মামুন ম. আজিজ

পতন

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

মেঘগুলোও টেকি দুনিয়ার দূর্ণিবার বহমান গতি হতে শিক্ষা নিয়েছে। ঘর থেকে বের হবার কালে ছিল ঐ দূরে, সূর্য তখনও স্মিত রোদেলা হাসি হাসছিল। মুহূর্তে হয়ে গেলো ঘন কালো, দিগন্ত দৃষ্টির সীমানার রঙ বদলে গেলো। মেঘগুলো ছেয়ে গেলো মাথার উপর। তারপর মেঘ নিংড়ে নেমে এল ঝুমঝুম বৃষ্টি। ইংরেজী প্রবাদে যাকে কুকুর বিড়াল বৃষ্টি বলা হয় -সেরকম। কোনমতে রিকশার হুট টেনে মাথা, হাত, পা আর আয়রন করা শার্ট, প্যান্ট দুটোকে ভিজতে না দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। তবুও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় ফাঁক ফোকড় গলে জিতেই যাচ্ছে বৃষ্টিরধারা। হঠাৎ পকেট ফুঁড়ে মোবাইলের আলো জ্বলে উঠে বৃষ্টিমোহাচ্ছন্নতাটুকু থেকে মুক্ত করে আমার মন। অর্পিতার জন্য নির্ধারিত রিং টন শুনে এক হাতে বৃষ্টি এড়ানোর পলিথিন ধরে অন্যহাতে বেশ কসরতে মোবাইল নিয়ে ছুঁয়ে দেই কানে। আমার বর্তমান প্রেমিকার নাম অর্পিতা। মোবাইলে জানতে চাচ্ছে আমি যাচ্ছি কোথায়। বলি, মেইন রোডের দিকে, ভার্সিটির বাসটা ধরব। তুমি কোথায় ? উত্তর আসে, এই তো কলেজের বারান্দায়। সাথে সাথে কলেজের দিকে তাকাই । ’শ খানেক গজ বামে ঐ  দূরেই তো কলেজটা। চারতলা দালানে সবগুলো করিডোরে কত শত সাদা পরী। চোখ ফিরিয়ে নেই, পাছে  না আবার অর্পিতা চিনে ফেলে আর তার বিরাগভাজন হয়ে পড়ি। তাছাড়া যেভাবে রিকশা হেলছে দুলছে তাতে দৃষ্টি টাও হেলে দুলে গেলে পড়েই যাব। এ তো রাস্তা নয় ক’দিনের বৃষ্টিতেই রূপান্তর ধারা মেনে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে পুরো এক খাল। কোথাও কোথাও গভীর খাদ হয়ে গেছে । দু’ধার জুড়ে ক্রমাগত থিকথিকে কাদার পুরু স্তর। হালুয়ার মত নরম নরম শক্ত। অথচ সে হালুয়ারূপ কাদায় পা পড়লেই বোঝা যাবে কত বিরক্তিতে কত যাতনা। সামনে দৃষ্টি মেলে বলে উঠি, এই তো তোমাদের কলেজ পেরোলাম। ও বলে , ভিজো না কিন্তু। আমি হাসি। অর্পিতাও হাসে। বৃষ্টির কুকুড় বিড়াল ভাবটা কমে যেতে শুরু করেছে। মুখে আর বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে না। অর্পিতা বলে, জানু বৃষ্টির দিকে বাড়াও একটা হাত। পলিথিন কোমড়ে গুজে হাত বাড়াই। ও বলতে থাকে, হে প্রিয় ঐ হাতে যত ফোঁটা বৃষ্টির কণা পড়ছে তত ভাল তুমি বাস আমায় জানি।  আমি বলি, তাই ? ও আরও বলে, আর যত ফোঁটা পড়ছে না হাতে তত ভাল কিন্তু বাসি আমি।  
…আর ব্যালেন্স রাখা গেলো না। রিকশার চাকাটা ঘোলাটে পানির অস্বচ্ছ গভীরে কোন এক লুকানো খাদে হোচট খেতেই  উল্টে গেলো বাম দিকে। পড়ে গেলাম। আমাকে গ্রাস করল কাদা পানির রাজ্যে। কাদার কাছে সর্ব ক্ষমতা বির্সজন দিয়ে আমি তখন হয়ে গেলাম যেন এক কাদা মানব। মাথা দিয়ে গড়িয় পড়ছে কাদার দলা। পুরো গায়ে কাদার লেপন। কাদা শিল্পের গিনিপিক আমি। বৃষ্টির গতিও থেমেছে অনেক। না হলে মুখটা কাদাময় হয়ে থাকা থেকে পরিত্রান পেতো কিছুটা। আমি গড়িয়েছি , কাদা জড়িয়েছে অথচ মোবাইলটা এখনও হাতে ধরা আমার। কানে দিলাম। সুইচড অফ হয়ে গেছে। অনই হলো না। রিকশাওয়ালা রিকশা টেনে রাস্তার সাইডে আনছে। আমিও সাইড হলাম। তখনই চোখ গেলো পাশের মিনি মার্কেটের করিডোরে। একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে। হাতের মোবাইলটা সে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। ফটোকপির দোকানের কাচের দেয়ালে আবছা প্রতিচ্ছবি রূপে নিজের অবয়ব দেখে নিজেই চিনলাম না। মেয়েটাকে চিনতে খুব একটা কষ্ট হলো না। অর্পিতাইতো। কিন্তু আমাকে চিনবে না তা যেন বুঝলাম। কি লজ্জা। রিকশা হতে পড়ে গেছি। কিন্তু দোষ তো আমার নয়। দোষীরা কি লজ্জা পায়? লজ্জা তো ভুক্তভোগীরই এ কালে কেবল। কিন্তু দোষ কার? গালিটা কাকে দেবো? রিকশা ওয়ালা, সিটি কর্পোরেশন, সওজ, ওয়াসা, পৌরসভা, স্থানীয় কমিশনার, এমপি, এলাকাবাসী, অসচেতন জনগণ  নাকি নিয়তিকে? কনফিউজড। বৃষ্টিকে গালি দেয়া যায়। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ এবং সহজ।
অর্পিতা এদিকেই আসছে। মোবাইলটা কি নষ্ট হয়েই গেলো?  অথবা লজ্জায় মোবাইলটা মরেই গেছে হয়তো। দর্শক কতজন হেসে উঠেছিল পতনের পর পরই। কতগুলো সুন্দরী তরুনীর চোখে মুখে জেগেছিল এক যুবকের পতনের সুখ। লজ্জা তো আসবেই। না অর্পিতাকে এ কাদামুখ এখন দেখানো যাবেই না। সরে যাই। হাঁটা শুরু করি বাসার দিকে। অবাক হই- অর্পিতাও যাচ্ছে সেদিকে। কিন্তু ও যে বলল ও এখন কলেজে… তারপর আরও অবাক করে দিয়ে পাশের মার্কেটের পাশের গলিতে ছাতাটা বন্ধকরে সে  দাঁড়ালো। বৃষ্টি আবার সদয় হয়ে গতিটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ঝিরঝিরি ধারায় ভিজছি।
একটা সিএনজি এসে দাঁড়ালো। সেখানে বসে থাকা ছেলেটাকে তো চেনা চেনা লাগছে। সেই ছেলেটাই। পাশের মহল্লার। অর্পিতাই বলেছে  ছেলেটা ওকে আগে অনেক ডিষ্টার্ব করত। কিন্তু সে কথা মিথ্যে প্রমান করেতই যেন অর্পিতা সিএনজিতে উঠে গেলো। হাসি হাসি মুখ। সিএনজির ভেতেরে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ভালোবাসা ঢুকে পড়ছে। দুজনে তাই যেন ঘেঁষে বসল। আমি শার্টে লেগে থাকা কাদা দুহাতে মেখে মুখটাতে আরেকটু বেশী করে মেখে নিলাম।  লুকায়িত প্রেমিক যুগল এ কাদামুখ আমার মোটেও চিনবেনা।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to পতন

You must be logged in to post a comment Login