নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি-২২

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ঠিকই বলেছেন ভাই, লং রুটে ও চালাতেই চায় না, বলে আমি সাইন দেখে পড়ে নিতে পারি না।

এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে বলে মনিরা ভয় পেয়ে বলল চুপ কর ভাবীর সাথে কথা বলো না উনি নিজেই চিনে যেতে পারবে।
এর মধ্যেই ভাবী বায়ে টার্ন নেয়ার ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে দিয়েছে, আস্তে আস্তে বায়ের লেনে চলে আসছে। এবারে স্ট্রাউডের সাইন দেখেই বাম দিকে টার্ন নিতেই সামনে দেখা গেল স্ট্রাউড মাত্র পাচ মাইল দূরে। স্ট্রাউড ছোট্ট একটা শহর। কাছে এসে রাশেদ ডান বাম বলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার ভাইয়ের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে বাসার কলিং বেলের সুইচ টিপে দিল একটু পরে মাইকে শব্দ হলো,
হু ইজ দেয়ার?
মনিরা এগিয়ে মাইকের সামনে বলল আমি ভাবী, দরজা খোল।

দরজা খুলছে না। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল, কি ব্যাপার?আবার বেল বাজাল, না, কোন শব্দ নেই। ফিরোজ, ভাবী এরা সবাই এর ওর মুখের দিকে দেখছে। আসার সময় গাড়ির ড্যাশবোর্ডে দেখেছে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী। এই ঠান্ডার মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মনিরা রাশেদ সাহেব উভয়ে উভয়ের দিকে তাকাচ্ছে, উভয়ের মুখে অব্যক্ত প্রশ্নের ছাপ কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। এভাবে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকা যায়?অপেক্ষা যে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর যন্ত্রনা দায়ক। বিশেষ করে এই রকম পরিস্থিতিতে। প্রচন্ড শীতে হাড়ে কাঁপুনি ধরার উপক্রম হয়েছে। নিজেদের গাড়িতে আসছে বলে তেমন গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আসেনি।

আরও প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রাশেদ সাহেবের ভাই এসে দরজা খুলে ফিরোজ আর তার স্ত্রীকে দেখে অবাক হলো, কি জানি হয়তোবা একটু লজ্জাও পেয়েছিল। আগে ওদের দেখেনি তবে অনুমানে বুঝে নিল বড় ভাইয়ের এক বন্ধু থাকে লন্ডনে, হয়তো ইনিই সেই ফিরোজ ভাই। কোথা থেকে যেন একটু হাসি ধার করে এনে মুখে লাগিয়ে বলল আসুন ভিতরে আসুন। ফিরোজ রাশেদের সাথে মালামালগুলি নিয়ে ভিতরে ঢুকল। বাসার ভিতরে ঢুকেই মনিরা দেখল ওদের একমাত্র পাচ বছরের মেয়েটি আগন্তুকদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনিরা বুকে তুলে নিয়ে বলল

আমাকে চিনেছ, বলত আমি কে?
বড় চাচী।
রোজার দিন বলে ওর বৌ রান্না ঘরে ইফতার বানাচ্ছিল। মনিরা ভাবিকে নিয়ে রান্না ঘরেই চলে গেল, রাশেদ ফিরোজকে নিয়ে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে রান্না ঘরে ঢুকে মনিরার কোল থেকে ভাতিজিকে বুকে নিয়ে সেও মনিরার মত জিজ্ঞেস করল
আমাকে চিনতে পেরেছ, মা?বলত আমি কে?
বড় চাচা।

ফিরোজ ওর সাথে আলাপ করছিলো, প্রথমে রাজনীতি নিয়ে আলাপ শুরু হলো সে আবার এখানকার ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলর।
তোমাদের এই জায়গাটা তো বেশ সুন্দর, পাহাড়ি এলাকা। মাঝে মাঝে জঙ্গল চার দিকের দৃশ্য গুলি বেশ সুন্দর। আমি গাড়িতে বসে তাই ভাবছিলাম এই এলাকায় এসে বাড়ি করব কিনা, লন্ডনে একদম থাকতে ইচ্ছা করে না।
প্রায় পনের বিশ মিনিট পর শেফালি আর মনিরা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেই রাশেদকে ডেকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে এলো। বারান্দা না ঠিক তবে দুই ঘরের মাঝের ফাঁকায় দাঁড়িয়ে
শেফালি বলল, ভাই কিছু মনে করবেন না, এখানে আপনাদের থাকা হবে না, এক্ষুনি উঠে পরুন। চলেন লন্ডনে ফিরে যাই।
কি ব্যাপার ভাবী?
বলব লন্ডন যেয়ে সব বলব আপনি এক মিনিটও দেরি করবেন না। মালপত্র যা নামিয়েছেন নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পরুন।

রাশেদ সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে ভাবীর পিছনে মনিরাকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার ভাবী কি বলছে?
যা বলেছে তা তুমি স্পষ্টই শুনতে পেরেছ, যা বলেছে তাই কর পরে ভাবিই সব বলবে, দেরী করোনা, ইফতারির সময় হয়ে গেছে।
শুনেই রাশেদ সাহেবের মুখটা কাল আধার হয়ে গেল, চোখ ভিজে গেল, পায়ের তলা থেকে কে যেন টান দিয়ে মাটি গুলি সরিয়ে নিয়ে গেল, বুকটা ছ্যাত করে কেঁপে উঠলো, গলা শুকিয়ে জিহবা আড়ষ্ট হয়ে গেল। আর কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না। মনিরা হত বিহবলের মত থমকে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা তখনো রাশেদের কোলে বসে একে একে সবার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে।

ভাবী আবার তাগিদ দিয়ে বসার ঘরে গিয়ে ফিরোজকে নিয়ে এসে কি সব আলাপ করল। ফিরোজ রাশেদকে বলল
চল তারাতারি কর বলেই মালামাল যেখানে নামিয়ে রেখেছিল সেখানে এসে দাঁড়িয়ে হঠাত্ কি যেন মনে হলো তাই পিছনে ঘুড়ে রাশেদকে বলল ওদের জন্য কি কি এনেছ সেগুলি বের করে দিয়ে যাও।
না থাক, কি হবে ওসব দিয়ে, সময় নেই। ভাবী বলছে তারাতারি করতে, চল পরে কখনো সুযোগ হলে দেয়া যাবে।

দুজনে মিলে যে ভাবে এনেছিল যেই ভাবে আবার গাড়িতে তুলে রেখে এসে দেখে মনিরার কোলে বাচ্চা মেয়েটা বসে ভাবছে এর মধ্যে এমন কি হলো যে বড় চাচা চাচী এসেই আবার চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে ওর এই মাত্র পাচ বৎসর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। পৃথিবীর কোন কাঠিন্যের ছোয়া ওকে এখনো স্পর্শ করতে পারেনি তাই ঠিক কোন সমাধান পাচ্ছে না। ফিরোজ এগিয়ে বসার ঘরে গিয়ে রাশেদের ভাইকে বলল
তাহলে আমরা আসি।
বসেন এখনি যাবেন কেন একটু চা খেয়ে যান।

না না চা খেতে হবে না, পরে কখনো এলে তখন হবে, এখন আসি। মনি কোল থেকে মেয়েটাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, আসি মা, ভাল থেক, আমরা চললাম।
বলেই কোন রকমে নামিয়ে দিয়ে ঘড় থেকে বের হয়ে গেল। সামনে শেফালি পিছনে রাশেদ সাহেব আর তার পিছনে ফিরোজ। রাশেদ সাহেবের মনে হচ্ছিল তার পায়ে লোহার জুতা আর সে হেটে যাচ্ছে কোন চুম্বক বিছানো পথ দিয়ে। অনেক কষ্ট করে পা টেনে নিতে হচ্ছে, চুম্বক যেন তার পাগুলিকে আটকে ধরে রেখেছে সে পা চালাতে পারছে না।

সবাই গাড়িতে উঠা মাত্রই ভাবী গাড়ি স্টারট করে লন্ডনের পথে ছুটে চলল। ইফতারির আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। গাড়িতে এক মাত্র দুই বোতল পানি ছারা আর কিছু নেই। শেফালি স্ট্রাউড শহরে ঢুকে একটা দোকানের পার্কিঙ্এ গাড়ি পার্ক করে ফিরোজকে বলল তারাতারি নেমে যাও দেখ কিছু নিয়ে এসো। এখানেই গাড়িতে বসে ইফতার করে আবার লন্ডনের পথে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই এম ফাইভ মটর ওয়ে। ঝড়ের মত এক শত মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি। ড্রাইভিং এর শিক্ষিকা মিসেস শেফালি আতিক মুখে কেমন একটা অস্বস্তির কালো রঙ মেখে ট্রাফিক নিয়মের কোন বালাই না মেনে এক মনে ছুটে চলেছে।

যেন পিছনে বৃশ্চিক দঙ্গশনের কোন অগ্নি দগ্ধ করুন বিভিষীকা ফেলে যত তারাতারি পালিয়ে যেতে পারলেই বেচে যায়। গাড়ির ভিতরটা নিস্তব্ধ, কারো মুখে কোন কথা নেই। কেবল মাত্র ইঞ্জিনের যান্ত্রিক একটা শব্দ আর তার সাথে গাড়ির চারটা চাকার সাথে মটর ওয়ের কঠিন পাথর পিচ মেশানো পথের ঘর্ষণের শব্দ। একটু পরেই হঠাৎ ফিরোজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওর বাসায় ফোন করে বলে দিল আমরা আসছি।

রাশেদ মনিরাকে বলল মনি পানির বোতলটা দাও তো।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ওরা ফিরোজের বাড়ির সামনে নেমে মালামাল নিয়ে নেমে এল। এর মধ্যে কারো মুখে কোন কথা নেই। রাশেদ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ঘরে গিয়ে শীতের কাপড় চোপর ছেড়ে কোন ভাবে রান্না ঘরে এসে খেয়ে মনিকে নিয়ে উপরে গিয়েই এই পৃথিবীতে এক মাত্র আশ্রয় মনির বুকে মাথা রেখে শুধু জিজ্ঞেস করলো,
মনি, একি হলো?কেন এমন হলো?এটা কিসের প্রাপ্তি?[চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to নক্ষত্রের গোধূলি-২২

You must be logged in to post a comment Login