আহমেদ মাহির

বিবর্ণ পাতা থেকে :: ৫

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

অমিয়া,

বহুকাল পর তোর কাছে লিখতে বসা । লেখার ফুরসত অনেক ; ইচ্ছেও কিছু কম নেই – আলস্যই ফুরসতটুকুকে কেড়ে নেয় । বেশ কাটছে পাহারের ওপরের দিন-রাত্রি । আরামকেদারা আর বিছানা করে করে বেশ পার হয়ে যাচ্ছে । কখনো সখনো আলস্য কাটাতে বইয়ের দ্বারস্ত হতে হয় , তবে তা এমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখে না । বইয়ের সর্বোচ্চ ভূমিকা হাঁটুর ওপর শরীরের বোঝার পরেও কিছু বাড়তি বোঝার মতন ।

হুম , আপন দেহটাও একটা বোঝা-বিশেষ এখন । শ্বাসের ব্যামো , দুর্বল হৃদযন্ত্র , বাত জ্বর , … মোটামুটি একটা ব্যামোর কারখানা খুলে বসেছি । স্বপন কুমার দাস নামে এক ডাক্তার ছোকরা প্রতি বিকেলে এসে এসবের কি সব হিসেব কষে যায় । ব্যামোর হিসেব কষা – দেখতে মন্দ লাগে না ; হাস্যকর । তবে ছেলেটাকে মন্দ লাগে না । খুব ডাক্তার-সুলভ গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করে । তবে সুযোগ পেলে গ্রামে ফেলে রাখা পরিবারের গল্পে প্রগলভ হতেও বিশেষ বিলম্ব করে না । এই ছেলেটাকে বিশেষ ভালো লাগার কারন – ওকে দেখলেই আমার কেন যেন মনে হয় , বাঙ্গালীরা এখনও সাদামাটাই রয়ে গেছে ।

গ্রামের সুরেন কাকার কথা মনে আছে তোর ? ডাক্তার সুরেন কাকা ? আমার অসুখ হলে উনাকে ডাকার আগেই উনি চলে আসতেন । হয়তো বাবার কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছেন বা কোনো পড়শির কাছে । যাবার সময় ঔষধের সাথে হোমিওপ্যাথির চিনির বড়িও দিয়ে যেতেন । উনাকে ভালোলাগার এটাই মুখ্য কারন ছিল সে সময় । এই বেচারা আজীবন মানুষের সেবা করে বেড়ালেন আর মারা গেলেন একা একা – বিনা চিকিৎসায় ! বড় অদ্ভুত না আমাদের জীবনটা ?

আসলেই বড় অদ্ভুত আমাদের জীবন । আমাকেই দেখ – আজীবন ছুটলাম নিজের অতীতটাকে মুছে ফেলতে । আর এখন অতীতের স্মৃতিতে জবর কেটে দিনকে সন্ধ্যে অবধি নিয়ে যাই , রাতকে ভোর অবধি ।

স্বপ্নিতার সাথে আমি একদিন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম রিকসা করে । তখন আমরা দু’জন দু’ শহরে থাকি । রিকসা ঘন্টা হিসেবে ঠিক করেছিলাম । আমরা ঘুরতে ঘুরতে গুচ্ছগ্রাম ছাড়িয়ে কতদুর চলে গিয়েছিলাম ! কত খুনসুটি – কত সাংকেতিক কথপোকথন আমাদের ! ফিরবার পথে ঠুনকো ধাতুর একটা আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর অনামিকায় । আংটিটির হয়তো অস্তিত্তও নেই আজ ; আমাদের বন্ধন এখনো আমায় মৃত্যু হতে আগলে রাখে । জানিস ? এখনও যখন বুকে ব্যাথা হয় বা শ্বাসের গতানুগতিক গতিতে কিছু গড়বড় হয় , তখন বেশ ভয় করে স্বপ্নিতার জন্যে । আমি না থাকলে যে ওর বড় কষ্ট হবে ! জানি সবই অর্থহীন ; তবু আমার কাছে এসব ভীষন অর্থ বহন করে । ওসব খুনসুটিই যে আমায় বাঁচিয়ে রাখে !

প্রসূণটা হঠাৎ করেই চলে গেল । জানি না এ বয়সে কি করে মানিয়ে নিচ্ছিস ওকে ছাড়া । কোন মেয়ের বাসায় আছিস এখন , তাও জানি না । চিঠিটার তিনটা প্রতিলিপি করবো ভাবছি । একটা তোর ঠিকানার জন্যে , অপর দু’টো তোর দু’মেয়ের ঠিকানার জন্যে । কিংবা কে জানে হয়তো এ চিঠিটাও পাঠানো হবে না ।

আরামকেদারার হাতলে কাগজ রেখে লিখছি । ডান হাতটা অসার লাগছে । আজ আর লিখতে পারছি না । প্রার্থনা করি , যতটা সম্ভব ভালো থাকিস ।

ইতি
তোর ভাঙ্গাচোরা
মাহির ।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


11 Responses to বিবর্ণ পাতা থেকে :: ৫

You must be logged in to post a comment Login