জোড়া পায়ে নিচে নেমে এলো।
আবার কিচেনে ঢুকতেই মারুফ ডাকল বলল

এদিকে আসেন, ওই ঐ দিকে দেখেন একটা বক্স আছে ওর ভিতর এপ্রোন আছে একটা গায়ে দিয়ে আসেন
কথা মত এগিয়ে গিয়ে কাঠের বাক্সটা খুলে এপ্রন বের করে গায়ে দিয়ে মারুফের সামনে দাঁড়াতেই মারুফ বলল
এই যে সিঙ্কের নিচে উপরে ডেকচি ওই গুলি সব ধুয়ে ফেলেন।
রাশেদ তাকিয়ে দেখল সাত আট টা বিভিন্ন সাইজের ডেকচি সাথে আছে আরো অনেক গামলা বাটি ইত্যাদি। কোথায় কিভাবে এগুলি ধুবে তার কিছুই বলেনি। খুজতে লাগল কোথায় ধোয়া যায়। হঠাত্ মারুফ চিতকার করে উঠল
কি হল ধোয়া হল? এদিকে আসেন এই যে এখানে এই গুলি সব উঠিয়ে ওই বিনে ফেলেন।
রাশেদ হতভম্ভ হয়ে জানতে চাইল কোথায় ধুব এগুলি?

বলেন কি এখনো ধোয়া হয়নি আরে ওই যে এতো বর সিঙ্ক দেখছেন না তারাতারি করুন।
হ্যা এতো বড় সিঙ্কই বটে কিন্তু এর মধ্যে যে তার চেয়েও বর ডেকচি কিভাবে ধোয়া সম্ভব তা বুঝে উঠতে না পারলেও বুঝতে পারল এই এখানেই ধুতে হবে এবং এখানে এই ভাবেই কাজ করতে হবে। এই তার নিয়তি। মানিয়ে নিতেই হবে। এখন বাছ বিচার করার  উপায় নেই। বিশাল ডেকচি, তার একটা উঠিয়ে নিয়ে সিঙ্কের পাশে লিকুইড সাবান, তারের জালি, সবুজ রঙের হারি মাজার শক্ত প্যড সব সরঞ্জামই আছে। ঠান্ডা গরম পানির টেপ দেখে নিয়ে হারি মাজতে শুরু করলেন। ওই সিঙ্কের মধ্যে এতো বড় ডেকচি নারা চারা করাই সামাল সামাল অবস্থা। তার মধ্যে ধোয়া! কি করবেন কি ভাবে করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এমনি সময় আবার তাগাদা
কি ভাই সাহেব হল?
অথচ তখনো মাত্র একটা ধুয়ে নিচে নামিয়ে রেখেছেন। বললেন
হ্য ভাই এই তো হচ্ছে।

এই ভাবে মোটামুটি আধ ঘন্টার মধ্যে ধোয়া হল। ওদিকে অন্য যারা ছিল তারা যে তামাশা দেখছে আর সিলেটি ভাষায় নানান রকম অশ্লিল মন্তব্য করছে তা নিরবে শুনে যাচ্ছেন। ওরা ভাবছে লোকটা আমাদের কথা বুঝতে পারছে না। কেউ কেউ ফাকে ফাকে কৌতুহল মেটাচ্ছেন।
ভাই সাহেবের বাড়ি কোথায়, নাম কি, ছেলে মেয়ে কয় জন, ফ্যামিলি কোথায়, কবে এসেছেন, কি ধরনের কত দিনের ভিসা, কেন এসেছেন এখানে আর কে আছে, আগে কখনো এসেছেন কিনা, দেশে কি করতেন????
ইত্যাদি যা সাধারন বাঙ্গালির সাধারন কৌতুহল। রাশেদ সাহেব বিরক্ত হলেও বেছে বেছে কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।, নিজে কোন প্রশ্ন করছেন না বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। এদের সাথেই থাকতে হবে।
রোজা মুখে, মনি চলে যাবার ব্যথা, অচেনা পরিবেশ, অনভ্যস্ত কাজ। এমনিতেই কোমরে ব্যথা হচ্ছে, হাত দুটা অবশ হয়ে আসছে। সেই ভোরে উঠেছে, পা দুটা শরীরটাকে আর দার করিয়ে রাখতে চাইছে না তার পর এই সব মন্তব্য। মনের ভিতর শুধু ঝর বইছে প্রচন্ড ঝর। ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। অনন্ত ধারায় মন রক্ত ঝরছে আর থাকতে পারছেনা শরীর। রাশেদ সাহেব জানেনা আর কতক্ষণ চলবে এই ভাবে। এক সময় ওগুলি ধোয়া শেষে অন্নান্য কাজ যা বলেছিল তা শেষ হলে পর একজন বলল
এই যে ভাই সাহেব একটু হাত চালিয়ে কাজ করবেন আরো ফাস্ট করবেন, আচ্ছা ওই যে ওই ব্রাশ টা নেন এবার কিচেনের ফ্লোর টা ঝারু দিয়ে ফেলেন। তার পর ওই যে দরজার বাইরে ওই ঘর টা দেখা যায় ওখান থেকে এক বস্তা পিয়াজ এনে ছিলবেন।
মারুফ বলল
কেন পিয়াজ লাগবে কেন পিয়াজ তো ওই বালতিতে আছে
ও আচ্ছা থাক তাহলে পিয়াজ আনা লাগবে না।

রাশেদ সাহেব ভাবলেন যাক এখন না হয় লাগল না কিন্তু পরে তো তা হলে আমাকেই আনতে হবে। এটা তা হলে আমার কাজ।
কিচেন ঝারু দেয়ার পর লক্ষ করল আড়াইটা বাজে। একটু দুই মিনিটের জন্য দাড়াবার সুযোগ পেয়ে কবির নামে ছেলেটাকে বলল
এখন কি কাজ?
কবির বলল
না এখন শেষ।
এর মধ্যে সবাই যাদু মন্ত্রের মত কিচেন ছেড়ে চলে গেছে।
উপরে চলেন আপনার বিছানা দেখিয়ে দেই। আসেন আমার সাথে। আচ্ছা এক মিনিট, ওই যে ওই দরজা টা বন্ধ করে আসেন ঠান্ডা বাতাস আসবে উপরে যাবার সময় সব সময় ওই দরজা বন্ধ করে যাবেন।
এই বলে কবির আবার নিচে নেমে এল

বলল আসেন আমার সাথে আপনাকে দেখিয়ে দেই।
বলে সেই দরজা দিয়ে বাইরে এলো। রাশেদ সাহেব ও এলেন ওর পিছে পিছে বাইরে আসতেই ঠান্ডায় সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল কিন্ত তা চেপে দাত কামড়ে রেখে তাকিয়ে দেখলো পিছনটায় কাঠের বেরা দেয়া ভিতরে একটা গাড়ি। ওই পাশে একটা ছোট কাঠের ঘর। ঘরের ভিতরে আলু পিঁয়াজের বস্তা, আদা রসু্‌ন, ধনে পাতা, ক্যাপসিকাম, গাজর, ফুল কফি, আরো অনেক কিছু। কবির বলল
এখানে লোক জন এই ভাবেই কথা বার্তা বলবে কিছু মনে করবেন না এখানে এই রকমেই চলে।
মালামাল গুলি দেখিয়ে বলল
যখন এই সব জিনিস নিতে বলব তখন এখান থেকে নিয়ে যাবেন। আপনাকে দেখেই বুঝেছি আসলে এই কাজ তো আপনার জন্য না কিনতু কি করবেন এসেই যখন পরেছেন করতে তো হবে। আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দিবো আজ তো শুক্র বার আজ কোন রকমে চালিয়ে নেন। শুক্র আর শনি বার এখানে খুব বিজি হয় সবাই ব্যস্ত থাকে সবার মাথা গরম থাকে তাই কে কি বলে না বলে হুস থাকে না। এই দুই দিনেই যত ব্যস্ত সপ্তাহের অন্য দিনে কিন্তু এত ব্যস্ত থাকবেনা। রাশেদ সাহেব এতোক্ষনে শুক্র বারের মহাত্ব্য বুঝতে পারলেন।
এই যে দেখে নেন এখানে কি কি আছে। আন্দাজে খোজা খুজি করবেন না, সময় নষ্ট হবে শেফ বা সবার মেজাজ গরম হবে। ওই যে কিচেনের পিছনে যে স্টোর ওখানে কি থাকে এখানে কি থাকে এগুলি মনে রাখবেন বলার সাথে সাথে নিয়ে দিবেন কাজ সহজ হবে কষ্ট কম হবে সময় কম লাগবে। দেখলেন তো এখন চলেন একটু রেস্ট নিবেন ও হ্য রোজা আছেন তো? আচ্ছা তা হলে আজকে তো তিনটা তেপ্পান্ন মিনিটে ইফতার তখন নিচে চলে আসবেন ইফতারের জন্য।আর রেস্টুরেন্ট খুলবে সারে পাচ টায় আপনি পাচ টায় নিচে নেমে আসবেন তখন বলে দিব এসে কি করতে হবে। আমি আপনার কাছেই থাকব।
ভাই আমাকে বলে দিবেন কি ভাবে কি করতে হবে বুঝতেই তো পারছেন একেবারে নতুন এর আগে তো কখন এমন কিছু করিনি।
ভাববেন না এরকম হয় কে আর সব কিছু শিখে আসে এদেশে এখানে এসেই সবাই শিখে আমরা দেশে কি কেউ কখন এই সব কাজ করেছি? হ্য আপনার কষ্ট হবে তবে আবার সুবিধাও আছে।

কি সুবিধা?
না মানে আপনি তো ইংরেজি পরতে পারেন বলতে পারেন ইংরেজি পরতে পারলে অনেক সুবিধা। চলেন উপরে চলেন ঠিক ঠাক করে নেন আবার কিন্তু পাচ টায় নামবেন দেখবেন ডাকাডাকি যেন করতে না হয়।[চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to নক্ষত্রের গোধূলি (তৃতীয় অধ্যায়) পর্ব-২৮

You must be logged in to post a comment Login