সুকুমার রায়ের “নতুন পণ্ডিত”
আগে যিনি আমাদের পণ্ডিত ছিলেন, তিনি লোক বড় ভালো। মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক-ধামক ন করিতেন, তাহা নয়, কিন্তু কখনও কাহাকেও অন্যায় শাস্তি দেন নাই। এমন কি ক্লাশে আমরা কত সময় গোল করিতাম, তিনি মাঝে মাঝে ‘আঃ’ বলিয়া ধমক দিতেন। তাঁর হাতে একটা ছড়ি থাকিত, খুব বেশি রাগ করিলেই সেই ছড়িটাকে টেবিলের উপর আছড়াইতেন— সেটিকে কোনোদিন কাহারো পিঠে পড়িতে দেখি নাই । তাই আমরা কেউ তাঁহাকে মানিতাম না।
আমাদের হেডমাস্টার মশাইটি দেখিতে তাঁর চাইতেও নিরীহ ভালোমানুষ। ছোট্ট বেঁটে মানুষটি, গোঁফ দাড়ি কামানো, গোলগাল মুখ, তাহাতে সর্বদাই যেন হাসি লাগিয়াই আছে। কিন্তু চেহারায় কি হয়? তিনি যদি ‘শ্যামাচরণ কার নাম?’ বলিয়া ক্লাশে আসিয়াই আমায় ডাক দিতেন, তবে তাঁর গলার আওয়াজেই আমার হাত পা যেন পেটের মধ্যে ঢুকিয়া যাইত। তাঁর হাতে কোনো দিন বেত দেখি নাই, কারণ বেতের কোনো দরকার হইত না— তাঁর হুঙ্কারটি যাহার উপর পড়িত সেই চক্ষে অন্ধকার দেখিত।
অকদিন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “সোমবার থেকে আমি আর পড়াতে আসব না- কিছু দিনের ছুটি নিয়েছি। আমার জায়গায় আর একজন আসবেন। দেখিস তাঁর ক্লাশে তোরা যেন গোল করিস্নে।” শুনিয়া আমাদের ভারি উৎসাহ লাগিল; তারপর যে কয়দিন পণ্ডিতমহাশয় স্কুলে ছিলেন, আমরা ক্লাশে এক মিনিটও পড়ি নাই। একদিন বেহারীলাল পড়ার সময় পড়িয়াছিল, সেজন্য আমরা পরে চাঁদা করিয়া তাহার কান মলিয়া দিয়াছিলাম। যাহা হউক, পণ্ডিতমহাশয় সোমবার আর আসিলেন না— তাঁর বদলে যিনি আসিলেন তাঁর গোল কালো চশমা, মুখভরা গোঁফের জঙ্গল আর বাঘের মত আওয়াজ শুনিয়া আমাদের উৎসাহ দমিয়া গেল। তিনি ক্লাশে আসিয়াই বলিলেন, “পড়ার সময় কথা বলবে না, হাসবে না, যা বলব তাই করবে। রোজকার পড়া রোজ করবে। আর যদি তা না কর, তা হলে তুলে আছড় দেব।” শুনিয়া আমাদের তো চক্ষু স্থির !
ফকির চাঁদের তখন অসুখ ছিল, সে বেচারা কদিন পরে ক্লাশে আসিতেই নূতন পণ্ডিতমহাশয় তাহাকে পড়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন। ফকির থতমত খাইয়া ভয়ে আম্তা আম্তা করিয়া বলিল— “আজ্ঞে— আমি ইস্কুলে আসিনি—” পণ্ডিতমহাশয় রাগিয়া বলিলেন, “ইস্কুলে আসনি তো কোথায় এসেছ? তোমার মামার বাড়ি?” বেচারা কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, “সাতদিন ইস্কুলে আসিনি, কি করে পড়া বলব?” পণ্ডিতমহাশয় “চোপরাও বেয়াদব— মুখের উপর মুখ” বলিয়া এমন গর্জন করিয়া উঠিলেন যে ভয়ে ক্লাশ সুদ্ধ ছেলের মুখের তালু শুকাইয়া গেল।
আমাদের হরিপ্রসন্ন অতি ভালো ছেলে। সে একদিন ইস্কুলের অফিসে গিয়া খবর পাইল— সে নাকি এবার প্রাইজ পাইবে। খবরটা শুনিয়া সে বেচারা ভারি খুশি হইয়া ক্লাশে আসিতেছিল, এমন সময় নূতন পণ্ডিতমহাশয় “হাসছ কেন?” বলিয়া হঠাৎ এমন ধমক দিয়া উঠিলেন যে মুখের হাসি এক মুহূর্তে আকাশে উড়িয়া গেল। তাহার পরদিন আমাদের ক্লাশের বাহিরে রাস্তার ধারে কে যেন হো হো করিয়া হাসিতেছিল, শুনিয়া পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিলেন। আসিয়া আর কথাবার্তা নাই— “কেবল হাসি?” বলিয়া হরিপ্রসন্নর গালে ঠাস্ ঠাস্ করিয়া কয়েক চড় লাগাইয়া, আবার হন্ হন্ করিয়া চলিয়া গেলেন। সেই অবধি হরিপ্রসন্নর উপর তিনি বিনা কারণে যখন তখন খাপ্পা হইয়া উঠিতেন। দেখিতে দেখিতে ইস্কুল সুদ্ধ ছেলে নুতন পণ্ডিতের উপর হাড়ে হাড়ে চটিয়া গেল।
একদিন আমাদের অঙ্কের মাস্টার আসেন নাই, হেডমাস্টার রামবাবু বলিয়া গেলেন- তোমরা ক্লাশে বসিয়া পুরতন পড়া পড়িতে থাক। আমরা পড়িতে লাগিলাম, কিন্তু খানিক বাদেই পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে “পড়ছ না কেন?” বলিয়া টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুঁষি মারিলেন। আমরা বলিলম, “আজ্ঞে হ্যাঁ, পড়ছি তো। ” তিনি আবার বলিলেন, “তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন, চেঁচিয়ে পড়।” যেই বল অমনি বোকা ফকিরচাঁদ
‘অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড—’
বলিয়া এমন চেঁচাইয়া উঠিল যে, পণ্ডিতমহাশয়ের চোখ হইতে চশমাটা পড়িয়া গেল। মাস্টার মহাশয় গম্ভীরভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকিলেন, তারপর কেন জানি না হরিপ্রসন্নর কান ধরিয়া তাহাকে সমস্ত স্কুল ঘুরাইয়া আনিলেন, তাহাকে তিনদিন ক্লাশে দাঁড়াইয়া থাকিতে হুকুম দিলেন, একটানা জরিমানা করিলেন, তাহার কালো কোটের পিঠে খড়ি দিয়া ‘বাঁদর’ লিখিয়া দিলেন, আর ইস্কুল হইতে তাড়াইয়া দিবেন বলিয়া শাসাইয়া রাখিলেন।
পরদিন রামবাবু হরিপ্রসন্নকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন এবং তার কাছে সমস্ত কথা শুনিয়া আমাদের ক্লাশে খোজ করিতে আসিলেন। তখন ফকিরচাঁদ বলিল, ‘আজ্ঞে হরে চেঁচায়নি, আমি চেঁচিয়েছি।” রামবাবু বলিলেন, ‘পণ্ডিতমশাইকে পাতকী বলিয়া কি গালাগালি করিয়াছিলে?’ ফকির বলিল, ‘পণ্ডিতমশাইকে কিছুই বলিনি, আমি পড়ছিলাম—
‘অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড—’
এই সময় নূতন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি বোধহয় শেষ কথাটুকু শুনিতে পাইয়াছিলেন এবং ভাবিয়াছিলেন তাঁহাকে লইয়া কিছু একটা ঠাট্টা করা হইয়াছে। তিনি রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া হাঁ হাঁ করিয়া ক্লাশের মধ্যে আসিয়া রামবাবুর কালো কোট দেখিয়াই “তবে রে হরিপ্রসন্ন” বলিয়া হেডমাস্টার মহাশয়কে পিটাইতে লাগিলেন। আমরা ভয়ে কাঠ হইয়া রহিলাম। হেডমাস্টার মহাশয় অনেক কষ্টে পণ্ডিতের হাত ছাড়াইয়া তাঁহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।
তখন যদি পণ্ডিতের মুখ দেখিতে ! বেচারা ভয়ে একেবারে জুজু ! তিন-চারবার হাঁ করিয়া আবার মুখ বুজিলেন, তারপর এদিক ওদিক চাহিয়া এক দৌড়ে সে যে ইস্কুল হইতে পালাইয়া গেলেন, আর কোনো দিন তাঁকে ইস্কুলে দেখি নাই।
দুইদিন পরে পুরাতন পণ্ডিতমহাশয় আবার ফিরিয়া অসিলেন। তাঁর মুখ দেখিয়া আমাদের যেন ধরে প্রাণ আসিল, আমরা হাঁফ ছাড়িয়া বাচিলাম। সকলে প্রতিজ্ঞা করিলাম, আর তাঁর ক্লাশে গোলমাল করিব না, যতই পড়া দিন না, খুব ভালো করিয়া পড়িব।
You must be logged in to post a comment Login