শৈলী টাইপরাইটার

সংখ্যাটি ছিল কত, ওরা যেন মানুষ না

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পি.আর.প্ল্যাসিড

——————-

এক সময় যখন বেশ আড্ডায় মেতে থাকতাম দেশে কিংবা প্রবাসে, তখন শোনতাম অনেকে অনেক

ধরণের বিষয় নিয়ে কথা বলতেন সেই আড্ডায়। আমি কখনো ভালো বক্তা ছিলাম না। শ্রোতা

হিসেবে নিজেকে নিজে সেরা না বললেও একজন নীরব শ্রোতা হিসেবে ভালো বলতে পারি

নিজেকে নিজে। স্কুল জীবনে আমার বাবাকে একটি কথা সবসময় বলতে শুনেছি, ” এলেমে

হেলেম বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে মেলে”। আড্ডায় অংশ নিলে বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন ধরনের ছেলেদের

নানান কথা শুনলে বুদ্ধি অনেক বাড়ে, এই কথাটিই বোঝাতে চাইতেন বাবা। তাই তখন

সুযোগ পেলেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় গেলেও বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধরনের কথা

শুনেছি মন দিয়ে। যা এখন বিভিন্ন লেখায় ব্যবহার করতে পারছি।

একবার আমাদের বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলন এবং আমার প্রিয় এক

ব্যক্তি, মনিরুল হক (বই প্রকাশক) জাপানের রাস্তায় গাড়িতে বসে নানা বিষয় নিয়ে কথা

বলছিলেন। আমি বলতে গেলে কোন কথাই বলছিলাম না সেদিন। তখন আমাদেরই একজন আমাকে

নীরব থাকতে দেখে বলেই ফেললেন, আমরা এত কথা বলছি, অথচ প্ল্যাসিড ভাই কোন কথাই বলছেন

না, কারণ কি? তখন মিলন ভাই বলেছিলেন, ”যারা জানে বেশি তারা বলে কম”। আমি তখন এই

উত্তরটিই দিয়েছিলাম, ”আমি বেশি জানি না, সবার কথা মনযোগ সহকারে শুনে আরো বেশি

জানার জন্য চুপ করে থাকি। সব সময় চেষ্টা করি আড্ডা বা যে কোন আসরে গিয়ে শ্রোতা

হিসেবে থাকার জন্য। সবাই যদি বক্তা হন, তাহলে শুনবেন কে?”

লেখার শুরুতে ভূমিকা দিলাম এজন্য যে, কোন এক আসরে শোনা একটি জোকস মনে পড়ল তা

লেখার শুরুতে ব্যবহার করার জন্য। (কল্পিত) আরিচাঘাটে এক বাস দুর্ঘটনায় অনেক লোক মারা

গেছে। সাংবাদিক এসে সেখানে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন লেখার কাজে ব্যস্ত। আশে

পাশের লোকদের কাছে সাংবাদিক জানতে চাইলেন, ভাই, এই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো

আপনারা, আচ্ছা বলেন তো এখানে মোট কতজন প্রাণ হারিয়েছেন?

এলাকাবাসীদের (প্রত্যক্ষদর্শী) একজন জানালেন, দুই জন পুলিশ আর নয়জন যাত্রী মারা গেছেন।

পুলিশও কিন্তু সেই বাসেই ছিলেন। তারপরেও তাদের যাত্রী বা মানুষ না বলে ভিন্ন পরিচয়ে তাদের

গণনার মধ্যে পরিচয় করিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ কিছুদিন ধরে লেখার কথা

ভাবছিলাম সিলেটে অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যার পর থেকে। এর আগে অবশ্য সময়ের অভাবে লেখা

হয়নি যেমন সত্যি, তার চেয়ে বেশি সত্যি লেখার বিষয়টি নিয়ে লেখার আগে আরো বেশি

খোঁজ খবর নেবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তুআমাদের সময় ডট কম-এ একটি ছোট সংবাদ পড়ার পর

আর না লিখে পারলাম না। কারণ লেখালেখি যেহেতু করি সুতরাং একটি সারিতে আমাকে

দাঁড়াতে যে হবেই, মনে করে।

আমাদের সময় ডট কম-এ দেখলাম বাংলাদেশে তিনজন প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনা মানুষের মৃতু্যু (হত্যা)-

কে কেন্দ্র করে বিশ্বখ্যাত ১৫০ জন লেখকের স্বাক্ষর সংবলিত প্রতিবাদের সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

বিশ্বখ্যাত বা নন্দিত লেখকগণ বাংলাদেশের মুক্তমনাদের হত্যা করায় উদ্যেগ প্রকাশ করে খোলা

চিঠি দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে। মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যার হাত থেকে

বাঁচানোর জন্য নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে দেশকে মেধা শূন্য না করারও আবেদন জানিয়েছেন

তারা। বিষয়টি আমার দৃষ্টি কেড়েছে, তাই না লিখে পারলাম না। সংবাদটি পড়ার পর দেশের

খ্যাতিমান লেখক ড. জাফর ইকবালের একটি লেখার কথাও মনে পড়ল।

সম্প্রতি সিলেটে খুন হওয়া বিজ্ঞান মনষ্ক লেখক অনন্ত বিজয় দাসকে নিয়ে লেখাটি লিখেছেন

তিনি। লেখাটিতে জাফর ইকবাল স্যার ব্লগারের সুন্দর অর্থবহ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

একসময় আমিও নিয়মিত ডায়েরী লিখেছি, স্যারের ভাষায় যাকে ব্লগ বলা যায়। তার লেখায়

তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রকৃত অর্থে দেশে-বিদেশে সব মিলিয়ে লক্ষ কোটি ব্লগার রয়েছে।

স্যারের ভাষায় তাদের দলে তাহলে আমিও পড়ি।

আমাদের দেশে ব্লগ লিখেন এমন তো অনেক লোকই আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ধর্ম

নিয়ে কোন কিছু যুক্তি দিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেন কিংবা অন্যের লেখার মতভেদ প্রকাশ

করার চেষ্টা করেন যুক্তি তর্ক দিয়ে। তাদের সুচিন্তিত লেখার মধ্য দিয়ে। এতে অন্যায়ের কিছু

দেখি না, যদি সেই লেখা কারো মনে কষ্টের কারণ না হয়। আসলে মানুষের মন যে খুবই নরম,

তুলতুলে। কখন কে যে, কি কারণে, কিভাবে কষ্ট পায়, আর কিসে খুশী হয়, সেটা আসলে কেউই

আগাম বুঝতে বা বলতে পারে না। আর এই না বোঝার কারণেই ঘটে যত সমস্যা।

আমি পৃথিবী বাসী একজন মানুষকেও হত্যা করার পক্ষে না। অন্যায়ভাবে যদি কেউ কোন মানুষ

হত্যা করে, তাহলে সংঘবদ্ধভাবে সেই হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে দোষী ব্যক্তিকে ধরে তার বিচার করার

পক্ষে আমি। মানুষ হিসাবে সত্যি বলতে সেটাই সবার বেলাতে হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত

অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেই প্রয়োজনে কি অপ্রয়োজনে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তাদের জন্য আমরা বিশ্বের কোন সচেতন লেখক বা সাংবাদিকের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন ধরনের

বিবৃতি দিতে দেখিনি। হঠাৎ করে কেন সালমান রুশদীর মতন ব্যক্তিরা ১৫০ জন এক হয়ে মাত্র

তিনজন ব্যক্তির জন্য বিবৃতি দিলেন আমাদের সরকারকে উদ্দেশ্য করে, তাদের দেশের দ্য গার্ডিয়ান

পত্রিকাতে, তা আমার বোধগম্য হয়নি।

বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী হলেও এটি একটি উল্লেখ যোগ্য

অসাম্প্রদায়িক দেশ বটে। এখানে বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সহাবস্থান অবশ্যই উদাহরণ দেবার মত

এবং প্রশংসনীয়। দেশে মাঝে মধ্যে অবর্ণর্নীয় যে সব ঘটনা ঘটছে, এসব যেন না ঘটে সেই

কামনা করছি। তবে আমার বিশ্বাস দেশের সরকার যথেষ্ট সচেতন এই ব্যাপারে এবং কার্যকর

ভূমিকাও রাখছেন বিভিন্ন সময় সন্ত্রাস দমনের মাধ্যমে। দেশের জনসাধারণ সরকারের সব ভালো

কাজেই সহযোগিতার হাত প্রসার করাতে এখনো বড় কোন দুর্ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে ঘটেনি ।

আমাদের যে কোন মূল্যে এই সুন্দর অবস্থা টিকিয়ে রাখা উচিৎ। এই জন্য বিদেশিদের কোন

প্রকার নাক গলানো ঠিক হবে না বলে মনে করি।

বিদেশি এই লেখকদের মনে হয় কেউ এমন বিবৃতি দেবার জন্য উৎসাহিত করেছেন, তারা যেন

সংঘবদ্ধ হয়ে (কথিত) ব্লগারদের বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি লিখে

পত্রিকার মাধ্যমে আবেদন জানান। এই কাজটি করার ফলে যা হতে পারে তা হচ্ছে, যা ছিল আমাদের

(দেশে) ঘরের ভিতর তা এখন (বিদেশে) বাহিরেও ছড়াবে। জানাজানি হবে। সুতরাং আমাদের

সমস্যা আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে। অন্য কেউ বলার আগেই সচেতন হওয়া মঙ্গলজনক।

(লেখাটি লিখে শেষ করা পর্যন্ত বিদেশী খ্যাতিমান লেককদের সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষলকারীর সংখ্যা

দাঁড়িয়েছে ১৫০ থেকে ১৯৭ জনে।)

বিষয়টি খুব ভালো লেগেছে এই জন্য যে, তারা আমাদের দেশ মেধাশূন্য হয়ে যেতে পারে বলে যে

আশঙ্কা করেছেন এবং এটাকে প্রতিহত করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে

বাংলাদেশে মানুষ মরছে প্রতিদিন, মারছেও মানুষ প্রতিদিন। এ ব্যাপারে আগে দেশের ভিতর

জনমত সৃষ্টি করা দরকার এসব বন্ধ করতে। যদি করতেই হয়। দেখবেন মানুষ মারা বন্ধ হলে একসময়

ব্লগারদেরও প্রাণ বাঁচবে। তখন দেশ হবে মেধাশূন্য হবার আশংকা মুক্ত। যেখানে আমরা মানুষ

মারা বন্ধ করতে পারি না সেখানে অন্য বিষয় চিন্তা করি কিভাবে?

আমরা অনেকেই লেখালেখি করি। তার মানে আমরা সবাই ব্লগার (জাফর ইকবাল স্যারের ব্যাখ্যা

অনুযায়ী।)। কিন্তু সবাই যে একটি নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে লিখে তা কিন্তু না। তাহলে কতিপয়

লোকের উপরই কেবল কেন মৃত্যুর হুমকি আসে। কেনই বা বহির্বিশ্বের লোকেরা এ নিয়ে চিন্তিত

হবেন? আমাদের দেশের পুলিশ বিভাগ যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা শুধু বিএনপি আর নারীর শরীরেই বুটের

লাথি মারতে পারে না। তাদের সুনাম আছে অনেক বড় বড় ডাকাতির ক্লু আর খুনের ক্লু বের

করতে পারার জন্য। বাংলাদেশ পুলিশের প্রশংসা যে আছে তা অনেক আগেই শুনেছি। তাহলে কেন

আমাদের দেশের এই কয়েকটি খুনের ক্লু বের করতে পারে না বর্তমান আইন শৃংখলা বাহিনী।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া খুনের আসামীদের ধরার ইচ্ছা করলে অবশ্যই ধরে বিচারের অধীনে এনে

পুলিশ বিভাগ পারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে। যথাযত শাস্তি প্রদান করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারলে

পরবর্তীতে জঘণ্য এই ঘুনের মতন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটার সম্ভাবনা থাকে বেশি। তবে

হ্যাঁ, এই কথাও সত্যি যে, দেশে এখন বিচার বহির্ভূত অনেক হত্যাই হচ্ছে। কে করছে আর কাদের

করছে এটা আলোচ্য বিষয় হওয়া ঠিক নয়। তার আগে এসব হত্যাকান্ড বন্ধ করার প্রক্রিয়া খুঁজে

বের করে এর সমাধান অচিরেই করতে হবে।

ব্লগার আর যুক্তিবাদী কিংবা মুক্তচিন্তার লোক আমরা যাই বলি, এর সংখ্যা তিনজন বা চারজন

যাই হোক, সেটাকে আমরা কোন সংখ্যায় না ফেলে যে কোন মানুষকে হত্যার প্রতিবাদের ভাষা

আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তবেই আমাদের দেশ মেধাশূন্য হবার কথা ভিন দেশি কাউকে আর

না ভাবলেও চলবে।

============================

লেখক পি.আর.প্ল্যাসিড ঃ জাপান প্রবাসী লেখক সাংবাদিক।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login