নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত-৫

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


কি, মুক্তি যুদ্ধে যাওয়া হোল না? বাবা টের পেলেন কি ভাবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। কি জানি কোথায় কোন ভুল করে ফেলেছি সব পরামর্শ ফাস হয়ে গেছে। বাবা বললেন তুমি কখনো গ্রামে থাকনি, গ্রামের কাচা রাস্তায় খালি পায়ে হাটনি, গাছে উঠতে পারো না, সাতার জানো না তুমি মুক্তি যুদ্ধ করবে কি ভাবে? তার চেয়ে চল বিজয় নগরে সুশীল বাবুর কাছে নিয়ে যাই উনি অন্তত তোমাকে মুক্তি যোদ্ধা না হোক উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাদের সহকারী বানিয়ে দিবেন। এই দিয়েই মোটা মুটি দেশের কাজ করার সুযোগ পাবে।

যুদ্ধে যাওয়া হলো না বলে যতটা খারাপ লাগছিল নিজেকে যতটা নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো, অকর্মন্য মনে হচ্ছিলো বাবার কথা শুনে তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। তখনই সুশিল বাবুর বাড়ির পথে রওয়ানা হোল। পনের বিশ মিনিটের মদ্ধ্যে চলে এলো। এখানে এসে দেখে তার মত অনেকেই সেখানে উপস্থিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হোল মালেকও ওখানে রয়েছে। মালেকের সাথে চোখা চোখি হতেই একটা স্বরযন্ত্রের আভাস দেখতে পেলো ওর চোখে মুখে। ও! আচ্ছা, তাহলে তুমিই এই কাজ করেছ?

স্কুলে যেমন স্কাউটিংয়ের ক্লাশ হোতো, সুশীল বাবুও সেই ভাবে তার হবু মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা রাইফেলের মত কি এক অস্র নিয়ে ভাষন দিচ্ছিলেন। পাশে মেশিন গান রাইফেল এইগুলিও রয়েছে, পরে জেনেছে ওটার নাম স্টেন গান। বাবা আর সুশীল বাবু একই স্কুলে পড়তেন। বাবাকে দেখেই সুশীল বাবু থেমে গেলেন। এসো বাদশা, বাবার গ্রামের নাম বাদশা। বাবা জাহিদকে দেখিয়ে বললেন এই হোল আমার বড় ছেলে, একে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম কাজে লাগাবেন। ওর খুব ইচ্ছা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। সুশিল বাবু খুশি হয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন এমন ছেলেই আমার দরকার, যাও বাবা ওই ওখানে বস বলে হাত দিয়ে তার সামনের ব্যাটেলিয়ন যে খেজুর পাতার মাদুরে বসেছে সে দিকে দেখিয়ে দিলেন, বাবাও এক পাশে বসলেন। সুশীল কাকা আবার শুরু করলেন। কি ভাবে শত্রু পক্ষের এলাকা পার হয়ে নিজ দলের কাছে পৌঁছান যায়, কি ভাবে শত্রুকে আক্রমন করতে হয়, নিজেকে রক্ষা করা, অস্ত্র রক্ষা করার নানা খুটিনাটি কৌশল তিনি বলে যাচ্ছেন। এই ভাবেই বেশ কয়েকদিন গেল। ভোরে আজানের পর থেকেই শুরু হয় বেলা একটু উপরে উঠলে যখন মানুষের চলা ফেরা শুরু হয় তখন শেষ হয়।

জাহিদের সারা দিন কাটে এ গ্রামে ও গ্রামে ঘুড়ে ঘুড়ে, সুযোগ পেলেই মালেকদের বাড়ি। ওই বাড়িতে কি যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা কি একটা আকর্ষন আছে যা এখনো বুঝে উঠেনি। এদিকে মালেকও ওর ঘনিষ্ঠ জনদের মদ্ধ্যে এক জন। ওই ঘটনার পর থেকে মালেকের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। একটু দূরে দূরেই থাকে। বুঝতে পেরে মালেকই একদিন এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বললো দেখ তুই আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাজ করতে পারবি না জেনে বুঝেই আমি মতিন চাচার সাথে পরামর্শ করে চাচাকে বলে দিয়েছিলাম, আমাকে ভুল বুঝবি না, তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে এখানেও আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
জাহিদদের একটা পাচ ব্যান্ডের ট্রানজিস্টর ছিলো। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার প্রায় সবাই এসে জমা হতো ওদের বাড়ি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুস্টহান শোনার জন্য, জাহিদ, মালেক, মতিন চাচা এরাও শুনত বিশেষ করে চরম পত্র আর দেশাত্মবোধক গানগুলি।

দেশ স্বাধীন হবার আশা নিরাশার স্বপ্ন আর নানান আলাপ আলোচনার মাঝে দিনগুলি বৈশাখী ঝড়ের মত উত্তাল গতিতে ছুটে চলেছিল। সুশীল বাবুর দেয়া ট্রেনিং শেষ এখন তা কাজে লাগাবার পালা। এখন তার আদেশে সঙ্গি সাথিদের সাথে নিয়ে গোলা বারুদ, সংবাদ, রসদ ইত্যাদি পৌঁছানোর কাজ চলছিল। সুশীল বাবু জাহিদকে দূরে কোথাও পাঠাতেন না। তাই কাজ শেষ হতেই মালেকদের বাড়ি। ওখানে না গেলে কি জানি কি একটা অপূর্ণ থেকে যায়, নানা ছল ছুতায় ও বাড়িতে যেতেই হয়। মলত এই এখন থেকেই মালেক আর যুঁইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। ও বাড়ি গেলেই যুঁইয়ের লাগামহীন ইয়ার্কি ফাজলামি সত্বেও যেতে হয়। বেশি দূরে না ওদের বাড়ি থেকে দেখা যায় মাত্র কয়েক পা পথ। পথই যেন কেমন করে টেনে নিয়ে যায়, সারা দিন যেখানে যাই হোক দিনের শেষে এক বার অন্তত যেতেই হয়। গায়ের সবুজ প্রান্তর, খোলা আকাশ, খোলা বাতাস জাহিদকে কানে কানে বলে যায় কি হোল জাহিদ আজ তুমি এখনো যাওনি? বেচাড়া জাহিদ আর কি করে তাই যায়। কাওকে কিছু বলতেও পারে না। এই যে মতিন চাচা এতো কাছের মানুষ কোথায় কি হচ্ছে কি করছে তার সব কিছু চাচার কাছে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই সেই মতিন চাচাকেও বলতে পারছে না। যা আছে তা শুধু তার একান্ত আপন মনেই আছে। কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না, কেমন একটা চাপা অস্থিরতা নিয়েই দিন গুলি চলে যাচ্ছে।

দিন কারো জন্যই থেমে থাকছে না। জাহিদের দিন গুলিও থেমে নেই চলে যাচ্ছে। সুশীল বাবুর নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে এলাকার অনেক কিছুই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনেক লোক জনের সাথে আলাপ পরিচয় হচ্ছে। এই ভাবেই এক দিন দেশ স্বাধীন হোল। রেডিওতে খবর শুনে সবাই একে একে জড়ো হোল সুশীল বাবুর বাড়িতে, বিজয় পতাকা ওড়াতে হবে। আনন্দ হবে উত্সব হবে, স্বাধীনতার উত্সব। বাসি উত্সব নয়, স্বাধীনতা বার্ষিকী নয় একেবারে জীবন্ত, সদ্য স্বাধীনতার উত্সব। এর কি কোন তুলনা আছে না কারো সাথে এর তুলনা করা চলে? কয়জনের ভাগ্যে এই উত্সব জোটে?এই দেশে আরও কত কোটি কোটি মানুষের জন্ম হবে কত কি হবে কিন্তু আজকের এই দিনের স্বাদ কজনে দেখবে?সুশীল বাবু জাহিদের হাতে এক টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন যাও ঝিটকা থেকে বাংলাদেশের পতাকা কিনে আন। কোন রকম টাকাটা হাতে নিয়েই দৌড়। দেড় মাইল পথ প্রায় দৌড়েই এলো, একটা মুহুর্ত নষ্ট করার উপায় নেই, উল্লাস কমে যাবে, আনন্দের গতি ধীর হয়ে যাবে, সুখের স্রোতে ভাটা পরে যাবে। পতাকা কিনেই তা বগল দাবা করে আবার দৌড়, বাজার থেকে বেড় হয়ে এসে পথে গ্রামের মেঠো পথের পাশে সবুজ গম খেতের গমের শীষে বেধে কখন যে পতাকাটা আটকে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। বাড়ির কাছে এসে যখন দেখে বগলের পতাকা নেই, কি হোল?আবার উলটো দৌড়।

বেশ খানিকটা পথ এসে দেখে গমের শীষের সাথে পতাকা ঝুলছে। নিয়ে আবার দৌড়। বাড়িতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন, সমস্ত এলাকার মানুষ চলে এসেছে। সবুজের মাঝে রক্ত লাল আর তার মাঝে দেশের মানচিত্র আকা পতাকা বাশের তৈরি মাস্তুলের মাথায় বেধে ওড়ানো হোল, হারমোনিয়াম তবলা রেডি ছিলো, পাশে দাঁড়িয়ে সবাই স্বাধীন ভাবে, মনের উচ্ছাসে চিতকার করে এক সুরে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইল। আহ! সে যে কি শান্তি, কি উল্লাস তা কি আর ভাষায় বলা যায়?সে শুধু অনুভুতি দিয়ে অনুভবের। জাতীয় সঙ্গীতের পর আরো দেশাত্মবোধক গান হোল, কে যেন কলতা বাজার থেকে মিষ্টি এনেছিল। গানের পরে মিষ্টি বিলানো হোল। হৈ চৈ শেষ করে গভীর রাতে মালেক এবং মতিন চাচার সাথে বাড়ির দিকে রওয়ানা হোল। পথে আসতে আসতে ভাবছিল এমন দিনে এক নজর না দেখলে কি আর সুখ পুর্ন হয়?যে করেই হোক একবার যেতেই হবে। কি ছুতা ধরে এই এতো রাতে যাওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল।

বেশি ভাবতে হোল না বাড়ির কাছে আসতে শুনতে পেল ওই মালেকদের বাড়ি থেকেই গানের সুর ভেষে আসছে। স্বাধীনতার উত্সব এখানেও হচ্ছে। জোসনা রাতে দুয়ারে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে বসে সব বোনেরা মিলে গাইছে। সবার মাঝে বসা ওর কণ্ঠটাই বেশি করে কানে বাজছে। যে গান শুনে বাঙ্গালির রক্তে উত্তাল স্রোত বেয়ে উঠেছিল, যে গান শুনে বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেই সব গান। বোনেরা হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিল। জাহিদ রাও এসে যোগ দিলো। পাটির এক পাশে বসে। মালেক তাড়া দিলো ‘এই এই ভাবে শুধুই হট্টগোল করে গান গেয়ে কি উত্সব হয়, যা চা নিয়ে আয়। শুনেই পারুল মাঝখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। কিছুক্ষন পরেই কয়েকটা কাপ, জগ ভরে চা আর তার সাথে এক গামলা গুর মুড়ি নিয়ে এলো এক এক করে। গুড় মুড়ি শেষ হলে আবার মেঘ বিহীন আকাশে বৃষ্টির মত সুরের ঝঙ্কার।

এই গান ইতো গত নয় মাস ধরে শুনছে কিন্তু আজ যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, আজ এই গানের সুরে আলাদা একটা আমেজ, আলাদা এক অনুভুতি। সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল তখন সারা জীবনের জন্য একটা সোনালী স্মৃতি সৃষ্টি করে থেমে গেল শুধু গানের রেশটা রয়ে গেল। জাহিদ উঠে মতিন চাচা সহ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিছন থেকে পারুল একটু জোড়েই বললো খেজুর গাছ কাটার সময় আজ হান্নান ভাইকে দিয়ে হাড়িতে এলাচ দিয়ে রেখেছি কাল সকালে এসে রস খেয়ে যাবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বলা তা জাহিদ ভাল করেই বুঝল আর বুঝল যুঁই। পিছন থেকে ডেকে যুই বললো শুনেছিস, তোর বৌ কি বললো?জাহিদের কানে আজকের এই রাতে যুঁই কথাটা সুমধুর হয়ে বাজলো। পারুলের চেহারা কেমন হয়েছিলো তা আর মৃদু চাদের আলোতে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। তবে জাহিদের অন্ধদৃষ্টি তা ঠিক অনুমান করে নিয়েছিল। পরদিন আর রাত পোহায় না, হে যামিনী তুমি কেন আজ বিদায় নিচ্ছ না? তুমি না গেলে যে হান্নান ভাই গাছে উঠবে না আর এলাচ দেয়া খেজুর রস খাবার ছলে আমার পারুর সাথে দেখা হবে না।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to নির্বাক বসন্ত-৫

You must be logged in to post a comment Login